সিলেট ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৩৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২০
দেলওয়ার হোসেন সেলিম:
শিশুমন যখন কৈশোরে পদার্পণ করে তখন শুরু হয় হাই স্কুল জীবনের পালা। মনে থাকে অনেক স্বপ্ন, অনেক কল্পনা, অনেক দুরন্তপনা। আমাদের গোয়ালজুর গ্রামে অবস্থিত ঢাকনাইল দক্ষিণ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে পূর্ব সিলেটের ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীতে ভর্তি হই। প্রতিদিন গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলিত হতাম আমরা সহপাঠীগণ। এ যেন শুধুমাত্র বিদ্যালয় নয়, ছিলো প্রাণের মিলন স্হল। তখন একাডেমীতে যাতায়াতের কোন যানবাহন ছিল না। কাঁচা সড়কে মাঝে মধ্যে আমি বাই সাইকেল চালিয়ে আসা যাওয়া করতাম। আজ নেই সেই টিনের চালা, বাঁশ বেতের ঘেরা দেয়াল, ঘাসে ভরা মাঠও নেই স্মৃতিময় এ বিদ্যাপীঠে।
আমাদের সময়ে শিক্ষক সংকট ছিল। বিজ্ঞানাগার ও সরন্জাম ছিল না। আসবাবপত্র, শ্রেণী কক্ষ, মিলনায়তন স্বল্পতা থাকার পরও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ ক্লাসে আপন সন্তানদের মতো পাঠদান করতেন। আজও আমার মনে চির জাগরুক হয়ে উঠছে ; একাডেমীতে অতিবাহিত মধুর স্মৃতি আর কলহাস্যের স্বর্ণালী দিনগুলি যেন একটি এলব্যামে গাঁথা উজ্জ্বল চিত্র। তখনকার যেসকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ইহ জীবন ত্যাগ করেছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীতে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছি। ঐসময়ে আমরা পেয়েছি শ্রেষ্ঠ গুণ সমৃদ্ধ কয়েক জন প্রধান শিক্ষক। যারা হলেন, শ্রদ্ধেয় মরহুম মহররম আলী স্যার, শ্রদ্ধেয় হিফজুর রহমান স্যার, শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান স্যার ও শ্রদ্ধেয় মাওলানা মুহিবুর রহমান স্যার। আমার সময়কালীন প্রধান শিক্ষকদের দেখেছি কত প্রখর ব্যাক্তিত্ব সম্পন্নই তারা ছিলেন। যেন এক উচুঁ পর্বতের মতো সেই ব্যাক্তিত্ব। ভাবতে অবাক লাগছে প্রধান শিক্ষক আর আমাদের মাঝে এতটুকু দূরত্ব থাকা সত্বেও তারা আমাদের হৃদয়ে কত কাছাকাছি ছিলেন। কত আপন করেই না ভালবাসা আর শ্রদ্ধার আসনে ছাত্র/ছাত্রীদের কোমল হৃদয়ে স্হান দখল করে নেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে শ্রদ্ধাভাজন স্যারদের কাছ থেকে উৎসাহ উদ্ধীপনা পেয়েছি।
স্যারেরা চেষ্টা করেছেন আমাদের প্রকৃত মানুষ করতে। তাদের ব্যাক্তিত্ব ছিল খুব বেশী। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবাদ স্যার শেখাতেন অংক। পরবর্তীতে আসেন মেছবাহ উদ্দিন খাসনবীস স্যার ও আক্কাস আলী স্যার। অংক বিজ্ঞানে তারা অত্যন্ত সফল শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু অংক নিয়ে আমার খুব ভয় ছিল। সে ভয় থেকে অংকের স্যারদেরও ভয় পাওয়া শুরু। এসএসসিতে অংশগ্রহণের পুর্বে আক্কাস স্যারের কাছে কয়েক দিন অংক শিখেছিলাম। গণিতে তিনি ছিলেন যথার্থ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষক। হাসিখুশী প্রাণবন্ত এ স্যারের হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো সুন্দর। ছাপার লেখা বলে মনে হতো। তিনি অত্যন্ত সহজ, সরলভাবে অংক বুঝিয়ে দিতেন। শেষ পর্যন্ত এসএসসিতে পাশ করে অংকের সংগে চিরকালের জন্য আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে। অথচ এখন ভাবি, যদি মন দিয়ে অংকটা শিখতে পারতাম !
সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে মতিন স্যারের কাছে ইংরেজী পড়েছিলাম। স্যারের উচ্চারণ ছিল মনে রাখার মতো। ঐ উচ্চারণ শেখাতে তিনি শাস্তি প্রদানেও কার্পণ্য করতেন না। মতিন স্যার সর্বদা ইংরেজী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আমাদের বলতেন, ভাল করে ইংরেজী না শিখলে জগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় মরহুম মহররম আলী স্যার এলাকার শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। বি.এড কোর্স সম্পন্ন করে তিনি বেশি দিন শিক্ষাদান করতে পারেননি। আকস্মিকভাবে অকালে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফলে আমরা তার আদর্শ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
মাওলানা মুহিবুর রহমান (মিয়াসাব) স্যার সব সময় সাদা কাপড় ও পান্জাবী পরতেন। মাওলানা স্যার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা পড়াতেন। অধিকাংশই দিবসের শেষ ক্লাসটিতে। তিনি ইসলামী শিক্ষায় আমাদের উৎসাহিত করতেন। ক্লাসের পড়া প্রতিদিন শিখে না আসলে আমাদের শাস্তি দিতেন। আমরা যারা তার ছাত্র ছিলাম, তাদের এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না। কারণ তিনি শেখাতেন মন-প্রাণ দিয়ে। আমার মনে হয়না কোন দিন, কোন ক্লাস বাদ দিয়েছেন তিনি।
ফরিদ স্যার ও রফিক স্যার বাংলা পড়াতেন। তাদের কাছ থেকে শোনেছিলাম মেজদিদি ও ছোট গল্পের মতো নাটকীয় ভংগিতে মজার মজার গল্প। রফিক স্যার ও ফরিদ স্যার আমাদের চলাফেরা ও কাপড় পরিধানের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
আসাদ স্যার ও হেলাল স্যার কোন দিন মারতেন না; বেশি ভয় দেখাতেন। অথচ একাডেমীর বাইরে ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল, আলাপী মানুষ। হেলাল স্যার ছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের মতো। অনেকটা চঞ্চল জীবনের অধিকারী। আসাদ স্যার আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
ভানুরাম বৈদ্য স্যার ঐচ্ছিক বিষয় হিসাব রক্ষণ ও কারবার পদ্ধতি পড়াতেন।
মরহুম আলমগীর স্যার বিজ্ঞান পড়াতেন। তিনি বিজ্ঞানের বাস্তব যুক্তি তুলে ধরে কঠোরভাবে বিজ্ঞান শেখাতেন।
আরেকজন স্যার ছিলেন আলাউদ্দিন। শ্রেণী কক্ষে ছাত্র ছাত্রীদের অহেতুক নড়াচড়া, কথা বার্তা পছন্দ করতেন না। মাঝে মাঝে ব্যাকরণ পড়াতেন। আঞ্চলিক ভাষায় বিশ্লেষণ করে বুঝানোর চেষ্টা করতেন।
এছাড়া খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আমাদের যারা কিছু দিন পড়াতেন, তারা হলেন – সালেহ আহমদ স্যার, জয়নাল আবেদিন স্যার, মরহুম আব্দুল কুদ্দুস স্যার।
ক্লাস শেষ হলেই প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ পেলে ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বাজাতো সমিরণ ও মরহুম বাবুল। এ দুজনই আমাদের কাছে আপন ভাইদের মতো মনে হতো।
তখনকার দিনে হাতে গোনা কয়েকজন সুযোগ্য শিক্ষকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই একাডেমী হয়েছিল একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ। আমার বিশ্বাস, গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর শিক্ষার্থীরা আজ যেখানেই আছেন, একথাটি নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন যে ব্যাক্তিগত প্রতিষ্ঠা নিয়ে যার যেটুকু গৌরব ! এরচেয়ে বেশি গর্ববোধ করবেন তার জীবন গঠনে শক্ত ভিত নির্মাণ করে দিয়েছিল যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার জন্য। দিন দিন এই একাডেমীর সুনাম ও সুখ্যাতি দিক থেকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কানাইঘাট উপজেলার জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ গাছবাড়ী এলাকায় শিক্ষার গৌরব গাঁথা ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মডার্ণ একাডেমী। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে আধুনিক ডিজাইনের ভবনের এখনকার এ বিদ্যাপীঠ। একঝাঁক অভিজ্ঞ শিক্ষক এখন নিয়োজিত আছেন, শিক্ষার্থীদের আলোকবর্তিকার মতো প্রজ্জ্বলিত শিখা জালিয়ে ধন্য করতে। দেশ – বিদেশে মেধার বিকাশ ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনির্ভর করতে।
শিক্ষকদের উপদেশ, পরামর্শ, দিকনির্দেশনা এবং নিজের মেধা ও চেষ্টার গুণে অতীতে একাডেমী প্রাংগণকে যারা সমৃদ্ধ করে গেছেন। একাডেমী প্রাংগণ যাদের পদচারণায় প্রাণবন্ত ছিল। সেসব কৃতী শিক্ষার্থীদের প্রতি যথাযথ সন্মান জানিয়ে আমি এখানে আমার সহপাঠী ক’জনের নাম ও সেসময়ের কিছু স্মৃতি উল্লেখ করছি। বিশেষ করে মনে ক্লাসের অবসরে মতি, শরীফ, জব্বার, মখলিছ, আশফাক, ইয়াহইয়া, মামুন, ফরিদ, কুদ্দুস,রুহুল, তাজউদ্দিন, শামীম, আব্দুস শাকুর, জালাল, বাবুল মিয়া, নজরুল নান্নু, সারওয়ার সাদর, আবুল কালাম,আবেদ, মাহমুদ, মতিন, সাধন, টুনু, অমরেশ, কিরণ, সুভাস সহ অন্যান্য সমসাময়িক বন্ধুদের নিয়ে ক্লাস রুমে নানান গল্প। রেস্টুরেন্টে বসে মজা করে চানা, খিচুড়ি খাওয়া এবং চায়ের কাপে ঝড় তোলার সেই দিনগুলি। অপরদিকে আমরা সহপাঠীদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে বড় অকালে মেধাবী আলাউদ্দিন। এসএসসি পরীক্ষার আগেই আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অথবা বাড়তি আয়ের জন্য প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে জব্বার, আগফাক, কয়সর, মান্নান, কুদ্দুস, মাসুক, ফারুক, মখলিছ, শামীম, মুছব্বির, তাজ, আব্দুর রহিম, খয়ের উদ্দিন, এমাদ প্রমুখ। আসলে ওদের প্রতিভা দেশের কাজে লাগানো উচিত ছিল। ছাত্রীদের মধ্যে আমাদের সাথে পড়াশোনা করেছেন, তাদের অনেকের বর্তমান অবস্থান জানা না গেলেও নাম মনে আছে ক’জনের।হাসিনা, ফেরদৌস, শাহিবা, রেনু, খাদিজা, কাওসারা, পিয়ারা, কলি, বিলকিস, লাইলী প্রমুখ। ঐসময় আমাদের এলাকায় সামগ্রিকভাবে নারী শিক্ষার হার অনেক পিছিয়ে ছিল। কুসংস্কার ও অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে। এখন আর নেই সেই আগের অবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা দেখা গেলো মডার্ণ একাডেমীর শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ছাত্রী। এছাড়া এলাকায় নারী শিক্ষার উন্নতিতে আলাদাভাবে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ১৯৯৩ সালে। আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল কানাইঘাট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। যাহা গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমী থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে। উক্ত কেন্দ্রের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্হাও ছিল না। তাই আমাদেরকে কেন্দ্রের আশপাশের আত্বীয় স্বজনদের বাসা বাড়ী, ভাড়া বাড়ী অথবা লজিং এ থেকে পরীক্ষা দিতে হয়। পরবর্তীতে আবার এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র করা হয় পার্শ্ববর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলার ঢাকাউত্তর মুহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ কেন্দ্রের দুরত্ব ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার। এই কেন্দ্রটির সাথেও সড়ক যোগাযোগ ছিল না। তাই অনেক শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুরমা নদী পেরিয়ে পরীক্ষা দিতে হতো। সম্প্রতি গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীকে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একাডেমীর পরিচালনা কমিটির সভাপতি অলিউর রহমান ও প্রধান শিক্ষক মিফতাহুল বর চৌধুরী ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীকে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র মনোনীত করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ পরিচালনা কমিটির সকল সদস্য, কেন্দ্রের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সমুহের শিক্ষকবৃন্ধ ও এলাকার সুশীল সমাজের ব্যাক্তিদের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। এছাড়া ২০১০ সাল থেকে গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয় (বাউবি) এর শাখা চালু হয়েছে। বাউবির সমন্বয়কারী আব্দুল হকের তত্বাবধানে প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের সাথে ফলাফল অর্জন করছেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রথম বারের মতো বর্ষ বরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ১৪১৮ বাংলা উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবে আমি ছিলাম প্রধান অতিথি। গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর সকল সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে শিক্ষার হার ও মান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী। আরো এগিয়ে যাক একাডেমীর সকল কার্যক্রম। এটাই কামনা করছি।
লেখকঃ সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি কানাইঘাট প্রেসক্লাব ; প্রাক্তন ছাত্র গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমী; ফ্রান্স প্রবাসী।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D