নিউইয়র্ক ট্রাফিকে করোনা বিজয়ী যোদ্ধা দিলরুবা সরকার

প্রকাশিত: ৫:২১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২০

নিউইয়র্ক ট্রাফিকে করোনা বিজয়ী যোদ্ধা দিলরুবা সরকার

হাকিকুল ইসলাম খোকন ,বাপসনিউজ: অদৃশ্য জীবানু ঘাতক করোনার ছোবলে আক্রান্ত আজ সারা বিশ্ব। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে বর্তমানে সবচে বেশী আক্রান্ত আমেরিকার মানুষ। আর নিউ ইয়র্ক সিটি হচ্ছে সে আক্রমণের কেন্দ্রস্থল। সরকারী হিসাব অনুযায়ী যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তর সেবায় নিয়োজিত আছেন ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থকর্মী। রাস্তায় বের হলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও সুপার সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন ফার্স্ট রেসপন্ডার খ্যাত পুলিশ , ফায়ার সার্ভিস , স্যানিটেশন, এমটিএ সহ অন্যান্য জরুরী সেবাদানকারী সংস্থা সমূহ। সঙ্গত কারণে তাদের মাঝে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশী। যে ৪০ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে সেবাদানকারী কর্মীদের সংখ্যাটা যুক্ত করলে পারসেন্টেজ আরও বাড়তে পারে। নিউইয়র্ক পোস্টের ১৩ এপ্রিল ২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগে প্রায় ৭ হাজার সদস্য সিক কলে আছেন,যার মধ্যে করোনা পজিটিভ ২৩৪৪ জনের। মারা গিয়েছেন ২৩ জন। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বাড়লেও জীবনের জয়গানও কিন্তু থেমে নেই। এ পর্যন্ত পুলিশ বিভাগে ৬০০ জন সদস্য সুস্থ হয়ে পুনরায় কাজে যোগদান করেছেন। মৃত্যুর মিছিল থেকে যারা ফিরে এসেছেন তাদেরকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছন নিউইয়কবাসী । এই করোনা সময়ে মৃত্যুকে জয় করে তারা প্রমাণ করেছেন- সাহসী মানুষ কখনো হারে না। হার না মানা বিজয়ী যোদ্ধাদের একজন হচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির ঘরের মানুষ , নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে অধিনে কর্মরত ট্রাফিক সুপারভাইজার দিলরুবা সরকার। ভাবতেই গর্ব হয় বাংলাদেশ জন্ম নেয়া মমতাময়ী নারী এখন নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের অধিনে ট্রাফিক সাহসী যোদ্ধা। শুধু করোনা নয়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চলেছেন জয়পুরহাটের এই জয়িতা। জীবনে যতটুকু পথ হেঁটেছেন তার সবটাই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পরিশ্রমের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধও করতে হয়েছে। সেখানে পারিবারিক সহযোগীতা যেমন পেয়েছেন, প্রথাগত সামাজিক সংস্কারের কারণে প্রতিবন্ধকতার পাল্লাটাও কম ভারী ছিল না। ভাবতেই অবাক লাগে কৃষি কাজের উদ্ভাবনসহ সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যে নারী, সমাজ বিবর্তনের ধারায় সে নারীই এক সময় হয়ে উঠেছিল গৃহবন্দী ভোগের উপকরণ। নিজেকে যোগ্য করে সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সমস্ত নারী সংগ্রাম করছেন তাদেরই একজন দিলরুবা সরকার। এখনও বাংলাদেশের অনেক মেয়ে বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে থাকতে পড়াশুনা ও চাকুরীর সুযোগ থাকলেও বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সংস্কারের কারণে গৃহসেবাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়। দিলরুবা সরকারও এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
সরকারী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবা আব্দুর রহিম ও মা সফুরা খানম এর ৭ সন্তানের সবার ছোট দিলরুবা সরকার এর জন্ম ১৯৬৬ সালে। ১৯৮১ সালে জয়পুরহাট সরকারী হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করার পর রাজশাহী সরকারী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করার পর ১৯৯১ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। ১৯৯২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স ইন এডুকেশন সম্পন্ন করে ঢাকা আনোয়ারা গার্লস কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ইতোমধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী বগুড়া জেলার আব্দুর রউফ সরকার রুবেল এর সঙ্গে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে চাকুরীটা ছেড়ে দিতে হয় মাস্টার্স ইন এডুকেশন করা দিলরুবা সরকারকে।
১৯৯৮ সালে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পা দিয়ে শুরু হয় আর এক নতুন জীবন সংগ্রাম। একেতো কাগজপত্র নেই, তার উপর নতুন দেশ নতুন ভাষা , নতুন সংস্কৃতি। তখন আগের মতো এতো তথ্যপ্রবাহও ছিল না। কাজ শুরু করেন ফাস্টফুড শপ ডানকিন ডোনাটস এ। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেন, খুঁজতে থাকেন প্রফেশনাল জব যেখানে নিজের সারা জীবনের অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারেন। উনার স্বপ্নের সারথি উনি নিজেই। যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাজ শুরু করেন নিউ ইয়র্ক সিটি বোর্ড অব এডুকেশনের অধীনে সাবস্টিটিউট টিচার হিসেবে। কিছু দিন কাজ করেছেন টিচিং এসিসটেন্ট হিসেবেও। কিন্তু এই চাকুরীগুলি সহজে পারমানেন্ট হয় না। তাই চাকুরী পরিবর্তন করে ২০০৭ সালে যোগদান করেন নিউইয়র্ক সিটি ট্রাফিক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। তখন শুধু বাঙালি নয় অন্য এথনেসিটির মধ্যেও খুব কম নারীই এ পেশায় ছিলেন। সাহস করে যোগদান করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেশাগত যোগ্যতা ও কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৪ সালে প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে পুলিশ সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৬ সালে সেরা কমান্ড সুপারভাইজার নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে পুলিশ হেড কোয়ার্টার কর্তৃক সেরা সুপারভাইজারের পুরস্কার লাভ করেন।
কথায় আছে , যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। পেশাগত জীবনের মতো পারিবারিক জীবনেও সফল দায়িত্বশীল এই পুলিশ কর্মকর্তা। দুই ছেলে মেয়ের বড় ছেলে মুনতাকা সরকার সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক থেকে বায়ো-কেমেস্ট্রীতে ব্যাচেলর শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার প্রস্ততি নিচ্ছেন। ছোট মেয়ে রাইয়ান সরকার বিখ্যাত Princeton University তে অধ্যয়নরত।

কথা হচ্ছিল করোনা থেকে কিভাবে মুক্তি পেয়েছেন – এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের সবারই বদ্ধমূল ধারণা যে করোনার সাথে যুদ্ধ করা মানে মৃত্যুকে কাছাকাছি থেকে দেখা। এটা ঠিক নয়। মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করলেও গোঁড়ামিকে তিনি প্রশ্রয় দেন না। বলেন, আল্লাহ যেদিন মৃত্যু লিখে রেখেছেন সেদিনই হবে একথা ঠিক। কিন্তু প্যানিক তৈরী করে মৃত্যুর আগেই মৃত্যু বরণ করা যাবে না। কষ্ট হবে কিন্তু মনোবল হারানো যাবে না। পূর্ব থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। এবং সেই সতর্কতার জায়গা থেকেই নিজ শরীরে করোনার উপস্থিতি টের পাওয়ার সাথে সাথেই স্বামীসহ ড্রাইভ করে চলে গেছেন ড্রাইভ থ্রো পরীক্ষা করানোর জন্য। ফলাফল পজেটিভ আসার পরও ঘাবডে যাননি। বলেছেন , জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ ঠিক রাখা খুব জরুরী। অস্থির হলে প্রতিরোধ করার শক্তি হারিয়ে যাবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা খুবই জরুরী। প্রচলিত বিজ্ঞানভিত্তিক যে সমস্ত স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হচ্ছে সেগুলিই অনুসরণ করেছি। যেমন শরীরে নতুন করে ঠান্ডা লাগতে না দেয়া।লবন পানি দিয়ে গার্গেল করে এবং লাল চা পান করে কিংবা গরম পানিতে স্ট্রীম নিয়ে শ্বাস প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখা। জ্বর বাড়তে না দেয়া। তিনি বলেন, আমি নিয়মিত নামাজ পড়েছি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে যে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন , উপাসনা করলে জীবন শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। মনের জোর হারিয়ে ফেললে মৃত্যুর আগে আপনার মৃত্যু হতে পারে।

করোনার ছোবল একদিন থামবে। থামবে মৃত্যুর মিছিল। ঘরবন্দী মানুষ আবার বুকভরে নি:শ্বাস নেবে সবুজ প্রকৃতিতে। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর যারা নিজের জীবনকে বিপন্ন করে আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন ,তাদের অবদানকে যেন ভুলে না যাই। সেবা গ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে দিলরুবা সরকারকে অভিনন্দন !
কামনা করি , যেভাবে করোনাকে পরাজিত করেছেন, ঠিক সেভাবেই জীবনের প্রতিটা খন্ডকে জয় করে সামনে এগিয়ে চলুন। কর্মক্ষেত্রে আরও সফলতা আসুক , যেন একদিন আপনার সফলতার গল্পই হয়ে উঠে সকলের অনুপ্রেরণার উৎস। (সুত্র:
আসলাম আহমাদ খান।)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ