সরকারি ধান সংগ্রহ : বিদ্যমান প্রথা বনাম মিলগেট ক্রয়

প্রকাশিত: ৮:৫২ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২০

সরকারি ধান সংগ্রহ : বিদ্যমান প্রথা বনাম মিলগেট ক্রয়

অাব্দুর রশিদ, ১১ মে ২০২০: সরকারি খাদ্য শস্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য, উৎপাদককে মুল্য সহায়তা প্রদান ও আপৎকালীন সরকারি খাদ্য মজুদ গড়ে তোলা। ধান/চল সংগ্রহে কৃষক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে। বিগত বছরে কৃষকের নিকট থেকে সরকারি ধান সংগ্রহে বিভিন্নমূখী সমস্যা এবং অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমন মওসুম হতে সরকার বরাদ্দ বাড়িয়ে সনাতন নিয়মের পাশাপাশি মোবাইল আ্যাপস এর মাধ্যমে পরিক্ষামুলক ভাবে সীমিত সংখ্যক কেন্দ্রে কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করা হয়েছে।এতে কৃষক নির্বাচনে স্বচ্ছতা ফিরেছে কিন্তু অনাকাঙ্খিত হয়রানী বন্দ হয়নি। ফলে সেই মধ্যস্বত্ত ভোগীদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।যেমন একজন কৃষক লটারীতে ২ মে/টন ধান সরকারি গুদামে বিক্রি করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত এই কৃষককে পানি/সার/এবং শ্রমিকের মূল্য পরিশোধের জন্য আদ্রতাযুক্ত ধান তাৎক্ষনিক বিক্রি করতে হয়েছে।কৃষক জানেন ভিজা ধান সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা যাবে না। তিনি একজন ফড়িয়ার কাছে বিক্রি করছেন যার সরকারি কেন্দ্রে ধান কেনা বেচার সাথে পরোক্ষ যোগাযোগ আছে। ফড়িয়া কৃষকের থেকে কৃষি কার্ড নিয়ে হাতে অতিরিক্ত কিছু ধরিয়ে দিচ্ছেন।খোরাকী পরিমান রেখে ২ মে/টন ধান ঐ কৃষকের এই মুহুর্তে বিক্রির প্রয়োজন নেই। তাই কার্ডটির হাত বদল ব্যবসায়ীর হাতে। অন্যদিকে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে নির্ধারিত মানের চেয়ে অধিক আদ্রতাযুক্ত ধান গ্রহনের কোন সুযোগ নেই। আদ্রতার তারতম্যের জন্য আনীত ধান অগ্রহনযোগ্য হলে দুরদুরান্ত থেকে আসা কৃষকের ভোগান্তির শেষ থাকে না। ড্রাইং ইয়ার্ড না থাকায় না পারে শুকাতে আবার না পারছে ফেরত নিতে। শাখের করাতের ন্যয় উভয় সংকটে।কাজেই মধ্যস্বত্তভোগীর শরনাপন্ন হতে হচ্ছে অনিচ্ছা সত্বেও। শর্ত কৃষি কার্ডটি তাকে ব্যবহার করতে দিতে হবে।বেচারা কৃষক মন্দের ভালো হিসেবে এই পথ বেছে নিচ্ছেন।এটাকেই অনাকাঙ্খিত ভোগান্তী বা বিড়ম্বনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়াও আছে স্থানীয় রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপ।মধ্যস্বত্তভোগী হিসেবে তাদের প্রতিনিধিরা নানা কৌশলে সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রির সমস্যাগুলো সামনে এনে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার কাজটি খুব সুক্ষভাবে করছেন। তারা কৃষি কার্ড ম্যানেজ করে কৃষকের নামেই ধান দিচ্ছে।আর এ কাজটি হয় শেষ প্রান্তিকে,যখন কৃষকের কাছে বিক্রয়যোগ্য ধান থাকে না। বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই আসলে কি ঘটছে।আইন রক্ষা হচ্ছে,ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে কৃষকই ধান দিচ্ছে। কৃষকের নামেই ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং টাকা ঐ কৃষকের ব্যাংক একাউন্টে জমা হচ্ছে।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।এখানে কর্মকর্তাদের তেমন কিছু করনীয় নেই।লক্ষমাত্রা অর্জনে বুঝে শুনে চেপে যাওয়া ছাড়া। আদ্রতার গ্রহনযোগ্য মানে উপনীত করতে বিড়ম্বনার কারনে পিক্ পিরিয়ডে ধান সংগ্রহের গতি থাকে অতি মন্থর।ধান গোলাজাত হয়ে গেলে সংগ্রহ শুরুর ১/২ মাস পরে যখন আদ্রতা কমে যায় তখন সংগ্রহের গতি পায়।ততদিনে প্রান্তিক কৃষকের বিক্রয়যোগ্য ধান তলানিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না ধান কোথা থেকে আসে। সংগ্রহ মওসুমের ক্রয়ক্রম পরিক্ষা করা হলে বাস্তবতা নিরুপন করা সম্ভব হবে।আর একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ন তা’হলো ভালজাতের চাল সরকারি ভান্ডারে মজুদ হওয়া।কৃষক চিকন, মধ্যম ও মোটা বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন করে থাকে।জাতভেদে এই ধানের দামেরও তারতম্য আছে।কৃষক যখন সরাসরি তার উৎপাদিত ধান সরকারকে দেবে তখন ভাল জাতের ধানই দেয়,যা তার ক্ষেতে ফলেছে।কিন্তু যখন মধ্যস্বত্ত্বভোগী উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় সরবারাহ করবে তখন হাইব্রিড মোটা জাতের ধান দেয়,যার বাজারমুল্য কৃষকের পন্যের চেয়ে এক তৃতিয়াংশ কম।অর্থ্যাৎ নিবিড়ভাবে উৎপাদককে সম্পৃক্ত করতে পারলে সরকারি মজুদের মান উন্নত হবে এবং ভোক্তাকে ভালমানের চাল সরবরাহ সম্ভব। সম্প্রতি সরকার পরোক্ষভাবে আদ্রতাজনিত ঘাটতির বিড়ম্বনা হ্রাস করার লক্ষে সংগ্রহ চলাকালীন ধান মিলিং করার সিদ্ধান্ত এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে।

বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব সরকার। আমরা দেখেছি বিগত ৯০ পরবর্তি সময়ে সারের জন্য হাহাকার, সারের দাবিতে কৃষকের মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে।এ সময় সার বিলি তদারকীতে ইউনিয়ন/ওয়ার্ডে দায়িত্ব প্রাপ্ত ট্যাগ অফিসারগণ লাঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু এই সরকার সারে ভর্তুকি দিচ্ছেন এবং বিক্রি উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখন সারের কোন সংকট নেই।কৃষক তার প্রয়োজনমত সার খোলাবাজার থেকে কিনে ব্যবহার করতে পারছেন। সীমিত কৃষি জমিতে ধান উৎপাদনে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতায় (চালের ক্ষেত্রে) পৌছানো সরকারের কৃষি নীতির দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে।চলতি বোরো মওসুমে/২০, সরকার ৮লক্ষ মে/টন ধান ২৬/-টাকা কেজি দরে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে সংগ্রহ করবে। তাই উৎপাদন ধরে রাখার স্বার্থে উৎপাদিত পন্য সরকারি ক্রয়ে প্রনোদনা যাতে কৃষকের ঘরে যায় সুনিশ্চিত হওয়া বাঞ্চনীয়।ধান দীর্ঘ মজুদযোগ্য পন্য নয়। চালের আকারে রুপান্তর করে সরকারি মজুদ ভান্ডারে রক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় কেবল ধানের জন্যই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়।

প্রস্তাবঃ ধান কাটার শুরু থেকেই সীমিত আদ্রতাযুক্ত ধান মিলগেটে ক্রয় করা যেতে পারে। ৭০’এর দশকে মিলগেট পারচেজ চালু ছিল।এই সময় বাংলার শস্যভান্ডার ছিল দেশের দক্ষিনাঞ্চল। আমন ধান ছিল মূখ্য ফসল(সিরিয়েল)। নৌপথ ছিল যাতায়াত ব্যবস্থা। বৃটিশ/পাকিস্তান আমলের এলএসডি সমুহ অধিকাংশ নদী কেন্দ্রিক,কিছু রেলকেন্দ্রিক।সড়ক কেন্দ্রিক সংখ্যা নগন্য।এমনকি টিপিসিগুলিও অধিকাংশই এভাবেই গড়ে উঠে। টিপিসি গুলি ৮০’র পরে এলএসডিতে রুপান্তরিত হয়েছে।সড়ক ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।নদীপথ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে । উক্ত সময়ে আদ্রতামাপার বিজ্ঞান সম্মত যন্ত্র সরবরাহ চোখে না দেখার অবস্থায়। সংগ্রহ ব্যবস্থায় মিলগেট প্রথা চালু হয়। মিলের নিকট থেকে জামানত রেখে সরাসরি ধান মিলেই কেনা হয়েছে। পেমেন্ট ডব্লিউ কিউএসসির মাধ্যমে।বয়লারযুক্ত হাসকিং মিল ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু মিলারদের সাথে অদূরদর্শী চুক্তির কারনে অনেক মিল ডিফল্টার হয়ে যায় এবং মামলা করে সরকারকে টাকা আদায় করতে হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অতীত ভূলের শিক্ষা থেকে এখন মিলারদের থেকে ১১০% জামানত রেখে ধান ক্রাশিং করা হয়। এখন ডিফল্টার হলে ক্ষতি মিলারের।গ্রামগজ্ঞে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সিদ্ধ অটো রাইস মিল-১০১৭, আতপ অটোমিল-২১৯,সিদ্ধ হাসকিং মিল-১৭৬০০,আতপ হাসকিং-১১৩৯ টি রাইস মিল,যার অধিকংশই শহরের বাইরে স্থাপিত হয়েছে। এখন যদি মিল গেটে ধান ক্রয় করা যায় তবে-(১) প্রান্তিক চাষি ধান কাটার সাথে সাথেই আদ্রতাযুক্ত ধান পরিস্কার করে মিলে দিতে পারবে। কারন মিলের ড্রায়িং সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারের একটি পরিবহন ব্যয় কমবে আবার কৃষক ন্যয্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে না।মিলার ফলিত চাল নিকটস্থ সরকারি গুদামে জমা দিবেন। এতে সরকারের সাশ্রয় শুধু নয়,মজুদ ব্যস্থাপনায় সুবিধা হবে। সংগ্রহ মওসুমে গুদামের স্থান সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে।কারন ধান মজুদে কম পরিমানে(মে/টনে) বেশী জায়গা দরকার হয়। মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ব কিছুটা হলে কমতে পারে।প্রাথমিকভাবে কৌশলগত স্থানে ২/১ টি অটো রাইস মিলে মিলগেট ক্রয় পদ্ধতি পরিক্ষামুলক ভাবে চালু করে দেখা যেতে পারে।তা’হলে বিদ্যমান সমস্যাগুলি যেমন নিরসন হবে আবার অধিক সংখ্যক কৃষককে সরকারি প্রনোদনায় সম্পৃক্ত করা যাবে।(২) বোরো ধান বাংলাদেশে বর্ষার আগে দিয়েই ধান কাটা শুরু হয়। হাওর অঞ্চলে এপ্রিল মাসে,দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে এপ্রিলের শেষ ও মে মাসের প্রথম দিকে আবার বর্তমান শস্যভান্ডার দেশের উত্তরাঞ্চলে শুরু হয় গোটা মে মাস জুড়ে। বোরো মওসুমে আগাম বৃষ্টি হলে ধান সংগ্রহ এবং হাসকিং মিল থেকে চাল সংগ্রহ ব্যহত হয়। ভাল ফলন হওয়া সত্তেও ২০০৮ সালের বোরো সংগ্রহের লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি কেবল মাত্র বৈরী আবহাওয়ার কারনে।২০২০ সালে এপ্রিল/মে মাসের আবহাওয়া ধান ক্রয়ের জন্য সহায়ক প্রতিয়মান হচ্ছে না।দেশে অটো রাইস মিলের সংখ্যা একবারে কম নয় সেহেতু চালের লক্ষমাত্রা হয়তো অর্জিত হবে কিন্তু ধানের বিশেষকরে কৃষকদের থেকে ক্রয়ে ব্যত্যয় হতে পারে।স্মরনযোগ্য যে,বোরো ধান সংরক্ষণ ও সংগ্রহ আবহাওয়ার গতি প্রকৃতির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।

লেখকঃ অাব্দুর রশিদ, অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ