এবার ঋণ নির্ভরতায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বড় ঘাটতির বাজেট

প্রকাশিত: ১:৫২ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০২০

এবার ঋণ নির্ভরতায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বড় ঘাটতির বাজেট

ঢাকা, ১৮ মে ২০২০: অাসছে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি বাড়ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হচ্ছে ঘাটতি বাজেটের কাঠামো। বড় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরেও এবার রীতি মেনে ৫ শতাংশের ভেতরে ঘাটতির অঙ্ক থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সব কিছু ঠিক থাকলে এ কাঠামোতেই দাঁড়াবে আসছে অর্থবছরের বাজেট।

আগামী ১১ জুন বাজেট ঘোষণা করা হবে বলে এরই মধ্যে জানা গেছে।
১৯৩০ সালের পর এত ভয়াবহ সংকটে আর পড়েনি পুরো পৃথিবী। করোনার প্রভাবে সৃষ্ট এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এবার এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী বলেন, ‘করোনার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হবে আগামী বাজেটে। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ব্যাংকঋণ লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে। তবে আমরা বিদেশি সহায়তা ভালো পাব বলে আশা করি।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ঘাটতি ঠিকই আছে। এটা বাড়বেই। তবে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কিনবে কে? এখন জীবনযাত্রার মান ধরে রাখাই কঠিন। ব্যাংকিং খাতে দুটো বিষয় আছে। একটি হলো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। এ খাত থেকে সরকার আরো ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমবে। করোনার আগেই স্থবির ছিল। আগামীতে সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে সমস্যা হবে। সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। আর বিদেশি সাহায্য বেশি নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অনুদান পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ঘাটতি ৬ শতাংশের নিচে থাকলে ঠিকই আছে।’
একই বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এ বছর যে ধরনের সম্পদ প্রয়োজন এবং অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে তাতে যদি ঘাটতি বড় হয় তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ৫ শতাংশের গোল্ডেন রুল ভাঙা যাবে না—এমন কোনো নিয়ম নেই। তাই এটা ভাবার বিষয় নয়। সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ঠিকমতো করা যাচ্ছে কি না, তা মূল বিষয়। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি যে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে সম্পদ আহরণ কম হয়েছে। অথচ এই সময়টাতে সম্পদ আহরণ বেশি হয়। তাই ঘাটতি বাড়বেই।’

ড. মোস্তাফিজুর রহমানও সঞ্চয়পত্র বিক্রির ব্যাপারে আশাবাদী নন। তিনি বলছেন, “এই বাস্তবতার নিরিখে বিদেশি সাহায্য এবং ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিদেশি সাহায্যের ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ঋণের প্রতি নজর দিতে হবে। ঋণ পরিশোধে আমাদের রেকর্ড ভালো। তবে ঋণের ক্ষেত্রে নেগোশিয়েট করতে হবে। শূন্য সুদ হারে ঋণ পাওয়া যায় কি না, তা দেখতে হবে। আমাদের বাস্তবায়নের দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা এবং রাজস্ব আহরণে জোর দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত না হলে ‘গোল্ডেন ফাইভ রুল’ ভেঙে লাভ হবে না, বরং ক্ষতি হবে।”

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, বাংলাদেশে ঘাটতি বাজেট করার ক্ষেত্রে সব সময় ‘গোল্ডেন ফাইভ রুল’ অনুসরণ করা হয়। এই রুল অনুযায়ী, ঘাটতি বাজেট সব সময় জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। তবে সব নিয়ম ভেঙে এবার বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এটি ৬ শতাংশের নিচে রাখার চেষ্টা করছেন। সে ক্ষেত্রে এটি জিডিপির ৫.৮ শতাংশ হতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ৬, ৭ শতাংশ ঘাটতি বাজেট কোনো সমস্যা নয়। প্রতিবেশী ভারত জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ ঘাটতি ধরে বাজেট প্রণয়ন করে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরের জন্য এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি প্রাক্কলন করেছে। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে চলতি অর্থবছর থেকে ২৯ হাজার ৬২১ কোটি টাক বেশি।

সাধারণত ঘাটতি মেটাতে সরকার দুই ধরনের খাতের ওপর নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক। অভ্যন্তরীণ খাত আবার দুই ভাগে ভাগ করা। এর একটি হলো, ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া। অন্যটি হলো, সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেওয়া।

অভ্যন্তরীণ উৎস : আগামী অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ সাত হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ব্যাংক থেকে সরকার ৭২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ২৪ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে এ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

বিদেশি উৎস : আগামী বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে সরকার ৭৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা পাওয়ার আশা করছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৬৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে ছয় হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে।