সিলেট ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ, মে ২০, ২০২০
সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে, ২০ মে ২০২০ : আমি এ.সি. ঘরে বসে সংবাদপত্রের খবর পড়ে কিংবা টিভির খবর দেখে, সেই খবরের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখি না। প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াই, জীবন ও জনপদ দেখি ; যে জনপদ নিয়ে লিখি সেখানে বারবার গিয়ে সেখানকার মানুষের হৃদয় ও জনপদের হাওয়াটা বুঝতে চেষ্টা করি । জীবন ছেঁকে রসদ নিয়ে এসে তারপর লিখতে বসি । “লকডাউন”- এর আগে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম উপন্যাসের তথ্য সংগ্রহের জন্য । একটা বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে চষে বেড়িয়েছি গ্রামের পর গ্রাম । মানুষের সাথে কথা বলে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে, আমি কি বাংলাদেশে আছি নাকি এটা আফগানিস্তানের তালেবান শাসিত কোন জনপদে ? খুব সতর্কতার সাথে বেছে বেছে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছি,
– আপনাদের এখানে বাউলগান হয় ?
উত্তর পেয়েছি,
– না ।
– কেন আপনারা গান-টান শোনেন না ?
– না, হইতে দেয় না ।
– কারা হইতে দেয় না ?
– মাওলানারা ।
– এদিকে ওয়াজ হয় ?
– হা খুব । শীতকালে তো শুধু ওয়াজই হয় ।
বেশকিছু মানুষের কণ্ঠে এই একই কথা ধ্বনিত হয়েছে । এখানে গ্রামের পর গ্রামে গত দুই-তিন দশকে কোন বাউল কিংবা শিল্পীর পা পড়েনি । সেখানে একতারা কিংবা দোতারার সুর বাজেনি । বাউলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজীরা । সেখানে তরুণরা ছোট ছোট হোটেলে কিংবা মুদি দোকানে ওয়াজ শোনে লাউড স্পিকারে ; হাতের মোবাইলে ওয়াজ শোনে । চৈত্রের দুপুরের রোদে সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে আমার কান্না পেত- আহা রে হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রামকানাই দাশ, সুষমা দাসের প্রাণের ভাটির জনপদ ; যে জনপদের মাঠে-ঘাটে শোনা যেত বাউলের সুর, সেই জনপদের আজ এ কী দশা !
একবার ভাবুন- একটা জনপদের মানুষ বছরের পর বছর গান শোনে না, সিনেমা দেখে না, বই পড়ে না, যাত্রা-নাটক দেখে না, অনেকে টেলিভিশনও দেখে না, কোন ধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তারা নেই ; উপরন্তু ওয়াজীদের উগ্র বয়ান তাদেরকে হিংস্র করে তুলেছে । এইসব মানুষেরা মানুষ খুন করবে না তো কারা করবে ?
এই দশা শুধু সুনামগঞ্জের নয় ; সারা বাংলাদেশের । সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলে হয়ত একটু বেশী । কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র এখন এটাই, এটাই বর্তমানের প্রকৃত বাংলাদেশ । একবার স্কুল ছুটির সময় বাসে আসার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অসংখ্য হিজাব-বোরখা পরা ছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছিল, পটিয়া বুঝি বাংলাদেশে থেকে বিচ্ছিন্ন !
বাংলাদেশের সাংস্কৃতি বিপর্যয় ঘটে গেছে, আরো ঘটবে । আমি শাহ আরেফিনের আস্তানা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বাংলার সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে এই সুফিরাও কি কম ভূমিকা রেখেছে ? তাইতোএইসব সুফিদের নামে আজ এত কিছু হয় । যাদুকাটা নদীতে শাহ আরেফিনের নামে সেতু হচ্ছে । অনেক মডারেট মুসলিম ভাবে, সুফিরা শান্তিবাদী ছিল । তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার করেছে । এরা হয় অজ্ঞ, নয়ত ধুরন্ধর । বেশীরভাগ সুফিই তো এসেছিল মুহাম্মদ ঘোরীর মত যোদ্ধাদের সঙ্গে । তারা কেউ ভারতবর্ষের মানুষদের ধর্মান্তরে এবং লুটপাটে মদত দিয়েছে যোদ্ধাদের, কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে । সিলেটের শাহজালাল, সুনামগঞ্জের শাহ আরেফিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া শাহ সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.) ওরফে শাহ পীর অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে, যুদ্ধ জয় এবং লুটপাটের পর তারা শান্তিবাদী সেজেছে । এরা কেবল জনপদের ধর্ম বদলায়নি, বদলে দিয়েছে বাঙালী মুসলমানের জীবনাচার, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি । এদের হাতে বাংলার ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে ।
আগে বাউলরা গ্রামে গ্রামে গান করে বেড়াতেন । গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন । কিন্তু এখন আর তারা আগের মত বায়না পান না । কারণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে আর সম্প্রসারিত হয়েছে ওয়াজের অপসংস্কৃতি । একসময় তৃণমূলে যারা গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, গত দশ-পনের বছর যাবৎ তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে । জীবিকার জন্য তাদেরকে অন্য পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে ।
তৃণমূলে এখনো যেসব বাউলশিল্পীরা আছেন, তারা মরমে মরে থাকেন । ভয়ে থাকেন যে, কখন তাদের ওপর আক্রমণ হয় । প্রায়ই তাদের ওপর আক্রমণের কথা শোনা যায়, তাদের চুল-দাড়ি কেটে দেবার কথা শোনা যায়, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেবার কথা শোনা যায় ।
দেশের এই অবস্থার জন্য আমাদের আগের প্রজন্মের শহুরে সংস্কৃতিকর্মীরা অনেকটা দায়ী । তারা এইসব নিপীড়ন এবং পরিবর্তন আঁচ করলেও আমলে নেননি । কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানাননি । সরকারের বিরুদ্ধে তাদের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি । বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবার পরিবর্তে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছেন এবং নানান সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন । এইসব নাগরিক ধুরন্ধর শিল্পীরা সরকারী অনুদান-পুরস্কারের পিছনে ছুটেছেন ; কালেভদ্রে তৃণমূলের কোন শিল্পীকে ঢাকার মঞ্চে এনে তার শিল্পকলা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়ে ভেবেছেন, তোমার জীবন ধন্য করে দিয়েছি ।
আচ্ছা ক’জন তৃণমূলের শিল্পী স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পদক পেয়েছেন ? তারা সত্যিকারের শিল্পী, রাজনীতি ঘেঁষা এবং রাজনীতিকের হাতের পুতুল নন বলে তারা বঞ্চিত থাকেন । নাগরিক শিল্পীরা নিজেদেরকে তৃণমুলের শিল্পীদের চেয়ে উঁচু শ্রেণীর শিল্পী বলে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে থাকেন ।
প্রত্যন্ত গ্রামে গেলেও মসজিদের আজানে কানে তালা লেগে যায়, তারপরও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রত্যেক উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা করে সরকার । অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরেও উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমী গড়ে ওঠেনি । এসবের বিরুদ্ধে সরব হয় না নাগরিকশিল্পী নামক চাটুকারেরা । অথচ তৃণমূলের শিল্পী ও শিল্প না বাঁচলে নগরেও যে একটা সময়ে শিল্পী ও শিল্প বাঁচবে না, এই বোধটি তাদের নেই । অপসংস্কৃতি তৃণমূল গ্রাস করার পর তাদের জিহ্বা বাড়িয়ে দেবে নগরের দিকে । কিন্তু তখন সময় ফুরিয়ে যাবে, বাঁচার উপায় থাকবে না ।
সুনামগঞ্জে রণেশ ঠাকুরের বাড়ি কারা পুড়িয়ে দিয়েছে তা সকলেই জানেন । তারপরও অধিকাংশ সংস্কৃতিকর্মী চুপ করে আছেন, কেউ মুখ খুললেও গলাভরা ‘দুর্বৃত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করছেন । এই দুর্বৃত্ত কারা ? যারা মূর্তি ও ভাস্কর্য়কে এক করে দেখে। যারা ভাস্কর্য এবং বাদ্যযন্ত্রকে ইসলামের শত্রু জ্ঞানে ধ্বংস করে।
এরা সেই মুসলমান ।
রণেশ ঠাকুর, পালাও ! যদি লড়াই করার নূন্যতম জায়গা থাকত তাহলে বলতাম, রণেশ ঠাকুর ! দাঁড়াও ; লড়াই কর ।
কিন্তু এটা লড়াই করার জায়গা নয়, রেফারি নিরপেক্ষ নয় । এখানে বাঁশি বাজবে সর্বদাই তোমার বিপক্ষে আর আহমদ শফি হুজুরদের পক্ষে । ফলে মাঠের খেলুড়েরা তোমার বাড়ি পোড়াবে, আখড়া পোড়াবে, এমনকি তোমাকে প্রাণেও মারবে । রণেশ ঠাকুর, তুমি তো বাউল মানুষ ; অত ইতিহাস পড়ো না, তোমায় একটা ঘটনা বলি শোন- আরবে এক সময় ‘ওকাজের মেলা’ নামক একটা মেলা হত । সেই মেলায় সারা আরব থেকে কবি, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, যন্ত্রশিল্পীরা আসতেন । সাতদিন ভরে তারা তাদের কলানৈপুণ্য প্রদর্শন করতেন । কবিতার প্রতিযোগিতায় যে কবিতাটি সেরা হত সেই কবিতাটি সোনালী পাতে লিখে কাবাঘরে ঝোলানো হত । সেখানে এতটাই সম্মানিত ছিলেন শিল্পী-কবিরা ।
রণেশ ঠাকুর, সেই সোনালী পাতে লেখা কবিতা এখন কোথায় ? কোথায় সেই বিখ্যাত ওকাজের মেলা ? রণেশ ঠাকুর, কেবল তোমার ভাটি অঞ্চল নয় ; সমগ্র বাংলাদেশের পরিণতি ঐ ওকাজের মেলার মতই হতে চলেছে। রণেশ ঠাকুর, তুমি পালাও ; আরো দুঃসময় আসছে !
(কৃতজ্ঞতায়)
Mishu Milan
সংগৃহীত পোষ্ট
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D