কামরুজ্জামান মোহন- এর উপন্যাস- ‘রুপালি’ নিয়ে কিছু কথা-

প্রকাশিত: ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ, জুন ২১, ২০২০

কামরুজ্জামান মোহন- এর উপন্যাস- ‘রুপালি’ নিয়ে কিছু কথা-

মহী উদ্দিন মহিম, ২১ জুন ২০২০ :

কামরুজ্জামান মোহন ছোট ভাই,
জনজগতের বন্ধু।
তার শিক্ষাজীবনের মাধ্যমিক থেকে-
লেখালেখি শুরু।সেই থেকেই আমি তার- পাঠক,
তার লেখা পড়ি,
বুঝতে চেষ্টা করি।
অনেক সময় তার-
লেখনীতে সামাজিক বৈষম্য
সমাজের দুষ্টক্ষত,
জন-মন-মানসিকতা,
সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিতে-
লুটেরা-অপসংস্কৃতির প্রধান্য,
মন্দ-মানুষ তৈরির নেপথ্যে-
কলকাঠি নাড়ার ক্রীড়কদের অপকর্ম-
সমাজের দগদগে ক্ষতগুলো
মোহন তার লেখালেখি –
সাহিত্যকর্মে তুলে ধরতে চেষ্টা করে।
এই ধারার লেখনি অব্যাহত রাখলে-
গণমানুষের অর্থনীতি রাজনীতি-
গণসংস্কৃতির বিকাশে
তা যথাযথ ভূমিকা রাখবে।
অবশ্য তার সব লেখায়
সবসময় এমন হতে হবে তা নয়।
একুশ বইমেলা’২০-য়ে প্রকাশিত-
তার লেখা ‘রূপালি’ উপন্যাস-
তার নিজস্ব চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ।
মানুষ নিরপেক্ষ নয়,
একজন সাহিত্যিকও নিরপেক্ষ হতে পারেনা।
গণমানুষের সাহিত্য-সংস্কৃতি
যা সমাজ রাষ্ট অর্থনীতি-
রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।
আবার লেখকের অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক,সামাজিক অবস্থানও
তার লেখনীতে প্রকাশ পায়,
লেখনিকে প্রভাবিত করে।
ঔপন্যাসিক কামরুজ্জমান মোহনও-
এর ব্যতিক্রম নয়।
আমি সাহিত্যিক- ঔপন্যাসিক নই,
অনেক সময় ধরে উপন্যাস পড়িনা,
অবশ্য এটি আমারই দূর্বলতা।
সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা –
সমালোচনা করতে হলে-
বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস-
সাহিত্যকর্ম পড়তে হয়,
লেখক কি বলতে চেয়েছে-
তা বুঝতে হয়,
বিভিন্ন লেখকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে
তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়,
এনিয়ে আমার যথেষ্ট ঘাটতি আছে।
দুএকটি উপন্যাস পড়ে-
আলোচনা সমালোচনা করা কঠিন।
এরপরও মোহনের সাথে আমার জন-জগতিক-
কিছুটা কাছাকাছি আবস্থানগত কারণে-
মোহনের উপন্যাস ‘রুপালি’ নিয়ে
আমার মনভাব ব্যক্ত করছি।
‘রুপালি’ গ্রামবাংলার
দুটি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের-
রুপালি এবং শুভ-র জীবনকথা ও
অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রধারীদের ভূমিকা নিয়ে-
‘রুপালি’ উপন্যাস রচিত।
বাংলাদেশের গ্রামীণসমাজ
আবহমানকাল থেকেই
সামন্ততান্ত্রিক- সাম্প্রদায়িক
সংস্কৃতির আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
এখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ছোঁয়াচ লেগেছে,
যা স্পর্শদোষে দুষ্ট হয়ে-
গণতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশে
তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ প্রয়োজন সাহিত্য সংস্কৃতি দিয়ে
এই জঞ্জালকে ধাক্কা দেয়ার।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী
ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রাম-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে
সাহিত্য-সংস্কৃতি যেভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে,
উজ্জীবিত করেছে,
আজ প্রয়োজন সেই-
উদ্দীপনা অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী সাহিত্যকর্ম।
সাবেকি সমাজ-সংস্কৃতিকে থেকে
নতুন উন্নতর সমাজ-সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন
গতিশীল শক্তিশালী উপন্যাস-সাহিত্যকর্ম।
মোহন তার চিন্তা চেতনায় –
রুপালি উপন্যাসে তা কতটুকু-
প্রতিফলিত হয়েছে-
তা পাঠকের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় বুঝা যাবে।
‘রুপালি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র-
রুপালি গ্রামের একটি সাধারণ মেয়ে,
সাধারণ হলেও তার একটি স্বপ্ন ছিল,
সে পড়াশোনা করে এগিয়ে যাবে,
সে স্বপ্ন দেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে,
স্বপ্ন দেখে ছোট্টছোট্ট ছেলেমেয়েদের পড়াতে।
কিন্তু তার এই স্বপ্ন
আই এ পরীক্ষার পূর্বেই চুরমার হয়ে যায়।
এই অল্প বয়সেই পরিবারের চাপে
তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো,
তার বিয়ে হলো শুভ-র সাথে।
কিন্তু সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা না থাকায়,
শ্বাশুড়ির অমানুসিক নিপীড়ন
দিনদিন রুপালিকে বিপাকে পেলে,
আমাদের গ্রামীণ সমাজে অনেক পরিবারে
বৌ তার স্বামী শ্বশুর শ্বাশুড়ি,
ননদের দ্বারা শাসিত নিপীড়িত হয়।
বৌ যখন শ্বাশুড়ি হয়,
তখন শ্বাশুড়ি আবার
বৌকে শাসন, শোষণ নিপীড়ন করে।
এভাবে চলছে ক্রিয়া-চক্রের খেলা।
রুপালির স্বামীর সংসারেও
এর ব্যতিক্রম হয়নি।
নাতি নাতনি চাই-
এনিয়ে শ্বাশুড়ির গোঁ ধরায়
শুভ দ্বিতীয় বিয়ে করলো।
নিম্নমানের মানসিকতা সম্পন্ন –
দ্বিতীয় স্ত্রী এ্যানি পুত্রসন্তান জন্ম দেয়ায় –
এতে এ্যানির অন্যায্য ক্ষমতা- প্রভাব বাড়ায়,
এ্যানি রুপালিকে বিদায়ের আল্টিমেটাম দেয়ায়,
রুপালির প্রতি-
শুভ- র অনাদর -অবহেলা ও
শুভ-র ইচ্ছায় -ই
শুভ রুপালির সংসার ভেঙ্গে যায়।
এই অবস্থাকে রুপালি
সহযভাবে মেনে নেয়নি,
চরম প্রতিবাদ করতে না পারলেও
তার ন্যায্য প্রাপ্যকে
ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করে
এক কাপড়ে রুপালি –
বাপের বাড়ি চলে আসে এবং
কিন্টারগার্টেনে শিক্ষকতার চাকরি নেয়।
এসময় রুপালি ভালোবাসার ফান্দে পড়ে
নিজাম নামক এক প্রতারকের সাথে
রুপালির দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়।
আমাদের গ্রামীণ সমাজের
সহয সরল লোকদের
নিজামের মত বাটপাররা
সমবায়সমিতি, এনজিও-র
ঋণ- জমা-কিস্তির ফাঁদে পেলে,
সেল্টার নেয়ার জন্য
বিয়ে বিয়ে জালে জড়ায়ে
মানুষকে নিঃস্ব করে পালায়,
‘রুপালি’ উপন্যাসেও
এমন প্রতারণার জাল বিস্তার করে
মানুষের-রুপালির স্বর্ণ গহনা টাকাপয়সা নিয়ে
বাটপার নিজাম পালিয়ে যায়।
যা ‘রুপালি’ উপন্যাসে
লেখক স্বার্থকভাবে তুলে ধরেছেন।
প্রতারক নিজাম রুপালির
এই বিয়ে টিকলো না।
নিজামের প্রতারণার শিকার হয়েও
রুপালি ঘুরে দাঁড়ায়,
সে বি এ পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়।
এরিমধ্যে শুভ-র ২য় স্ত্রী এ্যানি-
সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
শুভ আবার রুপালিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়,
দুই পরিবারের ইচ্ছে থাকলেও
রুপালিকে সম্মত করা যায়নি!
উপন্যাস- সাহিত্য জনগণকে স্বপ্ন দেখায়,
নতুন নতুন পথচলায় উজ্জীবিত করে,
রুপালির জীবনযুদ্ধের-
গড়া-ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাসে
তার দীপ্ত-তেজ কাম্য প্রজ্বলন না হলেও
রুপালির কিশোর-স্বপ্ন –
বি এ পাশ করা,
শিক্ষক হওয়ার বাসনা ও
অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে
আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লালিত ইচ্ছাকে
রুপালি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
কামরুজ্জামান মোহন –
‘রুপালি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র-
রুপালিকে সহজ সরল ভালো-
শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসাবে তুলে ধরেছেন।
তীব্র মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে
রুপালি ধীরে ধীরে দৃঢ়চেতা সম্পন্ন হয়ে উঠে।
রুপালি সাবেকী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াতে না পারলেও
তার নিজ জীবন পথচলায়
কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ার –
মানসিকতা ত্যাগ করতে পেরেছেন।
সজোরে ধাক্কা দিতে না পারলেও
লেখক ‘রুপালি’ -তে
বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনদের
জীবনযাপন আচার আচরণের বাস্তবরূপ
সুন্দরভাবে ফুটায়ে তুলতে পেরেছেন।
ভবিষ্যৎয়ে চাই-
ঔপন্যাসিক কামরুজ্জামান মোহন-
তার সাহিত্যকর্মেের মধ্য দিয়ে-
রুপালি তার ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলছে,
সমাজে প্রচলিত -শাসিত শোষিত নিপীড়িত
নিগৃহীত রুপালি- নারীরা রুখে দাঁড়িয়েছে,
অন্যায্য রীতিনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে,
তার নিজ পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দিচ্ছে,
নারী-মানুষ বান্ধব একটি সুন্দর
নতুন সমাজ গড়ায়
রুপালি- নারীরা ভূমিকা রখছে।
কামরুজ্জামান মোহন-এর নিকট
এ-ই প্রত্যাশাই করছি।
২১/০৬/২০২০ ইং।