করোনা ভাইরাসকে ভয় পাওয়ার আদৌ কিছু আছে কি?

প্রকাশিত: ২:৪৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৩, ২০২০

করোনা ভাইরাসকে ভয় পাওয়ার আদৌ কিছু আছে কি?

|| রাহমান চৌধুরী || ২৩ জুন ২০২০ : [সকলকে কষ্ট করে পুরো লেখাটা পড়তে অনুরোধ করবো।]

হয়তো লেখাটা পাঠ করলে আপনার মনের সাহস বাড়তে পারে। নানারকম প্রশ্ন মনে উদয় হতে পারে। কিন্তু লেখাটা আপনার মনে ভয় উৎপাদন করবে না। করোনা ভাইরাসকে আমাদের আদৌ ভয় পাওয়ার খুব বেশি কিছু ছিল কি? হয়তো শুরুতে আমরা আতঙ্কে হিসাননিকাশ করে দেখিনি ভয়টা আসলে কেন পেয়েছিলাম। বরং সবরকম হিসাব নিকাশ অভিজ্ঞতা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবস্থা দেখার পর মনে হচ্ছে আসলে করোনাকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। যা ভয় পাওয়ার সেটা আসলে বিশ্ব ব্যবস্থাকে, হয়তো বা বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে। কিন্তু ভয় পেয়েছি আমরা করোনাকেই। কারণ বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভয়টা সুকৌশলে আমাদের মনে তৈরি করে দিয়েছে। বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আমাদের গৃহবন্দী করেছে। করোনাকে ভয় পেয়েছি ঠিকমতো বুঝেশুনে সঠিক অঙ্কটা মেলাতে পারিনি বলে। করোনা ভাইরাসের আগে মহামারী আকারে আরো নানারকম ভাইরাসের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান শতকে তার মধ্যে আছে সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদি। বর্তমান ভাইরাসকে বলা হয় নভেল করোনা ভাইরাস। মানে অভিনব করোনা ভাইরাস বা অদ্ভুত করোনা ভাইরাস। কিন্তু কতোটা অভিনব বা সত্যিই তা কিনা সেটা বিচার বিবেচনা করে দেখা যাক। চাইলে দীর্ঘ লেখাটা কেউ একসঙ্গে পাঠ করতে পারেন। কিংবা চারটি পর্বে বিভক্ত লেখাটি বিভিন্ন সময়ে পাঠ করে নিতে পারেন।

প্রথমপর্ব:
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব জ্ঞানবিজ্ঞান ধন সম্পদে বহু অগ্রগতি লাভ করলেও, ভাইরাস রোগের চিকিৎসায় সেভাবে অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। কথিত বিভিন্ন ভাইরাসের রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসাবিজ্ঞান ‘স্পেনিশ ফ্লু’র সময় যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, বর্তমানে বলতে গেলে প্রায় সেখানে আছেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে বিশ-একুশ শতক নানারকম বিস্ময়কর অবদান রাখলেও, ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে নতুন কোনো অবদান লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বলা যায়, ভাইরাস রোগ প্রতিরোধে উনিশ শতকের শেষপাদে যতটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেই বর্তমান বিশ্ব চলছে। সার্স, মার্স সব ক্ষেত্রেই এটা প্রমাণিত হয়েছে। সার্স যুদ্ধে লড়াই করেছেন এমন একজন ব্যক্তি ব্রেইন ডোবারস্ট্রাইন বলেন, সত্যি বলতে একুশ শতক সার্স ভাইরাস প্রতিরোধে কম ভূমিকা রেখেছে, সার্স নিয়ন্ত্রণে উনিশ শতকের চিন্তা-ভাবনা বা প্রযুক্তি যথেষ্ট মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। কিছুতেই এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, উনিশ শতকের আবিষ্কার দিয়েই আমরা একুশ শতকে লড়ছি। বিভিন্ন বড় বড় অষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলি ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী নয়, কথাটা বহুজনই বলেছেন। কবে ভাইরাসের আক্রমণ হবে তার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলি টাকা ঢালতে চায় না, কারণ মুনাফা তাদের কাছে প্রধান কথা। স্বল্পকালীর সময় বা এককালীন সময়ে জন্য অষুধ বিক্রিতে তেমন মুনাফা নেই। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলিও পরিচালিত হয় ধনীদের স্বার্থ দ্বারা। ফলে ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে সেসব দেশের সরকারগুলিও খুব উৎসাহ দেখায়নি। স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর বেশির ভাগ ধনী দেশগুলি চিকিৎসাসেবা দেয় না, চিকিৎসা বিক্রি করে।

ফলে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা বন্ধই ছিল বলা যায়। ভাইরাসের আক্রমণ হলে তখন কিছুটা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায় মাত্র সরকারগুলির মনোভাবে। কিন্তু সুদূর লক্ষ্য নিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি বিশ্বের কর্তাব্যক্তিদের। ফলে সার্স রোগের আক্রমণেও বিশ্ব দিশেহারা হয়েছিল। সার্স রোগ মানে ‘সিভিয়ার একিউট রেসপাইরেটোরি সিনড্রোম’ বা সার্স রোগের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় দুই হাজার দুই সালের নভেম্বর মাসের ষোল তারিখে। চীনের গুয়ানজং প্রদেশের ফসহান শহরে সেদিন পঁয়তাল্লিশ বছরের এক যুবকের শরীরে এই রোগ সনাক্ত হয়। খুব উচ্চমাত্রার জ্বর, শুকনা কাশি আর সেইসঙ্গে তার শ্বাসতন্ত্রকে অকার্যকর করে তোলে। দুঃখজনকভাবে তার শ্বসনযন্ত্র দ্রুত বিকল হয়ে পড়ে। চীন কিন্তু তখন রোগটি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অবগত করে না। যখন রোগটি প্রথম আরম্ভ হয় দেখা গেল খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষক, দোকানদার বা রান্নার সঙ্গে যুক্তরা সংক্রামিত হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে তা স্বাস্থকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ আক্রান্তরা যখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান তা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকদের আক্রান্ত করে। যখন রোগটি চীনে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন গুয়াজং প্রাদেশিক সরকার এগারোই জানুয়ারি স্থানীয়ভাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করে এই রোগটির কথা ঘোষণা করে। দুই হাজার তিন সালের একত্রিশে জানুয়ারি দেখা যায় সার্স ভাইরাস দ্বারা গুয়ানজংয়ের সান ইয়াৎ সেন চিকিৎলয়ের ত্রিশ জন স্বাস্থ্যসেবিকা সংক্রামিত হয়ে পড়েছেন। পরে গুয়াজংয়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা রোগটি নানাভাবে ছড়াতে থাকে। বিভিন্ন কারণে পরে মনে করা হয় প্রাণী থেকে এই রোগ মানুষের দেহে ছড়িয়েছিল, যা ছিল মানুষের ফুসফুসের প্রদাহ ঘটিত গুরুতর রোগ।

চীন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে রোগটি সম্পর্কে জানায় দুই হাজার তিন সালের দশই ফেব্রুয়ারি। চীনে তখন ১০৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী সহ মোট ৩০৫ জন আক্রান্ত আর তার মধ্যে মারা গিয়েছে পাঁচ জন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তা আরো বেড়ে যায়। দুই হাজার তিন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই রোগটি চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারপরেই চীনের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। চীনে প্রথম রোগটি সনাক্ত হবার স্বল্পদিন পরেই গুয়ানজংয়ের সান ইয়াৎ সেন হাসপাতালের বয়স্ক একজন চিকিৎসক লিউ হংকং ভ্রমণে যান তাঁর এক আত্মীয়র বিয়েতে। তিনি কাউলনের মেট্রোপল হোটেলের নবম তলায় অবস্থান করেন যেখানে সেইসময়ে বিভিন্ন দেশের আরো অনেক ভ্রমণকারী ছিলেন। বৃদ্ধ এই চিকিৎসক নিজে তখন সার্স রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা তিনি জানতে পারেননি। কাউলন হোটেলে অবস্থানকালে লিউ নবম তলার ৭ জন সহ মোট ২৩ জনের মধ্যে রোগটিকে নিজের অজান্তেই সংক্রামিত করেন। বাইশে ফেব্রুয়ারি যখন তাঁর নিজের রোগ ধরা পরে, লিউকে হংকংয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লিউ হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের সাবধান করে দিয়ে বলেন যে তাঁকে যেন সকলের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়। তিনি মার্চের ৪ তারিখে সেখানে মারা যান। লিউর মাধ্যমে তাঁর ভগ্নিপতি আক্রান্ত হন পহেলা মার্চ, তিনিও হংকংয়ের একটি হাসপাতালে মারা মার্চের ১৯ তারিখে।

চিকিৎসক লিউর এই ভ্রমণের ঘটনা থেকে রোগ চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে হংকং থেকে আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভ্রমণকারীরা তখনো কেউই জানতেন না যে তাঁরা রোগটি বহন করছেন। কাউলনের মেট্রোপল হোটেলে অবস্থানকালীন অতিথিদের মধ্যে তিনজন ফিরে যান সিঙ্গাপুরে, একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, একজন আয়ারল্যাণ্ডে আর একজন ভিয়েতনামে, দুজন কানাডায় এবং সকলেই তাঁরা রোগটিকে বহন করে নিয়ে যান। কাউলন হোটেলের বিদেশী অতিথিদের বাকি কয়েকজনকে সার্স ভাইরাসে আক্রান্তের কারণে হংকংয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেট্রোপল হোটেলের সাতাশ বছরের এক অতিথি রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হংকংয়ের প্রিন্স অব ওয়েলস হাসপাতালের নিরানব্বই জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হন। ভিয়েতনামে রোগটিকে বহন করে নিয়ে যান একজন চীনা-আমেরিকান নাগরিক তাঁর নাম জনি চেন। তিনি ছিলেন মূলত সাংহাইয়ের অধিবাসী। তিনি রোগটি ধরা পড়লে ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি হ্যানয়ের ‘ফ্রেন্স হসপিটাল অব হ্যানয়’-এ ভর্তি হন এবং সে হাসপাতালের ৩৮ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে সংক্রামিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা কার্লো ছিলেন সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি চেনকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হন এবং ২৯ মার্চ মারা যান।

কানাডার একজন বয়স্ক মহিলা যিনি হংকংয়ে মেট্রোপল হোটেলের অতিথি ছিলেন, তিনি কানাডাতে ফিরে এসে সার্স রোগের আক্রমণে ৫ মার্চ মারা যান। তাঁর ছেলে সংক্রামিত হয়ে মারা যান ১৩ মার্চ। বিভিন্ন ঘটনার ভিতর দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে রোগটির খবর পৌঁছে যায়। ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গেছে রোগটি প্রথম চীন দেশে সনাক্ত হয়েছে আর তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সঙ্গে সঙ্গে অবগত না করার জন্য চীন সমালোচিত হন। যদিও দুই হাজার তিন সালের জানুয়ারি মাসে গুয়ানজং প্রাদেশিক সরকার সাংবাদিক সম্মেলনে রোগটির কথা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু দুই হাজার তিন সালের পনেরোই ফেব্রুয়ারি চীন সরকার নিজে তাদের তথ্য প্রকাশ করে এবং ততদিনে চীনে তিনশো পাঁচ জন আক্রান্ত হয়েছে। চীন আরো আগে তথ্যটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে না জানাবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়ে বলে, বিশ্বকে এ ব্যাপারে আগে সতর্ক না করাতে রোগটির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। মার্চের বারো তারিখের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগটি সম্পর্কে সারা পৃথিবীকে সতর্ক করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হু সারা বিশ্বের নাগরিকদের পরামর্শ দেয় আক্রান্ত দেশ বা অঞ্চলগুলি ভ্রমণ না করতে। দুই হাজার তিন সালের ফিফার মহিলা বিশ্বকাপ সে কারণে চীন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আইচ হকির মহিলা চ্যাম্পিয়নশীপ বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল করা হয়। বিভিন্ন আক্রান্ত দেশগুলি সভা-সেমিনার আন্তর্জাতিক সম্মেলন-এসব স্থগিত করে। চীন সহ সংক্রান্ত অঞ্চলের খাবারের দোকানের ব্যবসা সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছিল। হংকংয়ের পর্যটন ব্যবসায় বিপর্যয় ঘটেছিল।

সার্সের লক্ষণ ছিল অন্যান্য ফ্লুর মতোই। উচ্চমাত্রার জ্বর, শুকনা কাশি, মাথাব্যথা, ডায়ারিয়া, চামড়ায় র‌্যাশ হওয়া, ক্ষুধামন্দা, শ্বাসকষ্ট। কিন্তু রোগটা কীভাবে ছড়াতো প্রথম বিজ্ঞানীরা খুব একটা নিশ্চিত হতে পারেনি, কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিল রোগীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এটা ছড়ায়। সার্সের মৃত্যুর হার ছিল শতকরা প্রায় দশজন। কিন্তু সার্স ভাইরাসের লক্ষণ দুতিন দিনের মধ্যেই ধরা পড়তো। ফলে সার্স ভাইরাস খুব লম্বা সময় ধরে নীরবে সাধারণ মানুষের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারতো না বলে, খুব বেশি মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেনি। কিন্তু তারপরেও একত্রিশটি দেশে এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছিল। সবচেয়ে বড় সংক্রমণ ঘটে চীন আর হংকংয়ে। চীনে মোট আক্রান্ত হয়ে ৫০২৭ আর মারা যায় ৩৪ জন। হংকংয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭০৫ আর মারা যায় ২৯ জন। তাইওয়ানে আক্রান্ত হয় ২৪৬ জন মারা যায় ৭ জন। সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩৮ মারা যায় ৩ জন। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৭ কিন্তু কেউ মারা যায়নি। সকল দেশ মিলিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছিল ৮০৯৬ জন মারা যায় ৭৭৪ জন। বিভিন্ন দেশ আক্রান্ত হলে যখন মাস্ক পরার কথা বলা হয়, কোয়ারেন্টাইনে যাবার ‌সিদ্ধান্ত অা‌সে ঠিক তখনি হঠাৎ রহস্যময়ভা‌বে ভাইরাস‌টির অাক্রমণ কম‌তে থা‌কে। মাত্র অাট মাস এই ভাইরাস তার প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। দুই হাজার তিন সা‌লের পাঁচই জুলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা ক‌রে যে সার্স ভাইরা‌সের ভয় দূর হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। দুই হাজার চার সালের মে মাসের পর আর সার্স আক্রান্তের খবর পাওয়া যায় না। সার্স ভাইরাসের রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়ার কারণ এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনি। সার্স আক্রমণের সময় সংক্রমণ রোধে যে টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল তা তখন স্থগিত হয়ে যায়।

সার্স যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা মিলিতভাবে এটা প্রতিরোধ করার জন্য সমন্বিতভাবে কাজে নেমেছিলেন। ব্রেইন ডোবারস্টাইন তাদের একজন। তিনি এ ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে গেছেন। তিনি মনে করেন, এধরনের ভাইরাসের আক্রমণকালে ‘স্বচ্ছতা হচ্ছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নীতি রোগটিকে প্রতিরোধ করার জন্য’। তিনি লিখেছেন প্রথমদিকে বহু দেশই সঠিক তথ্য দিতে চাইতো না। তিনি এ কারণে বলেছেন যে, এই ধরনের সর্বগ্রাসী মহামারীর ক্ষেত্রে ‘ বিশেষ কোনো একটি দেশের খোলাখুলি নিজেকে প্রকাশ না করা বা দায়িত্বহীনতার পরিচয় শুধু তার নিজের দেশকেই নয়, সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে।’ যদিও সার্স ভাইরাসটি রহস্যজনকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, কিন্তু ডোবারস্ট্রাইন পরে খুশি মনেই লিখেছেন, সার্স ভাইরাস রুখতে নজীরবিহীনভাবে সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা এক হয়েছিল। সকলে খোলামনে এবং সদিচ্ছা নিয়ে অন্যদের কাজে সাহায্য করেছে, যতো দ্রুত সম্ভব তাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য জানাতে কার্পণ্য করেনি। ফলে দ্রুত ভাইরাসটির চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, বলতে গেলে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে। বিজ্ঞানের জগতে ভাইরাস রুখবার প্রচেষ্টায় সেবার প্রত্যেকে তাদের সেরাটাই দিয়েছিল। পারস্পরিক সহযোগিতা এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তিনি আরো বলেছিলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্য হবে যদি আমার দুই হাজার তিন সালের অভিজ্ঞতা থেকে না শিখি এবং তাকে কাজে না লাগাই। সার্স বুঝিয়ে দিয়েছে যদি আমরা সকলে যথেষ্ট ভালো প্রস্তুতি নিয়ে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করি তাহলে যুদ্ধটা সহজ হবে আর তখনই আমরা সংক্রমণকারী রোগগুলির বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়তে পারবো। বিশ্বে এমন কোনো দেশই নেই যে সম্পূর্ণ একা এই ভয়াবহরকম সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে পারে।

দ্বিতীয় পর্ব:
সার্সের পর আবার মার্স-এর দেখা পাওয়া গেল দুই হাজার বারো সালে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে। মিডল ইস্ট রেসপাইরেটোরি সিনড্রোম বা মার্স আরম্ভ হয় প্রথম সৌদি আরবে। সেখানকার একজন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ দুই হাজার বারো সালের তেরোই জুন থেকে জ্বরে ভোগার পর এগারো দিনের মাথায় মারা যান। তার জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট ছিল। সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসের বারো তারিখে কাতারের একজনের এমনটাই ঘটে যা সৌদি রোগীটির ঘটেছিল। সেই সময়ে ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন এ- কন্ট্রোল তখন যে দেশগুলি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার একটা তালিকা তৈরি করে। সে দেশগুলি হলোÑবাহরাইন, ইরাক, ইজরায়েল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইউনাইটেড আরব আমিরাত এবং ইয়েমেন। দুই হাজার তেরো সালের জুনের মধ্যে ৫৫ জন আক্রান্তকে পাওয়া যায় যার মধ্যে ৩১ জন মারা যায়। তার মধ্যে ৪৫ জনই ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের, যেমন: সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার, আরব আমিরাতের মানুষ। ৮ জন ছিলেন ইউরোপেরÑফ্রান্স, ইতালী ও ব্রিটেনের, ২ জন ছিলেন আফ্রিকার তিউনিশিয়ার। দুই হাজার চোদ্দ সালে আক্রান্ত পাওয়া গেল ২৫৫ জন। সে বছরের মে মাসের মধ্যে সংক্রমিত হলো ৫৭০ জন মারা গেল ১৭৩ জন। মার্স বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তার সংক্রমণের হার বেশি ছিল না। মনে হয় সৌদি আরবে হজ্জ করতে এসে অনেকে নিজ শরীরে রোগটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। মার্স ভাইরাস যে শুধু মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতো ব্যাপারটা তা নয়। নিশ্চয় আক্রান্ত রোগীর খুব ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে একজন মানুষের শরীর থেকে আর এক জন মানুষের শরীরে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মানুষ ছাড়াই অন্যভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বহুজন মনে করেন, উট থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। ফলে এ রোগ ছড়ানোর কারণটি এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। মার্স ভাইরাস কীভাবে ছড়াতো বর্তমান রচনায় এটা আলোচনার প্রধান বিষয় নয়। বিজ্ঞানীদের কাজ মার্স ভাইরাস কী প্রকারে ছড়াতো সেটা আবিষ্কার করা। মার্স নিয়ে বক্ষ্যমান রচনায় সামান্য প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ হলো, ভিন্ন একটি দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া।

যখন সার্স ২ বা কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলি খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সৌদি আরবের মানুষদেরকে অনেকেই মনে করে বর্বর। যদিও সেমিটিক অনেক পুরানো সভ্যতা কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌদি জনগণ বা সৌদি আরব দেশটি নিয়ে মানুষের মনে খুব ভালো ধারণা নেই। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরব একটি যুগান্তকারী বা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার আর ইসলামের পয়গম্বরের জন্ম যেখানে, সেই সৌদি আরব প্রথমেই কাবা শরীফ বন্ধ ঘোষণা করে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সকল সময় বলা হয় ইসলাম একটি কট্টোর ধর্ম। বলা হয়, মুসলমানরা অন্ধ আর কুসংস্কারাচ্ছ; যাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি সামান্য আগ্রহ নেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্বে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপটি গ্রহণ করে কিন্তু সেই সৌদি আরবের মুসলমানরা। ধর্মীয় সমস্ত কুসংস্কারকে বাতিল করে বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে তারা। কারো সাহস হয়নি রাষ্ট্রীয় এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। বা রাষ্ট্রের সকলে সেটা যুক্তিসঙ্গতভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। ধর্ম পালন রাষ্ট্র নিষেধ করেনি, ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সকলের ছিল। কিন্তু ধর্ম সৌদি আরবের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বা মানুষের জীবন আগে তারপরে ধর্মীয় বাড়াবাড়ি। সৌদি আরবে আগামী বছরে হজ্জ পালিত হবে না করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের কারণে। কিন্তু হজ্জ সৌদি আরবের একটি বড় উপার্জনের জায়গা। সৌদি আরব সেটা নিয়ে সামান্য মাথা ঘামাচ্ছে না। স্বীকার করতেই হবে, করোনা ভাইরাসে আক্রমণ প্রতিরোধে সৌদি আরব বহু বিজ্ঞানসম্মত দেশের চেয়ে নিজের বিজ্ঞাসমনস্কতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ এই দেশটি গণ জমায়েত ডেকে রোগটি দূর করার জন্য প্রার্থনা সভারও আয়োজন পর্যন্ত করেনি। বরং মানুষকে হাসপাতালগুলিতে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে আর বিভিন্ন ধরনের জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে সংক্রমণ দূর করতে চেয়েছে।

বিষয়টা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল না। সৌদি আরব করোনা আক্রমণের ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিল। ধর্ম পালনের নাম করে জনগণকে জমায়েত করতে দিলে যে প্রাণহানী ঘটবে, রাষ্ট্র সেটা বুঝতে পেরেছিল। রাজতন্ত্র সম্পর্কে যতোই নেতিবাচক হোক মানুষের ধারণা, সৌদি রাজপরিবার জনগণের জানমাল নিয়ে যে দুশ্চিন্তা করে তার প্রমাণ রেখেছে। গণতান্ত্রিক বহু দেশ তার জনগণের নিরাপত্তা বিধানে সেটুকু করার চেষ্টা দেখায়নি। ফলে সৌদি আরবকে চট করে বর্বর বলার আগে বহুবার বিবেচনা করতে হবে। রাজতন্ত্র তার প্রজার জন্য যা পেরেছে, ভারত এবং বাংলাদেশ সহ বহু রাষ্ট্রের সরকার কি জনগণের মঙ্গলের জন্য সেরকম কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে? জনগণের মঙ্গলের জন্য সৌদি আরব ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে সামান্য পাত্তা দেয়নি। জুম্মার নামায, ঈদের জামাত সব বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু সকল রকম জমায়েত নিষিদ্ধ করার পরেও দেখা যাবে, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক। সাড়ে তিন কোটি মানুষের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। যদি কাবা শরীফে নামাজ পড়া, উমরাও করার অধিকার দান, জুম্মার নামাজ আদায় করা ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়গুলি চালু রাখা হতো তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা কতোগুণ বাড়তো? ফলে সরকার যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, যখন রচনাটি তৈরি হচ্ছে তখন সৌদি আরবে আক্রান্ত জনসংখ্যা হলো ১১২২৮৮ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৮১৯। সৌদি আরবকে কি তাহলে বর্বর দেশ বলা যাবে? জন বিচ্ছিন্ন দেশ বলা যাবে? যখন সৌদি আরবে মৃতের সংখ্যা ৮১৯ তখন কানাডাতে আক্রান্ত ৯৭১২৫ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৯৬০।

মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। কাতারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩৫৯৫ আর মৃতের সংখ্যা মাত্র ৬৬। ইউনাইটেড আরব আমিরাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০৫০৭ আর মৃতের সংখ্যা ২৮৪। কুয়েত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩৮২৩, মৃতের সংখ্যা ২৭৫। ওমানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮৮৮৭, মৃতের সংখ্যা ৮৪। সবগুলি দেশের সংখ্যা যদি যোগ করে মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলেও মৃতের শতকরা হার এক শতাংশ হচ্ছে না। দাঁড়াচ্ছে মাত্র ০.৬ এর কাছাকাছি। কিন্তু সারা বিশ্বের গড় মৃতের হার সেখানে ৫শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃতের হার ফ্রান্সে প্রায় আঠারো শতাংশের বেশি, ব্রিটেনে ১৪ শতাংশের বেশি, স্পেনে ১০ শতাংশের মতো। ব্যাপারটা কি তাহলে এমন হতে পারে যে, সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মার্স ভাইরাসের আক্রমণের পর এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল বা মার্স ভাইরাসের আক্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে? না হলে এরকম সাফল্য খুব সচরাচর ঘটে না। যদি লক্ষ্য করি দেখা যাবে ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বেশি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা ৪১২১৬ জন হলেও মৃতের সংখ্যা মাত্র ২৬ জন। ভিয়েতনামে মৃতের সংখ্যা নেই আর আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘদিনেও সাড়ে তিনশোর বেশি হতে দেয়নি। বিষয়টা কি এমন কিছু যে, সার্স ১ এর অভিজ্ঞতা তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে সব মিলিয়ে এশিয়ার সাফল্য পাশ্চাত্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি। মৃতের সংখ্যা পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে অনেক কম। নিশ্চয় এর কারণ নিয়ে পরবর্তীত বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার সুযোগ থাকবে। মার্স সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য তখনি একটি ভবিষ্যত বাণী করেছিল যে, মার্স ভাইরাসটি পরে আরো বড় মহামারী আকারে বিশ্বে আবার দেখা দিতে পারে। সে কারণে এ নিয়ে গবেষণার প্রস্তাবও রেখেছিল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সে প্রস্তাব ধনী দেশগুলির কাছে গুরুত্ব পায়নি। বিশ্বের ধনী দেশগুলি নিজেরাও গবেষণায় তেমন আক্রমণ দেখায়নি। কিন্তু তখন থেকে গবেষণা চালিয়ে গেলে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের সকল দেশকে এভাবে দিশেহারা হতে হতো না।

যখন চীনে গত ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আরম্ভ হলো, চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তা সঙ্গে সঙ্গে অবগত করে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটাকে নতুন একটা খবর ছাড়া খুব বেশি ভয়াবহ মনে করেনি। বিশ্বকে এ ব্যাপারে বা নতুন করোনা ভাইরাসের মহামারী সম্পর্কে প্রথম দুমাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেইভাবে সতর্ক করেনি। বড় ছোট বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্ণধার সহ সংশ্লিষ্টরা ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। ফল যা হবার হয়েছে। বিরাট বিরাট দেশ বলে যাদের লোকে সমীহ করতো, তারাই এখন ভয়াবহভাবে করোনা ভাইরাসের শিকার। চীন হয়তো উহানেই করোনা ভাইরাসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারতো বাকি বিশ্বের সহযোগিতা পেলে। চীন সেরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই পুরো শহরটাকে কারাগার বানিয়ে এর প্রতিবিধান করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু বাইরে বসে আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল সেটা নিষ্ঠুরতা। পুরো শহরের মানুষকে কঠিনভাবে এভাবে অবরুদ্ধ করে ফেলা আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না। মায়াকান্নাটা আমাদের বেশি, সেজন্য পুরো ঘটনা সম্পর্কে না জেনেই মনে করেছিলাম চীন নিষ্ঠুর আচরণ করছে তার নাগরিকদের সঙ্গে। বলা হলো, চীন সরকার কীরকম নিষ্ঠুর, চিকিৎসার নামে পুরো একটা শহরের মানুষকে বন্দী করে রেখেছে। চীনের স্বৈরাচারী শাসনের স্বরূপ নিয়ে সারাবিশ্বে তখন সমাালোচনা আরম্ভ হলো। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের যতো দেশের মানুষরা তখন উহানে ছিল বা যারা পড়াশুনার জন্য গিয়েছিল, সকলের আহাজারি শোনা গেল, শহরটাকে বন্দী করে চীন সরকার তাদের জীবনটা অনিশ্চিত করে ফেলেছে। মৃত্যুপুরীর মধ্যে তাদের বন্দী করে রেখেছে। ব্যাপারটা নিশ্চয় তেমন ছিল না। কিন্তু প্রচারগুলি ছিল খুব নেতিবাচক।

বিভিন্ন ধরনের খবর আসছিল তখন চীনের উহান সম্পর্কে, যার মধ্যে সকলে কমিউনিজমের ভূত দেখতে পেয়েছিল। সরকার মানুষগুলিকে বন্দী করে রেখেছে, খাবার দিচ্ছে না ঠিকমতো। সপ্তাহে যে খাবার দেয়া হচ্ছে সেটা পরিমাণে অনেক কম। চীনের যেসব খাবার দেয়া হচ্ছে তা খাওয়া যায় না। খাদ্য কেনার জন্য পর্যন্ত কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। বিশ্বের জন্য করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়াবহ কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে সে-খবরটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে, চীনের শাসকদের দমনপীড়নের কথাগুলিই বেশি বলা হলো। কখনো এ ইঙ্গিতটা দেয়া হলো না যে, সকল নিষ্ঠুরতার পরেও উহানেই যদি এ ভাইরাসকে নির্মূল করা সম্ভব হয় সারা বিশ্বই তাতে লাভবান হতে পারে। কিন্তু সকল রাষ্ট্র চাইলে করেনা সঙ্কটের সমাধান তখনি হতে পারতো। যদি উহান থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয়ে থাকে, সেটা উহানের মধ্যে আটকে রেখে নির্মূল করার পদক্ষেপই ছিল সবচেয়ে সঠিক। পাশাপাশি ইতিমধ্যে যেসকল নাগরিক উহান ভ্রমণ শেষে বিভিন্ন দেশে ফিরে গেছে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সকল সরকার তাদের নিজনিজ দেশে কড়া নজরদারিতে রাখলে, তাদের সংক্রামিত হতে দেখলে তার প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সংক্রাণের সমাপ্তিটা সেখানেই ঘটতে পারতো। কিন্তু কারো পক্ষেই তখন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা হৃদঙ্গম করা সম্ভব হয়নি, বিশ্বের জন্য তা কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়নি। চীন যে মহামারীর হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে কতোটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাও বোঝা যায়নি। ফলে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে চীন উহানে অবরুদ্ধ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সেসব দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করলো। বাংলাদেশে ফিরে এলো অনেকে। নিশ্চয় এখন তারা টের পাচ্ছে উহানে থাকা সঠিক ছিল নাকি এই ফিরে আসাটা।

করোনা ভাইরাস নিয়ে চীন সম্পর্কে নানারকম মুখরোচক গল্প পরেও শোনা গেছে। কিন্তু বাস্তব সত্যটি হলো, চীনই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রথম সঠিক পদক্ষেপটি নিয়েছিল। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রই এখন সবচেয়ে ভয়াবহরকম করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত, মৃতের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি সেখানে। কারণ রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্রথমে কিছুতেই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কথা শুনতে চাননি। ট্রাম্পের জেদই যুক্তরাষ্ট্রকে ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রেই শুধু করোনায় আক্রান্তদের সংখ্যা সারা পৃথিবীর আক্রান্তদের প্রায় এক চতুর্থাংশের বেশি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের মৃতের ক্ষেত্রেও তাই। বর্তমানে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে, করোনা ভাইরাসের ভয়বহতার কথা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানরা জানতো। কিন্তু খবরটা তাঁরা গোপন করেছিলেন। নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা তা চেপে গিয়েছিল। কারণ তাঁদের ভয় ছিল, খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ধ্বস নামবে। ট্রাম্পের নিজেরই বিরাট ব্যবসায়িক সা¤্রাজ্য রয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে নিজেদের শেয়ারের দাম ঠিক থাকতে থাকতে সেগুলির একটা বিলিব্যবস্থা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে নীরব রইলো। বরং ট্রাম্প বলে বেড়ালো, এটা একটা সাধারণ ফ্লু। কিছুদিন আবার চীনকে দোষারোপ করলো। কিন্তু এখন বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ করছে, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিতে দেরি করাতে যুক্তরাষ্ট্রে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং ইতিমধ্যেই এক লক্ষবিশ হাজার মানুষ মারা যায়। ধনীক দেশগুলির কাছে আসলে আগে নিজেদের মুনাফা, তারপর জনগণের জীবনের মূল্য। নিজেদের মুনাফার স্বার্থে লক্ষ লক্ষ লোককে মৃত্যুপথে পাঠাতে তাদের মনে সামান্য দ্বিধা নেই। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবেই তা প্রমাণ করেছে।

তৃতীয় পর্ব
বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস আছে থাকবে। মানুষকে তার মধ্যেই টিকে থাকতে হবে। মানুষ বছরের পর সেভাবেই টিকে আছে। মানুষের জিন দিনে দিনে সেভাবেই প্রস্তুত হয়। চালর্স ডারউইনের সেই কথাটাই আবার সত্য হবে, যোগ্যরাই টিকে থাকে। মানুষকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ভয় পেয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বেড়ালে হবে না, ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা জন্য শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। শারীরিক এই সক্ষমতা অর্জন কঠিন কিছু নয়। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া আর কিছুটা শারীরিক পরিশ্রম করা। চিকিৎসাবিজ্ঞান ইতিমধ্যেই যা বলেছে আর তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবীর চুরাশি-পঁচাশি শতাংশ মানুষ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ফলে করোনা ভাইরাসটি খুব শক্তিশালী কিছু নয়। সকল মানুষ যদি ঠিমত খাবার দাবার পেতো আর কিছুটা শারীরিক পরিশ্রম করতো দেখা যাবে ভাইরাস নিরানব্বই শতাংশ মানুষকে কিছুই করতে পারবে না। প্রতি বছর কিছু মানুষ তো নানাভাবেই মারা যাবে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা বিভিন্নভাবে। সেসব নিয়ে এতদিন তো আমরা দুশ্চিন্তা করিনি। কিন্তু করোনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলাম কেন? মাত্র পাঁচ-ছয় শতাংশ মানুষের বাঁচামরার প্রশ্নে চুরাশি শতাংশ মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে বা গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে। স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

কথাটা বারবার বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আশি শতাংশ মানুষ সেটা টেরই পায় না। মানে ভাইরাসটি তাদের সামান্য কাবু করতে পারে না। ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, বিশ্বের আশি ভাগ মানুষের কাছে পাত্তাই পায় না ভাইরাসটি। যদিও বলা হচ্ছে আশি ভাগ কিন্তু বাস্তব অবস্থায় মনে হচ্ছে সংখ্যাটা হবে আরো বেশি। করোনা আক্রান্ত হলে শারীরিকভাবে টের পাচ্ছে বিশ বা পনেরো শতাংশ মানুষ। বিশ শতাংশের মধ্যে কারো টের পাওয়াটা খুবই সামান্য। কারো টের পাওয়াটা কিছুটা বেশি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেরে উঠছে। করোনা রোগ প্রতিরোধে আশি ভাগ মানুষের কিছুই লাগছে না। বাকি বিশ ভাগের মধ্যে কারো চিকিৎসা লাগছে। চোদ্দ-পনেরো শতাংশের দরকার হয় খুব সামান্য চিকিৎসা, জ্বর কাশির অষুধ। হয়তো কারো গলাব্যথা হচ্ছে সামান্য, কিন্তু করোনার নাম শুনে ভয়টা বাড়ছে। কিন্তু আসলে সেগুলি ভয়ের কিছু নয়। মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই সেরে উঠছেন। বিশ শতাংশের মধ্যে যাদের শ্বাস কষ্ট হচ্ছে দেশ ভেদ-এ সেটা বিভিন্নরকম। ধরা যাক আক্রান্তদের মধ্যে খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত শতাংশের শ্বাস কষ্ট হয় থাকে। হাসপাতালে সেজন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকলেই হলো। যদি ঠিক মতো অক্সিজেন পাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে করোনায় আক্রান্ত আটানব্বই শতাংশ মানুষ সেরে উঠবে কিংবা তার চেয়েও বেশি। বর্তমান বহু ধরনের পরিসংখ্যান তাই বলছে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু মানুষের মৃত্যুর একটা বড় কারণ চিকিৎসকরা প্রথম বুঝে উঠতে পারেনি চিকিৎসাটা কী হবে। দ্বিতীয়ত হাসপাতালগুলিতে সংক্রামিত রোগীদের প্রয়োজন মতো অক্সিজেন ছিল না। যদি হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতো বহু রোগী বেঁচে যেতেন। ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে না পারার কারণে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা। কিছু ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাবে অক্সিজেন দেয়ার প্রক্রিয়া ভুল ছিল। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখাটা কঠিন বা খুব ব্যয় বহুল কিছু নয়। কিন্তু প্রয়োজন হতো না বলে রাখা হয়নি। বাস্তবে তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? করোনায় আক্রান্তদের একদলের কিছুই দরকার হয় না। সামান্য চিকিৎসাও লাগে না সেরে উঠতে কারণ তারা কিছুই টেরই পায় না। কিছু সংখ্যক রোগীর দরকার হয় সহজে প্রাপ্ত কম দামের কিছু সাধারণ অষুধ। কিছু সংখ্যক রোগীদের আবার অক্সিজেন দিয়েই বাঁচানো যায়। ফলে করোনার চিকিৎসা নেই বলা যাবে না। চূড়ান্ত চিকিৎসা হচ্ছে অক্সিজেন সবচেয়ে জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, হয়তো অক্সিজেন দেয়ার পরেও দুই বা এক শতাংশ মানুষকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু দেখা যাবে তার কারণ করোনার সংক্রমণ যতোটা নয় তার চেয়ে ভিন্ন কিছু। হয়তো বিভিন্নরকম রোগে তিনি পূর্ব থেকেই আক্রান্ত বা বয়স অনেক বেশি। পৃথিবীর স্বাস্থ্য তালিকায় কয়টা রোগ আছে, যার ফলে দু-তিন শতাংশ লোক গড়ে মারা যাচ্ছে না? করোনায় যতো লোক মারা গেছে গত তিনমাসে তার চেয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায়, মদ্যপান আর ধূমপান এবং ক্যান্সারে বেশি লোক মারা গেছে। ক্যান্সারে মারা গেছে সাড়ে এগারো লাখ লোক। বর্তমানে বিশ্বে যে কয়েক লক্ষ মানুষ করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে মাত্র গড়ে দুই শতাংশ রোগীর অবস্থা সংকটজনক। করোনা তাহলে শেষ বিচারে দুই শতাংশ মানুষের জন্য আসলে ভীতিকর। বাকিদের সময় মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। ফলে মুত্যুর হার যেখানে দুই শতাংশ বা তার চেয়ে কম, সেখানে করোনাকে ভয় পাবার কী আছে? করোনা ভয়ে সেখানে দরজা জানালা বন্ধ করে, সকল আত্মীয়স্বজনকে ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন বাতিল করে ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? কারণ আসলেই নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা কারণ রয়েছে সেটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা।

চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমাদের গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। রাষ্ট্র আর হাসপাতাল আমাদেরকে আমাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি দিতে পারছে না বলেই, আমাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে। না হলে করোনায় আক্রান্ত হলে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কারণ আশি শতাংশ চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ্য হয়ে যাবে। চোদ্দ-পনেরো শতাংশকে কিছু প্যারাচিটামল এবং কাশির অষুধ খেতে হবে। সাত শতাংশের দরকার হতে পারে অক্সিজেন। ফলে সরকার আমাদের গৃহবন্দী না করে আমাদের জন্য হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করলেই হয়। লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন করোনার আক্রমণে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে বড়-একটা সংখ্যাকেই হয়তো বাঁচানো যেতো, যদি হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেনের অভাব না ঘটতো। ফলে যে মানুষগুলি বাঁচতো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা হাসপাতাল ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই সে মানুষগুলি মারা গেছে। চিকিৎসা সামগ্রির অপ্রতুলতা বা চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল না হলেই মানুষগুলি বেঁচে যেতো। যখন এভাবে আমরা অক্সিজেনের অভাবে মানুষকে মরতে দেখছি, নিকটজনদের মৃত্যুর খবর শুনতে পাচ্ছি; খুব ভয় পেয়ে যাচ্ছি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কী তাই? হাসপাতাল তাদেরকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনি। সরকার নিজের এই দুর্বলতার কথা স্বীকার না করে, বলতে চাইছে করোনা একটি ভয়াবহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ভয়াবহ হলে আশি শতাংশ মানুষ কিছুই টের পাচ্ছে না কেন?

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পূর্বেই দেখানো হয়েছে সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাতে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ছয়। শতকরা একজনও নয়। নিশ্চিত খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে সকল রোগীরা দরকার মতো হাসপাতালে অক্সিজেন পেয়েছে। যদি একটি ভাইরাসের সংক্রমণে শতকরা একজনও মারা না যায় তাহলে সে ভাইরাসটিকে ভয় পাবার কী আছে? খুবই দুর্বল ভাইরাস সেটি। সম্ভবত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার এর বেশি হতে পারে। ফলে এই ভাইরাসটির সংত্রমণের ভয়ে বছরের পর বছর ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? সামান্য সময়ের জন্য প্রস্তুতিমূলকভাবে ঘরে বসে থাকা যেতে পারে। যাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নতুন রোগটির উপযোগী করে গুছিয়ে নেয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যে বা সৌদি আরবে শূন্য দশমিক ছয়জন মানে যারা মারা গেছেন দেখা যাবে তাঁদের অন্যান্য অনেক ধরনের রোগ হয়তো ছিল। পাশ্চাত্যে মৃত্যুর হার বেশি, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে সকলকে অক্সিজেন দেয়া যায়নি। প্রথমে সেরকম প্রস্তুতি স্বাভাবিকভাবেই ছিল না হাসপাতাগুলিতে। ফলে সব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য কিছুদিন মানুষকে গৃহবন্দী থাকতে হতে পারে। কিন্তু করোনার ভয়ে বছরের পর বছর ঘরে বসে থাকার দরকার নেই। কারণ হাসপাতালগুলিতে সকল রকম চিকিৎসার সুবিধা থাকলে মৃত্যুর হার দেখা যাচ্ছে এক শতাংশের কম। ধরে নিচ্ছি যদি দুই শতাংশ হয় সকলকে ঘরে বসে থাকতে হবে কেন? হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমরা ঘরে বসে আছি, কারণ আমরা জানি হাসপাতালগুলিতে শয্যার অভাব আর তারচেয়ে বেশি অভাব অক্সিজেনের। সরকারের দায়িত্ব সেগুলির ব্যবস্থা করা।

লক্ষ্য করলে দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রচ্যে মৃতের হার মাত্র ০.৬। মৃতের হার এত কম হলে করোনাকে ভয় পাবার আদৌ কোনো কারণ কি থাকে? মৃতের হার সেসব দেশে কম কেন? প্রথম কারণটি হলো করোনায় আক্রান্তদের পঁচানব্বই শতাংশ এমনিতেই সুস্থ্য হয়ে যান। মধ্যপ্রাচ্যে তার চেয়ে কম মানে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো ছিল। যতদূর জানি সৌদি আরবের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার। ধরে নিতে হবে যথেষ্ট সেবারমান তাদের, ফলে আক্রান্তরা রক্ষা পেয়েছে। না হলে এমন তো হতে পারে না। দয়া করে করোনা মুসলমানদের খুব খাতির করেছে তা নিশ্চয় নয়! নিশ্চয় সামান্য ভিন্ন কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ধরা যাক তার মধ্যে বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক অবস্থা এবং তাপমাত্রা সেই সঙ্গে রোগীদের গড় বয়স। বিশ্বাস করবার কারণ আছে যে শীত আর বয়স দুটাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এবং মৃতের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। বিভিন্ন শীত প্রধান দেশের দিকে তাকালে সেটা ধারণা করবার কারণ রয়েছে। কিছু গবেষণাও হয়েছে। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু কিছু দেশ এমন সব অষুধ ব্যবহার করেছে, বহুজন মনে করেন তা সেসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। নিশ্চয় তা নিয়ে পড়ে গবেষণা হবে। চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো বিস্ময়ের। সিঙ্গাপুর খুবই ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৮ হাজার মানুষের বাস। সেখানে মোট আক্রান্ত ৪১২১৬ জন আর মৃতের সংখ্যা ২৬। মৃতের হার শূন্য দশমিক একও নয়। ভিয়েতনামে একজনও মারা যায়নি। সংক্রমণ ঘটেছে খুবই কম। কথাটা খুবই সঠিক রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল হলেই করোনার হাতে মানুষ বেশি মারা পড়বে।

চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে নানাভাবে চিহ্নিত করা যাবে। কেবল মাত্র ব্যয় বরাদ্দ নয়। দুর্নীতি হচ্ছে কিনা, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবার মান কেমন? চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে আর একটা কথা থাকে, সেটা হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা। বহু ধনীদেশ চিকিৎসা ব্যয় বেশি থাকা সত্ত্বেও, সংক্রমণ কমাতে পারেনি। বহু রাষ্ট্র সংক্রমণই বাড়তে দেয়নি। ভিন্ন আলোচনা সেটা। বাংলাদেশে যেমন বহু সাধারণ বা বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও মানুষ করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার বাইরে ভিন্ন ধরনের চিকিৎসা নিতে পারেনি। কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকালে তারা নিজেদের স্বার্থে হাসপাতালে দরজা বন্ধ রেখে মানুষকে মরতে দিয়েছে। ভিন্ন দিকে বিভিন্ন রকম অব্যবস্থপনার কারণে হাসপাতালে যেতে ভরসা পায়নি বহু মানুষ। বাংলাদেশে বহু হৃদরোগী খারাপ শরীর নিয়ে হাসপাতালে যেতে ভরসা পায়নি করোনায় সংক্রামিত হবার ভয়ে। ধরা যাক এগুলি হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও তেমনটা ঘটতে দেখা গেছে। মানুষ সংক্রামিত হওয়া আর মরনের ঢল নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন এরকম দেশের সম্পর্কে একই কথা বলা যাবে। সকলের তাদের চিকিৎসা প্রদানের কাঠামো যতোটা জোরালো, কিন্তু রাষ্ট্রটা আবার জনগণের নয়, ধনীকদের। ধনীকদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাই নানান রকম অঘটন ঘটেছে সেইসব দেশে। ঠিক আবার জনগণের রাষ্ট্র কিউবা, ভিয়েতনাম সেখানে দেখা গেছে সংক্রমণের সংখ্যা কম। কিউবা দরিদ্র দেশ হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। বিষয়গুলি খুবই ভিন্ন রকমের আলোচনার। পরে কখনো তা নিয়ে কথা বলা যাবে। কারণ এমনিতেই লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সরকারের হিসেব মতে বর্তমানে আক্রান্তের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও আক্রান্ত রোগীদের মৃতের হার বেশি নয়। দেড় শতাংশের মতো। বাংলাদেশের মানুষ সঠিক চিকিৎসা পেলে হয়তো সেটা সিঙ্গাপুরের হারের কাছাকাছি থাকতে পারতো। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশটাই তরুণ। কিন্তু অনেকেই সঠিক চিকিৎসা পাননি। বহুজন চিকিৎসা পাওয়া দূরের কথা, হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। নানারকম দ্বিমুখী আইন করে রাখা হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে। বর্তমানে শয্যা নাই হাসপাতালগুলিতে। কারণ বিভিন্ন জনের পরামর্শ সত্ত্বেও সরকার হাসপাতাল বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। চিকিৎসা সামগ্রি ঠিকমতো জোগান দেয়নি। সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজন মতো অক্সিজেন রাখার ব্যবস্থা নেয়নি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ রুহুল হক দুদিন আগেই বললেন, তিনি বারবার হাসাপাতাল, শয্যা সংখ্যা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন এসব বাড়াবার কথা বলে বলে হয়রান হয়ে এসেছেন মার্চ মাস থেকে। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন গা করেনি বা পাত্তা দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষের এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত হওয়া কারণ হলো, সবাই জেনে গেছে চাইলেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না। করোনার রোগী হাসপাতালে সাধারণত কখন ভর্তি হয়, যখন তাঁর অক্সিজেনের প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে যদি অক্সিজেনই না পান, নিশ্চিত মৃত্যু। মৃত্যুর প্রধান কারণ কিন্তু করোনার সংক্রমণ নয়, চিকিৎসা না পাওয়া। বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন ঘরে বসেও কীরকম ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন ভাবুন একবার। যদি করোনা রোগ তাকে পেয়ে বসে আর সেরকম দরকারে যদি অক্সিজেন না পান! নিশ্চয় এ রকম ভয় পাওয়াটা সকল মানুষের জন্য স্বাভাবিক। পাশাপাশি নিত্যদিন এই রকম ভয় পেতে পেতে মানুষ নানাবিধ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? মনের ভিতরে আমাদের যে ভয়, সেটা কিন্তু আসলে করোনাকে নয়। করোনা ভিয়েতনামে একজন মানুষেরও মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। সিঙ্গাপুরে একচল্লিশ হাজার আক্রন্তের মধ্যে শতকরা ০.১ জনের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি, মধ্যপ্রাচ্যে শতকরা ০.৬ জনের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। করোনা নিয়ে মানুষের মনে যে ভয়, সেভয়টা আসলে আমাদের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে। যদি অসুস্থ্য হন, যদি হাসপাতালে যেতে হয় কে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? নিশ্চিতভাবেই জানেন হাসপাতাল থেকে গাড়ি পাঠাবে না। নিজে গাড়ি বা কাউকে নিয়ে গেলেই যে ভর্তি হতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। যদি কিছু একটা করে ভর্তি হতে পারলেন, কপালে অক্সিজেন জুটবে কিনা। নিশ্চয় প্রধান ভয় এগুলিই। সত্যি বলতে এই ভয়টা সঠিক। যা এতক্ষণ বলা হলো, তা ঢাকা বা বিভাগীয় বা জেলা শহরের কথা। যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারো এমন আক্রান্তের ঘটনা ঘটে, সে চোখের সামনে নরক দেখবে। করোনা কেন, ভিন্ন অনেক রোগেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের এই নরক দর্শন ঘটে থাকে। মানুষের ভয়টা কি তবে করোনাকে? নাকি রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে? নাকি আরো সঠিকভাবে বললে, রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলাকে? চিকিৎসা ব্যবস্থার সেই বিশৃঙ্খলা এতটাই প্রকট যে, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন অনেক সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতিদিন তাদের মৃত্যুর খবর আসছে খুব মর্মান্তিক ভাবে। পরের ভয়টা বা বিষন্নতা হলো, মৃত্যুর পরের সৎকার বা দাফন নিয়ে। সৎকার বা দাফন নিয়ে নানারকম ভুল ধারণার জন্ম দেয়া হয়েছে। মানুষ শেষবারের মতো প্রিয়জনকে দেখতে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বহুদিন ধরে জনগণের চিকিৎসার জন্য সরকারের বরাদ্দ ছিল খুবই কম। বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে চিকিৎসা ব্যয় এতটাই কম যে বিস্মিত হতে হয়। বাংলাদেশের তুলনায় জনসংখ্যা কম এশিয়ার এরকম প্রায় প্রত্যেকটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বরাদ্দ এত কম কিন্তু সেই টাকাটাও জনগণের চিকিৎসাসেবায় ব্যয় না হয়ে, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সামগ্রি কেনার কাজে ব্যয় না হয়ে ব্যয় হয়েছে লুটপাটে। সরকারের আমলারা আর ঠিকাদাররা মিলে লুটপাট করেছে বরাদ্দকৃত টাকার বড় অংশটা। যদি সে টাকাটা ঠিক মতো দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে খরচ করা হতো হাসপাতালগুলির এমন বিপর্যয়কর অবস্থা হতো না। ফলে বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, ঠিক মতো অক্সিজেন পাননি বা আদৌ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিভাগের টাকাগুলি লুটপাট। সরকারের কাছে জনগণের এর জন্য শ্বেতপত্র দাবি করা দরকার। বিভিন্ন ব্যক্তির মৃত্যুর দায় নিতে হবে লুটপাটকারীদের। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিচার হতে হবে। নিজেদের লুটপাটের ভিতর দিয়ে তারা মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। মানুষের চিকিৎসার টাকা দিয়ে ভোগবিলাসিতা করেছে, নিজের পরিবারের জন্য সম্পদ বৃদ্ধি করেছে একদল মানুষ। প্রতিটি সরকারের চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে এটা চলছে। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মারা পড়ছে জনসাধারণ। করোনার ক্ষেত্রে ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে। বরাদ্দের টাকাটা ঠিক মতো ব্যয় হলে করোনায় এতো মানুষের মৃত্যু ঘটতো না। ফলে মনে রাখতে হবে মৃত্যুর প্রধান কারণ করোনা নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা। ঠিক চিকিৎসা পেলে করোনায় মানুষ মারা যাবে না।

কিন্তু যদি এমন হতো, চিকিৎসা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নেই, সরকার মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদগ্রীব; নিশ্চয় গত উনপঞ্চাশ বছরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল পৌঁছে যেতো। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য জরুরি সহ সকল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি থাকতো। যদি সেরকম একটি অবস্থায় হঠাৎ করোনার আক্রমণ ঘটতো, দুশ্চিন্তার কিছু ছিল কি? কিছু অর্থ বরাদ্দ করে তখন প্রত্যেক হাসপাতালে অক্সিজেন আর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রি পাঠিয়ে দিলেই হতো। চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রি ঠিকঠিক মতো পৌঁছে যেতো। দরকার মতো প্রশিক্ষণ পেয়ে যেতেন তরুণ চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। মানুষ যে করোনাকে ভয় পাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে করোনাকে ভয় পাওয়ার কিছুই ছিল না মানুষের। মানুষ ভয় পাচ্ছে গত উনপঞ্চাশ বছরের দুর্নীতি আর অব্যবস্থার ফলাফলকে। কিন্তু বর্তমান সরকার আন্তরিক হলে এখনো মানুষের মনের ভয় দূর করতে পারে। নিশ্চয় উনপঞ্চাশ বছরে ব্যর্থতা দুদিনেই ঘুঁচিয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমান করোনাকে মোকাবেলা করার জন্য স্বাস্থ্যখাতে যা যা করা দরকার তা করা সম্ভব। সরকার করোনার ভয়াবহ সঙ্কটকালে খুব চমৎকারভাবে খাদ্য সরবরাহ চালু রেখেছে। মানুষ কিনতে চাইলে ঠিকমতো হাতের কাছে খাদ্য সামগ্রি পেয়ে যাচ্ছে। দামটাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। সরকারের বিরাট একটি সাফল্যের দিক এটা। গণ মানুষের চিকিৎসায় সেরকম সাফল্য আনতে পারবে না কেন সরকার?

করোনার চিকিৎসা ব্যয়বহুল কিছু না, অস্ত্রোপচারের ব্যাপার নেই। ভিন্ন দিকে করোনা চিকিৎসায় প্রধানত দরকার আর একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা, চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে সুরক্ষা দেয়া। সরকার যদি আন্তরিকভাবে চায় জনগণকে শতভাগ চিকিৎসা প্রদান করতে তার জন্য দরকার, বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু অস্থায়ী হাসপাতাল বাড়ানো; সেইসঙ্গে বর্তমান হাসপাতালগুলিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। সেজন্য প্রধানত আর কী দরকার? সকল মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীরা যেন অক্সিজেন পান সেটা সুনিশ্চিত করা। অক্সিজেন, অক্সিজেন আর অক্সিজেন করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে প্রধান একটি চিকিৎসা। করোনার সাধারণ সংক্রমণে তেমন কিছুই দরকার নেই। মাত্র আক্রান্তদের সাত শতাংশর জন্য যেকোনো প্রকারে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। যদি তা করতে না পারে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। সরকার যদি তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তাহলে চিকিৎসাজগতে বিরাট আলো ফেলতে পারবে করোনার এই সঙ্কটকে কেন্দ্র করে। যা অর্থনৈতিকভাবেও সরকারকে নতুন পথ দেখাবে। মানুষ ঘরে বন্দী থাকাতে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সু সম্পন্ন হাসপাতাল বানাতে খরচ পড়বে তার চেয়ে কম।

চতুর্থ পর্ব
সকলকে পুনরায় ঠা-ামাথায় করোনা ভাইরাসের সংকটটি নিয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিচার বিবেচনা করতে বলবো। করোনার চিকিৎসা নেই কথাটা ঠিক নয়। হ্যাঁ টিকা নেই রোগ প্রতিরোধের জন্য, থাকলে ভালো হতো। কিন্তু আক্রান্ত হলেও ভয়ের কিছু নেই। প্রায় আটানব্বই-নিরানব্বই শতাংশ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চিকিৎসা রয়েছে আর তা খুব ব্যয় বহুল নয়। করোনায় আক্রান্ত হলে সুস্থ্য হয়ে উঠতে আশি-পঁচাশি শতাংশ মানুষের কিছুই লাগবে না। সুস্থ্য হবার জন্য দশ থেকে পনেরো শতাংশের লাগবে কিছু সাধারণ অষুধ। বাকি বড় জোর পাঁচ-সাত শতাংশের লাগতে পারে অক্সিজেন। যদি অক্সিজেন দেয়া যায় তাহলে আটানব্বই শতাংশের বেশি মানুষ বেঁচে যাবে। বাকি যে দু-শতাংশ মানুষ যাঁরা শারীরিকভাবে আরো ভঙ্গুর বা বেশি সংকটজনক, নিশ্চয় দরকার বোধে তাঁরা ঘরে থাকবেন নিজেদের স্বার্থেই। নিশ্চয় সেসব মানুষকে ঘরে সাবধানে রাখাটা কঠিন কিছু হবে না। হয়তো বয়সজনিত কারণে এঁদের একটা অংশ ঘরেই থাকেন। কিন্তু দু-শতাংশ মানুষের জন্য বাকি সকলকে ঘরে বন্দী করে রাখার মানে হয় না। নব্বই শতাংশর করোনার আক্রমণে বিশেষ কিছুই দরকার হচ্ছে না। নব্বই শতাংশ মানুষ তবে কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকবে কেন? বিশ্বটাকে কেন মনে করবে কারাগার? নিজেদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন তাঁরা, যখন যেখানে আক্রান্ত হন দেশে কিংবা বিদেশে, আক্রান্তরা সেখানেই তা দেশে হোক বা বিদেশে হোক প্রয়োজন হলে হাসাপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাবেন। বিশ্বের প্রতিটি দেশকে এখন থেকে সকলের জন্য সেরকম ব্যবস্থা রাখতে হবে। সকল হাসপাতালে থাকবে পর্যাপ্ত সংখ্যায় রোগীদের অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা।

সব বিচারে অক্সিজেন সরবরাহ করাটা করোনা ভাইরাসের প্রধান চিকিৎসা সেটা ইতিমধ্যেই বোঝা গেছে। বাসায় বা হাসপাতালে নানাভাবে সেটার ব্যবস্থা করা যায় সংকটজনক রোগীদের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর জন্য নতুন একটা অভিজ্ঞতা এটা, হাসপাতালে অক্সিজেন দেয়ার সুবিধা বাড়াতে হবে। সরকারি হাসপাতাল বাড়াতে হবে আর সেখানে প্রয়োজন মতো অক্সিজেন দানের সুযোগ থাকতে হবে। চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে দুটা পেশাই মানবসেবার সঙ্গে যুক্ত। ফলে মানবসেবার প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাটা দিতে হবে তাঁদেরকে সর্বাগ্রে। চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে অনেকটা বেকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বাংলাদেশে। চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ানো মানে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা। মানুষকে তখন আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে হবে না। চিকিৎসা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা নিয়ে মানুষকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকলে চিকিৎসা ক্ষেত্রের এই ব্যয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। রাষ্ট্রের যে পরিমাণ টাকা বিভিন্নভাবে লুট হয়ে যায় তা দিয়ে এরকম চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। চিকিৎসাসেবা দিয়ে দরকারে বিভিন্ন সময়ে বিদেশী মূদ্রা অর্জন করা যাবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে চিকিৎসাসেবা খাতে জনবল নিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিশেষ একটি উপায় হতে পারে। চিকিৎসা কেন নানারকম কর্মসংস্থান করে দেশের যুবকদের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। বাংলাদেশে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এর। দরকার তারজন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানীতে সত্তর লক্ষ বেকার ছিল। বহুদিন পর্যন্ত সে সঙ্কটের সমাধান হচ্ছিল না। জার্মানী ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। হিটলার ক্ষমতায় এলেন। বড় বড় রাজনীতিকরা যা পরেননি, হিটলার নিজের পরিকল্পিত যুদ্ধের প্রয়োজনে কর্মহীনদের নানারকম কাজে নিয়োগ দিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান করেছিলেন। তিনি বেকারদের নিয়ে বিরাট এক সামরিক বাহিনী বানিয়ে ফেলেছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধ কারখানায় কাজ দিচ্ছিলেন। হিটলার এমনিতেই এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেননি। কিছু কারণ ছিল। কয়েক বছরের মধ্যে পঞ্চাশ লাখ যুবকের কর্মসংস্থার করা সহজ কর্ম নয়। কিন্তু হিটলার তাদের কিছুতেই বেকার থাকতে না দিয়ে নানাভাবে কাজে লাগান। হিটলারের মতো আমি সেনাবাহিনী বাড়াবার কোনো পরামর্শ দিচ্ছি না। কথাটা একটা উদাহরণ মাত্র। কিন্তু শিক্ষক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা তো বাড়ানো যেতেই পারে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে দরকারও রয়েছে। দরকার দুর্নীতি বন্ধ করা আর জনকল্যাণমূলক সুচিন্তিত পরিকল্পনা নেয়া। বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক। ফলে বাইরের থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানী কমিয়ে সেসব পণ্যের কারখানা দেশে প্রতিষ্ঠা করলে শ্রমিকদের কর্ম সংস্থান হবে। জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনায় বা বিভিন্নরকম গবেষণার জন্য দেশের মেধাবীদের যুক্ত করতে হবে। কারণ প্রয়োজনীয় সব আবিষ্কার নিজের ঘরেই হতে হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান কিট কিংবা কিছু আবিষ্কার করলে, সেটার সকল দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টিশীল মেধার পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। দুর্বলতা থাকলে সেটা বাতিল না করে উন্নত করার জন্য সহায়তা দিতে হবে। বিশ্বে এভাবেই বড় বড় বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশও এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে, বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বড় বড় অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশের মেধাবীরা অন্য দেশে গিয়ে অনেক কিছু করতে পারলে নিজ দেশে না পারার কিছু নেই।

বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে মানসম্পন্ন চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা বাড়ালে মানুষের কর্ম সংস্থান হবে। করোনা বা তার চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণে চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ মারা যাবে না। তাহলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যের মান বাড়বে, তাদের প্রাণশক্তি এবং কর্মক্ষমতা বাড়বে। রাষ্ট্রের চেহারাটাই তাহলে পাল্টে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে উৎপাদন। বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে যখন বেকারত্ব কমে যাবে নানারকম বিশৃঙ্খলা কমে আসবে। সকল সেবামূল খাতে, পরিবহন ব্যবস্থায়, ব্যক্তিগত উৎপাদনে সর্বত্র লক্ষ্য করা যাবে সুশৃঙ্খলা। রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা কমে যাবে। সকল রকম সন্ত্রাস বা নৈরাজ্যমূলক কর্মকা- হ্রাস পবে। করোনা ভাইরাস অন্তত এটাও দেখিয়েছে, যখন বিভিন্ন দেশের সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাবে প্রতিটি দেশকে যতোটা সম্ভব নিজের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। নিজের উপর নির্ভরশীল হতে গেলেই, একই সঙ্গে কর্ম সংস্থান বাড়বে। কর্ম সংস্থান অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। মানুষের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। কর্ম সংস্থানের খাতগুলি সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। কর্ম সংস্থান কেমন করে একটি দেশের চেহারা পাল্টে দেয় তার বিরাট উদাহরণ হলো, প্রথম মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানী। ঘটনাটা হিটলারের হাত দিয়ে হয়েছিল, কিন্তু সেটা শিক্ষণীয় সকলের জন্য। হিটলার সেটাকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু মঙ্গলজনক কাজেও তা ব্যবহার করা যায়।

বিপদ কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে জার্মানী উদাহরণ দিয়েই শেষ করা যাক। নিঃসন্দেহে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জার্মানী। যুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হয়। ফলে যুদ্ধের নানা দায়-দায়িত্ব জার্মানীকে বহন করতে হয়, বিশেষ করে যুদ্ধ বাধানোর দায়ে ক্ষতিপূরণ দান তাদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ফ্রান্সের প্রস্তাব ছিল জার্মানী বিয়াল্লিশটি বাৎসরিক কিস্তিতে এক হাজার একশো বিশ কোটি পাউ- ক্ষতিপূরণ দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় উনিশশো একুশ সালের মে মাসে জার্মানীর জন্য মোট দেয় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ছয়শো ষাট কোটি পাউ-। জার্মানী তার প্রথম কিস্তি পাঁচ কোটি পাউ- শোধ করল। তিন বছরের শর্তে এটাই ছিলো তার নগদ অর্থে দেয় পরিশোধ। জার্মানীর পক্ষে পরবর্তী ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। জার্মানী মিত্র শক্তিকে দেয় ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে ফ্রান্স জার্মানীর ধাতু শিল্পের কেন্দ্রস্থল এবং কয়লা, অশোধিত লোহা ও ইস্পাত উৎপাদনের শতকরা আশিভাগ যেখানে পাওয়া যেতো, সেই রূঢ় অঞ্চল দখল করে। রূঢ় অঞ্চল দখলের পর জার্মানীর সার্বিক অর্থনৈতিক জীবন থমকে দাঁড়ালো। এর পরিণতিতে জার্মানীতে চরম মুদ্রা সংকট দেখা দেয়।

বিশ সালের মাঝামাঝি মার্কের মূল্যমান তার স্বাভাবিক হার এক ডলারের বিনিময়ে বিশ মার্ক থেকে নেমে দাঁড়াল পাউ- প্রতি দুশো পঞ্চাশ মার্ক। একুশ সালের মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়াল এক পাউ- সমান একহাজার মার্ক। তেইশ সালে পাউ- প্রতি পঁয়ত্রিশ হাজার মার্ক পাওয়া যেতো। সে সময় মাত্র কয়েক পেন্সের বিনিময়ে জার্মানীতে রাজার হালে জীবন যাপন করা যেতো বা যে কোনো বিদেশি মাত্র কয়েক শিলিংয়ের বিনিময়ে জার্মানীর সর্বত্র পরিভ্রমণ করতে পারতো। তেইশ সাল শেষ হবার আগেই মার্ক-এর মূল্যমান আরো নেমে গিয়ে এক ডলার সমান দাঁড়াল বিরাশি কোটি মার্ক। সে সময় এক জোড়া জুতার জন্য পঞ্চাশ লাখ মার্ক দিতে হতো, ছাপাখানায় মুদ্রিত একটি সংবাদ পত্রের জন্য দিতে হতো বিশ লাখ মার্ক। সুটের একটি কাপড় সংগ্রহের জন্য বিশ সপ্তাহ কাজ করতে হতো। জার্মানীর অবস্থা এমন দেউলিয়ার পর্যায়ে গিয়েছিল যে জার্মানীর রাইখস ব্যাংককে টাকা সরবরাহের জন্য তিনশো কাগজের মিল এবং বিশ হাজার ছাপাখানা বসাতে হয়েছিলো। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা টাকা ছাপানোর কাজ চলতো। বোঝাই যাচ্ছে যুদ্ধের পর জার্মানীর অর্থনৈতিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিটলার সেই অবস্থা থেকে জার্মানীর আর্থিক সঙ্গতি এমন জায়গায় নিয়ে যান, এমন বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন আর যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে সকলকে এমনভাবে ছাড়িয়ে যায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম চার বছর জার্মানীকে কেউই যুদ্ধে হারাতে পারেনি।

ফলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার নানা রাস্তা থাকে। কৃষিকে রক্ষা করা আর কর্মসংস্থান তৈরি করা তার প্রধান একটি দিক। জনগণের স্বাস্থ্য সেক্ষেত্রে প্রধান আর একটি বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুরানো আমলাতন্ত্র দিয়ে, পুরানো রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে আর বিরাট কিছু অগ্রগতি হবে না। সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। সারা বিশ্ব জুড়েই এ নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা পাওয়া যাবে। সারা বিশ্বে অনেক নিজেদের অর্থনীতির পুনর্মূল্যায়ন করছে। বহু রাষ্ট্রই বর্তমাস সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে নতুন করে সাজাবে। বাংলাদেশকে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বা পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। করোনা বিশ্বের জন্য নতুন কী পরিবর্তন আনবে? হয়তো খুব বেশি কিছু নয়। করোনা ভাইরাস রাতারাতি মানুষের সকল চিন্তাকে পাল্টাতে পারবে না। বিরাট পরিবর্তনের জন্য দরকার ঠান্ডা মাথায় বসে সুস্থ চিন্তা আর সঠিক পরিকল্পনা করা। নিশ্চয় সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এটা ঠিক মানুষের চিন্তাভাবনার কিছু পরিবর্তন তো আসবেই। বিভিন্নমুখী নানা ছোটখাটো পরিবর্তন নজরে পড়বে। করোনার এই সংক্রমণকে ঘিরে পাওয়া যাবে বড় মাপের অনেক সাহিত্য। নিশ্চয় পাওয়া যাবে নতুন দর্শনের আলোচনা। মানুষকে সামনের দিকে তাকাতে তা বাধ্য করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব থেকে যাবে আরো কিছু কাল। সেই সঙ্গে মানবিক রাষ্ট্র, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা মানুষের চিন্তায় নিশ্চয় আগের চেয়ে অনেক বেশি উঁকিঝুকি দেবে। নতুন ভাইরাসের আতঙ্ক থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে নতুন স্বপ্ন দেখবে।