পৌরাণিক তত্ত্বকথা আজও হয় নি বলা : প্রসঙ্গ শকুন্তলা

প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, জুন ২৫, ২০২০

পৌরাণিক তত্ত্বকথা আজও হয় নি বলা : প্রসঙ্গ শকুন্তলা

|| দুখু সুমন || ২৫ জুন ২০২০ : কালিদাস-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-সেলিম আল দীন শুধু ব্যাসের ধ্বজাই ধরেছেন, এঁদের কেউ-ই বিশ্বশ্রেষ্ঠ কবি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন [ব্যাসদেব]-এর মহাভারত-এর শুকুন্তলা উপাখ্যানের অন্তরঙ্গকে কিঞ্চিৎমাত্র স্পর্শ করতে পারেন নি। এঁরা সবাই শকুন্তলাকে পুষ্পপল্লবে ঘেরা খুব সাধারণ থেকে অতিসাধারণ এক বঙ্গনারীতে রূপায়িত করতে চেয়েছেন, এবং তাঁদের চেষ্টায় তাঁরা সার্থক। কিন্তু এই আখ্যানভাগের অন্তরালে জীবনসংক্রান্ত যে তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে, সে-প্রসঙ্গে কেউ একজন টু-শব্দটি পর্যন্ত করেন নি। ফলে কোথায় যেন একটা গভীর শূন্যতা থেকেই গেছে। আমি মোটেও বলতে চাইছি না যে, তাঁদের রচনায় চিত্রিত শকুন্তলা শৈল্পিক নয়। কিংবা তাঁরা সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। আসলে আমি বলতে চাইছি যে, তাঁদের আখ্যানে আমাদের প্রাচীন সমাজমানস ও ধর্মতাত্ত্বিক যে মূল তত্ত্ব এবং নারী হিশেবে শকুন্তলার আত্মপ্রত্যয় কিংবা ব্যক্তিত্ববোধের পূর্ণ পরিচয় খুঁজে পাই না। কণ্ব মুনির শিক্ষায় দীক্ষিত যে শকুন্তলা, তাঁদের লেখায় সেই শকুন্তলা অনুপস্থিত।

তাঁদের দেখা শকুন্তলা শুধুমাত্র তথানুগত সংস্কৃত সাহিত্যের আদর্শ নায়িকা। মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম-এ শকুন্তলার অসামান্য যৌনাবেদনময়ী, প্রেমময়ী এবং অতিপেলব হৃদয়ের সামান্য এক কিশোরী মাত্র, পরিণত শুকুন্তলার অগাধ ব্যক্তিত্ব কিংবা দায়িত্বকর্তব্যবোধ তাতে অনুপস্থিত। রাজার সঙ্গে বিয়ের আগে শকুন্তলা যখন শর্ত দেন যে, তার সন্তানকে ভবিষ্যৎ রাজা করতে হবে। রাজা রাজি হন। এখন এই শর্তের মাধ্যমে আমরা আসলে কী উপলব্ধি করলাম? শকুন্তলা রাজমাতা হওয়ার বাসনায় লোভী? না, একদম না। কারণ তার ব্যক্তিগত ক্ষমতার যে রূপরেখা পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, তাতে রাজমাতা হবার সামান্য বাসনা তার নেই।

তবে কেন এই শর্ত? এই শর্তের একমাত্র লক্ষ এবং উদ্দেশ্য মা হিশেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ। তাছাড়া কালিদাসের শকুন্তলা মহাভারত-বর্ণিত শকুন্তলার প্রায় অনুরূপ নির্মাণ। এখানে কোনো বিনির্মাণ কিংবা নতুন ব্যাখ্যা তৈরির প্রয়াস সেখানে নেই। কেননা কালিদাসের সময়টাই অমন, নির্মাণ-পুনর্নির্মাণই সেকালের প্রবণতা। এ নিয়ে মহাকবি কালিদাসকে একবিন্দু দোষ দিতেও আমার আপত্তি আছে। সে-সময়ের সাহিত্য বলতে যতটুকু সৃষ্টি তা ওই ধর্মকে কেন্দ্র করে। মেঘদূত-এও আছে এই ধর্মকেন্দ্রিকতা। তবে অভিশপ্ত যক্ষ যেন শেষ পর্যন্ত আর বন্দি হয়ে থাকে না কোনো ধর্মীয় মোড়কে, রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে এসে সোজা ঢুকে পড়ে আমাদের হৃদয়ের জানালা দিয়ে। সাহিত্যে এই ধর্মীয় প্রভাব কালিদাসের পরেও দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে।

এই লেখার আসল লক্ষ্য শকুন্তলার অন্তর্গত আগুনকে স্পর্শ করা। অগ্রজগণ যেখানটায় শকুন্তলাকে রেখে গেছেন, সেখান থেকে শুরু এই লেখার।
তারপর আধুনিক সভ্যতার সামান্য ছোঁয়া এসে লাগে সাহিত্যভুবনে। গদ্যচর্চা শুরু হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহান সংস্কারকদের হাতে বাংলা গদ্য একটা সংবৃত রূপ লাভ করে। এই কালপর্বে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকের অনুবাদে হাত দেন। বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা মূলত কালিদাসেরই শকুন্তলা। অনুবাদকের স্বাধীনতার সুযোগ বিদ্যাসাগরও তেমন গ্রহণ করেন নি। তাই এ প্রসঙ্গে কথা বলারও তেমন কিছু নেই।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও শকুন্তলাকে নিয়ে তেমন কোনো নতুন ব্যাখ্যায় মৌলিক আলোচনায় অবতীর্ণ হন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তেমন কোনো নতুন পাঠ সৃষ্টি করলেন না। অবশ্য তেমন করে নতুন পাঠ তৈরির উপযুক্ত সময়ও সেটা না। ব্রিটিশ-ভারতে পরাধীন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য তথা অস্তিত্ব রক্ষার সময় তখন। ততদিনে পূর্ণ হয়ে গেছে ইংরেজশাসনের শতবর্ষ। তখন পাশ্চাত্য শিল্পসাহিত্যের জয়জয়কারের ভিড়ে খুব কারিশমা করে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই নিজেদের সাহিত্যকে একটু একটু করে মেলে ধরতে চেষ্টা করেছেন মাত্র। ফলে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ দু’জনের আলোচনা প্রায় একই রকম। পাশ্চাত্য সাহিত্যসম্রাট শেক্সপিয়রের সঙ্গে কালিদাসের এক ধরনের মিল তৈরি করে ইংরেজদের ভিড়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টাই তাঁদের মূল প্রবণতা।

এঁদের মধ্যে সেলিম আল দীনের শকুন্তলা কিছুটা মৌলিক ব্যাখ্যায় সামান্য কৃতিত্বের দাবিদার। তবে শকুন্তলাকে নিয়ে একটি নারীবাদী পাঠপরিকল্পনার সুযোগ তাঁর হাতে ছিল। কারণ অগ্রজদের প্রতিবন্ধকতার কাল তখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। শকুন্তলা নাটকটি মূলত সেলিম আল দীনের, সেলিম আল দীন হয়ে উঠবার আগের রচনা। তবুও ভীষণ দরদে এক কিশোরীর যৌবনবতী হয়ে উঠবার শারীরিক ও মানসিক অন্তঃজ যন্ত্রণার নিদারুণ চিত্র অঙ্কন করেছেন তাঁর শকুন্তলা নাটকের শকুন্তলা চরিত্রের মাধ্যমে। নাটকটির দুটি অংশ। এক অংশে স্বর্গীয় ষড়যন্ত্র, বিশ্বামিত্রের সর্বনাশ এবং শকুন্তলার জন্মপ্রসঙ্গ। এই অংশটি মহাভারতের অনুরূপ মাত্র, নতুন কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাতে নেই। পরের অংশটি সম্পূর্ণ মৌলিক, এবং শকুন্তলা-নির্ভর। শকুন্তলার যে বয়সটা তিনি চিত্রিত করেছেন, মহাভারতকার হয়তো তা বাহুল্য বিবেচনায় এড়িয়ে গেছেন।

শকুন্তলার প্রেম-বিয়ে-সংসার পর্যন্তও পৌঁছান নি সেলিম আল দীন। তাঁর শকুন্তলা কিশোরী শকুন্তলা, পরিণত যুবতী না। যেন সে স্বর্গ থেকে মর্তে পতিত অভিশপ্ত কোনো দেবশিশু। পৃথিবীর জন্য ভয়ংকর ঘৃণা ছাড়া ভাব-ভালোবাসা কিছু নেই তার মধ্যে। ফলে সেলিম আল দীনের শকুন্তলা কোনোভাবেই আমাদের হয়ে উঠতে পারে না। তবে পরিণত সেলিম আল দীন যদি নতুন করে শকুন্তলা নাটক লিখতেন, হয়তো আমরা অন্য কোনো শকুন্তলাকে পেতে পারতাম। যা হয় নি, তা হয় নি। সামনে হবে, সামনের যারা তারা করবে। সেলিম আল দীনের শকুন্তলা-কেন্দ্রিক এই আলোচনাকে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সমালোচনা বলে ভুল করবেন না। আমি আগেই বলেছি, শকুন্তলা শুরুর দিকে লেখা, সেলিম আল দীনের তখন লিখে হাত মকশো করার কাল। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন প্রসঙ্গে আলোচনা অন্য কোনোদিন হবে, আজকের প্রসঙ্গ আলাদা। যদি সেলিম আল দীন নিয়ে প্রবল আগ্রহ কারো থেকে থাকে, তবে অনুরোধ করব কীর্তনখোলা থেকে শুরু করতে। এরপর যত সামনে যাবেন, তত তলিয়ে যাবেন। কারণ তাঁর সাহিত্যকর্ম, সে যেন এক মহাসমুদ্রের আখ্যান।

কীর্তনখোলা থেকেই মূলত সেলিম আল দীনের খেলা শুরু। এরপর ভাবে-ভাষায়, বিষয়ে-বাসনায় বাংলা নাটকের নতুন যুগের শুরু নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের হাতে।

সৌন্দর্যের আরাধ্য প্রতিমা শুকুন্তলাকে আমরা অগ্রজদের লেখায় সুন্দর করেই পেয়ে গেছি। তাই সেদিন থেকে শকুন্তলা চরিত্র প্রসঙ্গে একটা কথা বলা মানেও সময় নষ্ট করা। এই লেখার আসল লক্ষ্য শকুন্তলার অন্তর্গত আগুনকে স্পর্শ করা। অগ্রজগণ যেখানটায় শকুন্তলাকে রেখে গেছেন, সেখান থেকে শুরু এই লেখার।

মহাভারতের শকুন্তলা আখ্যান মূলত স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ব্যাখ্যার সঙ্গে জড়িত একটি আখ্যান। একই সঙ্গে এই আখ্যানে উঠে এসেছে সামাজিক প্রেক্ষিতে নারীর অবমূল্যায়ন—নারীনির্যাতন, নারীজাগরণ, নারীবিদ্রোহ, নারীর প্রতিশোধ গ্রহণসহ নারী-পুরুষের মূল সম্পর্ক নির্ধারণ ও নব মূল্যায়ন।

যেমন ধরুন এমন একটা পরিস্থিতি ঘটল যে, কেউ একজন ভালোবেসে কিংবা কাম-তাড়নায়, অবশ্যই তা জোর করে নয় বরং নিজেই জোড় ক’রে প্রার্থনা করে কোনো পতিতা-কন্যাকে বিয়ে করল। যে কন্যা নিজে পতিতা না, এমনকি মায়ের সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে বসবাসরত সুশিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু কিছুদিন পরে যদি লোকসমাজের দোয়াই দিয়ে সেই কন্যাকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় মানসিক নির্যাতন করে। যদি ‘পতিতা’ বলে গাল-মন্দ করে, তখন কি আমাদের বিবেক দংশিত হবে? আমরা কি এই কন্যার হয়ে মুখ খুলব? দাঁড়াব একজন নির্যাতিতা নারীর পক্ষে?

এই পরিস্থিতিতে যার বা যাদের বিবেক-দংশন হবে না, তাদের জন্য আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ। আর যারা বিবেকের দংশনে পীড়িত হবেন, তারা প্রথমেই শুনে রাখুন এই কন্যাই আলোচনার কাঙ্ক্ষিত নারী শকুন্তলা। মিষ্টি-মধুর আদিরসাত্মক শকুন্তলা নয়, শিক্ষিত মার্জিত ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারীচরিত্র শকুন্তলা। মহাভারতের এক নির্যাতিত নারী শকুন্তলা। মহাপ্রতাপশালী পৃথিবীর অধিপতি সম্রাট রাজা দুষ্মন্ত তার নির্যাতনকারী। সম্রাটের অতুল ক্ষমতা দেখে-শুনে নিশ্চয়ই আমরা আর শকুন্তলার হয়ে মুখ খুলব না! কিন্তু তাতেও ক্ষতি নেই, সেই মহাপরাক্রমকে প্রতিহত করবার ক্ষমতা শুকুন্তলার আছে।

এই আলোচনাকে নিছক চর্বিতচর্বণ মনে না হলে, আসুন এগিয়ে যাই। শকুন্তলা উপাখ্যানটি যাদের মাথায় নেই, তাদের সাহায্য করতে সম্পূর্ণ গল্পটি সরল বাংলায় উপস্থাপন করতে না পারায় আমি ভীষণভাবে দুঃখিত। আসলে একটি লেখাতে অত বড় আখ্যান উপস্থাপন সম্ভবও না। দয়া করে গুগল ঘেঁটে শুধু শকুন্তলার কাহিনিটা মাথায় নিয়ে আবার যোগ দিন এই লেখার সঙ্গে।

শকুন্তলা তার শিশুপুত্র ভরতকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনানগরের রাজদরবারে দুষ্মন্ত রাজার সম্মুখে উপনীত হলেন। নিজের ও পুত্রের পরিচয় দিলেন। রাজা তাকে চিনতে পেরেও লোকলজ্জার ভয়ে আপন পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার করলেন। [আমরা কাশীরাম দাস-অনূদিত মহাভারত-এর আলোকে কথা বলছি। আপনারা সবাই হয়তো জানেন যে, অনুবাদকের হেরফেরে তাদের অনূদিত মহাভারতগুলির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। সেই পার্থক্য তত্ত্বগত নয়, কিছু গল্পের সংযোজন-বিয়োজনজনিত। এই লেখায় যেহেতু তাত্ত্বিক দিকের আলোচনাই করব, সেক্ষেত্রে অনুবাদের সামান্য ইতর-ভেদ তেমন কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।] শকুন্তলা রাজাকে আবার অনুরোধ করলেন, রাজা দ্বিগুণ উৎসাহে অস্বীকৃতি জানালেন।

রাজাকে বোঝাতে বিদুষী শকুন্তলা এবার বেদ-পুরাণ আর দেবতাদের আলোচনার আলোকে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত তত্ত্বে বয়ান দিচ্ছেন :

মিথ্যা হেন বল রাজা, কভু ভাল নহে।
মিথ্যা হেন পাপ নাহি সর্ব শাস্ত্রে কহে।।
পতিব্রতা নারী আমি না কর হেলন।
আমারে নীচের প্রায় না ভাব রাজন।।
পুত্ররূপে জন্মে পিতা ভার্যার উদরে।
শাস্ত্রেতে প্রমাণ আছে, জানে চরাচরে।।
ভার্যারে জননী-সমা দেখি সে কারণ।
মোরে উপেক্ষিয়া দোষ করিলে রাজন।।
অর্ধেক শরীর ভার্যা সর্ব শাস্ত্রে লিখে।
ভার্যা সম বন্ধু রাজা নাহি কোন লোকে।।

সরল বাংলায় দাঁড়ায়, শকুন্তলা রাজাকে বলছেন—মিথ্যা মহাপাপ, মিথ্যা বলো না। আমি অন্ত্যজ কোনো নারী মাত্র নই—আমি একজন পতিব্রতা নারী—আমাকে অবহেলা করো না। শাস্ত্রমতে পৃথিবীর সবাই জানে যে, স্ত্রীর গর্ভে পুত্র-কন্যা রূপে স্বামী যে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, তা ওই স্বামীর-ই ক্লোনিং মাত্র। অর্থাৎ পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী স্বামী তার স্ত্রীর গর্ভে সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করছে। সেইদিক থেকে ব্যাখ্যা করে নিজের স্ত্রীও স্বামীর কাছে তার মায়ের মতোই সম্মানিত। আমাকে এভাবে উপেক্ষা করে তুমি অন্যায় করছ রাজা। ধর্মীয় মতে স্বামীর অর্ধেক অংশ স্ত্রী। যে কারণে স্ত্রীর প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে অর্ধাঙ্গিণী শব্দটিও প্রচলিত আছে। শুধু তাই নয়, স্বর্গ-মর্ত-পাতাল এই তিন ভুবনে স্ত্রীর মতো বন্ধু আর কেউ নেই। শকুন্তলার এই সব জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কি প্রমাণ করে না যে, সে-কেবল মাত্র একটা সৌন্দর্যের ডিব্বা মাত্র নয়। তার কথা শুনে কি আমাদের মনে হয় না কতটা শিক্ষিত এবং মার্জিত মানুষ ছিল সে?

শিব এক নবজাতকের রূপ ধারণ করে দুর্গার কাছে দুগ্ধ প্রার্থনা করলেন। দুর্গাও পুত্রতুল্য করে তাকে দুগ্ধ পান করালেন।

এখন স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর পুনর্জন্ম—এই মূল তত্ত্ব নিয়ে একটু আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আজ প্রথম শুনলেন এই তত্ত্ব। অনেকের কাছে হাস্যকর ঠেকছে। নিছক হাস্যকর মনে হলে, আপনি আলোচনা ত্যাগ করতে পারেন। আর যাদের বিজ্ঞানমনস্ক মন ‘টু বি অর নট টু বি’র দোলায় দোলায়িত হচ্ছে তারা আসুন, আসুন আরও একটু গভীরে যাই।

আমাদের অনেকের মনে শিব-দুর্গাকে নিয়ে খুব রসালো একটা আবছা সত্য গল্প আছে যে, শিব তার স্ত্রী দুর্গার দুগ্ধ পান করেছিলেন। হুম, ঘটনা সত্য। তবে আমরা অনেকেই আসল সত্যটা জানি না, আসল ব্যাখ্যাটা জানি না। কেবল আলো-আঁধারময় আবছা একটা আংশিক সত্যকে জানি। শিব-দুর্গাকে নিয়ে আপনি আপনার রসময় ভাবনা চালিয়ে যেতে পারেন। কারণ তারা জগতের রসের আধার। বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র সম্পূর্ণটাই লিখেছিলেন হর-পার্বতীর যৌনজীবনকে উপজীব্য করে। কামসূত্র এত সরলপাঠ্য কোনো গ্রন্থ না যে, একবার পড়লেই সব বোঝা সম্ভব। নিবিড় পাঠে কামসূত্র মূলত মানুষের জীবনবেদ। সেদিন যেমন দরকারি ছিল—আজও তেমন আছে। যা হোক, এ নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ নেই। হর-পার্বতীর দুগ্ধ পান প্রসঙ্গে ফেরা যাক, কারণ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক বিশ্লেষণে এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন একটা গান শুনে নেই। গানের চরণগুলি এমন—

যে শক্তি হইতে উৎপত্তি সে শক্তি পত্নী কি কারণ।
কহ দেখি ভোলানাথের বিশেষ বিবরণ।।
সমুদ্র মন্থনের কালে, বিষপান করেছিলে,
ডেকেছিলে দুর্গা বলে রক্ষা কর আপনি।
জ্বলেছিলে বিষপানে, বাঁচালাম স্তন্যদানে
তখন কি ভুলেও বলেছ জননী।।

দেব-দানবেরা গলদঘর্ম হয়ে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন, অনেকেরই এসব তথ্য জানা নিশ্চয়ই। নয়তো সমস্তটা ব্যাখ্যা করে আলোচনাকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। গানে যতটুকু আছে যে, সমুদ্রমন্থনে যৌক্তিক ঘটনাচক্রে গরল বা তীব্র বিষ উত্থিত হয়। যে বিষ ভীষণ বিষধর সাপের বিষ। এই গরল উত্থিত হওয়ার সময়ই অনেকে মূর্ছিত হয়ে পড়েন। দেবতারা উপায়ান্তর না পেয়ে শিবের স্মরণ করেন। এই তীব্র বিষের ছোবল থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য শিব সেই গরল নিজের মুখে ঢেলে দেন। সবাই বিস্মিত, হতবাক। তখন তার স্ত্রী দুর্গা তার কণ্ঠনালি রোধ করেন। বিষ পেটে নামতে না পারলেও শিবের কণ্ঠ বিষক্রিয়ার নীল বর্ণ ধারণ করল। সে যাত্রায় পৃথিবী রক্ষা পেল বটে, কিন্তু তীব্র বিষের প্রতিক্রিয়ায় শিব অসুস্থ বোধ করলেন। তখন দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনরক্ষার তাগিদে শিবকে স্ত্রীর দুগ্ধ পান করতে হবে। কী ভীষণ কেলেঙ্কারি! এ কী প্রকারে সম্ভব? তখন শিব এক নবজাতকের রূপ ধারণ করে দুর্গার কাছে দুগ্ধ প্রার্থনা করলেন। দুর্গাও পুত্রতুল্য করে তাকে দুগ্ধ পান করালেন।

এখন নিশ্চয়ই কারও আর সেই আদিরসাত্মক হাসিটি পাচ্ছে না, পাচ্ছে? যা হোক, শিবের অন্য একটা নাম পঞ্চানন। শিবের পাঁচ মাথার সেই ছবি যদি কারও নজরে পড়ে থাকে, তবে খেয়াল করে দেখুন সেখানে একটি মাথা এক নবজাতক শিশুর। এ থেকে এ বিতর্কের অবসান হতে পারে। কিন্তু কেন এই হাস্যকর কাণ্ডের অবতারণা? এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী? আমি নিজেও নিশ্চিত কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানি না, তবে বিজ্ঞান দুধ ও বিষের কোনো সম্পর্ক হয়তো ব্যাখ্যা করে থাকবে। সেদিকে না গিয়ে আমরা যদি এই ঘটনার সামাজিক ব্যাখ্যায় যাই, তাহলে কী চিত্র স্থির হয় চোখের সামনে? মূল চালিকাশক্তি কে? আদি মা-প্রকৃতি। নারীর ক্ষমতায়ণের এমন উৎকৃষ্ট উদাহরণ পৃথিবীর আর কোনো প্রাচীন সাহিত্যকর্ম কিংবা দার্শনিকতায় আছে বলে আমার জানা নেই।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নাম আমরা অনেকেই জানি, দেশজুড়ে থাকা রামকৃষ্ণ মঠগুলোর সন্ধানও আমরা কিছু জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো এই কথা জানি না যে, কালী-উপাসক রামকৃষ্ণ নিজের স্ত্রীর মধ্যেও মাতৃরূপিণী কালীকে অনুভব করতেন। গড় হয়ে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে নিজের স্ত্রীর চরণে প্রণাম করতেন। কেন করতেন—কী ভাবে ভাবিত হয়ে থাকতেন, তার স্পষ্ট নমুনা আমরা উপরে আলোচনা করেছি।

আসুন শকুন্তলার এই বিশেষ তত্ত্বকথার আরও একটি চাক্ষুষ প্রমাণের দিকে এগিয়ে যাই। পাশ্চাত্যের দিকে খেয়াল করুন, কিং অষ্টম হেনরি, কিং নবম হেনরি বা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ—এরা সবাই তো পিতা-পুত্র কিংবা মাতা-পুত্রী-ই ছিলেন। তাহলে বাপ-ছেলের একই নাম কেন? তাহলে কি শকুন্তলার দেয়া তত্ত্ব সেখানেও বর্তমান, অন্য কোনো গ্রন্থে কিংবা অন্য কোনো দার্শনিক ব্যাখ্যায়? আপনার কি মনে হচ্ছে জানি না, আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে। শিল্পসাহিত্যের আলোচনায় বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তবু এই বিজ্ঞানমনস্ক মনকেও কখনো কখনো আশ্রয় করতে হয় প্রাচীন রীতিনীতি, প্রচলিত বিশ্বাস এবং জীবনপ্রণালির উপর। আমাদের আলোচনার উপর থেকে ভরসা উঠে না গেলে, আসুন এগিয়ে যাই।

স্বামীর জীবনে ভার্যা আগে যদি মরে।
পথ চাহি থাকে ভার্যা, স্বামী অনুসারে।।
মরিলে স্বামীরে উদ্ধারিয়া লয় স্বর্গে।
হেন নীতিশাস্ত্র রাজা কহে সুরবর্গে।

শকুন্তলা এবার দেবতাদের অনুগামী হয়ে রাজাকে নীতিশাস্ত্র শোনাচ্ছেন। একজন স্ত্রী তার স্বামীর জীবনে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেখুন, পৃথিবীতে যেমন গুরুত্ব, তেমন গুরুত্ব মৃত্যুপরবর্তী পরলোকেও।

চতুষ্পদে গাভী শ্রেষ্ঠ দ্বিপদে ব্রাহ্মণে।
অধ্যয়নে গুরু শ্রেষ্ঠ পুত্র আলিঙ্গনে।।

শকুন্তলা এবার পিতার জীবনে পুত্রের গুরুত্বের দিক বিবেচনা করে বলেন যে, চার পা-বিশিষ্ট প্রাণীর মধ্যে গাভী শ্রেষ্ঠ, মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ। শিক্ষায় গুরু শ্রেষ্ঠ, আর আলিঙ্গনে শ্রেষ্ঠজন নিজের ঔরসজাত পুত্র। এখানে পুত্র বলতে কেবল পুত্রকে বোঝায় না, বোঝায় সন্তান। সে ছেলে-মেয়ে যাই হোক না কেন। এ কি কোনো সামান্য লুতুপুতু ধরনের রমণীয় বয়ান, না কোনো তত্ত্বজ্ঞানীর দান করা তত্ত্বজ্ঞান?

পিতারে না দেখিয়া পুত্র সদা ভাবে দুখ।
সে কারণে দেখিতে আইল তব মুখ।।
আলিঙ্গন দিয়া তোষ আপন কুমারে।
দুঃখ নাহি, ত্যজ কিংবা রাখহ আমারে।।

ক্রমশই শকুন্তলার যুক্তিনির্ভর শিক্ষিত মন মানবিক আবেগে উদ্বেলিত হয়ে আসছে। বলছে, ছেলে তার বাপকে না দেখে মনের দুঃখে পোড়ে—তাই আজ সে আসছে বাপকে দেখতে। হে রাজা, আমাকে ত্যাগ করলে করো, কিন্তু বুকে জড়িয়ে নিজের ছেলেকে আদর-সোহাগে তুষ্ট করো। পুত্র নিয়ে রাজসভায় শকুন্তলা মোটেও কাঁদতে আসে নি, এসেছে পুত্রের অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য।

বিশ্বামিত্র পিতা মোর মেনকা জননী।
প্রসবিয়া বনে, গেল থুয়ে একাকিনী।।
জননী ত্যজিল পূর্বে, তুমি ত্যজ এবে।
তোমারে বলিব কী মরিব এই ভাবে।।

তিনি শকুন্তলার আগুনটা দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু সে আগুনে সমস্ত পুড়ে ছাই হয়ে যাক তা তিনি চান নি।
শকুন্তলার এমন হৃদয় বিদীর্ণ করা সংলাপ তার জনমদুখী এক করুণ সত্তাকে উপস্থাপন করে। পিতৃমাতৃহীনা নারী, স্বামীসোহাগিনী হয়ে স্বামীসঙ্গে বসবাস করতে এসে দ্বিগুণ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হচ্ছে। এভাবে শকুন্তলা যখন ক্রমশই আবেগায়িত হয়ে ওঠে, রাজা তত বেশি ক্রূর হয়ে ওঠে। আবেগায়িত শকুন্তলাকে রাজা দুর্বল ভাবতে শুরু করে। দ্বিগুণ উৎসাহে শকুন্তলাকে রাজা নোংরা কথা বলে :

বেশ্যা বলি মেনকারে কে বা নাহি জানে।
বেশ্যার প্রকৃতি তোর খণ্ডিবে কেমনে।।
বেশ্যাগর্ভে জন্ম তোর বেশ্যার প্রকৃতি।
এই পুত্র সেই মতো লহে মোর মতি।।

রাজা দুষ্মন্ত ক্রমশই অস্বাভাবিক মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত করে শকুন্তলাকে। তুমি থেকে নেমে আসে তুই সম্বোধনে। তোর মা মেনকা বেশ্যা, তুইও তেমন। তোর জন্ম যেমন বেশ্যার গর্ভে, সেই রকম তুইও নিজের গর্ভে কার না কার সন্তান ধারণ করেছিস! ছি কী লজ্জা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলেই কি পুরুষকে মানায় এতটা নগ্নতায়? এ কি কেবলই পুরুষতন্ত্র আর পুরুষযন্ত্রের ক্লিশে অহংকার নয়?

প্রিয় পাঠক, মাথা কি আর ঠান্ডা রাখা যাচ্ছে? রক্তে কি আগুন জ্বলতে এখনও বাকি? যদি বাকি থাকে, তবে আপনি ভীষণ নির্লিপ্ত একজন মানুষ। আপনার এই নির্লিপ্ত মনকে আমি সম্মান করি। এমন নির্লিপ্ততা থেকেই কেবল সম্ভব শিল্পের শুদ্ধ রস আস্বাদন এবং তার নিপুণ বিশ্লেষণ। কিন্তু আমি তেমন হতে পারি না কেন জানি! ভীষণ ইচ্ছে করছে দুষ্ট দুষ্মন্তকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ধুলায় লুটিয়ে ফেলতে। ইচ্ছে করছে তার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলি, ইচ্ছে করছে তার দম্ভিত পুরুষযন্ত্রটিকে পাথরে থেঁতলে দিতে! থাক এসব ব্যক্তিগত রাগ-অভিমান। আসুন দেখি শকুন্তলা কী বলে :

তোমার আমার রাজা অনেক অন্তর।
সুমেরু সরিষা রাজা যত দুরান্তর।।

না, শকুন্তলাও পারে নি আর বিনয়ী হয়ে থাকতে। ক্রোধ আর শক্তির সংমিশ্রণে শকুন্তলা এখন দুর্বিনীতা। এতক্ষণ অনুনয়-বিনয় করলেও এইবার সে আপন শক্তির প্রকাশ করছে। হায় দাম্ভিক রাজা, কত সামান্য তুমি—তা তোমার অনুমানে নেই। তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য ঠিক ততটাই, যতটা পার্থক্য সুমেরু অঞ্চল আর সামান্য সরিষাদানার মধ্যে।

আমার দেখহ শক্তি আপন নয়নে।
এখনি যাইতে পারি জথা ইচ্ছা মনে।।
ইন্দ্র-যম-কুবের-ভুবন আদি করি।
মুহূর্তেক চরাচর ভ্রমিবারে পারি।।
যত নিন্দা কর, সহি স্বামীর কারণে।
আপনা না জান, নিন্দা কর অন্যজনে।।

দেখ রাজা! আমার শক্তি নিজে চোখে দ্যাখো। স্বর্গ-মর্ত-পাতাল আমি নিমেষেই ভ্রমণ করতে পারি। দেবতাদের যে কারও ঘরে যেকোনো সময় যেতে পারি আমি। এতটা শক্তি নিয়েও থেমে যায় শকুন্তলা। শকুন্তলাকে থেমে যেতে হয়, ব্যাসদেব নিজে থামিয়ে দেন শকুন্তলাকে। ভারতীয় নারীর মডেল তৈরি হয়ে আছে সতী-সাবিত্রী-কুন্তি-মাদ্রি-বেহুলাদের দিয়ে, যত বিদ্রোহী-ই তুমি হও না কেন—তুমি যে স্বামীসোহাগিনী ঘরনি! তাই শকুন্তলা দুষ্মন্তকে এই কথা বলতে পারল না যে, রাজা এক লহমায় আমি তোমার মুণ্ডু ছিঁড়ে নিতে পারি। না, তেমন কিছু বলল না শকুন্তলা। স্বামী বলে তাকে ক্ষমা করে দিল। আজ শুধু স্বামী বলে দুষ্মন্তকে শকুন্তলা দয়া ভিক্ষা দিয়ে গেল :

হেন মিথ্যাবাদী তুমি হইলে নিশ্চয়।
তোমার নিকটে থাকা উচিত না হয়।।

চরম ঘৃণায় পরম তাচ্ছিল্য দেখিয়ে শকুন্তলা মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়, ঠিক তখন আকাশ থেকে দৈববাণী উচ্চারিত হয়। যে দৈববাণী শকুন্তলার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ। দৈববাণী শকুন্তলার কথারই সমর্থন করলে রাজসভাসদগণ রাজার মুখের দিকে তাকান। সলজ্জ রাজা তখন সব সত্য স্বীকার করে, লোকলাজ লোকভয়ের অজুহাত দেখিয়ে শকুন্তলার ক্ষমা ভিক্ষা করে। অতঃপর যা হবার তাই হলো, তারা সুখে শান্তিতে সংসার শুরু করে দিল।

মন চাইলেও শকুন্তলা পারল না দুষ্মন্তকে ত্যাগ করে যেতে। জিতে যেতে যেতে হেরে গেল শকুন্তলা, শেষ পর্যন্তও মহামুনি ব্যাস শকুন্তলাকে জিততে দিল না। কারণ তিনি শকুন্তলার আগুনটা দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু সে আগুনে সমস্ত পুড়ে ছাই হয়ে যাক তা তিনি চান নি। তিনি বিদ্রোহী শকুন্তলাকে না, ভারতের মডেলকন্যা শকুন্তলাকে চিত্রিত করেছেন।

এ বিষয়ে মীরাবাঈ প্রসঙ্গ খুব প্রাসঙ্গিক। আবার দুঃখিত, বিস্তারিত আলোচনা অসম্ভব। সংক্ষেপে বিষয় এই, স্বামী মেবার রানা প্রতাপ সিংহ মীরাকে সন্দেহ করে মীরাসহ তার তামাম আরতিমন্দির কামানের গোলায় উড়িয়ে দিতে যথাস্থানে কামান বসান, গোলা ছুড়ে দেয়ার আগেই রানা সব রহস্য উদ্‌ঘাটন করেন। তাতে নিশ্চিত প্রমাণ মিলে মীরা নির্দোষ। সঙ্গে সঙ্গে রানা মীরার হাত-পায়ে ধরে ক্ষমা মার্জনা করেন। কিন্তু না, মীরা কোনো কবির মডেল চরিত্র মাত্র নয়। মীরা সত্যিকারের মানুষ। মীরা তাকে শুধু অনুরোধ করে যে, সে যেন মীরার বৃন্দাবন যাত্রার আয়োজন করে দেন। বাকি জীবন সে সেখানেই কৃষ্ণনাম জপে পার করে দিবে। রানার কোনো চেষ্টা কোনো কাজে আসে না। অবশেষে রানা শুধু একটি মিনতি করে, যাবার আগে শুধু একটি পুত্র সন্তান তাকে দিয়ে যেতে। না, তুমি যখন আমার দিকে কামান দাগিয়েছ, তখনই আমি মরে গেছি রানা। আর না।

মীরা সেদিন চলে যেতে পেরেছিল। মীরা মানুষ বলে নারীসম্মান আর ব্যক্তিত্বকে রক্ষা করতে পেরেছিল। পৌরাণিক আখ্যানেও এমন দুএকটি দৃষ্টান্ত মিলে, যেমন গঙ্গা ত্যাগ করেছিল শান্তনু রাজাকে। শান্তনুকে গঙ্গা বিয়েই করেছিল একটি কঠিন শর্তে। কোনোদিন কোনো কাজে শান্তনু বাধা দিতে পারবে না। তেমন করেই চলছিল। এক এক করে নিজের গর্ভের সাতটি পুত্রসন্তানকে গঙ্গায় নিয়ে জলে ফেলে দিয়ে আসে। অষ্টম সন্তান নিয়ে জলে রওনা হলে শান্তনু রাজা আর স্থির থাকতে পারে না। গঙ্গার হাত থেকে পুত্র কেড়ে নেয়। শর্ত ভঙ্গ হয়, গঙ্গা শান্তনুকে ত্যাগ করে চলে যায়। এই পুত্রই মহাভারতের অজেয় ক্ষমতাধর মহামহিম ভীষ্ম।

কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরিত্রগুলো পুতুলচরিত্র। কিছু মডেল তৈরি করে, সত্য-কল্পনায় মিশ্রিত কাব্যাকারে লেখা কোনো একটা গল্পের মাধ্যমে বেদ-উপনিষদ কিংবা সংহিতায় বর্ণিত ধর্ম ও জীবনতত্ত্বের ব্যাখ্যা করাই ছিল ব্যাসের মূল প্রবণতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই মডেল চরিত্রগুলো কিছু অলৌকিক শক্তির প্রকাশ হিশেবে আবির্ভূত হন। সীতা-রাধা-দ্রৌপদীর মতো দুঃখ কষ্ট সহ্য করে আদর্শ ভারতীয় নারীর মডেল হিশেবে পুরাণে যাদের উপস্থাপন করেছেন, তারা সবাই মানুষের চরিত্র নিয়েও কোথায় জানি মানুষ থেকে আলাদা। এরা সাধারণ মানুষের কাছে রক্তমাংসেরই মানুষ হয়ে ওঠে। তাদের হাসিকান্না মানুষকে স্পর্শ করে। কিন্তু একটু বিজ্ঞানমনস্ক মন নিয়ে বিবেচনা করতে গেলেই এদের প্রতি আর করুণা জাগে না। হ্যাঁ, সামাজিকভাবে দেখতে তারা নির্যাতিতা নারীদের দলভুক্ত। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মন বলে, না, এরা মানুষ না। এরা সমাজের আদর্শ মানুষের কবিকীর্তি মাত্র। আসুন একটু যুক্তিতে সামনে এগিয়ে যাই।

সীতার জন্ম মাটি থেকে। জনক রাজার লাঙ্গলের ফলায় বেঁধে ভূমি থেকে উঠে আসে সীতা। পরিচয় পায় জনক রাজনন্দিনী জানকী। রাধার জন্ম কৃষ্ণের বাম অংশ থেকে। আজীবন ষোড়শী রাধা। দ্রৌপদীর জন্ম যজ্ঞের নীলাভ শিখা থেকে। তার আরেকটা নাম তাই যাজ্ঞসেনী। পাঞ্চাল দেশের রাজার যজ্ঞ ছিল, তাই সে প্রতিষ্ঠা পেল পাঞ্চাল রাজনন্দিনী পাঞ্চালী নামে।

পৌরাণিক এই তত্ত্বের বিবেচনায় নারীবাদী অপেক্ষাকৃত দুর্বলতম ভাবনা।
শকুন্তলা মায়ের উদরেই জন্মেছিল। কিন্তু মা তাকে ফেলে স্বর্গে চলে যায়। এই চলে যাওয়ার মধ্যেও তেমন দোষ ছিল না। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের বীর্যে যার জন্ম, তার কি ক্ষয় সম্ভব! মা যাকে বনে ফেলে গেল, বনের শকুনরা তাকে নিরাপদে রাখল। ভুলে যাবেন না, শকুনের চরিত্রের সঙ্গে কি এই কর্ম মানানসই। ঠোঁটের সামনে একটা নবজাতক শিশু, মুহূর্তেই যাকে খুবলে খেয়ে নেবার কথা, সেই তাকেই কিনা শকুনেরা পাহারা দিয়ে রাখছে। কণ্ব মুনি তাকে উদ্ধার করে আশ্রমে নিয়ে যান এবং শকুনে বেষ্টিত ছিল বলে নাম দেন শকুন্তলা।

মানুষের সঙ্গে এই চরিত্রগুলোর মিল-অমিল খুঁজে বের করা আলোচ্য বিষয় নয়। এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য শকুন্তলার জীবনকাহিনির অন্তরালে প্রাচীন সমাজ ও সামাজিক আচারবিচার, নিয়মনীতি, তত্ত্ব, ব্যাখ্যা সর্বোপরি পুরাণে এই আখ্যান রচনার মূল কারণটা চিহ্নিত করে তুলে ধরা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে দেখলে শকুন্তলা উপাখ্যান নিঃসন্দেহে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের একটি আদর্শ মানদণ্ড।

নারীর প্রতি অকথ্য মানসিক নির্যাতন যেমন আছে তেমনই আছে নারীজাগরণ—আছে নারীর বিদ্রোহীরূপ—আছে ভারতীয় নারীর আদর্শ মাতৃরূপ। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর মধ্যে এই মাতৃপ্রতিমার সন্ধান খুঁজবেন, তার পক্ষে কী আর সম্ভব সেই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করা? কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মন পুরাণের আদি তত্ত্বগুলো থেকে অনেকটা দূরেই বসে থাকে। ফলে অসমতা কমে না। পুরুষতান্ত্রিক অহংকারও যায় না। ফলে কোনোভাবেই সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না নারীনির্যাতনের নির্মম অধ্যায়। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে প্রাচ্যের এই তত্ত্বগুলোর প্রসার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নিশ্চিত হবে নারী-পুরুষ সমতার বন্ধন। সেদিন আর নারীবাদ-পুরুষবাদের মতো পাশ্চাত্য চিন্তার পিছনে ছুটে বেড়াতে হবে না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, পৌরাণিক এই তত্ত্বের বিবেচনায় নারীবাদ অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর ভাবনা।

আলোচনা-পর্যালোচনায় কোনো খুঁত না থাকাই অস্বাভাবিক বলে মনে করি আমি। নানা মুনির নানা মতের প্রেক্ষিতেই ছড়িয়ে পড়ে নতুন আলোকরশ্মি। আমার এই লেখা দিয়ে বিশ্ব উদ্ধার হয়ে যাবে, এমন ভাবি না। তবু যদি পাঠকের মনে সামান্য চিন্তার উদয় হয় এই লেখার প্রেক্ষিতে, কিংবা যদি নতুন কোনো শকুন্তলার ছায়া আজ পড়ে থাকে আমার লেখায়, সেই সামান্য প্রসাদেই আমি তুষ্ট।

#
দুখু সুমন
জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৮২; জামালপুর। এম ফিল গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশায় অভিনেতা।

ই-মেইল : dukhusuman@gmail.com