লঞ্চ দূর্ঘটনার সাংবাদিকতা

প্রকাশিত: ২:১২ অপরাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০

লঞ্চ দূর্ঘটনার সাংবাদিকতা

|| ফজলুল বারী || সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ২৯ জুন ২০২০ : করোনা মহামারীর এই সময়ে দেশে প্রতিদিন বিপুল মৃত্যু-সংক্রমনের খবরে সবার মন ভারাক্রান্ত থাকে। আজ এরমাঝে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দূর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে।

বুড়িগঙ্গার নামইতো বুড়ি। প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী একটি নদী। এটি এমন একটি নদী, যেটিতে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর, সেখানে এভাবে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় এক লঞ্চ আরেক লঞ্চকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিলো!
এতে একসঙ্গে ৩২ জন মানুষকে মেরে ফেললো একটি ঘাতক লঞ্চ! এমনিতে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবি-দূর্ঘটনা-এত মৃত্যু একটি অস্বাভাবিক ঘটনাও বৈকি। এই মৃত্যুপথযাত্রী নদীর সঙ্গে পরিবেশ দূষনের বিষয়টিও জড়িত।
দূষিত বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন কোন মাছ পর্যন্ত বাঁচেনা। এ নদীর পানি আজ এতটাই বিষাক্ত যে এর পানিতে মাছ সহ জলজ প্রানীরাও স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারেনা। লঞ্চ দূর্ঘটনার পর দমকল কর্মীরাও তাই বলছিলেন।
তারা বলছিলেন দূষিত নদীর পানি অনেক ঘোলা। তাই তাদের উদ্ধারকর্মী ডুবুরিরা পানির নীচে সোলার বাতির আলোয় তারা কিছুই ভালো দেখতে পারছেননা। বাংলাদেশের অনেক মানুষের হাতে অফুরন্ত সময়ও।
তাই এমন সব ঘটনার পর মানুষ যেভাবে ভিড় করেন তাতেও স্বাভাবিক উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। এর ওপর আবার এত মিডিয়া দেশে! এত মিডিয়ার সাংবাদিক-ক্রু-ক্যামেরা সবকিছু মিলে জনসমাবেশটি অনেক বড় হয়ে যায়।
বিদেশে এমন ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে কর্ডন করে ফেলে পুরো অকুস্থল। দমকল কর্মী, উদ্ধার কর্মী, তদন্ত সংশ্লিষ্ট ছাড়া আর সবাই বাধ্যতামূলক থাকেন পুলিশ কর্ডনের বাইরে।
সাংবাদিক সহ সবাইকে পুলিশ কর্ডনের বাইরে থেকেই কাজ করতে হয়। এ নিয়ে কারও জোরাজুরির সুযোগ নেই। কারন সবাই আইনে তাদের কর্মক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা জানেন। কিন্তু বাংলাদেশে সবাইতো ঈশ্বর!
এমন আইনানুগ কড়াকড়িতে গেলে উল্টো লাশ লুকানোর রিপোর্ট-গুজব শুরু হবে! যখন যিনি যে দূর্ঘটনায় পড়েন তখন তিনি বা তারা প্রথমে এমনিতে ভীতসন্ত্রস্ত হন। ওই সময়েই অনেকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
নদী মাতৃক বাংলাদেশের অনেক মানুষই সাঁতার জানেন। কিন্তু দূর্ঘটনায় পড়লে যেখানে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের বোধই ঠিকমতো কাজ করেনা, সেখানে সাঁতার জানা মানুষও সাঁতার ভুলে যান।
এরপর বুড়িগঙ্গার দূষিত পানিতে ডুবে ভিকটিমদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে যাবার কথা। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে এক লঞ্চ আরেক লঞ্চকে পিছন থেকে ধাক্কা দিলো! আর সেটি দুমড়ে মুচড়ে ডুবে গিয়ে কারন হলো এত মৃত্যুর।
মৃতদের বেশিরভাগ মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। তারা ঢাকায় কাজ করেন অথবা ব্যবসা করেন। সোমবার সকালে ঢাকা এসে তারা সবাই টুপ করে মরে গেলেন! এক স্বজন বলছিলেন, তার ভাই করোনার ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলেন ঢাকায়।
তার আর করোনা নিয়ে ভাবতে হবেনা। নৌ প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী অকুস্থলে গিয়ে বলেছেন সিসিটিভির ফুটেছে ঘটনা দেখে তাঁর হত্যাকান্ড মনে হয়েছে। মন্ত্রী বয়সে তরুন। ভনিতা কম জানেন।
তাই তদন্ত কমিটির কাজ শুরুর আগেই এভাবে কথা বলাটা তাঁর ঠিক হয়নি। যদিও তিনিও জানেন এসব তদন্ত কমিটি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর ভবিষ্যত কী তা সবার মতো তিনিও জানেন।
এরজন্যেই হয়তো সত্য কথাটি তিনি অকপটে বলে ফেলেছেন। এই দূর্ঘটনার আগে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চের পিছনের দিকে কাটা পড়ে খেয়া নৌকায় যাত্রী লোকজনের মৃত্যুর ঘটনায় হৈচৈ হয়েছিল। তা এরমাঝে অনেকেই ভুলে গেছে।
বাংলাদেশে এসব যানবাহন দূর্ঘটনার অন্যতম কারন অদক্ষতা। অজ্ঞতা। লঞ্চ চালক-সারেং সহ কয়জন এ বিষয়ে পড়াশুনা করা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত এসব কেউ জানেননা। এসব নিয়ে যে পড়াশুনা আছে তাও অনেকে জানেননা।
সবাই ওস্তাদের কাছে শেখা শিষ্য! ওস্তাদ নিজেই আইনকানুন জানেনা। শিষ্য কী শিখবে! এসব জলযানের সব জায়গায় এখন ক্যামেরা থাকে উন্নত বিশ্বে। সবকিছু মূল সূত্র নিরাপত্তা আগে। মানুষের জীবন মূল্যবান।
যে কোন যানবাহন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সঙ্গে যাত্রীদের জীবন, চালক-কর্মীদের জীবন জড়িত তাদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় থাকে সবার আগে। চালকের আসনে বসে চালক এর যে অংশগুলো দেখেননা তাকে তথ্য দিতে হয় ওয়াকি টকিতে।
সোমবারের ঘটনা নিয়েও তদন্ত কমিটি হয়েছে। এর রিপোর্টও হয়তো কোন দিন প্রকাশ হবেনা। কারন এসব ব্যবসার সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। লঞ্চ ব্যবসায় বাংলাদেশে প্রভাবশালীরাই বিনিয়োগ করেন। কোকো লঞ্চের কথা অনেকের মনে আছে।
তেমন অনেক প্রভাবশালী এই আমলেও পয়দা হয়েছে গন্ডায় গন্ডায়। বাংলাদেশের ছোট লঞ্চগুলো বিদেশে ফেরি হিসাবে পরিচালিত। বাংলাদেশের লঞ্চ দূর্ঘটনার খবর বিদেশে ফেরি দূর্ঘটনা হিসাবে খবর হয়।
এই ফেরি দূর্ঘটনার খবরও বিদেশি মিডিয়ায় চলে গেছে। বাংলাদেশে এক সময় লঞ্চ দূর্ঘটনা অনেকটা নৈমত্তিক ঘটনা ছিল। মিডিয়া অফিসগুলো থেকে দ্রুত স্পটে পাঠানো হতো সাংবাদিকদের। আমি এমন গোটা দশেক স্পট কভার করেছি।
এক সময় এমন লঞ্চ দূর্ঘটনার মুখস্ত একটি স্পট ছিল চাঁদপুর। মেঘনার মোহনায় মোড় নেবার সময় স্রোতের তোড়ে ডুবে যেত অনেক লঞ্চ। এবং আমরাও দ্রুত পড়ি কী মরি করে চাঁদপুর ছুটতাম।
চাঁদপুরে যত লঞ্চ দূর্ঘটনা ঘটেছে এর বেশিরভাগ লঞ্চের আর কোনদিন হদিস পাওয়া যায়নি! তখন লঞ্চ ডুবির সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা, রুস্তম এসব অকুস্থলে রওয়ানা হতো। তখন আরেকটি নিউজ হতো। তাহলো হামযা-রুস্তম বৃদ্ধ!
বয়সে পুরনো জরাজীর্ন উদ্ধারকারী জাহাজ। নতুন লঞ্চগুলো অনেক বড় এবং ভারী। পুরনো বুড়ো হামজা-রুস্তম তাই এসব লঞ্চ টেনে তুলতে পারতোনা। এরপর বেশি টাকায় বেশি শক্তির উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় কেনা হলো।
কিন্তু এই বেশি টাকার বেশি শক্তির প্রত্যয় বুড়িগঙ্গার অকুস্থলে পৌঁছতে পারলোনা। কারন ক্রেন সহ প্রত্যয়ের উচ্চতার কারনে এটি বুড়িগঙ্গা সেতু পেরিয়ে আসতে পারবেনা! এই ঘটনা থেকে কী শিক্ষা নেবে বাংলাদেশ?
লন্ডনের টেমস নদীর ওপরের সেতুটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে প্রয়োজনে খুলে দেয়া যায় পাটাতন। তখন সেই পাটাতনের স্বয়ংক্রিয় খোলা পথ দিয়ে এদিকের জাহাজ ওদিকে দিকে যায়। পৃথিবীতো কোথাও কারও জন্যে থেমে থাকবার নয়।
আধুনিক সময়ের মানুষের প্রতিটি নির্মানের সময় এমন জরুরি নানা প্রয়োজনের কথাও পরিকল্পনায় রাখা হয়। রাখতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে এত টাকায় কেনা প্রত্যয় যদি এমন সেতু নিচা যাওয়া যাবেনা বলে অচল বসে থাকে তবে এটি কিসের প্রত্যয়!
প্রয়োজনের সময় যদি ওপাশে অলস বসেই থাকে তাহলে এসব কেনা নিশ্চয় জাদুঘরে সাজিয়ে রাখবার জন্যে নয়। নিশ্চয় কম নয় প্রত্যয়ের লাটবহরের খরচও। তখন চাঁদপুরে কোন লঞ্চ ডুবলে তা তলিয়ে গেলে সে লঞ্চের হদিস মিলতোনা কোনদিন!
কিন্তু ডুবুরিরা পানির নীচ থেকে এসে বলতেন নানান রহস্য গল্প! পানির নিচে শুধু পাকা ঘরবাড়ি আর মালবাহী রেলগাড়ির ওয়াগন! সেই পাকা ঘরবাড়ি নানান সময়ে নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।
আর নদী ভাঙ্গন রুখতে এক সময় রেলওয়ের পুরনো পরিত্যক্ত মালবাহী গাড়ির ওয়াগন ফেলা হতো। পানির নীচে সেগুলো সৃষ্টি করেছে দৃষ্টিনন্দন জলভাষ্কর্য্যের! ক্লিওপ্যাট্রার আমলের এমন জলভাষ্কর্য কাজে লাগিয়েছে পর্যটনের বিকাশে।
একবার চাঁদপুরে ডুবন্ত লঞ্চের উদ্ধার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো লাশ ভাসছে ভোলার লালমোহন এলাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদপুর থেকে চলে গেলাম লক্ষীপুরে। সেখান থেকে মজু চৌধুরীর ঘাট।
মজু চৌধুরীর ঘাট থেকে সী ট্রাকে ভোলায়। আমার শৈশব ভোলায় কেটেছে। খবর পেয়ে ভোলার বন্ধুরা গাড়ি তৈরি করে রেখেছিলেন। ভোলার সাংবাদিক সহকর্মী হাসিব রহমানও ছিলেন তৈরি। লঞ্চটি ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে লালমোহন যাচ্ছিল।
যারা মারা গেছেন তাদের সিংহভাগ ছিলেন লালমোহন এলাকার গরিব মানুষজন। তারা এত গরিব যে তাদের পরিবারের পক্ষে হতভাগ্য স্বজনের লাশ বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবার সামর্থ্য ছিলোনা।
প্রকৃতির কী খেয়াল! তাদের লাশগুলো ভাসতে ভাসতে চলে গেছে তাদের বাড়ির ঘাটে! অতএব তাদের আর লাশ পরিবহনের খরচ লাগলোনা। এ ঘটনাটি কমপক্ষে ১৫/১৬ বছর আগের।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নানাভাবে এগোলেও তেমন দূর্ভাগ্যের ঘটনা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি। আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় দেখেছি বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের অনেক নিহত-নিখোঁজ মানুষের কবর নেই!
লঞ্চ দূর্ঘটনায় তাদের অনেকে মারা গেছেন। লাশ পাওয়া যায়নি। হয়তো সেই লাশ ভাসতে ভাসতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মাছেদের খাবার হয়েছে। যাদের লাশই পাওয়া যায়নি তাদের কবর কী করে হবে!
আমাদের অঞ্চলের মানুষজন বাবা-মা’-স্বজনের জন্ম মৃত্যু দিবসে তাদের কবর জিয়ারত করেন। যাদের লাশই পাওয়া যায়নি যাদের কবরই নেই তাদের কবর জিয়ারত কিভাবে করা সম্ভব? এই সবকিছু নিয়েই বাংলাদেশের মানবজীবন।

ছবিঃ লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ইসলামপুরের ব্যবসায়ী শামীম। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে তাঁর স্ত্রী ও ভাইসহ স্বজনদের আহাজারি। ২৯ জুন। ছবি: দীপু মালাকার

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ