সিলেট ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:২৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২০
|| সৈয়দ অামিরুজ্জামান || ১০ জুলাই ২০২০ : বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রাতঃস্মরণীয় বহুমাত্রিক পন্ডিত। তিনি ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, অাইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, জ্ঞানতাপস ও ভাষাসৈনিক। এছাড়াও ভাষাতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসেও তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। উনিশ শতকের বাংলা নিয়ে যেসব চর্চা হয়েছে তার বেশিরভাগই আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই প্রবণতার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবের কতখানি সম্পর্ক আছে তা নিয়ে আজকের গবেষকরা রীতিমতো সন্দিহান।
উনিশ শতক সংক্রান্ত এপার বাংলার বেশিরভাগ গবেষণাতেই শহরাঞ্চলের মুসলমানদের অবদান যেমন অনুল্লিখিত, তেমনই আপামর গ্রাম বাংলায় ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে ধারা বিদ্যমান ছিল এবং সেই চেতনার দ্বারা গ্রামীণ মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন, তার উল্লেখ প্রায় থাকেই না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শৈশবের জীবন যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারা উনিশ শতকের শেষভাগে কলকাতা শহর থেকে সামান্য কিছু দূরে বসিরহাট মহকুমাতে কি ভীষণ রকমভাবে তখনও বর্তমান ছিল।
শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই, শুক্রবার- অবিভক্ত বাংলার অবিভক্ত ২৪ পরগনা বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত পেয়ারা গ্রামে। এই বসিরহাটেই জন্মেছিলেন সাংবাদিকতার অন্যতম আদিগুরু মুজিবর রহমান। তার সম্পাদিত ‘দ্য মুসলমান ‘পত্রিকা বিশ শতকের সূচনাপর্বে গ্রামীণ সাংবাদিকতার বৃত্ত অতিক্রম করে শহর কলকাতাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। গ্রামবার্তা প্রবেশিকা’ এবং তার কিংবদন্তী সম্পাদক কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ-কে ঘিরে সারস্বত সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন থাকলেও মুজিবর রহমান সম্পর্কে এপার বাংলার শহুরে বুদ্ধিজীবী মহল পালন করে যান আশ্চর্যজনক নীরবতা। বেগম রোকেয়ার জীবদ্দশায় তার সংস্কারমূলক কাজকে সমর্থন ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই ‘ দ্য মুসলমান’ পত্রিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।
শহীদুল্লাহর ষষ্ঠ ঊর্ধ্বতন পুরুষ- শেখ দারা মালিকি থেকে তার পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ পর্যন্ত সকলে ছিলেন বসিরহাটের কাছাকাছি হাড়োয়া গ্রামের সমাধিস্ত মধ্যযুগের অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যতম অগ্রদূত সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী ওরফে পীর গোরাচাঁদের দরগার খাদেম। সেই সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশের ভিতরে শহীদুল্লাহ এর প্রথম নাম হয়েছিল মোহাম্মদ ইবরাহিম।
তার মা হরুন্নেশা কিন্তু পুত্রের সে নাম বদলে রাখেন শহীদুল্লাহ। এই পোশাকী নামটি সেই সময়ের নিরিখে কিছুটা অভিনবই ছিল। হরুন্নেশা ছেলের ডাক নাম রেখেছিলেন সদানন্দ। সেই ডাক নামেই কিন্তু শহীদুল্লাহ তার পারিবারিক পরিমণ্ডলে পরিচিত ছিলেন। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনায়ই ছিল উনিশ শতকের গ্রাম বাংলার মর্ম চিত্র। তাই বাড়ির পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মামার বাড়ি দেগঙ্গা এলাকার ভাসলিয়া গ্রামের সাওতালিয়া মক্তবে যখন শহীদুল্লাহ ভর্তি হলেন, তখন বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, কথামালা, বোধোদয় – এগুলিও তার পাঠ্য হলো। বিদ্যাসাগরের শিশু পাঠের পাশাপাশি সেই মক্তবেই তিনি পড়লেন মীর মশাররফ হোসেনের লেখা শিশুপাঠ্য বইগুলি ।
মক্তবের পরিমণ্ডলের বাইরে প্রথাগত শিক্ষা শহীদুল্লাহ শুরু করেছিলেন একটু বেশি বয়সেই। প্রথমে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন হাওড়া জুনিয়র হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৪ বছর বয়সে মাইনর পাশ করে ভর্তি হলেন হাওড়া জেলা স্কুলে। ছেলেবেলা থেকেই ভাষা শিক্ষার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। তবে তিনি নিজেই লিখে গেছেন, স্কুলে মৌলভী সাহেবের কাছে মার খাওয়ার ভয়ে আরবি, ফারসির বদলে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে ছিলেন।
স্কুল জীবনে তিনি ওড়িয়া, হিন্দি তামিল এমনকি গ্রিক ভাষা সম্পর্কে শিখতে শুরু করেন। স্কুলছাত্র শহীদুল্লাহ বাংলা বর্ণমালায় আরবির অন্তর সম্পর্কে চর্চা করতে শুরু করেছিলেন। সেই সময়ই ফারসি এবং সংস্কৃততে কবিতা লেখাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় শহীদুল্লা উত্তীর্ণ হন ১৯০৪ সালে। ১৯০৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। হুগলি মহসিন কলেজ এর পর ভর্তি হন। বিএ পড়ার এই সময়ে তার শরীর অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিল সেই কারণে তার পড়াশুনায় সামরিক ছেদ পড়ে।
পারিবারিক কারণে তাকে তখন যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিতে হয়েছিল। তারপর আবার শিক্ষকতা ছেড়ে সিটি কলেজে ভর্তি হন ১৯১০ সালে। সেখান থেকে সংস্কৃতে দ্বিতীয় শ্রেণির অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন। সে বছরই তার বিয়ে হয়। শহীদুল্লাহ একই সঙ্গে সংস্কৃতে এমএ এবং আইনে গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের তৎকালীন বেদ বিষয়ক অধ্যাপক পণ্ডিত সত্যব্রত সামধ্যায়ী একজন মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেন।
শহীদুল্লাহ তার স্মৃতিচারণে পরবর্তীকালে বলেছিলেন- পণ্ডিত সত্যব্রতের সামনে আমি এই তর্ক তুলেছিলাম যে, শাস্ত্রে শুদ্র এবং নারীকে বেদ পড়ানো নিষিদ্ধ বলা আছে। তাই কোন যুক্তিতে আমাকে বেদ পড়ানো হবে না! আমি তো নারীও নই শূদ্রও নই, তাহলে আমাকে বেদ পড়াতে আপনার আপত্তি কোথায় ?
শহীদুল্লাহ’র এই যুক্তির প্রতি কোনো রকম কর্ণপাত করেননি সেই প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হন। স্যার আশুতোষ সত্যব্রতকে অনুরোধ করলেও তিনি উপাচার্যের অনুরোধ রক্ষা করতে অস্বীকার করেন। উল্টো উপাচার্যকে হুমকি দেন, যদি মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়ানো হয়, তাহলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করবেন।
শহীদুল্লাহ সেই সময়ে সারস্বত সমাজের বেশ কিছু মানুষদের কাছে নিজের আর্জি নিয়ে যান। প্রেসিডেন্সি কলেজে শহীদুল্লাহ প্রাক্তন শিক্ষক সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ শহীদুল্লাহকে অনুরোধ করেন, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে। তিনি আশ্বাস দেন পরীক্ষার বিষয়ে সব রকম সাহায্য তিনি শহীদুল্লাহকে করবেন ।
শহীদুল্লাহর আর এক শিক্ষক, বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে তাঁকে বলেন; পণ্ডিতেরা প্রতিহিংসাপরায়ন হতে পারেন। সুতরাং সে বিষয়ে সাবধানী হয়ে শহীদুল্লাহের বেদ বা না পাড়াই ভালো, সংস্কৃত না পড়াই ভালো।
তৎকালীন পত্রপত্রিকা গুলিতেও শহীদুল্লাহকে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপকের বেদ না পড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা হয়। ’দি বেঙ্গলি’ পত্রিকার সম্পাদক রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় অধ্যাপক সত্যব্রতের সমালোচনা করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আলী সম্পাদিত ‘ দি কমরেড’ পত্রিকাতেও শহীদুল্লাহের পক্ষ অবলম্বন করে জোরদার শাওয়াল চালানো হয়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক তাঁর সেই প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলো না ।ফলে উপাচার্য স্যার আশুতোষের পরামর্শে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নতুন বিভাগ ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ‘নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন শহীদুল্লাহ ১৯১০ সালে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত ওই বিভাগটিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহই ছিলেন সেই সময়ের একমাত্র শিক্ষার্থী। ১৯১২ সালে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয় এমএ পাস করেন। স্যার আশুতোষ জার্মানিতে সংস্কৃত পড়তে ভারত সরকারের একটি বৃত্তির জন্য শহীদুল্লাহ এর পক্ষে সরকার বাহাদুরের কাছে সুপারিশ করেন। দুর্ভাগ্যের কথা, সংশ্লিষ্ট বৃত্তিটি পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে পরীক্ষা দিতে হয়, ক্ষীণ স্বাস্থ্যের কারণে শহীদুল্লাহ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না। তার বিদেশযাত্রা সেই পর্যায়ে সম্ভব হয় না।
সেই সময়ে (১৯১৪ সালে) শহিদুল্লাহ এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছুদিন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯১৫ সালে আবার ফিরে আসেন নিজের গ্রাম বসিরহাটে। সেখানে কিছুদিন তিনি ওকালতিও করেছিলেন। এই সময়ে স্যার আশুতোষ তাকে বলেন; “ওকালতি তোমার কাজ নয়, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসো।”
স্যার আশুতোষের ব্যবস্থাপনায় ১৯১৯ সালে শহীদুল্লাহ শরৎকুমারী লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এই কাজটি ছিল মূলত গবেষণাকর্মে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনকে সহায়তা।
ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণা এবং সাহিত্য চর্চার প্রতি ছিল শহীদুল্লাহর প্রবল উৎসাহ। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘মদন ভস্ম’ নামে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছিল। পত্রিকার সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবী (রবীন্দ্রনাথের ভগিনী) সেই প্রবন্ধটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটিতে স্বর্ণকুমারীর সেই প্রবন্ধটিও প্রকাশ হয়েছিল।
ছাত্রজীবনে শহিদুল্লাহ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, আল এসলাম, কোহিনুর ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। সেই সময়ে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ছাত্র অধ্যক্ষও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ গঠন শহীদুল্লাহর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই কাজে তার সব থেকে বড় সহযোগী ছিলেন মুজফফর আহমদ। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে সভাপতি করে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়েছিল। শহীদুল্লাহ ছিলেন এই সংগঠনের সম্পাদক এবং মুজফফর আহমদ ছিলেন সহকারী সম্পাদক। ১৩২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এই সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। শহীদুল্লাহ এবং মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক যৌথভাবেই পত্রিকাটি সম্পাদনা করলেও পত্রিকা সম্পাদনার কাজে মুজফফর আহমদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
কাজী নজরুল করাচিতে সেনার চাকরির পদ থেকে কর্মচ্যুত হওয়ার পর কলকাতায় এসে এই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফফর আহমদের পাশের ঘরে এসে উঠেছিলেন। নজরুলের বহু লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। ১৯২০ সালে একটি স্বল্প আয়ুর শিশুপাঠ্য মাসিক পত্রিকা ‘আঙ্গুর‘ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন শহীদুল্লাহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তার আহ্বানে ওখানে শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একমাত্র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে তিনি উচ্চতর গবেষণার জন্য প্যারিসে যান এবং কাহ্নপা ও সরহের মরমী গীত সম্পর্কে গবেষণা করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি এবং ধ্বনিতত্ত্বের ডিপ্লোমা লাভ করেন।
এই সময় শহীদুল্লাহ প্যারিসে বিশ্ব বিখ্যাত বেশ কিছু ভাষাতত্ত্ববিদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময় তিনি কিছুদিন পড়াশুনা করেছিলেন। শহীদুল্লাহ একাধারে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি তার বিদেশে অধ্যায়নকালে প্রাচীন ফারসি এবং তিব্বতি ভাষায় নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে ও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন এবং ধ্বনিবিজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করেন ।
১৯২৮ সালে বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে আবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। মনীষী কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে আবুল হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখেরা বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ ‘ও তাদের মুখপাত্র ‘শিখা’, যে প্রক্রিয়াটিকে অন্নদাশঙ্কর রায় অভিহিত করেছিলেন ‘বাংলা দ্বিতীয় জাগরণ’ হিসেবে ,তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যান।
এই সময়কালেই মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মপদ্ধতি এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে শিখা গোষ্ঠিতে উদার, মানবিক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা প্রকাশের জন্য ঢাকার প্রভাবশালী মহলের একটা বড় অংশ আবুল হোসেনের বিচারের আয়োজন করেছিলেন। এই গোটা প্রক্রিয়াটি একটি সম্মানজনক সমাধানের ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহর বিশেষ অবদান ছিল। তিনি অত্যন্ত যুক্তি সহকারে সেই সময়ের ইসলামী মৌলবাদীদের এটা বোঝাতে সমর্থ হন যে, আবুল হোসেনের প্রকাশভঙ্গিতে কিছু অসংযম থাকলেও তিনি আদৌ ইসলামবিরোধী কোন কথাই বলেননি।
এরপর পূর্ব বঙ্গ সাহিত্য সমাজের সঙ্গে শহীদুল্লাহের একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে উঠেছিল। চারের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পেশাগত কারণে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় শহিদুল্লাহকে থাকতে হয়েছিল। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই বাংলা ভাষা, হরফ এবং সংস্কৃতির উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের যে আক্রমণ নেমে আসে, প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ভূমিকা নিতে দেখা যায় শহীদুল্লাহকে।
দেশভাগের অব্যবহিত আগে ‘৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই মতের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ সোচ্চার হয়েছিলেন শহীদুল্লাহ। দ্বিধাহীন ভাষায় তিনি সেদিন লেখেন-
দেশে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে সে সম্মান বাংলার। দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলার সঙ্গে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলা ভাষার জন্য আরবি ও রোমান হরফের প্রবর্তনের যে প্রবণতা তখন দেখা দিয়েছিল, সদ্য গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাকে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি শহীদুল্লাহ।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে স্পষ্ট ভাষায় শহীদুল্লাহ বলেন-
আমরা হিন্দু বা মুসলমান একথা যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য এই যে আমরা বাঙালি।
এ ধরনের স্পষ্ট উক্তির জন্য পাকিস্তানের মৌলবাদী সমাজ তার উপর ভয়ঙ্কর রকম খাপ্পা হয়ে যায়। তার সম্বন্ধে রটনা করা হয়, তিনি হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারপ্রান্তে দণ্ডায়মান ভারতীয় চর। কিন্তু কোন ধরনের অপবাদই নিজের সংকল্প থেকে শহীদুল্লাহকে এতোটুকু টলাতে পারেনি ।
১৯৬৩ সাল থেকেই তার শারীরিক অবনতি অবস্থার ঘটতে থাকে। ১৯৬৮ সালে পত্নীবিয়োগে তিনি গভীর আঘাতপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ৮৪ বছর বয়সে বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক এবং জ্ঞানতাপস ও বহুমাত্রিক পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর জীবনাবসান হয়।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D