সিলেট ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:০২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৩, ২০২০
|| এ কে এম জামীর উদ্দীন || ২৩ জুলাই ২০২০ : মধ্যযুগীয় ভাবধারার অবসান ঘটিয়েছিল রেনেসাঁ। এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় আধুনিক পৃথিবীর। ওই রূপান্তরের পর থেকে কয়েকটি যুগ-সন্ধিক্ষণকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে গত শতাব্দীর নব্বই দশক ছিল অন্যতম। আমাদের চিন্তা-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন এনেছিল এই কাল। আর এর নেপথ্যে ছিল কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি। কিন্তু এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তিটিই নতুন শতাব্দীর গোঁড়ায় জন্ম দেয় অর্থনৈতিক সংকটের।
১৯৯৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি আতঙ্ক গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভীতি হচ্ছে Y2K, যার সম্প্রসারিত নাম Year 2000। কম্পিউটার ব্যবহারকারী ও এর প্রোগ্রামারদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল, ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক এই যন্ত্রটি অনেকাংশে বিকল হয়ে যেতে পারে। ওই সময় অধিকাংশ কম্পিউটারে কোড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একটি বর্ষের শেষ দুই সংখ্যাকে উল্লেখ করা হতো। যেমন, ১৯৯৯ সালের ক্ষেত্রে শুধু ৯৯। ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, এই কোড ২০০০ সালকে চিনতে পারবে না।
এর জের ধরে নতুন শতাব্দীর শুরুতেই কম্পিউটার বিকল হয়ে যেতে পারে অনেকাংশে। ফলে বড় করপোরেট কোম্পানিসহ সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে কম্পিউটার কেনার ধুম লেগে যায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে চাঙা হয়ে উঠল। অবশ্য নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবসায় প্রকৃত চাহিদার চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা শুরু করে ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামও পুঁজিবাজারে অনেক বেড়ে যায়। সামগ্রিকভাবে এসবের ফলশ্রুতিতে শুরু হয় ইন্টারনেট বুদবুদ (বাবল)। এর আরেক নাম ছিল ডটকম বাবল।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যালেন গ্রিনস্প্যান বিষয়টি আগাম ধরতে পেরেছিলেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের তিনি সতর্কও করেছিলেন। কিন্তু, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তিনি নেননি। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ব্যবস্থায় মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টেনে ধরার জন্য তিনি বা ফেড কোনো উদ্যোগই হাতে নেয়নি।
এদিকে ২০০০ সালের শুরু থেকে কম্পিউটার বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। কারণ, এর আগেই লোকজন Y2K মোকাবিলায় প্রচুর কম্পিউটার কিনে নেয়। এতে চাহিদার ধস নামে। শুরু হয় কোম্পানিগুলোর আর্থিক সংকট। ওই বছর মার্চে তাদের শেয়ারের দাম আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। এক পর্যায়ে দ্য গ্লোব ডটকম, পেটস ডটকম, বুহু ডটকমসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে একাধিক বড় কোম্পানির ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে উঠে।
এর মধ্যেই ওয়ার্ন্ড ট্রেড সেন্টারে ১/১১-এর সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়। এতে মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠে।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পতিত হয়। ২০০১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে এই মন্দার ব্যাপ্তি ছিল নভেম্বর পর্যন্ত। এটি ছিল মধ্যমসারির অর্থনৈতিক সংকট।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার মতে, কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিক অর্থাৎ ছয় মাস যদি দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি সংকুচিত হয়, তখন এই পরিস্থিতিকে মন্দা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই সময় মানুষের চাকরি চলে যাওয়া থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন রকম সংকটের উদ্ভব হয়। এখন যেমন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ তা মোকাবিলা করছে।
২০০১ সালের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ওই পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রেও তৎকালীন বুশ সরকার কর কমানোসহ বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছিল। একইসঙ্গে সেন্ট্রাল ব্যাংক পলিসি রেট (সিবিপিআর) কমাতে থাকে ফেড।
সিবিপিআর হচ্ছে এক ধরনের সুদহার, যেটি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এটি একইসঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব (আমানত ও ঋণ) ধরনের সুদের ভিত্তিহার। এই সুদহার কমানো হলে ব্যাংকগুলো কম খরচে টাকা ধার পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আর এই টাকা ব্যাংক ঋণ হিসেবে দেয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
২০০১ সালের মন্দা মোকাবিলা করার জন্য বাজারে ব্যাপকভাবে টাকার জোগান দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ফেড। এর অংশ হিসেবে সিবিপিআর কমাতে থাকে। ২০০০ সালের মে-তে এই রেট ছিল ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ। এরপর তা পর্যায়ক্রমে এগারো বার কমিয়ে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে করা হয় এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো কম খরচে ব্যাপকভাবে ডলার নিতে থাকে ফেড থেকে। পুরো বাজার মুদ্রায় সয়লাব হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধরনের মুদ্রা প্রবাহের ধরনকে অর্থনীতির ভাষায় সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি বলা হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাভের প্রধান অংশ আসে ঋণ দেওয়া টাকার সুদ থেকে। ২০০১ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো বেশি লাভের আশায় গৃহায়ণ খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া শুরু করে। অনেক ব্যাংক ঋণগ্রহীতার টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা বিবেচনা না করেই অর্থ ধার দিতে থাকে।
ফলে বাড়ির ব্যবসা খুব দ্রুত লাভজনক হতে শুরু করে সেখানে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাঙাভাব তৈরি হয়। মন্দা থেকে বেরিয়ে আসে দেশটি। কয়েক বছরের মধ্যেই বাড়ির দাম অনেকগুণ বেড়ে যায় সেখানে। একপর্যায়ে প্রকৃত মূল্যের চেয়েও বাড়ির দাম হয়ে যায় অনেক। অর্থাৎ ডটকম বাবলকে সামাল দিতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানেই আরেকটি বাবলের সৃষ্টি হলো। এর নাম হাউজিং বাবল বা গৃহায়ণ বুদবুদ।
কৃত্রিমভাবে বাড়ির দাম বাড়ানোর এই খেলা যথারীতি এক সময় বন্ধ হলো। এর জের ধরে বাড়ি নিয়ে ব্যবসা করা ব্যক্তিরা পথে বসে যান। ওইসব বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তারা। পরে ওই সম্পত্তি দখল করল ব্যাংক। কিন্তু, বিক্রি করতে গিয়ে দেখা গেলো তাদের দেওয়া ঋণের চেয়ে বাড়ির দাম অনেক কম।
এর ফলে ২০০৭ সালের দিকে দেশটির অনেক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি ডলার খেলাপি হয়ে যায়। যেহেতু ঋণের টাকা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলো ব্যাংক, ফলে আমানতকারীদের টাকাও তারা পরিশোধ করতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় শত শত ব্যাংক। এসবের জের ধরে শুরু হয় ১৯৩০ পরবর্তী সবচেয়ে বড় মন্দা। এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে দেশে। অর্থাৎ সময়মত পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে কী ধরনের ভয়াবহ ঘটনার উদ্ভব হয়, সেটি ২০০১ সালের মাঝারি মন্দা ২০০৭ সালের সঙ্কট তৈরির করার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিয়েছিল।
আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও ভয়ঙ্কর ঘটনাটি এখন ঘটছে। কেননা, ১২-১৩ বছরের মধ্যে কখনোই দুনিয়া দুটি বড় মন্দা মোকাবিলা করেনি। কিন্তু, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন সেটি হচ্ছে।
১৯৩০ সালের মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমবারের মতো সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ, টাকা ছাপিয়ে বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রা প্রবাহের মাধ্যমে চাহিদার সৃষ্টি করা হয়। এতে বিভিন্ন দ্রব্যাদি কেনার সামর্থ্য তৈরি হয় মানুষের। ফলে মন্দার আঘাতে পর্যদুস্ত কারখানাগুলোও প্রাণ ফিরে পায়। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ছিলেন এই নীতির অন্যতম উদ্ভাবক।
উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দিকে চোখ দেওয়া যেতে পারে। দেশটি ১৯৩৩ সাল থেকে চলমান সংকটের আগে ১৩ বার ছোট-বড় মন্দায় পড়েছিল। বলতে গেলে প্রায় সবসময় সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে পরিস্থিতির সামাল দেয়।
এবারও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ পৃথিবীর সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুদ্রানীতির প্রয়োগ করছে। আমরা এখনো জানি না, এই রোগের প্রাদুর্ভাব কখন শেষ হবে। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, করোনাভাইরাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতি আগের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত হওয়া মন্দাগুলোর গড় ব্যাপ্তি ছিল ১৫ মাস। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ বারবার টানার কারণ হচ্ছে, দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিকে এখন পর্যন্ত তার মুদ্রা ডলারের আধিপত্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। ফলে ওই দেশ মন্দা থেকে বের হতে না পারলে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।
কিন্তু, মন্দার ব্যাপ্তিকালের এসব হিসাব-নিকাশ পরোয়া না করেই বাংলাদেশ ভি-শ্যাপড রিকভারির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মানে হচ্ছে, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নেওয়া। এর অংশ হিসেবে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের জন্য।
কিন্তু, অন্য দেশগুলো এর ভিন্ন পথে হাঁটছে। সম্প্রতি ব্রিটেন বলেছে, গত ৩০০ বছরের ইতিহাসে চলমান সংকট তাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে। ১৭০৯ সালে ইউরোপে গ্রেট ফ্রস্টকে (সে বছর ভয়াবহ বরফপাত হয়েছিল) কেন্দ্র করে যে মন্দার উদ্ভব হয়েছিল, এরপর চলমান অর্থনৈতিক সংকট দেশটির জন্য সবচেয়ে খারাপ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত সুস্পষ্টভাবে বলেছে, চলতি অর্থবছর দেশটিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি চার থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। এত কিছুর পরও এত বড় মন্দার মধ্যে আমাদের দেশের জন্য ভি-শ্যাপড রিকভারি বা আট দশমিক দুই শতাংশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু যৌক্তিক তা যথেষ্ট চিন্তার অবকাশ রাখে।
ইতোমধ্যে মন্দা মোকাবিলা করার জন্য ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ, যা জিডিপির প্রায় তিন দশমিক সাত শতাংশ। এই টাকার বড় অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ছাপিয়ে বাজারে জোগান দিতে হবে। এর পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকার ব্যাংক ঋণ নেবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। সাধারণত, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার অধিকাংশ সময় ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি সামাল দেয়। কিন্তু, পরিস্থিতি এবার ভিন্ন। মন্দার কারণে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকবে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই টাকা ছাপিয়ে সরকারের কাছে তা সরবরাহ করতে হবে। এসব কারণে, বাজারে ছাপানো অর্থের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়বে আগামী দিনগুলোতে।
এই ধরনের সম্প্রসারণমূলক মনিটরি পলিসি বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২০০১ সালের মন্দার জের ধরে কেন ২০০৭ সৃষ্টি হয়েছিলো তা ইতোমধ্যে আলোকপাত করা হয়েছে।
চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মাসের মধ্যে এই অর্থবছরের জন্য মনিটরি পলিসি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, স্বাধীনতার পর আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী হওয়ার পর কখনোই চলতি মন্দার মত কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেনি।
কিন্তু, কতটুকু দক্ষতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলমান পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। আমরা দেখেছি, মন্দা মোকাবিলার প্রশ্নে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী রিশি সনকের চেয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি অনেক সরব গণমাধ্যমের সামনে। এর মানে ব্রিটিশদের বেইলি আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিচ্ছি’। মন্দা শুরু হওয়ার পর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাশও একাধিকবার জাতির কাছে নিজেকে তুলে ধরেছেন গণমাধ্যম ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জো পাওয়েল ও ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট খ্রিস্টিনা ল্যাগার্দের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ প্রযোজ্য। তাদের এই ধরনের উপস্থিতির কারণ হচ্ছে, সরকারের চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোই অগ্রণী ভূমিকা রাখে মন্দা মোকাবিলায়।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের ক্ষেত্রে এই উদাহরণ উল্টো। ভদ্রলোককে বছরে এক বা দুইবার মনিটরি পলিসি ঘোষণা করার সময় গণমাধ্যমের সামনে দেখা যায়। একই উদাহরণ তিনি মন্দার সময়ও অব্যাহত রেখেছেন। মহামারির কারণে এবার তিনি আদৌ গণমাধ্যমের সামনে আসবেন কি না, সেটা নিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহের অবকাশ আছে। মূলত দেশের ভঙ্গুর ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সাংবাদিকদের তির্যক প্রশ্ন এড়ানোর জন্যই তার এই ধরনের প্রয়াস বলে কথিত আছে। যদি উনি সত্যিকার অর্থে জাতির সামনে আসতে চান, তাহলে ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে মনিটরি পলিসি ঘোষণা করতে পারেন।
এবারের আমাদের মনিটরি পলিসি যে সম্প্রসারণমূলক হবে সেটা এখন থেকেই নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়। এর বিকল্পও অবশ্য নেই। কিন্তু, আগামীতে আর্থিক খাতের ঝুঁকি কী রকম হতে পারে, সে বিষয় নিয়ে সুস্পষ্টভাবে এখন পর্যন্ত আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি আদৌ কিছু বলছে? ফেড কিন্তু ইতোমধ্যে ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আগাম ঝুঁকির বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছে। কিন্তু, আমাদের এখানে সে ধরনের চর্চা নেই বললেই চলে। অধিকন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসি বা ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্ট ব্যাপকভাবে অবহেলিত। এসব ডিপার্টমেন্টকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না এখানে।
আগামী দিনে অর্থনীতি কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তা এখনই পরিমাপ করা উচিৎ। পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদের এসব সমস্যা এড়ানোর জন্য যদি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে চলমান সংকটের চেয়ে বড় বিপদে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
যদি প্রণোদনা ও সরকারের ব্যাংক ঋণের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার না হয়, তাহলে স্ট্যাগফ্লেশনের মতো পরিস্থিতি এখানে সৃষ্টি হতে পারে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা মোকাবিলা করেছিল।
মন্দার সময় কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে শ্রমিকরা চাকরি হারায়। জার্মান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কসের বিখ্যাত পুস্তিকা মজুরি, শ্রম ও পুঁজি-এর সারসংক্ষেপ নিয়ে কিছুটা আলোচনা এখানে করা যেতে পারে। তিনি ১৮৪৯ সালে বলেছিলেন, ‘কারখানার মালিকরা অধিক মুনাফা বা চলতি মুনাফা ধরে রাখার জন্য শ্রমিক ছাঁটাই করেন। এর ফলে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে কারখানার উৎপাদিত দ্রব্য আর বিক্রি হয় না। ফলশ্রুতিতে কারখানার মালিকদের আরও লোকসানের মুখে পড়তে হয়।’
মন্দার সময়ও একই ঘটনা ঘটে। উৎপাদন খাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনার টাকা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে মালিকের লাভের পাশাপাশি শ্রমিকের হাতেও বেতনের টাকা যাবে। এতে তাদের ব্যয় করার ক্ষমতা বাড়বে।
কিন্তু, ছাপানো এই টাকা উৎপাদন খাতে যদি যথাযথভাবে ব্যবহৃত না হয়, তাহলে একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেমন তৈরি হবে, তেমনি প্রবৃদ্ধিও অচলাবস্থায় পড়বে। অর্থনীতিতে এই পরিস্থিতির নামই হচ্ছে স্ট্যাগফ্লেশন।
১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত কেইনসের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন, মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য খারাপ নয়। কারণ, এতে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ার মাধ্যমে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীলতা পায়। সৃষ্টি হয় নতুন চাকরির। সর্বোপরি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এটি মূল্যস্ফীতির সমস্যাকে সহজে সমাধান করে ফেলতে পারে।
কিন্তু, সত্তরের দশকে এই ধরনের একমুখী ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অল্প সময়ের মধ্যে দুইবার মন্দার মুখোমুখি হয়। ফলে যথারীতি বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর জন্য সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। একই সময়ে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়া, ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট আন্দোলনবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত খরচের জের ধরে স্ট্যাগফ্লেশনের মুখোমুখি হয় যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা আরও বেশ কিছু দেশও একই সময় এই সংকটে পড়ে।
চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মধ্যমেয়াদে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি হয়ত নাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটের ঘটনাও আমরা দেখেছি। এক লাখ কোটি টাকার ওপরের প্রণোদনা প্যাকেজ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি এই স্ট্যাগফ্লেশনের মত ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এ ছাড়া, সরকারের উচিৎ শ্রমঘন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, যেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের উদাহরণ নিয়ে আসা যেতে পারে। মহামন্দার সময় রিপাবলিকানদের হটিয়ে ১৯৩৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীন হন। ডেমোক্রেটিক পার্টির এই নেতা ১৯৩৫ সালে একাধিক সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। রাস্তা, সেতু থেকে শুরু করে ম্যুরাল অঙ্কনের মতো প্রকল্পে লাখ লাখ আমেরিকান নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। মহামন্দার কাটানোর জন্য তার এই নীতি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের সরকারেরও এই রকম কিছু ছোটো প্রকল্প আছে। কিন্তু মন্দা কাটানোর জন্য তা পর্যাপ্ত নয়।
যেহেতু, বাংলাদেশ আগে কখনো তেমন কোনো মন্দা মোকাবিলা করেনি, ফলে এখানে সংকট মোকাবিলা করার মতো অভিজ্ঞ লোকবলেরও অভাব আছে। কিন্তু, সেই অপ্রতুলতা কাটানোর জন্য বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ আমাদের হাতে নেই। আসছে মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ, পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যথায় ভি-শ্যাপড রিকভারির স্বপ্ন এল-শ্যাপড-এ পরিণত হয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে আমাদের জন্য। আর তা যদি হয়, মন্দার রেশ আমাদের অনেক বছর ধরে টানতে হবে।
এ কে এম জামীর উদ্দীন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
russellspb@ymail.com
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D