বিজ্ঞানমনস্ক শিশু সংগঠক ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী আসগর

প্রকাশিত: ৩:১৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০২০

বিজ্ঞানমনস্ক শিশু সংগঠক ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী আসগর

|| এ.এন. রাশেদা || ২৪ জুলাই ২০২০ : অধ্যাপক ড. আলী আসগরকে আরও নানা অভিধায় অভিষিক্ত করা যায়। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে। প্রকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর গ্রহণের পরে তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফিজিক্স ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। শিশু কিশোরদের বিজ্ঞান চেতনায় সমৃদ্ধ করা, বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। তিনি পাঁচবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। দেশব্যাপী শিশু কিশোর ও অভিভাবকদের কাছে প্রিয় ও নমস্য ছিলেন তার সম্মোহনী বক্তৃতার জন্য। এক সময়ে কার্জন হলে শিশুদের বিজ্ঞান ক্লাস পরিচালনা করেছেন। দীর্ঘদিন চলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিজ্ঞানের এই ক্লাস। শত শত খেলাঘরের ভাইবোনেরা এতে অংশগ্রহণ করে পুলক অনুভব করত। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী ও বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বিজ্ঞান শিক্ষার ধারাকে বেগবান করতে পারে এমন নানাবিধ চিন্তা থেকে সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তার কর্ম পরিচালনা করতেন। বিটিভিতে বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায়।

বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তোলার কাজে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমেলার আয়োজনে যোগদান করে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দেয়া, জাতীয়ভাবে যে সব বিজ্ঞান সপ্তাহ পালিত হতো সেখানে অবদান রাখা এবং বিজ্ঞানবিষয়ক নানা সেমিনার বা ওয়ার্কশপে ড. আলী আসগরের ছিল সপ্রতিভ অংশগ্রহণ। শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনাও ছিল বিস্তর।

এই বিজ্ঞানমনস্ক ও শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনার এই শিক্ষকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির মুখপত্র ‘মৈত্রী’ প্রকাশের কালে। ১৯৮০ সালে সেপ্টেম্বরে শিক্ষা সংখ্যা মৈত্রীর জন্য লেখা চাওয়ায় তিনি সম্মত হয়ে ‘পরীক্ষা পদ্ধতি ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা’ শিরোনামে লিখেছিলেন। আমি সেই প্রবন্ধের সামান্য অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি।
ড. আলী আসগরের চিন্তাধারাকে তুলে ধরার জন্য। একপর্যায়ে তিনি লিখছেন, “সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সমস্ত অর্থ সঞ্চিত ছিল বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত না হয়ে ব্যক্তি বিশেষের দানছত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে শিক্ষা একটি সামাজিক ব্যাপার না – হয়ে অনেকটা সৌখিনতা হিসেবে পরিগণিত হতো। তারপর একপর্যায়ে তিনি লিখছেন, ‘প্রগতিশীল প্রতিটি সমাজ এক গতিশীলতার মধ্যে তার ভারসাম্য রক্ষা করছে। তারপর তিনি বলেছেন: উপযুক্ত শিক্ষা বলতে অবশ্য সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা দেয়া বোঝায় না। সামাজিক প্রয়োজনের বৈচিত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে মেধা ও প্রবণতার পার্থক্যের কারণে সবাইকে একই শিক্ষা প্রদান সঠিক নয়। সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার এই বৈচিত্রকে সমাজ ও ব্যক্তির কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব। সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বৈচিত্রকে বৈষম্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে কোন এক শ্রেণী যেন অন্য শ্রেণীর ওপরে শোষণ চালাতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। সবাইকে সমান সুযোগ প্রদান মেধা ও প্রবণতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিন্যস্ত করা সুষ্ঠু পরীক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই শুধু এটা সম্ভব।” ১৯৮০ সালে শিক্ষাকে যেভাবে বিন্যস্ত করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে ভেবেছিলেন–আজও তা সুদূরপরাহত এবং দেশ পরিচলনাকারীদের চিন্তা-ভাবনা তা থেকে অনেক দূরে।

অধ্যাপক ড. আলী আসগর যেমন শিশু সংগঠন ‘খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তেমনি ‘বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদ’ নামে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চেতনায় ঋদ্ধ একটি একটি সংগঠনের সঙ্গেও প্রতিষ্ঠাকাল থেকে যুক্ত হয়েছিলেন। যেখানে ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার, বুয়েট -এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আ. মু জহুরুল হক, ঢাবি পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এম হারুন-অর রশিদ, অধ্যাপক ড. অজয় রায়, এসএম মুজিবুর রহমান, ড.সুলতান আহমেদ এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম। আরও ছিলেন ড. আবদুল্লাহ আল মুতী, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, সাহিত্যিক বশীর আল হেলাল, অধ্যাপক ড. মনসুর মুসা, অধ্যাপক ও আবুল কাশেম ফজলুল হকসহ আরও অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত। পাক্ষিক প্রবন্ধ পাঠের আসর তাদের একটি নিয়মিত কর্মকাণ্ড ছিল এবং তা বেশ জমজমাট হতো।পরবর্তীতে ১৯৮৫ তে তারা প্রকাশ করেছেন ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি ‘ ও ১৯৮৮ তে বিজ্ঞান দর্শন সংস্কৃতি ‘। ১৯৮৫ ও ৮৬ সালে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যৌথভাবে বিজ্ঞান লেখক সম্মেলনের আয়োজনও তারা করেছিলেন। সর্বত্রই ড. আলী আসগরের ছিল সরব উপস্থিতি।

অনেক ধারার সঙ্গে যুক্ত থেকেও মাসিক শিক্ষাবার্তার আয়োজনে যেসব সেমিনারের আয়োজন করা হত, তার প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ছিলেন তিনি। হয় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক হয়ে, আলোচক হয়ে অথবা সভাপতিত্ব করার জন্য। যেমন ‘পাবলিত পরীক্ষা পদ্ধতি : সংকট ও সুপারিশ’, ‘শিক্ষাদর্শন, লক্ষ্য ও সমাজ এবং ২৬-২৭ অক্টোবর ১৯৯৫ দু-দিনব্যাপী বিজ্ঞানচর্চা : সমকালীন বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনার। প্রথমক্ত দুই সেমিনারে তিনি ছিলেন আলোচক ও প্রবন্ধ উপস্থাপক। শেষোক্ত সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ শফি এবং সভাপতির দায়িত্বে অধ্যাপক ড. আলী আসগার। প্রবন্ধের ওপর আলোচকদের আলোচনা শেষে সভাপতির বক্তব্যের একপর্যায় ড. আলী আসগর বলেন-” আমরা যদি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি যুদ্ধাবস্থার শর্তারোপ করি এইভাবে যে, আমাদের যত যোগ্য শিক্ষক ও বিজ্ঞানী আছেন এবং আমাদের যা কিছু সামর্থ্য ও সম্পদ আছে তা আমাদের তরুণদের শিক্ষা প্রদানের কাজে নিয়োজিত করব এবং এতে কোনো সমর্থ শিক্ষাবিদকে অবসর দেয়া যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে মানসিক ও শারীরিকভাবে শিক্ষা প্রদানে সক্ষম থাকেন এবং এতে প্রতিটি শিক্ষালাভের যোগ্য ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থী –শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে, তার অর্থনৈতিক অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন? এজন্য অবশ্য নতুন এক মূল্যবোধ ও আয়োজন প্রয়োজন হবে। আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে যে, একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ-আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালাভের ভেতর দিয়ে এই জনশক্তি সৃষ্টি হতে পারে এবং তা যতই ব্যয়বহুল হোক। শেষ পর্যন্ত এই বিনিয়োগই সবচেয়ে ফলপ্রসূ উন্নয়ন আনতে পারে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় বিনিয়োগ তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা বস্তুগত প্রাচুর্য আনে না কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী যে-প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে নৈতিক ও চেতনাবোধের ক্ষেত্রে তা হিসাবে আনলে –বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রের বিনিয়োগই সবচেয়ে দক্ষ বিনিয়োগ”। উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও প্রণিধানযোগ্য। কারণ আজও আমরা বিজ্ঞান শিক্ষাধারায় বরাদ্দ অপ্রতুল দেখি। ১৮-১২-২০১৯ দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ রিপোর্ট করেছে ‘মাদরাসায় রেকর্ড বরাদ্দ’। আর আমরা লক্ষ্য করছি স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা সবচাইতে অবহেলিত। প্রতিষ্ঠানে না আছে শিক্ষক, না ল্যাবরেটরি। শিক্ষক থাকলেও নেই বেতন। আবার প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা করা হয়েছে।

সমাজে ড. আলী আসগরের মতো চিন্তাধারার মানুষের আজ হাহাকার। মানুষ তৈরির কারখানায় আজ মানুষ তৈরি হয় না। দেশের বর্তমান অবস্থা সে কথাই প্রমাণ করে।

ড. আলী আসগর প্রচুর লিখেছেন। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিষয়ে তার শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আর ২০টি বই। বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের মধ্যে- ‘ভাষা ও বিজ্ঞান’, বিজ্ঞান প্রতিদিন’, ‘সময় প্রসঙ্গে’, ‘বিজ্ঞানের বিচিত্র জগৎ থেকে ‘বিজ্ঞানের মজার প্রজেক্ট, ’ ‘বিজ্ঞান ও সমাজ’, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের পথে’, ‘পরিবেশ ও বিজ্ঞান’, বিজ্ঞানের দিগন্তে, ‘বিজ্ঞান আন্দোলনসহ আরও অন্যান্য।

ড. আলী আসগরের বিজ্ঞান-চিন্তা, সমাজকে এগিয়ে নেয়ার চিন্তা-বর্তমান সমাজ ও সরকার অনুধাবন করতে না পারলেও করোনাকাল অতিক্রান্ত শেষে বিশ্বব্যাপী ওলোট-পালটের পরে দেশবাসী একদিন অবশ্যই অনুধাবন করবে, বিজ্ঞান কি? মানবকুলের শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি? তিনি আজ নেই। ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার বিদায় নিয়েছেন এই মর্ত থেকে। জন্মেছিলেন ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে। কিন্তু বেঁচে থাকবেন তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে; বিজ্ঞান সবার কাছে চরম সত্যে প্রতীয়মান হওয়ার হাজার বছরের পথ ধরে।

প্রয়াত অধ্যাপক ড. আলী আসগরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক নটর ডেম কলেজ, সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা]