সিলেট ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৫৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২০
||কামাল আহমেদ || ২৯ জুলাই ২০২০ : পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক হঠাৎ করেই আবার আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে তা যতটা না বাংলাদেশে হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে ভারতে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এখন একধরনের অস্থিরতা ও উদ্বেগ স্পষ্ট। দ্য হিন্দু পত্রিকা (বিস্ময়কর ও বিভ্রান্তিকর শিরোনামে) জানিয়েছে যে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার চার মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চেয়েও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি (শেখ হাসিনা ফেইলড টু মিট ইন্ডিয়ান এনভয় ডেসপাইট রিকোয়েস্টস: ঢাকা ডেইলি, হিন্দু অনলাইন, ২৫ জুলাই, ২০২০)।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোনের পরই ভারতীয় বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টিকে ভারতের জন্য দুঃসংবাদ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, ভারত-চীন সামরিক সংঘাতের পটভূমিতে দিল্লি তার প্রতিবেশীদের ওপর থেকে মনোযোগ হারানোর কারণে পাকিস্তান সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেরা অবস্থায় বলে আমরা শুনে আসছি, তখন ভারতের এ রকম উদ্বেগে মনে হয় বাস্তবে বন্ধুত্বের এই ভিত্তিটা হয় তত জোরালো নয় অথবা কোথাও কোথাও সমস্যা রয়েছে।
করোনা মহামারির কালে প্রায় সব দেশেই সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধির কারণে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি বন্ধ রয়েছে অথবা সীমিত আকারে চলছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী কোনো বিদেশি অতিথি বা কূটনীতিককে সাক্ষাৎ না দিলে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে, তা বোঝা মুশকিল। বরং এ ধরনের উদ্বেগ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতারই ইঙ্গিত দেয়। মনে হয় যেন ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের সঙ্গে যাদেরই বৈরিতা আছে, এ রকম কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক থাকতে পারবে না।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল তার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা এবং দণ্ডিতদের পক্ষসমর্থন। সেই টানাপোড়েনের কারণে কূটনৈতিক যোগাযোগে অবনমন ঘটলেও বাংলাদেশ কিন্তু তার সঙ্গে কখনো সম্পর্ক ছিন্ন করেনি।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম সার্ক প্রায় মরণাপন্ন হয়ে পড়েছিল কী কারণে, তা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু করোনা মহামারি মোকাবিলার প্রয়োজনে ভারতই আবার সেই সার্কের পুনরুজ্জীবনে উদ্যোগী হয়েছিল। সার্ক ছাড়াও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ডি-৮ নামের আরেকটি জোটের সহযোগী। আটটি জনবহুল মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ কার্যক্রম কতটা আছে বা নেই কিংবা তাতে বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে কি না, সেসব প্রশ্ন থাকতেই পারে। গত এপ্রিলে ঢাকায় এই জোটের শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, যা মহামারির কারণে স্থগিত হয়ে যায়। মহামারি না হলে ইতিমধ্যে এই উপলক্ষে ইমরান খানের ঢাকা সফর হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সম্মেলনটি স্থগিত হওয়ার কারণেই হয়তো এই টেলি-সংলাপ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে পাকিস্তানি হাইকমিশনারের বৈঠকে ভারতীয় বিশ্লেষকেরা এতটা বিস্মিত হয়েছেন।
ভারতীয় কূটনীতিক ও বিশ্লেষকেরা এর আগে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি নিয়েও নানা রকম বক্তব্য দিয়েছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শোভন ছিল না। চীনের সঙ্গে বৈরিতা তীব্রতর হওয়া এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার পটভূমিতে একটি ধারণা চালু আছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিষয়টি ভারতের কাছে অগ্রাধিকার পাবে। তবে বাস্তবতা একেবারেই আলাদা।
ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, তা প্রায় নজিরবিহীন। কিন্তু এর বিপরীতে বাণিজ্যিক লেনদেনে ন্যায্যতার প্রশ্নও উপেক্ষিত থেকেছে। এরপরও বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণের দিক থেকে ভারত চীনের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। চীনের তুলনায় ভারতের সামর্থ্যগত সীমাবদ্ধতাই হচ্ছে এর কারণ।
করোনা মোকাবিলায় সহায়তার ক্ষেত্রেও ভারতের থেকে চীন অনেক এগিয়ে আছে। সেটাও সামর্থ্যের কারণে। চীন আগে থেকেই ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী, মাস্ক, ভেন্টিলেটর এবং টেস্টিং কিট উৎপাদন করতে থাকায় বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। অন্যদিকে, ভারত যেসব সামগ্রী পাঠিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি সামগ্রী ছিল ম্যালেরিয়া চিকিৎসার ওষুধ হাইড্রোক্লোরোকুইন, যার ব্যবহার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা চিকিৎসায় অনুমোদন করেনি।
মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন এক বড় ধরনের মন্দার মুখোমুখি, তখন রপ্তানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। এ রকম পরিস্থিতিতে চীন তার বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বিষয়টিকে বাংলাদেশকে উৎকোচ প্রদানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। করোনার প্রতিষেধক টিকার পরীক্ষায় যুক্ত হওয়ার জন্য চীনের আহ্বানে বাংলাদেশের ইতিবাচক সাড়া দেওয়াকেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতের তরফে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয় না। কয়েক বছর ধরে দেশটির ক্ষমতাসীন দল, বিজেপি কথিত অনুপ্রবেশকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে বাংলাদেশবিরোধী যে প্রচার চালিয়ে আসছে, তা দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। দলটির সভাপতি অমিত শাহ কথিত অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকা অভিহিত করে বহিষ্কারের অঙ্গীকার করেছেন। গত বছরে সীমান্ত দিয়ে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের কাউকে কাউকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনীতিতে কথিত অনুপ্রবেশকারী ইস্যুটি কতটা প্রাধান্য পাচ্ছে, তার একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এবং নাগরিকদের জাতীয় রেজিস্ট্রার বা এনআরসি। আসামে এই এনআরসিতে ১৯ লাখ বাংলাভাষী নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে। এখন পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতেই এনআরসির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্বভাবতই বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়। কিন্তু, সেই উদ্বেগ নিরসনে ভারতের বর্তমান নেতৃত্বের ন্যূনতম আগ্রহ নেই।
গত বছরের আগস্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দিল্লি সফরের সময়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর যৌথ বিবৃতিতে যে তাঁরা সম্মত হতে পারলেন না, আলাদা বিবৃতি প্রকাশিত হলো, তা ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন।
তারপরও অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে একটি অর্থনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারকে সই করেছেন। তিস্তার পানিবণ্টন অনিষ্পন্ন থাকলেও ফেনী নদীর পানি প্রশ্নে ছাড় দিয়েছেন। ওই সব সমঝোতার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে নজরদারির জন্য ভারতীয় রাডার স্থাপনের বিষয়ও রয়েছে। কিন্তু ভারত তার যথার্থ স্বীকৃতি দিতে এখনো কার্পণ্য করে চলেছে। একমাত্র যে সীমান্তে বেসামরিক মানুষজন ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহত হচ্ছেন, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্বনির্ধারিত দিল্লি সফর বাতিল করেছিলেন। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ে তাঁর সফর বাতিল করেছিলেন। কিন্তু গত ছয় মাসে ভারতের তরফে এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি, যাতে আস্থার সংকট দূর হয়েছে বলে প্রমাণ মিলবে। প্রতিবেশীর প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্পর্কে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে না পারলে অন্যদের প্রতি দোষারোপের কোনো সমাধান নেই।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে জাতিগত স্বাধিকারের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই ইতিহাস সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ জম্মু-কাশ্মীর প্রশ্নে একেবারে নিশ্চুপ রয়েছে। বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ককে জোরদার ও টেকসই করার উদ্দেশ্যে তার নিরাপত্তাগত চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু দৃশ্যমান সুসম্পর্কের নিচে যে অদৃশ্য ফাটল তৈরি হয়েছে, তার স্বীকারোক্তি মেলে ভারতের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের বক্তব্যে।
মেনন আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এনআরসি প্রসঙ্গে ২১ জুলাই বলেছেন, ‘যেভাবে এই গোটা বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে এই নিয়ে বিতর্কের সময়ে এবং সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় যা যা বলা এবং করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সংবাদমাধ্যমে তাঁদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। ভারতের বিভিন্ন সরকার ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ এবং গঠনমূলক সহযোগিতার কাঠামো তৈরি করেছে, তা যদি প্রভাবশালী ভারতীয় নেতাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক লাভের জন্য দেওয়া বিবৃতিতে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তা লজ্জার।’
শিবশঙ্কর মেনন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি যে সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই সরকারও সহযোগিতাকাঠামোর দুর্বলতার জায়গাগুলো অনুসন্ধান করেনি। বিজেপি সরকারের সেটা করার সম্ভাবনা যে নেই, তা মোটামুটি এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উগ্র রাজনৈতিক ধারায় সেটা যে সম্ভব নয়, ভারতের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা সেটুকু অন্তত উপলব্ধি করবেন, সেটাই প্রত্যাশা। মেননের উপলব্ধিকে তাই স্বাগত জানাতেই হয়।
#
কামাল আহমেদ
সাংবাদিক
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D