সিলেট ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১, ২০২০
|| মো. শফিকুল ইসলাম || ০১ অাগস্ট ২০২০ : করোনা ভাইরাসের প্রকোপে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক যোগাযোগ প্রায় থমকে আছে। তারই মধ্যে আমাদের জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে হবে। এটাই আমাদের বর্তমানের চ্যালেঞ্জ। যা সবাইকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প পথ নেই। সরকার চেষ্টা করছে এবং সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হল সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে সহযোগিতা করা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা চলমান।
করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের পাঁচ কোটি ছাত্র-ছাত্রীর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে রয়েছে চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল এপ্রিল মাসে, কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় এখনো পরীক্ষা শুরু করতে পারেনি সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে মনে করছে সাধারণ নাগরিকেরা। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের স্নাতকে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় তারা দীর্ঘ সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে। তাই আর অপেক্ষা না করে কোরবানি ঈদের পর যেকোনো উপায়ে পরীক্ষা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করছি। প্রায় ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা তাদের নির্ধারিত সময়ে দিতে পারেনি। প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষা দিতে না পারায় এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।
আমার ছোট বোন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তাই আমি বুঝতে পারি তাদের সময় কিভাবে পার হচ্ছে এবং কি দুশ্চিন্তায় পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনায় তারা তেমন মনোযোগ দিতে পারছে না। পরীক্ষার প্রস্তুতি ও পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় ছন্দপতন ও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমার বোনের জন্য পরীক্ষার আগে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিটি সাবজেক্টে আলাদা শিক্ষক ছিল। আইসিটি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সব বিষয়ে পুরো প্রস্তুতি নেওয়ার পর পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কোনোভাবেই না কমায় পড়াশোনা প্রায় এখন ছেড়ে দিয়েছে। পড়তে বসতে বললেও মোবাইল ফোনে গেমস খেলে। ফলে বোঝা যাচ্ছে যে ঘরবন্দি অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠেছে পরীক্ষার্থীরা। মূলত কিছু করার নেই, সেটা আমরাও বুঝি।
কেউ কেউ মনে করছেন আগে যে প্রত্যেক পরীক্ষার মাঝে দুই থেকে তিনদিন বিরতি ছিল, তা কমিয়ে এক দিন করে বিরতি দিলে সেশনজট কমতে পারে। কিন্তু সেটাও বাস্তবে কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু আমি মনে করি পরীক্ষার সময়সূচি দেয়া উচিত যাতে কোরবানির পর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক বা না হোক ঈদের পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু করা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষার্থীদের পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও থমকে আছে। আমি মনে করি আর সেশনজট না বাড়িয়ে বিকল্প মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। তাই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব এবং শিক্ষার্থীরা ঝুঁকির মধ্যে যাতে না পড়ে সেই ব্যাপারেও আমাদের সমাধান রয়েছে বলে মনে করি। ঈদের পর যদি আমরা পরীক্ষা না নি-ই তাহলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমাদের জন্য অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। তাই পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আমার তিনটি প্রস্তাব সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরলাম। যদি সরকার মনে করে তাহলে এই প্রস্তাবের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে পারে এবং পরীক্ষা পরবর্তী কার্যক্রমও চালু করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
প্রস্তাব-১: অনেক অভিভাবক মনে করছে অটো পাস দিয়ে পরীক্ষা শেষ করা যায়, কিন্তু বোর্ড পরীক্ষায় সেটা বাস্তবায়ন করা কিছুটা নীতিগত সমস্যা রয়েছে। যদিও ভারতে অটো পাস দিয়েছে। আমি ভিন্ন প্রস্তাবের কথা বলছি যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে কয়জন শিক্ষক পাঠদান করিয়েছে, তাদের নিকট থেকে ১০০ মার্ক স্ট্যান্ডার্ড ধরে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে মার্ক দেবে। ধরা যাক, ১৩ জন শিক্ষক ক্লাস নিয়েছেন। এই ১৩ জন শিক্ষক তাদের বিগত এক বছরের অভিজ্ঞতা, ধারণা এবং বিশ্লেষণপূর্বক নিরপেক্ষ ভাবে প্রত্যেক কোর্সের মার্ক প্রদান করবেন এবং ঐ সাবজেক্টে প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষায় যে মার্ক পেয়েছে তার রেকর্ড বের করতে হবে। পরে দুই ধরনের মার্কের যোগ করার পর যে গড় মার্ক আসবে, সেটাই হবে ঐ সাবজেক্টের ফলাফল। এভাবে সকল সাবজেক্টের মার্ক হিসাব করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জিপিএ বের করা সম্ভব। এতে আর কোনো পরীক্ষা নিতে হবে না।
প্রস্তাব-২: বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছি। তাই আমি মনে করি পুরো পরীক্ষাটি অনলাইনে নেওয়া যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট এক্সেস থাকতে হবে। এতে যে খরচ হবে আমার মতে একজন অভিভাবক সেইটুকু বহন করতে পারবে। কারণ স্বাভাবিক পরীক্ষার সময়ে কিন্তু একজন অভিভাবকের এর তুলনায় আরও বেশি খরচ হয়ে থাকে। তাই আমি মনে করি অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।
আমাদের শিক্ষার্থী হল ১৩ লক্ষ, তাই পরীক্ষার সময় অনলাইনে গার্ড দেওয়ার জন্য ৬৫০০০ শিক্ষক দরকার। কারণ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক বরাদ্দ থাকবে। এই সিস্টেমে জুম বা টেনসেণ্ট অ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে ভার্চুয়াল বা অ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষা সংক্রান্ত দুই দিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে। যাতে উভয়পক্ষ অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা অর্জন করতে পারে। এই সিস্টেমে প্রশ্নপত্র সংক্ষিপ্ত আকারে হবে এবং পরীক্ষা হবে ১ ঘণ্টার এবং ১৩ দিনে ১৩টি সাবজেক্টের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষার একদিন পূর্বে শিক্ষার্থীদের মেইলে যাবে এবং পরে শিক্ষার্থী উত্তরপত্র প্রিন্ট করে নেবে। আর প্রশ্ন শিক্ষার্থীর মেইল আইডি এবং মোবাইলে ৫ মিনিট পূর্বে কেন্দ্রীয় সিস্টেমের মাধ্যমে পাঠাবে। এক ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন করে উত্তরপত্রের ছবি তুলে ঐ সিস্টেমে জমা দেবে এবং হার্ড কপি সংরক্ষণ করে শিক্ষার্থীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেবে। পরীক্ষার সময় মোবাইল ক্যামেরার সম্মুখে তার ফেইস এবং লেখার হাত এমনভাবে রাখতে হবে যাতে শিক্ষক তাকে মনিটরিং করতে পারে। কোনো বড় ধরনের প্রশ্ন এবং অংক প্রশ্নে বড় অংক দেওয়া যাবে না। সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন হবে যাতে ১ ঘণ্টায় পরীক্ষা শেষ করা যায়। বন্যায় এই পদ্ধতি আরও বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করি।
প্রস্তাব-৩: গতানুগতিক ভাবে বিগত বছরের ন্যায় পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি মূল কেন্দ্র থাকবে এবং এর অধীনে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে সাবকেন্দ্র থাকবে। প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে সাবকেন্দ্রের আওতায় আরও কিছু ইউনিয়ন ভিত্তিক উপ সাবকেন্দ্র থাকবে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী যে জায়গায় বসবাস করছে সেখানে তার নিকটবর্তী স্কুল বা কলেজে পরীক্ষা নিতে হবে। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে না এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও সম্ভব। প্রশ্ন ও উত্তরপত্র যথারীতি অতীতের ন্যায় বণ্টন এবং পরীক্ষা সম্পন্ন করা যেতে পারে। অবশ্যই প্রতি প্রস্তাবে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন হবে এবং এ বিষয়ে কিছু পরিকল্পনা ও নির্দেশনা নেওয়ায় প্রয়োজন হবে।
#
মো. শফিকুল ইসলাম
পিএইচডি ফেলো, জংনান ইউনির্ভাসিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, উহান, চীন।
ও
শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D