জন্মদিনে ভালোবাসা শুভেচ্ছায় কৃতজ্ঞতা ❤

প্রকাশিত: ১২:০৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২০

জন্মদিনে ভালোবাসা শুভেচ্ছায় কৃতজ্ঞতা ❤

|| ফজলুল বারী || সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ২২ অাগস্ট ২০২০ : আমার আরেকটা বিব্রত দিন গেলো শনিবার। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত-বিব্রত হবার দিন। আমার বন্ধুদের সিংহভাগের গড় বয়স ১৮-২৫। কত পবিত্র তাদের ভালোবাসা যা শুধুই আমিই অনুভব করতে পারি। তারাই আমার নায়ক-নায়িকা-প্রিয় প্রজন্ম।

ফেসবুক আসার আগে এভাবে জন্মদিন টের পেতামনা। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা জন্মদিন আরেক কারনে টের পাই। আমাদের নানান সার্ভিস জন্মদিন তারিখ উল্লেখ করে  রেজিস্ট্রিকৃত। তারাই নানাভাবে এরা মনে করিয়ে দেয়, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
কিন্তু এখন বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আগষ্ট মাসে যাদের জন্ম তাদের জন্মদিন পালন করাটা বিব্রতকর। ১৫ আগষ্ট আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।
২১ আগষ্ট হত্যার চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। আইভি রহমান সহ অনেকে প্রান হারিয়েছেন খুনি তারেক নকশার সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায়। সেই হামলার শিকার কতো মানুষ এখনও দেহে বহন করে চলেছেন যন্ত্রনার স্প্রিন্টার।
সেই আগষ্ট মাসে জন্মদিন উদযাপন দৃষ্টিকটু।অমানবিক। তা স্বত্ত্বেও আমি আগষ্ট  মাসের ১৫, ২১ তারিখ বাদ রেখে প্রিয় প্রজন্ম অনেকের জন্মদিন পালন করি। লাকেম্বায় সবাইকে নিয়ে তিরিশ ডলারের একটা কেক কাটার অনুভবই আলাদা।
এখানে বাবা-মা স্বজনহীন সেই ছেলেটা বা মেয়েটার তাতে কি যে মিলিয়ন ডলারের আনন্দ অনুভব হয় তা বলে বোঝানো যাবেনা। এটা যে করি এরজন্যে যদি কেউ কষ্ট পান তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে তা অবশ্যই আমার জন্মদিন নয়।
মাঝে মাঝে কেউ না বলে সারপ্রাইজ দেবার নামে তেমন আয়োজন করলে তাতে খুব বিব্রত লাগে। এবার বাংলাদেশ থেকে গত কিছুদিন ধরে এক প্রিয় প্রজন্ম আমার একটি প্রোট্রেট ছবি চাইছিলেন। কেনো চাইছিলেন তা বুঝতে পেরে দেইনি।
কষ্ট পেয়েছে প্রিয় প্রজন্ম। কিন্তু আমার এতে যে বিব্রত লাগে সেখানে না হয় একটু কষ্টই দিলাম ভাই। আসলে এই শোকাবহ আগষ্ট ছাড়াও আমাদের শৈশবে আমাদের বাড়িতেও কখনও ভাইবোনদের জন্মদিন পালন করা হয়নি।
আমার আব্বা আমরা খুব ছোট থাকতে সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেন। এরপর স্থানীয় এক স্কুলের চাকরি-টিউশনির টাকায় সংসার চালাতেন। এমন এক সৎ পিতার কষ্টে চালানো সংসারে আমরা বড় কষ্টে মানুষ হয়েছি।
দেশে সাংবাদিকতার চাকরি যখন করতাম মাসে ২ হাজার টাকা বাড়িতে দিতাম। এখন বিদেশে সুযোগ পেলেই অনেক ঘন্টা কাজ করি বলে অনেক বেশি দিতে পারি। কিন্তু আমাদের স্বচ্ছল জীবনটা আমার আব্বা দেখে যেতে পারেননি।
এখন অন্য কোন জমি-সম্পদের বিরোধ নয়, লেখালেখির কারনে আমার অনেক বন্ধু অনেক শত্রু। অনেকের মতো অনেক কিছু লুকোছাপা করে লিখতে পারিনা। অনেকের অনেক প্রতিভাও আমার নেই। প্রতিভাবানদের বেশিরভাগ এখন দেশে টাকার কুমির।
সেই প্রতিভাবানদের ছিঁচকে টাইপের যারা এখন নিজেদের দেশের মা-বাপ মনে করেন তাদের কেউ কেউ লেখা পছন্দ না হলেই প্রায় এই করবো সেই করবো বলে হুমকি দেন! এমন হুমকিদাতাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সরকারি চাকুরেও আছেন।
অফিসিয়েল বেতনও আমাদের কুড়ি-ত্রিশ ঘন্টা আয়ের বেশি হবেনা। আবার কেউ কেউ মনে করেন ফেসবুকে বসে অমুক তমুককে হুমকি দেয়াই তাদের চাকরি! এসব শিশুতোষ হুমকিদাতারা শুধু আমাকে না, একসঙ্গে অনেককে হুমকি দেন!
যেমন, আওয়ামী লীগ করা কে কে আমার বন্ধু তালিকায় আছে দেখে নেয়া হবে, এই বলেও তাদেরও হুমকি দেয়া হয়! অরাজকতা ছাড়া এমন একেকজন নিজেদের কী মাপের সার্টিফিকেটদাতা ভাবতে শুরু করেছেন বুঝতে পারেন?
এসব দেখেশুনে হাসিও পায়। কারন দেশে থাকতেও আমি অনেক নিভৃতচারী ছিলাম। এদের চিনতামনা অথবা সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস ছিলোনা। একবার এক হুমকিদাতার বিষয়ে জানতে চাইলে বলা হয়, ভাই এটা বেশি জুনিয়র ভাই।
আপনাকে চিনলে-জানলে এভাবে বলতোনা। এরপর তার চাকরি পাবার যোগ্যতা শুনে চমকে উঠি। প্রতিবার আমার ফেসবুকীয় জন্মদিনের কিছু প্রতিক্রিয়া দেখে হাসিও পায়। বিশেষ কিছু ভালোবাসার মুখ ইনবক্সে এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা লিখে যান।
ওয়ালে এসে যেন কিছু লিখতে ভয় পান! সেই যে চিহ্নিত হবার ভয়! তাকে  তাদেরকে আমি দোষও দেইনা। যার মর্যাদা আছে সেইতো মর্যাদা রক্ষা নিয়ে চিন্তায় থাকে। কাজ যে কাউকে টিকিয়ে রাখে। তাবেদারি নয়।
জন্মদিনে যারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যারা জানাতে পারেননি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসা। আপনাদের সবাইকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমরা যে যেখানে আছি যার যার সামর্থ্যমতো আমাদের দেশের জন্যে কাজ করে যেতে হবে।
একজন একজনকে হেল্প করলেই চলবে। আমাদের দেশের একটা তরুন ছেলে বা মেয়েকে যদি তার হাত ধরে একটু এগিয়ে দেয়া যায়, এরসঙ্গে একটি পরিবারও এগিয়ে যায়। দেশে থাকতে আমি এক কাজটাই করার চেষ্টা করতাম।
আমার কাছে যারা সাহায্যের আশায় দেখা করতে আসতেন, তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিতে কখনো হয়তো একটা ফোন কিনে দিতাম। বসুন্ধরা সিটির দোকানগুলোয় তখন পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে সংযোগ সহ নকিয়ার ফোন সেট পাওয়া যেত।
অনেক যুবকের কাছে তখন একটা ফোন ছিল স্বপ্নের মতো বিষয়। অথবা ভালো কিছু কাপড়-জুতো। তেমন কিছু উপহার তার হাতে তুলে দিলে তার নিজের প্রতি আস্থা-উদ্যম তা বিপুল বেড়ে যেত। ফোন হাতে নিজেকে ব্যক্তিত্বপূর্নও মনে করতো।
এমন একটু সাহস দেয়া সেই ছেলেমেয়েদের প্রায় সবাই এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এখন অস্ট্রেলিয়ায় গত এক যুগ ধরে এই সাহস দেবার কাজটাই করি। একটু সঙ্গ-বন্ধুত্ব দেয়া, কাউন্সিলিং করা, গাড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ব্যাস!
এভাবেই অনেক সময় আমাদের আড্ডায় অনেকের প্রথম চাকরিটাও হয়ে যায়। এরপর আড্ডার টেবিল থেকে কৌশলে সরে দিয়ে দেশে অপেক্ষমান প্রেমিকাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় বিপুল সাহসের ঘোষনা, ‘চাকরিটা আমার হয়ে গেছে শুনছো, আর কেউ আমাকে আটকাতে পারবেনা’।
এরপর প্রথম রোজগারটি মায়ের কাছে পাঠালে সেই মা যে আনন্দ কৃতজ্ঞতায় কাঁদেন আর দোয়া করেন! এভাবে যে কাউকে প্রথম একটা মাস একটু সময়-সঙ্গ দিলেই চলে। এরপর তারা তখন নিজেরাই হাঁটতে চলতে শিখে যায়।
সারা বাংলাদেশের এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের বেশিরভাগ এমন ছেলেমেয়েরাই মূলত সারাদিন আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় ভাসিয়েছে। তারা যোগ্য। তারা কাজ চায়। যতক্ষণ এই দেহে প্রান আছে ততক্ষণ তাদের জন্যে কিছু করার চেষ্টা করে যাবো।
প্রিয় প্রজন্ম, জন্মদিনে তোমাদের কাছে এই আমার অঙ্গীকার। যখন আমি থাকবোনা তখন শুধু লিখবে তোমাদের মাধ্যমেই আমি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশটাকে ভালোবাসতাম। জয় বাংলা।