বাংলার বাউল আখড়া

প্রকাশিত: ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৬, ২০২০

বাংলার বাউল আখড়া

বিশেষ প্রতিনিধি || ০৬ অক্টোবর ২০২০ : মাঝে মাঝেই ভাবি আউল-বাউল, ফ্যাকরা-ফকির, সাঁই-দরবেশ, ভৈরবী বৈষ্ণবী, সহজিয়া-মরমিয়াদের ভাবের রাজ্যে যদি কিছু সাধারণ অনুসন্ধিৎসু, ভূতে পাওয়া মানুষজনদের প্রবেশ না ঘটত তবে বাংলার দেহবাদী কায়া সাধনার নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত সাধক সম্প্রদায়ের সাধন ধারা, দেহতত্ত্ব ও সাধন নির্দেশের মধুস্রাবী সঙ্গীতের কী দশা হতো! সবই তো হারিয়ে যেত গ্রামের গহনে। ভাগ্যিস বাঙালি বিদ্বৎসমাজের কারও কারও গ্রাম ঘোরার বাতিক ছিল। আর ছিল পরিমণ্ডল ঢুড়ে এইসব সাধন সম্প্রদায়ের অনুসন্ধান করবার মতো একটা মন। যে মন উদাসীনের বিচিত্র ভুবনের ডাকে সারা দিয়ে পুথিপড়া লোক সংস্কৃতিচর্চার আড়াল ধসিয়ে সরাসরি বেড়িয়ে পড়তে পারে গ্রামদেশে এইসব উপাসক সম্প্রদায়ের সন্ধানে। বিদ্বৎসমাজ যাকে ‘লোকায়ত ধর্ম’ বা গৌন ধর্মের স্রোত বলে করেই পৃথক করে রেখেছে। তবে এ কাজটি বাঙালি করবার আগে করে গিয়েছিলেন এক বিদেশী। তিনি উইলসন সাহেব। ভারতীয় ধর্ম সম্প্রদায়গুলোকে তিনি ১৮ টি ভাগে ভাগ করে পথ প্রদর্শকের কাজটি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ১৮৬২ সালে। এর আট বছর বাদে অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়কে এমন এক উপমুখ্য সম্প্রদায়ে ভাগ করে দেহবাদী কায়াসাধনার বৃত্তান্ত পেশ করলেন যেখান থেকে বেড়িয়ে আসলে গ্রাম্যভূমির লোকায়ত যাপনের হদিশ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি উৎসাহ দেখাল জমিদারী এলাকাভুক্ত কুষ্টিয়ার সাধক লালন ফকির সাঁইকে নিয়ে। সাঁইজি অবশ্য ঠাকুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে বেরোনো প্রবাসী পত্রিকার হারামণি বিভাগে ঠাই পাওয়ায় আগেই শরীরে থাকার সময়েই হরিনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়দের মতো বাঙালি বিদ্বজনের নজরে পড়েছেন। যেমন উইলসন সাহেবের কত আগে ১৮০২ সালে শ্রীরামপুরের মিশনারী উইলিয়াম কেরির নজরে পড়েছিল নদিয়ার কুষ্টিয়ার মতো আরেক এলাকা ঘোষপাড়া। যেখানকার কর্তাভজা ধর্ম ও ধর্মগুরু দুলাল চাঁদ ও সতী মা তাঁদের একেশ্বরবাদের কায়া সাধনা দিয়ে মিশনারীদের নজর কেড়েছিলেন। ধর্মান্তকরণের স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে তাই কেরি, মার্শম্যানরা তখন ঘোষপাড়া যাতায়াত করছিলেন। তবে উইলসন সাহেবের কোনো স্বার্থবুদ্ধি ছিল না। Religious sects of the Hindus’ ছিল আদতে একটি অনুসন্ধিৎসার ফসল।

১৮৭০ সালে বেরোনো অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ও তেমনই এক মৌলিক গবেষণার নজির। এরপরই বলতে হয় ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর কথা। যিনি বীরভূমের বাউলদের আচরণবাদকে দেখেই ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করলেন বাংলার বাউল’ নিয়ে। বাউলিয়া তত্ত্ব বলা ভালো সেই প্রথম বিদ্বৎসমাজে উঠে এল। অক্ষয়কুমার দত্তের সমপর্যায়ের আরেক মানুষ হলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তিনিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আর এরপর বাউল গবেষণা যার হাতে সর্বপ্রথম বৃহৎ আকারে আকরগ্রন্থ হিসাবে উঠে এল তিনি কুষ্টিয়ারই সন্তান উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ১৫০০ বাউল গান।

কুষ্টিয়ার আরেক কৃতী, বাংলাদেশের প্রখ্যাত লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীও। বর্তমানে অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসাবে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন এ বঙ্গে শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী। ওপার বাংলার আহমদ শরীফও বাউল তত্ত্ববিদ হিসাবে সমধিক পরিচিত। এ প্রসঙ্গে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও উল্লেখ্য। ঠিক যেমন এখানে ১৯৬৬ সালে বঙ্গীয় লোক সঙ্গীত রত্নাকর সম্পাদনা করে আশুতোষ ভট্টাচার্য এক অনন্য নজির গড়েছেন। এই। সমস্ত নজিরের পেছনেই রয়েহে আসলে উদাসী মন। না হলে ভাববাদী কায়া সাধনার এলাকাতে চলাফেরা করা বেশ শক্ত।

প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রশিল্পী। ঘর ছাড়লেন মনে উদাসীনের ওঠাপড়ায়। না হলে তন্ত্র বিষয়ে কালজয়ী গ্রন্থখানি লেখাই হতো না। সাধক নিগমানন্দ তাঁর সাধন উপলব্ধ জ্ঞানে লিখলেন ‘তান্ত্রিক গুরু’। পণ্ডিত প্রবর গোপীনাথ কবিরাজ বেনারসে সাধু মহাত্মাদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন বলেই লেখা হয়েছিল ‘সাধু দর্শন ও সৎ প্রসঙ্গ তাঁর তন্ত্র বিষয়ে তাত্ত্বিক গবেষণাও এখানে উল্লেখ্য। শক্তিনাথ ঝাঁ সেই কবেই আউলিয়া-বাউলিয়া সঙ্গে আখড়াবাসী হয়েছেন। বাউল ফকির সংঘের সভাপতিও তিনি।

রাজশাহীতে জন্মেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র রায়। গ্রামে ছিল বৈরাগীপাড়া। মরমিয়া বাদের ছোঁয়া লাগল মনে তাঁর সেখান হতেই। এরপর এপার বাংলায় আসার পর সেই বৈরাগী ছোঁয়া আরও যেন পরিধি পেল। তিনি চলে এলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়ার ঘোষপাড়া, জয়দেবে, পাথরচাপুড়িতে, দুবরাজপুরে, বর্ধমানের বৈরাগীতলার মেলায় বাউল ফকিরদের সান্নিধ্যে। এসে পড়লেন দ্বন্দ্বে। যে দ্বন্দ্বে আমিও পড়েছিলাম ২০০০ সালে শুরুর সময় মেলায়-আখড়ার বৈষ্ণবীয় বহরে। বৈরাগীতলা, জয়দেব, সোনামুখী, রামকেলী সবই বৈষ্ণবীয় সাধকদের নামে জমায়েত। অথচ ভিড় বাউলদের। এই দ্বন্দ্বের ভেতরে সুধীর চক্রবর্তীও পড়েছিলেন। তাঁর প্রচারিত গ্রন্থ ‘বাউল ফকির কথা’তে বাউল আর বৈষ্ণব বিভাজন নিয়ে একখানি অধ্যায়ই আছে লালনশাহী মতের সাধক দুদ্দুশাহের বিভাজন রেখাকে নামিত করে।

প্রশান্তচন্দ্রও দ্বন্দ্বে পড়ে যার উল্লেখ রেখেছনে—‘বাউল বৈষ্ণবধর্ম এক নহে তো ভাই/ বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই/ বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ/ তুলসীমালা অনুষ্ঠান সদাই/ বাউল মানুষ ভজে,যেখানে নিত্য বিরাজে/ বস্তুর অমৃত মজে, নারী সঙ্গী তাই।’ সহজিয়া বৈষ্ণবতায়ও নারী বা সাধন সঙ্গিনী অনিবার্য। এই সাধনধারাও বাউল মতের ‘বস্তুর’ই সাধনা। কায়াবাদী সাধকরা তো বস্তুহীন নন। শরীরের বর্জ্য ও রজ-বীর্য নিয়েই তো তাঁদের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদ। বাউলের সিংহভাগ সাধন সঙ্গীতও তো এই আচরিত পথ ও পন্থা নিয়েই। দুদ্দু শাহ তাঁর মধুস্রাবী গানে বাউলের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদের অনেক কিছুই স্পষ্ট করেছেন। তাঁর গানে দেহকেন্দ্রিক আচরণের আধিক্যই বেশি। তিনি তন্ত্রাচারী ফকির বাউলের আচরণও গানে ব্যক্ত করেছেন আবার বাউল বৈষ্ণবের সাজুয্যের আচরণবাদকে পৃথক করতে নিদান হেঁকেছেন। তাঁর এই হাঁকাহাঁকিতে অবশ্য নদিয়া-রাঢ়ের বাউলেরা নেই। নদিয়া রাঢ় দুই ভূমিতেই বৈষ্ণবীয় আচরণবাদের দাপট। স্বভাবতই তা বাউলে মিশেছে। বাউলরা সাধন সঙ্গিনীকে ‘বোষ্টুমী’ বলেও ডাকাডাকি করছেন। লালন শাহের ‘চরণদাসী’ হওয়ার আশায় এ পথের মেয়েরাও তাই অনেক বাউল সাধকের কথকতায় ‘বৈষ্ণবী’ হয়ে উঠেছেন। অথচ বাউলের সাধন সঙ্গিনী ‘চরণদাসী’ হওয়ারই উপযোগী সাধনের গোপ্য ধারায়–নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা/ মায়েরে ভজিলে হয় তাঁর বাপের ঠিকানা। এই ঠিকানায় সন্ধানী মেয়েরা বাউলপথে ‘চরণদাসী’ হলেও সাজুয্যের বৈষ্ণবতায় ‘বোষ্টুমী’ হয়ে বসেছেন কোথাও কোথাও। লীনা চাকী এঁদের নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন। বাউল মেয়েদের মনের কথা জেনে লিখে ফেলেছেন ‘বাউলের চরণদাসী। বাউল বৈষ্ণবের সাজুয্য ধারায় কোথাও হয়েছেন আবার ‘বৈষ্ণব বাউল। এসব দ্বন্দ্বখেলায় সুধীর চক্রবর্তী যেমন পড়েছেন, পড়তে হয়েছে মরমিয়াবাদের সন্ধানী সকলকেই। প্রশান্ত চন্দ্র রায় সত্তর দশকে সেই দ্বন্দ্বমেলায় পড়েছিলেন। সালতামামির আখড়া মেলাতে ঘোরায় তিনি সুধীর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝাঁ-দের সমসাময়িক প্রশান্তচন্দ্র লিখেছেন, ‘মালা তিলক কষ্ঠীধারী বৈষ্ণবএর সাথে মানুষভজা বাউলের পার্থক্য এতটাই যে বাউলরা বস্তুবাদী, বস্তু অর্থে শুক্র, জীবন রস।

সহজিয়া বৈষ্ণবদের অনেক ধারা। পাটুলির স্রোত, বীরভদ্রের স্রোত, নিত্যানন্দের স্রোত, রূপকবিরাজী স্রোত। সব স্রোতেই কলমি পুঁথি আছে। আছে রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্বের কথা। কৃষ্ণ মানে ভগবান নন, মানুষ। কৃষ্ণ মানে যিনি কর্ষণ করতে পারেন। কৃষ্ণ হলেন ক্ষেত্রজ পুরুষ। যিনি বীজ বুনতে পারেন। বীজ মানেও কৃষ্ণ, অর্থাৎ বিন্দু বা বাউলের বস্তু। রাধা হলেন ক্ষেত্র অর্থাৎ কিনা সাধন সঙ্গিনী, বোষ্ট্রমী। বাউলের চরণদাসী। তাই সহজিয়া বৈষ্ণবরাও এক অর্থে বস্তুবাদী। চৈতন্য এই এলাকায় শরীরের চেতনসত্তা, চৈতন্যদেব নন। দুদ্দুশাহ বৈষ্ণবীয় গুপ্ত কড়চার কথা যে জানতেন তাঁর মস্ত প্রমাণ গানে সাধনতত্ত্বের ব্যবহার। দুদ্দু গুরু লালন সাঁইয়ের মতো নিরক্ষর ছিলেন না। তিনি পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরবি ফারসি ভাষা ও ইসলামি তত্ত্বের পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর গ্রাম হরিশপুরে বৈষ্ণব ধর্ম এবং সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা ছিল। লালন ঘরানার এই সাধকের গান পড়লেই তাঁর বিদ্যাচর্চা সহজেই অনুমেয়। দুদ্দুর গান ও রচিত গ্রন্থ ছিল। সেগুলো অমুদ্রিত থাকায় দুর্লভ। শক্তিনাথ ঝাঁ ২০১২ সালে দুদ্দুশাহের ২১৪টি গান অর্থ সংকেত সহ গ্রন্থনা করেছেন।

এর অনেক আগেই বাংলা একাডেমী, ঢাকা থেকে প্রকাশ পেয়েছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় ‘বাউল গান ও দুদ্দু শাহ’ গ্রন্থখানিপ্রশান্তচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত ও সংকলিত গ্রন্থ ‘সহজিয়া সাধন সঙ্গীত’ এ দুদ্দুর গান রেখেছেন, তবে লালন ঘরানার আরেক মরমিয়া পাঞ্জু শাহের গান সংকলনভুক্ত হয়নি। পাঞ্জুর জীবিত কালেই তাঁর রচিত গান ও গ্রন্থ ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহহার প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে। প্রশান্তচন্দ্র যে আখড়ায় নাড়া বেঁধেছিলেন সেই কেন্দুলি তমালতলার সুধীর বাবার ওখানে সন্ধেবেলার দৈন্যগানের আসরে সাঁইজি, দুদ্দু ও পাঞ্জুর গান হতো। লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনে থাকলেও গুরুকুলের পাঞ্জু শাহের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

প্রশান্তচন্দ্রের মূলত ওঠাবসা রাঢ়বঙ্গের বাউলের সঙ্গে। সুধীর খ্যাপার আখড়াই তাঁর মহাজনী পদ শোনা ও সংগ্রহের প্রধান জায়গা। এখানেই তাঁর রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে সান্নিধ্য। সে বিবরণ তিনি নিজেই দিয়েছেন তাঁর লেখা ‘বাউলগান ও ভাবসংগীত’ গ্রন্থখানিতে–’কেঁদুলি গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটতে শুরু করে। বোলপুরের ভাবসাগর বিশ্বনাথ দাস, বাঁকুড়া খয়েরবনীর সনাতন দাস, গৌর খ্যাপা, পবন। দাস, জয়দেব কেঁদুলির শান্তিরঞ্জন, বাঁকাশ্যাম দাস, লক্ষ্মণ দাস, তারকেশ্বর দাস, লক্ষ্মণ দাস(পূর্ণদাসের মেজোভাই), রাধারানি দাস(পূর্ণদাসের দিদি)। এঁদের সকলকেই তিনি তাঁর কর্মস্থল চিত্তরঞ্জনে গান শোনানোর জন্য নিয়ে গেছেন। তবে বোলপুরের প্রবীণ বাউল দেবীদাস, জয়দেবের তারক খ্যাপা, খ্যাতিমান শান্তদাস বাউল, রামপুরহাটের কানাই বাউলের অনুল্লেখ এখানে চোখে পড়ারই মতো। যেমন গৌরখ্যাপার সাধন সঙ্গিনী দুর্গা খেপী ও আহমেদপুরের ফুলমালা দাসীর কথা অনুল্লেখ রাখলে রাঢ়ের মরমিয়া সাধনার কথা অসম্পন্ন রয়ে যাবে। আর দু’জন সোনামুখী বাঁকুড়ার হরিপদ গোঁসাই ও নির্মলা মা।

প্রশান্ত রায় লিখেছেন, ‘বাউল তত্ত্ব দর্শন ও গানের কথা’ নিয়ে দুই বাংলার পণ্ডিত গবেষক অনেক গ্রন্থ লিখেছেন অনেক গবেষণাও হচ্ছে কিন্তু বিশেষ করে বাংলাদেশের গবেষকরা লালন ফকিরকে নিয়েই বেশি কাজ করেছেন, অবিভক্ত বাংলার বিশেষ করে রাঢ় বাংলায় যাদুবিন্দু, পদ্মলোচন, নিতাই খ্যাপা, রাধাশ্যাম দাস, মদন নাগ, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়(কণ্ঠমশাই), পীতম্বর দাস, হাউড়ে গোঁসাই, গোঁসাই প্রেমানন্দ, কোঠরে বাবা, গোঁসাই নরহরি প্রভৃতি অনেক মহাজনের গানের কথা বাংলাদেশের পণ্ডিত গবেষকদের পুস্তকে খুব একটা নজরে পড়ে না।

লালন ফকির সাঁই দুই বাংলাতেই পপুলার কালচার। তাই তাঁকে নিয়ে চর্বিত চর্বন চর্চা বেশি। বসন্তকুমার পালের প্রথম লালন জীবনী ‘মহাত্মা লালন ফকির’ ১৯৫৫ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকুল্যে বেরোনোর পর প্রামাণ্য লালনচর্চা বলতে সুধীর চক্রবর্তীর ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ ও শক্তিনাথ ঝাঁয়ের ‘ফকির লালন সাঁই দেশ কাল এবং শিল্প’ এ বিষয়ের পুরোধা আবুল আহসান চৌধুরী। তাঁর ‘কুষ্টিয়ার বাউল’ গ্রন্থখানিও মরমিয়া আলোচনায় প্রনিধানযোগ্য।

লালনের পাশাপাশি আবুল আহসান কাঙাল হরিনাথকে নিয়েও এখন কাজ করে চলেছেন। বাংলা একাডেমীর সহ পরিচালক সাইমন জাকারিয়া লিখেছেন ‘উত্তর লালনচরিত’। তাঁর বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাধক শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবর্ষ পালন হল সিলেট শহরে। আয়োজকদের ডাকে সাড়া দিয়ে সংকলন স্মরণিকায় করিমের গান নিয়ে সে সময় লিখবার সুযোগ ঘটেছিল। রাঢ়ের আখড়ায় করিম প্রচলিত। প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনে তাঁর উপস্থিতি নেই। হাওর ভাটি অঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুড়ে হাওরের বিস্তার। আর ভাটি পুরুষ করিম, দুর্বিন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণ, আরকুম শাহ, পাগলা কানাই, শিতালং শাহ, করিম শাহরা এপারের আখড়াবাড়িতে পরিচিত। রাঢ়ের কিংবদন্তি সনাতন দাস মঞ্চে উঠলেই দুর্বিন শাহ গাইবেন না এ হতে পারেনা। রাঢ়ের সাধুসঙ্গের উদাসীন প্রশান্তচন্দ্র কেন ভাটির সাধকদের গান সংকলনভুক্ত করলেন না এটা আশ্চর্যের। অথচ গ্রন্থটিতে দু’কলম ভূমিকা আছে ভাটিপুরুষ খালেদ চৌধুরী। প্রশান্তচন্দ্র ঠিকই লিখেছেন, রাঢ়ের সাধক বাউলদের পদ ওপারে কম প্রচলিত। এর প্রধান কারণ কিন্তু গ্রন্থনা। এ বঙ্গে একটি লালন সমগ্র নেই পপুলার কালচার হয়েও। কুবিরের গান অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করেছেন সুধীর চক্রবর্তী। শক্তিনাথ ঝাঁ সংগ্রহ করেছেন রাঢ়ের অনন্ত, গুরুচাঁদ, রাধাশ্যাম গোস্বামীদের গান। মুর্শিদাবাদের বাউলদের আচরনবাদ ধরা রয়েছে তাঁর ‘বস্তুবাদী বাউল’ গ্রন্থখানিতে। বর্ধমানের যাদুবিন্দু, কোটার অনুরাগী সাঁই, বৈরাগীতলার রাধাপদ গোস্বামী, মুর্শিদাবাদের মনমোহন দাস, শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য সহ উল্লেখ্য সাধক মহাজনদের পদও তিনি গ্রথিত করেছেন ‘বাউল ফকির পদাবলি’তে।

বাংলাদেশের চিত্রটা কিন্তু এমন নয়। সেখানে শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, মছরু পাগলা, দ্বিজদাস, দীন শরৎ, আরকুম শাহ, পাগলা কানাইয়ের মতো উল্লেখ্য মহাজনদের সমগ্র বের হয়েছে। তাই সাধুগুরুর গান। সংগ্রহে ওপার বাংলা অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশে আমার ‘বাউলগানের কথকতা’, ‘দেহসাধনায় যৌনতা’ বইদুটি রমরমিয়ে চলার পর এবছর যখন একুশে গ্রন্থমেলায় ঢাকা থেকে বের হল পশ্চিমবঙ্গের বাউল তখনই যোগসূত্রের বহর আরও বেড়ে গেল। ওখানকার সুমনকুমার দাশ, সৈয়দা আঁখি হক, বঙ্গ রাখাল, পার্থ ঠাকুরের মতো আমার বয়সীরা মরমিয়াবাদ নিয়ে অকল্পনীয় সব কাজ করছেন। তাই বাংলাদেশে বাউলিয়া চর্চা এখন আর কোনও মতেই লালনচর্চাতে থেমে নেই। বরং এপার বাংলাতেই কাজের ঘাটতি রয়েছে।

রাঢ়ের প্রাচীন বাউল অনন্ত গোঁসাই। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে ওঁর পদ গ্রথিত করেন। এরপর শক্তিনাথ ঝাঁ। প্রশান্তচন্দ্র রায় অনন্ত গোঁসাই ও রাধাশ্যাম দাস–এই দুই রাঢ়ের বাউলের পদ সংকলিত করেছেন। রাঢ়ের সাধক বাউলদের মধ্যে অনন্ত গোঁসাইয়ের পর রাধেশ্যাম দাসের যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। তাঁর গুরু হলেন আহমদপুরের গুরুচাঁদ গোস্বামী। ফুলমালা দাসী আমাকে ওঁর আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাধেশ্যামের ‘অজ্ঞান তিমির হে গুরু নাশ করো জ্ঞান অঞ্জন নয়নে দাও’–এই গানখানি দিয়েই রাঢ়ের বর্তমান বাউলেরা আসর বন্দনা সারেন। নদিয়া, মুর্শিদাবাদেও রাঢ়ের এই দুই মহতের পদ গাওয়া হয়ে থাকে। অনন্ত গোঁসাইয়ের ছেলে হলেন অত্রুর গোঁসাই। নবনী দাসের বাবা। পূর্ণদাস, লক্ষ্মণ ও রাধারানি দাসী এই বংশধারারই বাউল। রাঢ়ের আরেক মহৎ যাদুবিন্দু। তাঁর গুরু নদিয়ার সাহেবধনী সম্প্রদায়ের কুবির গোঁসাই। বর্ধমানের পাঁচখালিতে যাদুবিন্দুর সমাধি আছে। ওর নাতি দেবেন গোঁসাইএর কাছ থেকে সুধীর চক্রবর্তী যাদুবিন্দুর গানের খাতা পেয়েছিলেন। প্রশান্তচন্দ্র যাদুবিন্দুর পদ রেখেছেন গ্রথিত সংকলনে।

পদ্মলোচন বা গোঁসাই পোদোও রাঢ়ের প্রাচীন বাউল। উপেন্দ্রনাথ, সুধীর চক্রবর্তী ওঁর গান সংগ্রহ করেছেন। রাঢ়ের আসরে অনিবার্য পদ্মলোচন। প্রশান্তচন্দ্র রাঢ়ভুক্ত আখড়ার মানুষ বলেই তাঁর গ্রন্থনায় পদ্মলোচনকে রেখেছেন।

বর্ধমানের নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব সমাধিস্থ হতেন একথা ‘কথামৃতে’ আছে। সুধীর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝাঁ কেউই এই মহতের গান গ্রথিত করেননি। প্রশান্তচন্দ্র রাঢ়ের আখড়া থেকে নীলকণ্ঠের গান সংগ্রহ করেছেন।

হাউড়ে গোঁসাইও নামি পদকর্তা। তন্ত্র, বেদপন্থা অবলম্বন করে শেষমেশ তিনি সনকানন্দ স্বামী। উপেন্দ্রনাথ তাঁর গান রেখেছেন। শক্তিনাথ, সুধীর চক্রবর্তী, প্রশান্তচন্দ্রও তাঁর গান গ্রথিত করেছেন।

হাওরের বিশিষ্ট মরমিয়া দীন শরৎ। বাংলাদেশে তাঁর গান নানাভাবে গ্রথিত হয়েছে। পার্থ ঠাকুরের ‘দীন শরৎ বলে’ গ্রন্থখানি এবারই একুশে গ্রন্থমেলাতে বের হয়েছে। সুমনকুমার দাশ এবছর বাংলাদেশের চোদ্দ মহতের একশোটি করে গান গ্রথিত করেছেন। দীন শরৎ তাঁর অন্তর্ভুক্ত। নদিয়া ও রাঢ়ে দীন শরতের গান যথেষ্টই চর্চিত। স্বভাবতই প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনেও তাঁর জায়গা হয়েছে।

বিশ শতকে রাঢ়বঙ্গে সম্মাননীয় সাধক ও পদকর্তা সনাতন দাস। বাঁকুড়ার সোনামুখির খয়েরবুনি যাননি মরমিয়াবাদের অনুসন্ধিৎসুরা এ হতে পারেনা। পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট জনপ্রিয় তিনি। ১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন লালন পুরষ্কার। রেডিয়ো, দুরদর্শনে। নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। দেশ বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। বাদবাকি সময় খয়েরবুনির নিমগ্ন সাধক। ঋত্বিক ঘটকের ছেলে ঋতবান ওঁর ওপর তথ্যচিত্র নির্মান করেছেন। একুশ শতকের প্রচারের আলো মাখা পার্বতী দাস বাউল ওঁরই শিষ্য। ৯২ বছর বয়সে চলে গেছেন তিনি গতবছর। তাঁর এই চলে যাওয়াতে বাউল সাধনার একটি যুগের অবসানই হল বলা চলে। অনন্ত গোঁসাই থেকে সনাতন দাস–রাঢ়ের এই গুরুত্বপূর্ণ পরম্পরা। তমালতলার সুধীর বাবার আখড়ায় বসে প্রশান্তচন্দ্র রায় যার অনেকখানি অবলোকন। করেছেন। তাঁর একটুকরো ভূমিকাতে এবং দশ মহাজনের সংকলিত পদ সহ তিনশো। পদের তিনি গীতি নির্দেশও দিয়েছেন। সেসব এলাকায় বাউলের গুহ্য সাধনার বিষয়টি তিনি শুনে, বুঝে বলবারও চেষ্টা করেছেন দু’এক লাইনে। গুরুবস্তু, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চাঁদের গায়ে চাঁদ এসব গোপন দেহতত্ব তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন বাউল সাধকদের কাছে। আর এখানে কিছুটা ফাঁক রয়ে গেছে। সেকথা নিজেই প্রশান্তচন্দ্র বলেছেন, ‘যেহেতু আমি তাঁদের সমাজের দীক্ষিত নই সে কারণে কিছু কিছু গোপনীয়তাও তাঁরা রক্ষা করেছেন।’

এই গোপনীয়তা মরমিয়াবাদের বৈশিষ্ট্য। সাধক কখনও শিষ্য বা বায়েদ ছাড়া দেহতত্ত্ব প্রকাশ করবেন না। তবে বায়েদ ও সাজা বাউল হরহর করে বলতে থাকেন। দেহতত্ত্ব। যার অনেকটাই ভুলে ভরা। অনুমান, লোকসাধনা বর্তমানের সাধনা। আমার গুরুকরণের আগে হেথাহোথা ঘুরছি ভেতর বাড়ির মানে জানতে। নবাসনের নির্মলা মা সার বলেছিলেন আমায়, ‘আগে সাধনে আয়, সব বলব তোরে।’ আমার গুরুজি বলেন, ‘সাধন বর্তমান। সাধন করে দেহতত্ত্ব বুঝতে হয়। দেহসাধনার অনুভূতি বাপ আমার, প্রমাণ। এটা অনুমানের ধর্ম নয়।’ আর এই বর্তমানে না এলে কিছু ভুলত্রুটি থাকে। যেমন অনেক বাউল গুরু আর বায়েদ বলেন ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ হল পুরুষ প্রকৃতি মিলন। প্রশান্তচন্দ্র ‘গীত নির্দেশ’ অংশে তাই-ই লিখেছেন। তবে লালনশাহী ঘরানা ও কুষ্টিয়া মতাদর্শে চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অর্থাৎ কিনা গুরু-শিষ্যের মিলন হচ্ছে। গুরু শিষ্যিকে নির্দেশ দিচ্ছেন, টানছেন যেন চুম্বকদণ্ডের মতো। শিষ্য সেই প্রতিধর্মের লৌহকনিকা। লেগে যাচ্ছেন গুরুর গায়ে। অর্থাৎ কিনা গুরুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন শিষ্য বাউল। সাধন এলাকার এই মার্গ নিয়ে তাই আমাদের ভাবনার কিছু নেই–’চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি?’

প্রশান্তচন্দ্র গুরুমার্গকে অনুধাবন করে নিজে পদও লিখেছেন বেশ কিছু। বাউলের দেহতত্ত্ব ও মরমিয়াবাদের ভাব এসব গানের মূল বিষয়। তিনি বাউল স্বভাবী বলেই এসব গানে অনেক সাধন আধারই মিশেছে। আমার আপশোষ, এমন মানুষের সঙ্গে আলাপ হল না। তিনি চলে গেলেন সাঁইজির দেশে।