সিলেট ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:১৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৪, ২০২০
সৈয়দ অামিরুজ্জামান || ১৪ অক্টোবর ২০২০ : দীর্ঘদিন যাবৎ পাটকলের শ্রমিকেরা রাজপথে অান্দোলন করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের আধুনিকায়ন, না ধ্বংস সাধন? পাটখাত সুরক্ষায় অামাদের ভাবনা ও সরকারের করণীয় কী হওয়া উচিত? এ নিয়ে এক ওয়েবিনার সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও পরামর্শের কথা অালোচনা করা হয়।
ওয়েবমিনারে বক্তারা বলেছেন, পাটশিল্প বন্ধ করার মধ্য দিয়ে সমস্ত পাট খাতই ধ্বংস হবে।
শুধু শ্রমিকই নয়, পাটচাষী, কৃষক এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাটকল বন্ধ করে আধুনিকায়নের নামে যে সময় নেওয়া হবে, তাতে বাংলাদেশ বিশ্বে পাট পণ্যের বাজার হারাবে অন্যরা সে বাজার দখল করে নেবে সেটা আর ফিরে পাওয়া যাবেনা।
সভাপতির বক্তৃতায় রাশেদ খান মেনন এমপি পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কেবল কতিপয় আমলা- ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে নয়, পাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অংশিদারদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পরিপুর্ণ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক নয়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে পাটই ছিল আমাদের রাজনৈতিক দাবির কেন্দ্রবিন্দু।
সংবিধানে মালিকানার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়াত্ব খাতের যে প্রাধান্য রয়েছে এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে তাও নাকচ হয়ে গেল।
সরকার গত ২৮ জুন বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের অবসায়ন করে এসব পাটকলের ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ কর্মসূচির মাধ্যমে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। আরো প্রায় ১৩ হাজার ক্যাজুয়াল বা বদলি শ্রমিক এই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের সুবিধে পাবেন না। এসব পাটকল ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত করার পর পুঞ্জীভূত লোকসান দিয়েছে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, গত ১১ বছরেও মাত্র এক বছর নাকি এগুলো মুনাফা অর্জন করতে পেরেছে। অতএব, ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে এসব পাটকলের অবসায়ন সম্পন্ন করার পর তথাকথিত ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)’ ব্যবস্থার অধীনে পাটকলগুলোকে নাকি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন প্লান্ট ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে। তখন শ্রমিকদের আধুনিক প্রযুক্তি পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার চাকরি প্রদানেরও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সরকার দাবি করেছে, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন করে চালু করা হলে পাটকলগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। দেশের জনগণ যখন নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর তাণ্ডবে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে গত মার্চ থেকেই ‘ভার্চুয়াল লকডাউনের’ কারণে ঘরবন্দি ছিল, তখন এমন মহাসংকটের মধ্যে এ সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক ছিল কিনা? তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই গেল। সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামনে লোভনীয় ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আর্থিক মুলা’ ঝুলিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে পাটকলগুলোকে প্রাইভেটাইজেশনের প্রক্রিয়ায় নিক্ষেপ করা হলো; যার মূল উদ্দেশ্যই হলো, এই ২৫টি পাটকলের প্রায় ২ হাজার ২৪০ একর (আরেক হিসাব মোতাবেক ২৬০০ একর) জমিজিরাত, অন্যান্য স্থাপনা, ভৌত অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোর মালিকানা কিংবা দখলদারি দেশের পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলোকে দিয়ে দেয়া।
রাষ্ট্রায়ত্ত এই ২৫টি পাটকলের লোকসানের কারণগুলো মোটামুটি সবারই জানা। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ৬০-৭০ বছরের বা আরো মান্ধাতা প্রযুক্তি দিয়ে এ পাটকলগুলো গড়ে উঠেছে (আমিন জুট মিলের বেশকিছু তাঁত ও যন্ত্রপাতি নাকি ১৯১৫ সালে ম্যানুফ্যাকচার্ড!)। অতএব, সর্বাত্মক বিএমআরই করে সব পাটকলের খোলনলচে বদলে ফেলা ছাড়া মিলগুলোকে লাভজনক করার সুযোগ নেই। আরো মারাত্মক হলো, খোদ বিজেএমসি থেকে শুরু করে প্রতিটি মিলের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের একাংশ চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ার পরের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থাপনার ধারাবাহিকতায় এবং সরকারের লেজুড় শ্রমিক নেতাদের যোগসাজশে। ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, সবচেয়ে মারাত্মক দুর্নীতি গেড়ে বসেছে অসময়ে কাঁচা পাট ক্রয়ে। এ দেশে পাট কাটার মৌসুম জুলাই-আগস্ট মানে বর্ষাকাল এবং গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে পাট বিক্রির ভরা মৌসুম আগস্ট-সেপ্টেম্বর হলেও বিজেএমসির পাট ক্রয়ের অর্থায়ন পেতে পেতে প্রতি বছর ডিসেম্বর চলে আসে, যখন পাটবাজারের জোগানের প্রধান অংশটা বেপারি-ফড়িয়া-আড়তদারদের গুদামে গিয়ে জমা হয়ে যায়। ফলে ভরা মৌসুমের পাটের সস্তা দামের সুবিধা কখনই বিজেএমসির মিলগুলো পায় না। বরং এই ক্রয় প্রক্রিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাবাজির দৌরাত্ম্য গেড়ে বসে থাকায় একদিকে দুর্নীতিবাজ মহলগুলো তাদের খাই মেটানোর সুযোগ পেয়ে যায়, অন্যদিকে তখন পাটের দাম ভরা মৌসুমের তুলনায় অনেক বেড়ে যাওয়ায় মিলগুলো তাদের প্লান্টের সারা বছরের উৎপাদন ক্যাপাসিটির অর্ধেকও ব্যবহার করার মতো কাঁচা পাট কিনতে পারে না। মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি এবং অসময়ে কাঁচা পাট কেনার এই যুগল সংকট যে সমস্যাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে তা হলো, বিজেএমসির পাটকলগুলোয় উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ প্রাইভেট মালিকানার পাটকলগুলোর পণ্যের চেয়ে এমনকি আন্তর্জাতিক দামের চেয়েও বেশি হয়ে যাওয়ায় লোকসান দিয়ে এসব পণ্য রফতানি করতে হয়। এ সংকটের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সরকার ঘোষিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ বাস্তবায়নের ফলে সব ধরনের শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তার মজুরি ও বেতন প্রায় দেড় গুণ বৃদ্ধির ব্যাপারটি। এসব সমস্যার যোগফল হলো, মিলগুলো সরকারের জন্য ভর্তুকির ‘ফুটা পাত্রে’ পরিণত হয়েছে। অতএব, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘আমি তো ফুটা পাত্রে পানি ঢেলে পাটকল টিকিয়ে রাখতে পারব না,’ তখন তার যুক্তি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে তার প্রকৃত রূপটি উদ্ঘাটনের জন্য নিচে কিছু বিষয় তুলে ধরছি—
১. ২০০৯ সালে ১৪ দলীয় মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ড. কাজী খলীকুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি পাট কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যেখানে কমিশন উল্লিখিত সমস্যাগুলো বিস্তৃতভাবে পর্যালোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। ১৮ জুলাই ওয়ার্কার্স পার্টি বাংলাদেশ আয়োজিত ওয়েবিনারে (ইন্টারনেট সেমিনার) ওই কমিশনের দুজন সদস্য বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতা সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য শহীদুল্লাহ চৌধুরী এবং পাটকল সম্পর্কিত আরেকজন বিশেষজ্ঞ খালেদ রবের বয়ানে আমরা ওই প্রস্তাবের বর্ণনা শুনলাম। প্রতিবেদনের দ্বাদশ পৃষ্ঠায় কমিশন বিজেএমসির মিলগুলোর মান্ধাতা আমলের ৬ হাজার ৪০০ হেশিয়ান তাঁত বাতিল করে ওগুলোর পরিবর্তে চীনা ভিক্টর বা ওয়ান্ডা কোম্পানির সাড়ে তিন হাজার আধুনিক তাঁত বসানোর মাধ্যমে মিলগুলো বিএমআরই করার হিসাব-নিকাশ উপস্থাপন করে দেখিয়েছিল যে পুরনো তাঁতগুলোয় সারা বছর যেখানে মাত্র ১৬ টন হেশিয়ান উৎপাদনের ক্যাপাসিটি রয়েছে, সেখানে চীনা আধুনিক তাঁতগুলোর প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ৩৬ টন। ফলে পুরনো তাঁতে যেখানে প্রতি টন হেশিয়ান উৎপাদনে ওই সময় খরচ পড়ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, তার তুলনায় চীনা তাঁতে প্রতি টনে খরচ পড়ত ১ লাখ ৯ হাজার টাকা। কাঁচা পাটের অপ্রতুল জোগানের কারণে পুরনো তাঁতগুলোর ক্যাপাসিটির অর্ধেকও ব্যবহার করা যাচ্ছিল না বিধায় উৎপাদন কম হওয়ায় টনপ্রতি খরচ আরো বেড়ে যাচ্ছিল। কমিশন পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাওয়ানী জুট মিলকে বিএমআরই করার জন্য সরকারের কাছে ৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পেশ করে দাবি করেছিল যে আধুনিকায়নের পর মিলটিতে উৎপাদন খরচ মিটিয়ে প্রতি বছর ৪০ কোটি টাকা মুনাফা হবে। অতএব, আড়াই বছরের মধ্যেই সরকারের ঋণ শোধ করে মিলটি লাভজনক হয়ে যাবে। দুঃখজনকভাবে সরকার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।
২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমএম আকাশ ওয়েবিনারে আরেকটি চমকপ্রদ খবর জানালেন যে ২০১৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে বিজেএমসির যৌথ উদ্যোগে ২৫টি মিলের ব্যাপারে একটি গবেষণা সম্পন্ন হওয়ার পর চীন সরকার বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিল যে সব মিল বিএমআরই করে লাভজনক করার জন্য চীন বাংলাদেশকে প্রাক্কলিত খরচের ৮০ শতাংশ ‘সফট লোন’ হিসেবে প্রদান করবে এবং যদ্দিন ওই ঋণ শোধ না হবে তদ্দিন উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের ৬০ শতাংশ আন্তর্জাতিক দামে চীন কিনে নিতে থাকবে। বাকি ৪০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহার করবে কিংবা অন্য দেশে রফতানি করবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ওয়েবিনারকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে চীনের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে পাইলট প্রকল্প হিসেবে গালফ্রা হাবিবসহ তিনটি পাটকল বাছাই করে প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এ সম্পর্কে আর কিছুই শোনা যায়নি। বরং ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা-পরামর্শ ব্যতিরেকে রহস্যজনকভাবে ২৮ জুনের সরকারি সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করা হলো।
৩. খালেদ রব ও শহীদুল্লাহ চৌধুরী দুজনেই জানালেন, বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই পাটকলগুলো কখনই লাভজনক ছিল না। কাঁচা পাট রফতানির পরিবর্তে পাটজাত পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে পাটকল প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অর্থায়ন সুবিধা দিয়ে সহায়তা করেছিল। আদমজী, বাওয়ানী, আমিন ও ইস্পাহানী জুট মিলের মতো প্রথম দিকের বড় পাটকলগুলো সরাসরি সরকারই প্রতিষ্ঠা করার পর অবাঙালি মালিকদের কাছে নামমাত্র দামে এগুলোর মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে এমএম ইস্পাহানীর নেতৃত্বে আদমজী, বাওয়ানীসহ তখনকার পাটকলগুলোর মালিকদের একটি ডেলিগেশন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাটকলগুলো লোকসান দেয়ার কারণ দেখিয়ে মিলগুলো সরকারে ফেরত নেয়ার দাবি জানায়। তখন সরকার পাটকল মালিকদের সুবিধা দেয়ার জন্য ‘বোনাস ভাউচার স্কিম’ চালু করেছিল পাটজাত পণ্য রফতানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রার ৩৫ শতাংশ মালিকদের তাদের ইচ্ছেমাফিক খরচের ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্যে। একই সঙ্গে প্রতিটি ২৫০ তাঁতের পাটকল প্রতিষ্ঠার মোট খরচ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার মধ্যে ১ কোটি টাকা সরকারের প্রদেয় নির্ধারণ করে পূর্ব পাকিস্তানি মালিকদের জন্য মাত্র নগদ ১৫ লাখ টাকা এবং আরো ১০ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টিসহ মোট ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পাটকলের মালিক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করায় ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানি মালিকদের পাটকলগুলো প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। অতএব, এ দেশে পাকিস্তান আমলের পাটকলগুলোর প্রতিষ্ঠা লাভ-লোকসানের ব্যবসায়িক বিবেচনায় হয়নি, বোনাস ভাউচারের ‘কৃত্রিম সহায়তার’ আকর্ষণে হয়েছিল বলা চলে। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণের পর মিলগুলোয় অদক্ষতা, দুর্নীতি, লুটপাট, প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ, বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন ও পাটক্রয়ের দুর্নীতি, শ্রমিক নেতাদের দৌরাত্ম্য ও প্রশাসনে অরাজক হস্তক্ষেপ, অপ্রতুল সরকারি অর্থায়ন—এগুলোর সম্মিলিত অভিঘাত ক্রমে বেড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মরণদশা ডেকে এনেছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংক গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাটকলগুলো বন্ধ করার জন্য বিএনপি সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই চুক্তির বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার বিশ্বের সর্ববৃহৎ আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত ১১ বছরে তারাও এক বছর ছাড়া মিলগুলোকে লাভজনক করতে ব্যর্থ হয়েছে (অবশ্য মির্জা আজম পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় উল্লিখিত চীনা প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল সরকার!) এই লোকসানের দরিয়া থেকে উত্তরণের পথ কি প্রাইভেটাইজেশন? ১৯৭২ সালে ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি যাত্রা করেছিল। এরশাদের আমল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রাইভেটাইজেশন শুরু হয়ে এখন বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলের সংখ্যা মাত্র ২৫টিতে নেমে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে বিরাষ্ট্রীয়কৃত পাটকলের একটিও কি লাভজনক অবস্থায় টিকে আছে? যারা ওই পাটকলগুলোর মালিকানা পেয়েছিল, তারা মিলগুলোর জমিজিরাত, যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো কীভাবে লুটপাট করেছে, তার নজির তো আমাদের সামনেই রয়েছে! অন্যদিকে বোঝাই যাচ্ছে, বিজেএমসির অধীনে রেখে শুধু বিএমআরই করেও পাটকলগুলোকে ধারাবাহিকভাবে লাভজনক রাখা যাবে না। বিকল্প ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির কথা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে।
৪. এ ব্যাপারে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বিজেএমসি ভেঙে দিয়ে বিকেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে প্রতিটি পাটকলের সঙ্গে পারফরম্যান্স কন্ট্রাক্টের অধীনে সরকারকে এই ২৫টি পাটকল আধুনিকায়নের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটাকে ওয়েবিনারের আলোচকরা গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন।
৫. খালেদ রব তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেছেন, একসঙ্গে সব পাটকল বন্ধ করে দিলে মিলগুলো বিএমআরই করে চালু করতে যে বছর দুয়েক সময় লাগবে তদ্দিনে বাংলাদেশ পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়ে ফেলবে, যা ভবিষ্যতে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তার প্রস্তাব হলো, যে মিলগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো চালু রেখে পাটজাত পণ্য জোগানের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মান্য করা হোক। একই সঙ্গে বাকি মিলগুলোর দ্রুত বিএমআরই সম্পন্ন করে সেগুলো চালুর ব্যবস্থা করা হোক। তিনি পাটকলগুলোকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন।
আশা করি, উপরের আলোচনা থেকে ২৫টি পাটকল একসঙ্গে বন্ধ করার মারাত্মক ভুলটি উপলব্ধি করে সরকার সেখান থেকে সরে এসে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য ১৪ দলীয় জোটসহ শ্রমিকদের সঙ্গে অবিলম্বে সংলাপের উদ্যোগ নেবেন। এবং অামাদের পাটশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে করণীয় সম্পর্কে এবং এ খাতের ভবিষ্যত নিয়ে দিকনির্দেশনা তৈরি করবেন।
#
সৈয়দ অামিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক : অারপি নিউজ;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
E-mail : rpnewsbd@gmail.com
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D