ত্রিপুরা জনগোষ্টিকে কৃষি জমি থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবীতে শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন

প্রকাশিত: ১:৪৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০২০

ত্রিপুরা জনগোষ্টিকে কৃষি জমি থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবীতে শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন

বিশেষ প্রতিনিধি || শ্রীমঙ্গল, ০৮ নভেম্বর ২০২০ : ‘ত্রিপুরা জনগোষ্টিকে শতবছরের কৃষি জমি থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাতিল ও লাউয়াছড়া বনের জন্য ক্ষতিকর আশ্রয়ন প্রকল্প অন্যত্র স্থানান্তরের দাবীতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চৌমুহনা চত্বরে রোববার দুপুর ১২টায় ইউএনও বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের পর মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্টিত হয়েছে।

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র রক্ষা আন্দোলন নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে অায়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশে একাত্মতা ঘোষণা করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ অামিরুজ্জামান।

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক জলি পালের সভাপতিত্বে ও এডভোকেট আবুল হাসানের সঞ্চালনায় আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশে অারও বক্তব্য রাখেন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নেতা জনক দেববর্মা, সংগঠনের যুগ্ম অাহবায়ক কাজী শামসুল হক ও এস কে দাশ সুমন, সংগঠনের যুগ্ম সচিব জাভেদ ভূঁইয়া ও প্রীতম পাল প্রমূখ।
এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক সৈয়দ ছায়েদ আহমেদ, অপি চন্দ, বৃষ্টি চন্দ, অনন্ত দূর্বা, সোহেল শ্যাম সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিরা।

মানববন্ধন ও সমাবেশে একাত্মতা ঘোষণা করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ অামিরুজ্জামান বলেন, “বনের মানুষ বনে থাকবে। কারণ বনকে তারাই রক্ষা করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে তাই অামরা দেখে অাসছি। অামাদের দেশ বহুজাতির মিলনক্ষেত্র। অার তাই ত্রিপুরা জনগোষ্টিকে শতবছরের কৃষি জমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। অার লাউয়াছড়া বনের জন্য ক্ষতিকর আশ্রয়ন প্রকল্প অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।”

মুজিববর্ষ উপলক্ষে ‘জমি নেই, ঘর নেই’ – এমন মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে সরকার নিয়েছে উদ্যোগ। আর তা প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসন নিয়েছে পদক্ষেপ। সে অনুযায়ী লাউয়াছড়া বনের প্রায় ১ কি.মি. অদুরে আশ্রয়ন প্রকল্প – ২ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার খবরে বেঁকে বসেছে শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসা স্থানীয় ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠি ও সচেতন মহল।

তারা মনে করছেন, এখানে এমন একটি ইট সুড়কি’র আদিখ্যাতা ও জনমানুষের কোলাহল তৈরী হলে লাউয়াছড়া বন হবে বিপন্ন এবং আদিবাসী ত্রিপুরী জনগোষ্টিও অনিরাপত্তায় ভুগবেন। তাই এ প্রকল্প বন লাগোয়া বাস্তবায়ন না করে শ্রীমঙ্গল শহরের আশেপাশে বেহাত প্রভাবশালীদের অপদখলে চলে যাওয়া শত শত একর ভূমি উদ্ধার করে সেখানে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প করা হউক।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, আমরা মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই মানবিক উদ্যোগকে স্বাগত জানাই তবে তা যেনো কারো উচ্ছেদের কারন না হয়, বাঙালি ও আদিবাসীদের মধ্যে স্থায়ী জিঘাংসার সৃষ্টি না করে। আমরা চাই, শ্রীমঙ্গলের প্রত্যেকটি ভূমিহীন ও গৃহহীন ঘর পাক, তবে তা বাস্তবায়ন করতে যেয়ে যেনো আমরা প্রকৃতি ও ভিন্ন জাতিগোষ্টির জীবনাচরণকে বিপন্ন না করে ফেলি।

এ মানববন্ধন থেকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন ও সরকারকে উদ্দেশ্য করে বাসদ নেতা আ্যডভোকেট আবুল হাসান বলেন, ‘সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবীদার, তবে আপনাদের জায়গা নির্বাচন করা ভূল। আপনারা শ্রীমঙ্গলে উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আদিবাসী মানুষ ও প্রকৃতিকে বিপন্ন করতে পারেন না, ডলুবাড়িতে ১২০টি ত্রিপুরা আদিবাসী পরিবার রয়েছে, ৩৮২ একর জমির ব্যাপারে ১৯৭৮ সালে মহামান্য হাইকোর্টের একটি রায় রয়েছে এবং সরকারকারের প্রতি আদালতের নির্দেশনা রয়েছে ত্রিপুরাদের জমির মালিকানা যেনো দেওয়া হয় কিন্তু আজও আদালতের রায় বাস্তবায়ন হয়নি। শহর এলাকার সরকারী খাস জমি উদ্ধার করে সেখানে ভূমিহীনদের আবাসন গড়ে দেন, শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িতরা শত শত একর জায়গা দখল করে রেখেছে, হাওর ধংস করে ফিশারী করছে, বিভিন্ন প্রভাবশালীরা পাহাড় দখল করে রিসোর্ট করেছেন সেগুলো উদ্ধার করেনে অনতিবিলম্বে, প্রশাসনের সে শক্তি ও সাহস যদি না থাকে তাহলে আমরা আপনাদের সাথে থাকব।

বক্তারা বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে প্রশাসনিক আমলা যারাই এই সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত তারা নিশ্চয়ই আমাদের যৌক্তিক দাবী পর্যা লোচনা করে ইতিমধ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন এবং অনত্র জায়গা নির্ধারণ করবেন। নৌকা মার্কার সরকার ক্ষমতায়, আপনারাই ‘নৌকা মার্কার ভোটারদের আপনারা উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছেন, ওরা তো, বিএনপি – জামাত, বাসদ, কমিউনিস্টকে ভোটে দেয় না, তাহলে আপনারা সেটা করার চেষ্টা করছেন কার ইশারায়?

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক জলি পাল বলেন,‘ বনবিভাগের লোকেরা ও প্রভাবশালীরা মিলে লাউয়াছড়া বনকে খেয়ে ফেলছে, রক্ষক আজ ভক্ষক। ভূমিহীনদের জঙ্গলে কেন, সেখানে জীবিকা নির্বাহের জন্য নিশ্চয়ই তারা বনের দিকে নজর দেবে, এর ফলে লাউয়াছড়ার বুকে শেষ পেরেকটুকু বিদ্ধ হবে।সমস্ত উপজেলার অপদখলকারীদের হাত থেকে সরকারী জমি উদ্ধারে প্রশাসনের সাথে আমরা থাকব এবং আমরা মনে করি সবাই মিলে লাউয়াছড়া এবং আদিবাসী জনগোষ্টিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। লাউয়াছড়ার বাফার জোনে যত সরকারী সম্পত্তি দখলে রয়েছে সেগুলো কেন উদ্ধার করছেন না, নাকি ভয় পান। আমরাও চাই কেউ ফুটপাতে থাকবে না, সুতরাং, শ্রীমঙ্গল শহর এলাকার পাশে জায়গা নির্ধারন করেন এবং তা করলে তাদের জীবিকা অর্জন ও দৈনন্দিন কর্মকান্ড সম্পাদন সহজ হবে।

ত্রিপুরা জনগোষ্টি নেতা জনক দেববর্মা বলেন, শান্তিপুর্ণভাবে আমরা এখানে বসবাস করছি, আমরাও চাই ভূমিহীন মানুষরা জমি ও গৃহ পাক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, তবে তা হতে হবে পরিকল্পিত এবং পরিবেশ, প্রকৃতি এবং বিভিন্ন জাতি -গোষ্টির জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রেখে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, সরকারের পদক্ষেপ একপ্রকার স্ববিরোধি হয়ে যাচ্ছে, একদিকে ঘর দেওয়ার পদক্ষেপ অন্যদিকে আমাদের কৃষিজমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা। এটা অনস্বীকার্য যে, শ্রীমঙ্গলের ইউএনও অত্যন্ত চমৎকার মানুষ, তিনি আদিবাসীদের জন্য ব্যাপক কাজ করেছেন যা আগে কখনো আমরা পাইনি। আমরা তাঁর কাছে অনুরোধ করব, আমাদের জীবন ও জীবিকা যাতে হুমকীর সম্মুখীন না হয় সেটি লক্ষ রেখে স্থান নির্বাচন করুন, আপনি কতিপয় তথাকথিত প্রভাবশালীদের নিকট থেকে সরকারী খাস জমি উদ্ধার করেন, শ্রীমঙ্গলবাসী আপনার পাশে থাকবে।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নেছার উদ্দিন জানান জানান, আমরা আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে একটি স্মারকলিপি পেয়েছি, এখন আমরা সেটি বিশদভাবে পর্যালোচনা ও আলাপ আলোচনা করে দেখব। খাস জমি উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি বলেন, উপজেলার সমস্ত সরকারী খাস জমি এবং কি অবস্থায় রয়েছে সেরকম এটা তালিকা আমরা করে ফেলেছি। বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য যোগ্য জমির শ্রেণী আমরা খুঁজে খুঁজে সমস্ত ভূমিহীনদের দেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করছি। অবৈধ দখলদারদের কাছে কি পরিমান সরকারী জায়গা অপদখলে আছে সেটিরও তালিকা করা হচ্ছে এবং সেগুলো উদ্ধারকাজ চলমান প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যতে তা আরো জোরদার করা হবে।