সিলেট ২৪শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:২৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২২, ২০২০
ফারহিম ভীনা || ঢাকা, ২২ নভেম্বর ২০২০ : ভিয়েতনামের কবিতা হচ্ছে হালং বে। আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন রাখা হয়েছে হালংবের জন্য। হালং শহরের নামেই হালং বে নামের উপসাগর, টুং কিং উপসাগরও নাকি বয়ে চলেছে তার পাশে। হালং বে মানে ড্রাগনের অবতরণ ভূমি-এখানেই। আদিকাল থেকে বাস করে আসছে বিশাল ড্রাগন। এর সাথে জড়িয়ে আছে দারুন এক রূপকথা। দেশটির সূচনালগ্ন থেকে নাকি বারবার অন্যান্য দেশের আক্রমনের শিকার হয়েছিল ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম রাজ্যের সেই প্রাচীনকালের রাজা শত্রুদের ঠেকানোর জন্য মা ড্রাগনকে ছানাপোনাসহ হালং বে উপসাগরে পাঠায় শত্রু নিধনের জন্য। মা ড্রাগন আর ছানাপোনারা তখন মুখ থেকে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করলে এগুলো সব পাহাড় হয়ে শত্রুদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। আর মা ড্রাগন তখন শান্তির সমুদ্রের প্রেমে পড়ে থেকে যায় এই উপসাগরে।
খুব সকাল সকাল প্রিয় আর প্রিতু উঠে পড়েছে। বোঝা গেল হালং বে নিয়ে ওদের আগ্রহ অনেক। প্রিতু নাশতার টেবিলে বলল, ‘মা এটা নাকি পৃথিবীর নতুন সাত আশ্চর্যের একটি’? প্রিয় জুস সিপ করতে করতে বলে হুস UNESCO এটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বন্ধুরা বলেছে ভিয়েতনামের আসল সৌন্দর্যই হালং বে। তবে দালাং- এর চেয়ে নিশ্চয়ই সুন্দর নয়। দালাং দুই ছেলেকে খুব মুগ্ধ করেছে। আম্মা বলল নাতীদের, দালাংতো মূলত: কৃত্রিম সৌন্দর্য। হালং বে হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য’। নাহ্ নাশতার টেবিলে গল্প করার সময় নেই। আমরা উঠে দৌড় দেই । দৌড়, দৌড়, দৌড়।
সীক্রুজে যাচ্ছি আমরা। ক্রজটা ঠিক বোট নয়, তিনতলা মাঝারী জাহাজ। এটি খুব সুন্দর না, মাঝারী মানের হবে। আমরা একটু মন খারাপ করি। জানালার পাশে দু সারি চেয়ারের মাঝখানে একটা টেবিল, তাতেই গ্রুপ করে বসার ব্যবস্থা। আমাদের চারজনের সাথে আছে নরওয়ের এক দম্পতি। আমাদেরকে দেখে বিমর্ষ মুখে বলল, ‘দেখো আমাদেরকে বলেছে বিলাসবহুল ক্রজ- travel operator has promised us a wonderful trip in luxury sea-cruise. That is a pure scam. কেমন হবে ভ্রমণ বুঝতে পারছি না’। প্রিয় আর প্রিতুর মলিন মুখ দেখে ওদের দিকে চোখ মটকে বলল, Wishing you a pleasant trip! ‘ভ্রমণ আনন্দময় হোক’।
ক্রুজটা চলতে শুরু করলে আমরা বেমালুম ভুলে যাই আমাদের নৌযাটি আমাদের তেমন পছন্দ হয় নাই। হালং বে বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। সত্যিই ঈশ্বর দারুন এক আঁকিয়ে- পৃথিবী জুড়ে তিনি এঁকে চলেছেন অপূর্ব সব ছবি। আমরা সীট ছেড়ে খোলা জায়গায় চলে যাই। আম্মা পেছন থেকে বলতে থাকে, ‘সাবধান তোমরা কেউ সাঁতার জনো না’। সম্মোহিতের মত আমরা সবাই চলে যাই জাহাজের সামনে- সামনেই সবুজ দ্বীপ এসে মিলিয়ে যায়, ফের দেখা মেলে অন্য কোন দ্বীপের। প্রিতু বলে, ‘শোন মা এই যে দ্বীপ দেখছ, এরকম দ্বীপ কিন্তু একটা দুটো নয়, এখানে দ্বীপ আছে দুই হাজার। ভাবতে পারো? ৯৮৯ টির নাম আছে, বাকীগুলো নামহীন। হুম গুগল সার্চ করে এসেছে ছেলেরা।
মানুষের পৃথিবীতে হালং বে যেন একটুকরো স্বর্গ। হঠাৎ দেখি সাগর ফুঁড়ে দৈত্যের মত উঠে দাঁড়িয়েছে পাহাড়। পাহাড় একটা বিস্ময়ের নাম, একটা আনন্দের নাম। পাহাড় আসলে ভালবাসা ও কবিতার নাম। পাশে নরওয়ের রবার্ট ও অ্যালিস দাঁড়িয়ে আছে রবার্ট মুগ্ধ হয়ে বলছে, ‘Great things are done when people and mountain meet’. আমি পাহাড় বিষয়ক কবিতা মনে করতে চাই, কিন্তু তেমন কিছু মনে করতে পারি না। সুনীলকে মনে পড়ে- ‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ’ তারপর আর কিছু মনে পড়ে না। তবে মনে পড়ে পাহড়ের সৌন্দর্য নয়, পাহাড়ের বিরাটত্ব আর অহংকারী একটা রূপ থেকে কবি পাহাড়কে বশ করতে চান। আব্বার কাছে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়েছি- The Mountain. পাহাড় এখানে সৌন্দর্য নয়, রহস্য- পাহাড় ঢেকে ফেলে শহরকে, নক্ষত্র, নদী ও আকাশ সবাই পাহাড়ের ওপারে। কবিতায় শহরটি কাঁদে- কি অদ্ভুত সুন্দর কবিতা। কিন্তু পাহড়ের কাছে এলে এই বিরাট স্থানু সৌন্দর্য্যের কাছে আমার মাথা নত হয় বার বার।
একজন ইংরেজি জানা গাইডের দেখা মেলে অনেকক্ষণ পর। উনি বলছেন, দ্বীপগুলোর নাম বেশিরভাগই দিয়েছে জেলেরা, বেশিরভাগ দ্বীপ তাদেরই আবিষ্কার। উনি দ্রুত নাম বলে যান, সাথে বলেন অর্থ। হন গা চাই (লড়াকু মোরগের দেশ), হন মই সা (ছাত দ্বীপ), হন ভাই (হাতি দ্বীপ).. আরও কত। আছে রুশ মহাকাশচারী চারম্যান টিটভের সম্মানার্থে তার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা টিটভ দ্বীপ। পর্যটকরা হঠাৎ গাইডের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে খেয়াল করি আমাদের সামনে দুটি পাহাড় মিলে যেন তৈরী করেছে প্রাকৃতিক তোরণ! কি অপূর্ব সে দৃশ্য! রবার্ট মুগ্ধ হয়ে বলছে, ‘What a spectacular scenario! It is much more than we expected’. একটু একটু করে দুপুর হচ্ছে। দূরে দুপুরের রেখাকে কেমন মানুষের মত একা লাগে। আমাদের চারপাশে এক অপূর্ব জগৎ, সমুদ্র, আকাশ, পাহাড় আর অচেনা সম্মোহিত সব মানুষ। এখানে প্রতিদিন বেড়াতে আসে নতুন নতুন মানুষ। মানুষ বেড়াতে আসে পাহাড়ের কাছে, আদিম পৃথিবীর কাছে। মানুষ চোখ বড় করে দেখে অপার রহস্য নিয়ে দূরের সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। তাতে জ্বলছে কেমন সবুজ মণি মাণিক্য। হঠাৎ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, মানুষের ও ভেতর আছে অহংকারী একরোখা এক স্থির পাহাড়।
গাইড বলেন, তোমরা নিশ্চয় এবার বাইথো মাউন্টেন বা কবিতা পাহাড়ে যেতে পারোনি। পরের বার যখন ভিয়েতনামে আসবে তখন কবিতা পাহাড়ে উঠবে। একসময় এই দেশের সম্রাট ছিলেন সলে খান তোঙ। এই হালং বে আর পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে তিনি কবি হয়ে ওঠেন। এখানকার সৌন্দর্য নিয়ে তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন পরের সম্রাট এই পাহাড়ে খোদাই করে রাখেন তার একটি দীর্ঘ কবিতা। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম কবিতা পাহাড়। এই পাহাড় থেকে হালং বে’র সত্যিকারের রূপ দেখা যায়।
আমি আনমনা হয়ে পড়ছি। কিন্তু শুনতে চাই গাইডের কথা। গাইড বলছেন, এবার তোমাদের গুহার গল্প বলব। কারণ এরপর তোমরা গুহায় যাবে। প্রিয় প্রিতম কানের কাছে, মুখ নিয়ে আসে, ‘মা আমরা গুহায় যাবো? কি মজা হবে।’ এই- যে সব পাহাড় দেখছ, তার অনেকগুলোতেই আছে গুহা। এক একটা গুহার সৌন্দর্য এক এক রকম, গল্প আছে অনেক রকম। গুহাদের মধ্যে Trinh nu cave, surprise cave, Heaven cave, Tunnel cave, Bright cave বেশি বিখ্যাত। Trinh Nu cave কে বলা হয় Love story of Halong Bay ড্রাগন রাজা ও তার সুন্দরী প্রেয়সীর বিয়ে হয় এই গুহায়- বিয়ের এই অনুষ্ঠানে স্বর্গ থেকে ঈশ্বর ও অপ্সরীরা নেমে এসেছিল। তাদের সংসার জীবন ভারী সুখের ছিল, ড্রাগন দম্পতির ১০০ সন্তান বাস করে এইসব গুহায়। এখনো কান পাতলে নাকি শোনা যায় ড্রাগন রাজা গান শোনাচ্ছেন তার রানীকে। গাইড বলে যান, The myth is not dead in our life. It is still very much present. এখনো বৃষ্টি হলে হাল বে তে শোনা যায় ড্রাগন রাগ গান শোনাচ্ছেন আর প্রেয়সী রানীকে। আহ্ কি অপূর্ব গল্প। আমরা খুশী হয়ে উঠি।
এই গুহাকে নিয়ে আছে এক মর্মান্তিক প্রেমের গল্পও। সে হাজার বছর আগে, কতদিন তোর নেই লেখা জোকা, এক গরীব তরুণী ভালবাসতো জেলে তরুণকে। পরিবারের কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেও সে স্বামীর কাছে যায় না, লুকিয়ে থাকে এই গুহায়। লোকমুখে এই কথা শুনে প্রেমিক জেলে এসেছিল নৌকা চালিয়ে। সেসময় এক ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড়ে ছিটকে যায় দুজন দুজনের কাছে থেকে। সেই থেকে এখনো প্রেমিক প্রেমিকা খুঁজে বেড়ায় অন্যকে। এবার আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়।
গাইড কথা থামিয়ে বলেন, দেখো সামনেই দুটো মোরগ লড়াই করছে। আমরা তাকিয়ে দেখি ছোট দুটো পাহাড় যেন ঝুঁটি ফোলানো মোরগ হয়ে ঝগড়া করছে। এটাকে নাকি ‘কিসিং রক’ও বলা হয়। তবে ভিয়েতনামিজরা এই দুটি পাহাড়কে ‘গা চই’ বা ‘লড়াইরত মোরগ’ বলে ডাকে। প্রিয় প্রিতু ছবি তুলে চলেছে। কিসিং রক প্রমাণ করে যুদ্ধ ও ভালবাসা আসলে ছলনাময়ী। দৃষ্টিভঙ্গীর ভিন্নতার কারণে একই জিনিস ভালবাসা ও যুদ্ধের রুপে কল্পনায় আসে। এইবার আমাদের গুহা দেখার পালা। ছোট ছোট নৌকায় তিন- চারজন করে গুহার ভেতর যাওয়ার কথা শুনে প্রিয় আর প্রিতুর আর তর সয় না। আমরা নৌ টার্মিনাল থেকে ছোট ছোট নৌকা করে চলেছি Tien Cung Cave নামের এক গুহায়।
খাড়া পাহাড়ের ভেতর এক অন্ধকার পথে ঢুকে পড়লে বুঝি গুহায় ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠে, দেখি ওপরে জলরাশি যেন হঠাৎ যাদু বলে স্থির হয়ে আছে- চুনাপাথরের প্রাগৈতিহাসিক কাব্য। সত্যি মহাকাল যেন লিখে রেখেছে অপূর্ব এক কাব্য। সামুদ্রিক ঝড়, অবিরাম বৃষ্টিপাত, জোয়ার ও ভাটা সব কিছু মিলে শিলায় এনেছে পরিবর্তন। প্রাণীর বিবর্তনের মত শিলারও পরিবর্তন ঘটে। আমরা গুহা পেরিয়ে সমুদ্রে নামি, পেরিয়ে যাই আর একটি পাহাড়ী দ্বীপ। মনে হচ্ছে সৃষ্টির আদিকালে আমরা চলে এসেছি কোন এক অলৌকিক মন্ত্র বলে। ওপরে অসীম নীলাকাশ, রৌদ দগ্ধ দুপুরে ভাসমান বিস্মিত মানুষ সব!
জাহাজে যখন ফিরে এসেছি দুপুর তখন মিলিয়ে গেছে। প্রিয় প্রিতু গুহা ভ্রমণের আনন্দের আত্মহারা। নিজেদের আসনে ফিরে দেখি লাঞ্চ দেওয়া হয়েছে- লেবুর রসে ভেজানো কাঁচা চিংড়ি, স্কুইড, বিশাল একটি ভাজা মাছ আর সেদ্ধ আলু। রবার্ট আর অ্যালিস দেখাল মাছ ঠকমত পরিষ্কার করা হয় নাই। আম্মা তো আগেই বলে গিয়েছে, এসব খাবার খেতে পারব না। আশে পাশে কয়েকটা টেবিলেও দেখলাম অভিযোগ গুঞ্চরিত হচ্ছে খাবার নিয়ে। আমাদের সবার সামনে এবার অনেক চিপস দেয়া হলো আমরা সবাই চিপস খাচ্চি। অনেক ক্ষিধে লাগলেও এই অপূর্ব পরিবেশে আমরা। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যেতে পারি ক্ষুধাকে। এইবার সবার টেবিলে বিভিন্ন কাটা ফল দেওয়া হলে আমরা খুশী গয়ে উঠি।
আম্মা মনে করিয়ে দেয়, কাল সকালে ফ্লাইট, আজ রাতে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করো না। সবাই অনেক টায়ার্ড। তাইতো মানুষ ক’দিনের জন্য বেড়াতে আসে, আবার ফিরে যায়। মানুষের ভেতর আছে গন্তব্যঘোর বেড়াতে এসে কদিনের পাখিজীবন শেষ করে ফিরে যায় নিজের আস্তানায়। আমরা ছুটতে ছুটতে দেখছি সমুদ্র, নদী, গুহা ও পাহড়! হঠাৎ মনে হয়, এত দেশের পযর্টক সব হালংবের সাগর তীরে এসে কেমন নীরব হয়ে উঠেছে। সবার চোখ সাগরে। কিন্তু ওপরে আকাশ কাশফুলের কাব্য হয়ে উঠেছে। সহ্যি কি সুন্দর জীবন! আনন্দ এখন তারায় তারায় আমাদের রক্তধারায়। সত্যিই তো পৃথিবীর সব রাজকন্যারা আজ হালং বে তে বেড়াতে এসেছে। একসময় আনন্দ নিয়ে আমরা সব ফিরে চলি শহরে দিকে, তখন বৃষ্টি নেমেছে ঝম ঝম করে। রূপকথা বলে, বৃষ্টি মানেই শুভ। ড্রাগনেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। আর ড্রাগন রাজা রানীকে শোনানোর জন্য গলা খুলে গাইছে গান।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D