নারী কেবলই সৌন্দর্যবর্ধন করেনা, বরং প্রত্যেক নারীই যোদ্ধা

প্রকাশিত: ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০২১

নারী কেবলই সৌন্দর্যবর্ধন করেনা, বরং প্রত্যেক নারীই যোদ্ধা

ইয়াতুননেসা রুমা || ঢাকা, ০৮ মার্চ ২০২১ : নারী কেবলই সৌন্দর্যবর্ধন করেনা, বরং প্রত্যেক নারীই যোদ্ধা।

জন্ম থেকে প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীকে যুদ্ধ করে যেতে হয়। যুগে যুগে কালে কালে সংগ্রামে বা কঠিন সময়ে নারী যেমন সেবার হাত বাড়িয়েছে তেমনি অস্ত্র হাতেও শত্রুর মোকাবেলা করেছে। সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের পাশাপাশি সফলতার সাথে কাজ করছে। সমাজের বাধা-বিপত্তি ঠেলে সামনে এগিয়েছে, দৃষ্টান্ত হয়েছে আরও অসংখ্য নারী ও পুরুষের কাছে।
তবে এখনো সমাজের একটা বড় অংশ নারী স্বাধীনতার বিষয়ে মগজে সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করছে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় দেখানো যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এক শ্রেনীর লোকেদের। তাদের ধারণা নারী কোন প্রয়োজনেই আসেনা, নারীর কাজ কেবল শোভাবর্ধন। কিন্তু না। যুগ যুগ ধরে নানান ক্ষেত্রে নারীদের সফলতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক নারী। হাজার হাজার বছর ধরে নারীদের সফলতার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।

বাংলার ইতিহাসে যোদ্ধা থেকে জ্যোতিষী পর্যন্ত গুনী ও বিপ্লবী নারীদের সংখ্যা গর্ব করার মতো। সংগ্রামী ও আদর্শিক এসব নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ খনা, চন্দ্রাবতী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্র, কামিনী রায়, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সাইদা খানম, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সহ প্রমুখ নারী পথিকৃৎ। আজকের নারী জাগরণের এই যে সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ হচ্ছে এরা প্রত্যেকেই তার একেকটি ভিত।
বর্তমান যুগের নারীরা সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সকল নারীর অবদান অপরিহার্য। সাঁতরে সমুদ্র পাড়ি দেয়া থেকে শুরু করে এভারেস্ট বিজয়, রাজপথে আন্দোলন সহ সকল ক্ষেত্রে রয়েছে নারীর দৃপ্ত পদচারণ।
নারী জাগরণের এতসব গৌরবময় ইতিহাস থাকলেও নারীদের চলার পথ আজও মসৃন হয়নি।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর ছুঁই ছুঁই । স্বাধীনতার এতো বছর পরেও নারীদের ভাগ্যের তেমন কোন পরির্তন ঘটেনি। নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আজও লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ এসব ঘটনা ঘটে চলছে প্রতিনিয়ত। এর কারণ সমাজের পশ্চাৎপদ মনোভাব। কন্যাশিশুদের সাহসী হয়ে উঠবার শিক্ষা না দেয়া। ধর্ষণ ঠেকাতে অভিভাবকরা মেয়েদের আবদ্ধ করে রাখাটাকেই সহজ সমাধান মনে করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন ও অনিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়েদের অন্দরমহলে রেখে বড় করাকেই নিরাপদ মনে করে। কিন্তু তারা ভাবে না এটি মেয়েদের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে রেখে মেয়েদের নিরাপদ রাখা যায়না। বরং অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সাহসী ও যোগ্য করে গড়ে তোলাই সমাধানের পথ। সরকার ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে এর প্রতিরোধে আরও জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ার দেয়ার পক্ষে রয়েছে বিপুল মানুষ।চারদেয়ালে আবদ্ধ হয়ে নারী থাকবে না বরং নারীলোভী পুরুষ থাকবে।

প্রতিবছরের ৮ মার্চ বেশ ঘটা করে নারী দিবস পালন করা হয়, নারীর অধিকার ও এগিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলা হয়। অথচ সেই অধিকার বাস্তবায়ন কেউ করে দেয়না। নারীর ভাগ্যের পরিবর্তন নারীর নিজেকেই করতে হয়। নারীর মুক্তি আজও ঘটেনি, যুগের পরিবর্তনে কেবল নতুন মোড়কে নতুন রূপ ধারণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় নারীরা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে নারীদের শোষণ এখনো দূর হয়নি। নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র তথা বিভিন্ন দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও, নারী তার প্রকৃত স্বাধীনতা এখনো লাভ করেনি। বর্তমানে অনেক নারী ঠিকই উপার্জন করছে। তবে সে এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়। যেমনটা পুরুষ স্বাধীন। অধিকাংশ নারীকে এখনো উপার্জিত সকল অর্থ তুলে দিতে হয় পুরুষের হাতে।

রাজনীতিতে নারীর সমান অবদান থাকলেও সমান অবস্থান এখনো হয়নি। রাজনীতির মাঠে একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারীর শ্রম ও ত্যাগ বেশি থাকলেও শীর্ষ পদে নারীদের সংখ্যা হাতে গোনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান ক্ষমতাবান নারী হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুবই হতাশাজনক। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে আমরা উদাহরণ বলি। মূলত তারা ব্যতিক্রম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে— “Exceptional is not example.” আল জাজিরায় শেখ হাসিনা নিজেই একটা ইন্টারভিউতে বলেন – “দেশের পুরুষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা নারীদের শীর্ষে মানতে পারেন না।”
পুরুষ রাজনীতিকদের প্রেরণার উৎস হিসেবে অনেক নারীর নাম উচ্চারিত হয়। অথচ সেই মেধা ও শ্রম দিয়ে সেই নারী নিজেই হতে পারেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তা হচ্ছেনা নানা কারণে। নারীরা তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে বিসর্জন দেয় স্বামী, সন্তান ও সংসার টিকিয়ে রাখতে। যেটা পুরুষ রাজনীতিকদের করতে হয়না। আমরা পুরুষদের দেখি নারী কর্মীদের উৎসাহ বা বাহবা দিতে। মূলত পুরুষেরা নারীদের বাহবা দেয় বা সহ্য করে ততক্ষণ, যতক্ষণ সে নিজে ঐ নারীর থেকে এগিয়ে থাকে। নারী যখন পুরুষকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় তখন সেই পুরুষই নারীর চরিত্রে নোংরা কাদা লাগিয়ে তাকে টেনে ধরে। যেখানে রয়েছে অনেক নামধারী প্রগতিশীল পুরুষও।

আর যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলি, কোন দলই নির্বাচনী বিধিমতে ৩৩% নারী কোটা পূরণ করতে পারেনি। বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ নারী প্রধান শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও কার্যত মন্ত্রীসভায় নারীর উপস্থিতি ১৫ শতাংশেরও কম। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়াকে বাদ দিলে নারী নেতৃত্ব হতাশাজনক। কোন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তো আবার একজনও নারী নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বামপন্থী দলগুলোর অবস্থাও একই।
নারীর সকল স্তরে সাবলীল অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, আর রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ না থাকলে সে পথ কখনোই প্রকৃতপক্ষে উন্মুক্ত হবেনা।

এবার আসি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর দিকে: ছাত্র সংগঠন গুলোতেও নারী নেতৃত্ব শোচনীয়। কেন্দ্রীয় শীর্ষ পদগুলোতে নারীদের দেখা যায়না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ সহ উল্লেখযোগ্য সংগঠনগুলিতে কখনোই শীর্ষ দুই পদে নারী নেতৃত্ব আসেনি। তবে দুই একটি সংগঠনে অবশ্য দেখা গেছে। তাও কালেভদ্রে দুই-একবার।
অথচ রাজপথে মিছিল, স্লোগান, সকল আন্দোলনে নারীরা সমান ভাবে অংশ নিয়েছে।
আমাদের এই জায়গার উত্তরণ ঘটাতে হবে। নারী পুরুষ সকলকে উপলব্ধি করতে হবে, নারী কেবল মিছিলের সামনে শোভাবর্ধন করতে নয় কিংবা কোন সংঘর্ষের ঢাল হিসেবে নয় বরং রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি সঠিক পথে আগাবে। সঠিক নারী নেতৃত্ব নারী ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মেয়েদের ফলাফলের হার ভালো হলেও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যা যাতে বাড়ে সে ব্যাপারে এখনি সচেষ্ট হতে হবে।

আমি আশাবাদী, নারী তার প্রকৃত স্বাধীনতা একদিন লাভ করবে। আর সেজন্য নারী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একজন নারী সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সে তার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে পারবে। বর্তমানে কিছু কিছু পুরুষও নারীদের ব্যাপারে অনেকটা সহযোগী মনোভাব পোষণ করছে। নারীদের অধিকারের ব্যাপারে তারা অনেকটাই সচেতন ভূমিকা পালন করছে। আমি তরুণীদের আহবান করবো নিজেকে যোদ্ধা ভেবে সমাজ গঠনের এ লড়াইয়ে অংশ নিতে। এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তিত হবে। নারীরাই পারবে পুরুষের হাতে হাত রেখে একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে।

#

ইয়াতুননেসা রুমা
সহসভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী