ধর্ম যখন সন্ত্রাসীর হাতিয়ার-৯: অসাম্প্রদায়িকতা – ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম এবং চলমান হেফাজতী তান্ডব সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ৯:২১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২১

ধর্ম যখন সন্ত্রাসীর হাতিয়ার-৯: অসাম্প্রদায়িকতা – ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম এবং চলমান হেফাজতী তান্ডব সংস্কৃতি

|| হাফিজ সরকার ||

১৬ এপ্রিল ২০২১ : পর্ব-২
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যে লোকজ সংস্কৃতির অবয়বে সুফিবাদী ও চৈতন্যবাদী যে সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদের ধারা বহমান, যার প্রকৃষ্ট উদাহারণ মরমী কবি লালন শাহ ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই ধারাকে প্রত্যাখান করে ও‍য়াহাবী ইসলামের আদর্শে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতকে নির্মানের কোন কোন মহল বৃটিশ শাসনাকাল থেকেই সবিশেষ তত্‍পর। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, তবে ধর্মের সাথে রাজনীতির সংমিশ্রণ সাধারণ মানুষ কখনও চাননি। সাহিত্য এবং লোকজ সংস্কৃতির শাখাগুলো যেমন ভক্তিগীতি, দেহতত্ত্ব ও মুর্শিদি, বাউল, মারফতি, কির্তন, যাত্রাপালা বা মেলায় বাংলার সাধারণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির মৌল উপাদান হল অসাম্প্রদায়িক এবং সেকু্লার। কিন্তু দীর্ঘকাল থেকে তাকে সাম্প্রদায়িকীকরনের চেষ্টা চলছে।

পল্লবিত সাম্প্রদায়িকতাঃ

এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭১ সালে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সালে গৃহীত দেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রজাতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেই সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর আরোপিত হয় নিষেধাজ্ঞা।এরপরের ইতিহাস আমাদের সকলের জানা। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমনের হত্যার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেকক্ষতাকে মুছে ফেলা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বাংলাদেশে তা আজও প্রবাহমান। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে মৌলবাদ পল্লবিত হয়েছে, জঙ্গিবাদ হয়েছে পরিপষ্টু । আর ১৯৭১-এর রাজনৈতিক সংগ্রাম বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ইহলৌকিকতার ভিত্তিতে যে রেনেসাঁর উদ্ধোধন ঘটিয়েছিল,তার
দুয়ার ক্রমাগতভাবে হয়েছে রুদ্ধ।

দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিষঃ

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে
সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাস্প ছড়িয়েছিল, ৭৪ বছর পরে এখনও আমরা তার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারিনি। জাতীয় জীবনে তার খেসারত আমাদের প্রতিনিয়ত
দিতে হচ্ছে। ঊনিশশো সাতচল্লিশের দেশভাগের যে পলিটিকস সেটা আজ অবধি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভীষণভাবে কাজ করে। সাতচল্লিশে যে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বিষবৃক্ষ আমরা বপন করেছিলাম সেটাই এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে এবং যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে করার সুযোগ করে দিয়েছি সেটাই আমাদের দেশকে সাতচল্লিশের বাতাবরণে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাতচল্লিশে দেশভাগের সুবাদে বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসের কারণে অনেককে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে, নারীরা নির্যাতিত হয়েছেন।

বিপদঃ

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সীমান্ত গান্ধী – খান আব্দুল গাফ্ফার খান, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের মতো রাজনীতিবিদগণ যে উদারতাবাদী ইসলামের ভাবধারায় গোটা ভারতবর্ষকে উদ্ভাসিত করে রেখেছিলেন তাকে প্রত্যাখান করে সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী, গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলওয়ার হোসেন সাঈদী, শাহ আহম্মদ শফির মতো ব্যক্তিরা জঙ্গীবাদী ইসলামের প্রসার ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। বসে নেই হিন্দু, বৌদ্ধমৌলবাদীরাও৷। গুজরাট দাঙ্গার রূপকার নরেন্দ্র মোদী আজ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী,শ্রীলংকায় জাতিগত সহিংসতার পরে শুরু হয়েছে মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা। ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস হিন্দুত্ববাদের নামে ভারত ও নেপালে গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বড় হুমকি হিসেবে আজ বিরাজ করছে, অন্যদিকে ইসলামের নামে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ পাকিস্থান ও বাংলাদেশে গণতন্ত্রও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ভয়াবহ বিপদ হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া সাম্প্রদায়িকতা শুধু ধর্মীয় বাতাবরণে সীমাবদ্ধ থাকছে না – জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে উপজীব্য করে ক্রমাগত সহিংস হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারের স্বরূপ উন্মোচন আজ আবার জরুরি হয়ে পড়েছে।

সমস্যা বিশ্বব্যাপীঃ

শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা পৃথিবীতে আজ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে তীব্র সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। এটি সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে প্রায়ই অগণতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু ও মানবতাবিরোধী পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে এবং তা অন্যান্য রাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্মীয় এবং জাতিগত দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বব্যাপী অসঙ্গতি বিরাজ করছে। শান্তির বিপরীতে ৫৬টি ধর্মীয় সংঘাত পৃথিবীকে অসহনশীল করে তুলছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছেন সংখ্যালঘু-সহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অগণতান্ত্রিক, অসহনশীল ও মানবতা বিরোধী আচরণ বর্তমান সময়ে চরম আকার ধারণ করেছে ৷ তাই এই মুহুর্তে এর পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্র যখন ধর্মনিরপেক্ষঃ

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারনার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভাবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। অর্থাত্‍ “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্রসবার”। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া হ’ল এ নীতির সর্বজনীনতা। দৃঢ়তার সাথে তাকে ঘোষণা করা এবং সকল রাষ্ট্রে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক তা সেই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ যেই হোক না কেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি আধুনিক বিশ্বে ধর্মরাষ্ট্রকেই শুধু প্রত্যাখ্যান করেনা বরং যেসব রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য লালন করে অথবা সমাজের একটি অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত করে তাদেরকেও প্রত্যাখান করে।

অসাম্প্রদায়িকতা হ’ল গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তঃ

গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িকীকরণ। গণতন্ত্রের ধারনাটি পশ্চিম ইউরোপে কিভাবে বিকশিত হয়েছে সেটা বুঝতে হবে, কেননা ইউরোপ থেকেই গণতন্ত্রের ভাবনা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। মধ্যযুগে ইউরোপ ছিল সামন্তবাদের অধীন এবং সংস্কৃতিতে ছিল ধর্ম কেন্দ্রীকতা। সেই ধর্মকেন্দ্রিকতা ও গীর্জার একাধিপত্যকে ভেঙ্গে রেনেঁসা ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যখন সমাজ এগিয়েছে, সেইসাথে অর্থনীতিতে বিকশিত হয়েছে পুঁজিবাদ এবং তার অনুষঙ্গি বিষয় হিসেবে গণতন্ত্রের ধারনাটি বিকশিত হয়েছে, ব্যক্তি-অধিকারের প্রশ্নটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এবং ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে সামন্তবাদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়েছে, রাজতন্ত্র অবলুপ্ত হয়েছে; ব্যক্তি-অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সমাজটা ধর্মের যে একচ্ছত্র আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত ছিল সে আচ্ছাদন থেকে মক্তি পেয়েছে, আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশে যখন আমরা গণতন্ত্রের কথা বলবো, তখন আমরা যদি অসাম্প্রদায়িক না হই, তাহলে আমরা কখনওই গণতান্ত্রিক হতে পারবো না, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না। আর গণতন্ত্র যখন রাজনীতি থেকে অর্থনীতিতে পরিব্যপ্ত হয়, পুঁজিবাদ সৃষ্ট বৈষম্যকে বিনাশ করে, তখন সেই বিকশিত গণতন্ত্রের রূপ হয় সমাজতন্ত্র।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মানেই অগণতান্ত্রিকঃ

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে। গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের মত প্রকাশের অধিকার যেমন আছে, তেমনি জীবনকে প্রভাবিত করে এমন প্রত্যেকটি বিষয়ে অভিমত দেওয়ার সুযোগ আছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা হতে পারে সরাসরি (একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও মধ্যসত্মাধিকারী ব্যতিত একটি সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যের নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে) অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে (যেমন: আইনসভার সদস্য)। এখানে একজন নাগরিক হিন্দু, মুসুলিম, শিখ, পার্সি, অজ্ঞেয়বাদী এবং নিরীশ্বরবাদী যাই হোন না কেন প্রত্যেকের মত, অভিব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার আছে। কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রগুলো এ সকল অধিকারকে স্বীকার করে না।।

অগণতান্ত্রিকতাই সৃষ্টি করে অসাম্যঃ

কোনো সমাজ গণতান্ত্রিক কি না তা বোঝা যায় সেই সমাজে সংখ্যালঘুসম্প্রহায়ের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের অবয়ব থেকে, কেননা তার মধ্যে নিহিত আছে সংখ্যালঘুর জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রকৃত নিশ্চয়তা। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অংশ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শগত দ্বন্দ্বে এগিয়ে থাকে। আবার নিছক রাজনৈতিক গণতন্ত্রও যথেষ্ট নয় যদি না তা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিব্যপ্ত থাকে। কারণ এর ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ সুবিধা বঞ্চিত হয়। আর্থ-সামাজিক গণতন্ত্রের অভাব শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ এবং সংখ্যালঘুর ভিত্তিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অসমতার সৃষ্টি করে। তাই রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৃহত্তর পরিসরে গ্রহণযোগ্য হতে হয়।

সেকুলারিজমঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাখ্যাঃ

পাকিস্তনি রাষ্ট্র-কাঠামোর সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে প্রত্যাখান করে পুর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন সংস্কৃতি ও ভাষার ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিল – সেই পথ ধরে ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রাম হয়ে উঠেছিল ধর্মনিরপক্ষতার প্রতীক এবং তা প্রতিফলিত হয়েছিল দেশের প্রথম সংবিধানে। ধর্মনিরপেকক্ষতা তথা সেকু্লারিজম গৃহীত হয়েছিল গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি মৌলনীতি হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবে আমরা জেনে এসেছি সেকুলারিজম হচ্ছে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইহজাগতিকতার বিস্তার। আমরা বুঝি যে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে ইহজাগতিকতা প্রতিষ্ঠার কাজটি খুব কঠিন এবং অনেক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার অংশ৷ কেননা ৫০০ বছর পর এখনও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যটরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ শাসন করেন এবং এখনও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট শপথ নেওয়ার সময় বাইবেল স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করেন। যে সনস্ত দেশগুলো অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েগেছে, সে সমস্ত দেশগুলোও কিন্তু এখনও রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ধর্মাচারের শেষ স্পর্শগুলো থেকে সরে আসতে পারেনি। তবে এটাও ঠিকযে ইউরোপ আমেরিকা-সহ পশ্চিমা সভ্যতার ধারক সকল দেশে ক্রিস্টমাস এখন মুলতঃ একটি সামাজিক উপলক্ষ্য, যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিকতা আছে । কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেসিতে রাজনীতি আছে, ধর্মও আছে। তাই ইহজাগতিকতার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে দীর্ঘকালের লড়াই। আসলে হাজার হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতা যে ধর্ম কেন্দ্রীকতার মধ্য দিয়ে গেছে তা অতিক্রম করতে অনেক সময় লাগবে। ৫০০ বছর সেই কালপ্রবাহে হয়তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু তার বিপরীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার সময় বা তার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মজিুবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের নেতত্বৃ দানকারী আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে অসাম্প্রদায়িকতার অর্থহচ্ছে “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার”৷ অর্থাত্‍ তারা ব্যক্তিজীবনে জগত্‍মূখীনতার উপর গুরুত্বারোপ না করে রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল ধর্মানুসারীর সমানাধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারঃ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শাসনকে দীর্ঘতর করার জন্য ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে। পরবর্তীতে সাতচল্লিশের ভারতভাগ, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মক্তিযুদ্ধ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মহল ধর্মকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ধর্মকে ব্যবহার করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও পিডিপি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে। জামায়াতে ইসলামী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী এবং মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন নেজামে ইসলামী মোজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানীদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও এদেশীয় দোসররা ধর্মের নামে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে অসম্মান করেছে।
(চলবে)

(হাফিজ সরকার)