ঘামে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কোথায়, কে শ্রমিক!

প্রকাশিত: ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ, মে ২, ২০২১

ঘামে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কোথায়, কে শ্রমিক!

।।|| কৌশিক দে ||।।

করোনা দূর্যোগ, তীব্র তাপদহ- আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই- দিন দিন তীব্র হচ্ছে। লুটেরা-পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় দিন দিন বাড়ছে ধনীক শ্রেণি। মুক্তবাজার অর্থনীতি, লুটপাটের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র শ্রমজীবী মানুষের সততার ওপর ভর করে এগিয়ে চলেছে অর্থনীতি। নানা প্রতিবন্ধকতায়ও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পার করা বাংলাদেশ শুধু এশিয়া মহাদেশই নয়, বিশ্বের অন্যতম আত্মনির্ভরশীল দেশে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পেছনের মানুষগুলো সব সময়ই পিছিলে পড়ছে। এদেশের শ্রমজীবী মানুষ যেমন শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, তেমনি লুটেরাদের চাপে নিত্য নিস্পেষিত হচ্ছে। আর ঠিক তখনি আমরা পালন করছি মহান মে দিবস, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার দিন।
পৃথিবী সৃষ্টি থেকেই শোষণের যাঁতাকল শুরু হয়েছে। আর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে শোষক ও শোষিত শ্রেণি। একপক্ষ শোষণ করবে, আরেক পক্ষ শোষিত হবে। আর এভাবেই চলবে উন্নয়নের চাকা। কিন্তু যাদের ঘামে ঘুরছে উন্নয়নের চাকা, তারাই উপেক্ষিত থাকে বা থাকছে। সাফল্য গাঁথার গল্পেও গড় হাজির এ শ্রেণির মানুষেরা। আবার শোষকদের মুখোশের আড়ালেও ঢাকা পড়ে যায় শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। ফলে শোষণের যাঁতাকল, শ্রমমূল্য বঞ্চনা সেই তিমিরেই থেকে যায়। সমাজ-সভ্যতা উন্নয়নের জয়গানে মুখরিত হয় দুনিয়া।
১৮৯৬ আহা এযে ১৩৫ বছর আগের ইতিহাস। এ ইতিহাস শ্রমজীবী মানুষের সুনিদিষ্ট কর্মঘন্টা, শ্রমমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তার। সেই ইতিহাস যেন, এখনো সদ্য। এইতো সেদিনের কথা। এইতো আজকের ইতিহাস। কষ্টবেদনার অবসানহীনতার ইতিহাস। সময় বয়ে যায়, ঘামের মূল্যায়ন হয়না। নানা রঙের ফানুসের গল্প শুনতে হয়।
ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল শিল্পনগরীখ্যাত খুলনার সাথে। নিউজপ্রিন্ট, হার্ডবোর্ড মিল, দাদাম্যাচ, টেক্সটাইল মিল আজ ইতিহাস। ইতিহাসের পথে পাটকল ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, স্টার, ইর্স্টান, আলিম, খালিশপুর (পিপলস), দৌলতপুর। এখন খুলনায় মিলের হুইসেল বাজে না। শ্রমিকের পদভারে ভারী হয়না শিল্পাঞ্চল। মৃতপুরীর মতো অবস্থা শ্রমিক কলোনীগুলো। আর কবে হুইসেল বাজবে কেউ জানেন না, সুনিদিষ্ট কোন তথ্যও মেলেনা।
খুলনার শ্রমিকদের সাথে আমার সর্ম্পক দীর্ঘদিনের। এ সর্ম্পক আত্মার। এ সর্ম্পক প্রাণের সর্ম্পক। কতদিন খুলনার খালিশপুর বা আফিল, ইস্টার্ন এলাকার শ্রমিকদের সাথে কথা হয় না, দেখা হয় না বছর পেরিয়ে গেল। কষ্টক্লিষ্টে বেঁচে থাকা এইসব শ্রমিকদের চোখে দেখেছি স্বপ্নের পাহাড়। নিজেদের শোষণ মুক্তির যে কোন পথই তাদের আকৃষ্ট করতো। সেই চেনামুখগুলো আজ বড় অচেনা। জীবন-জীবিকার টানে তাঁরা আজ ছিন্ন। শ্রমিক মুক্তির শ্লোগান আজ তাঁদের কাছে দুর্গম গিরি।
১৮৮৬ সালের ইতিহাস তো ইতিহাস। ওই ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের প্রতিনিয়ত আন্দোলিত করে। ওইদিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন ওই শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা। কিন্তু আন্দোলনরত শ্রমিকদের দমাতে মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় পুলিশ। এতে ১১ শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেপ্তার হন আরও বহু শ্রমিক। পরে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ছয়জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। এ নিপীড়ন, হত্যা শ্রমিকদের দমাতে পারেনি। বিক্ষোভ অগ্নিগর্ভ ধারণ করে। পরে সরকার শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ১৮৯০ সাল থেকে পহেলা মে বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ ১৩৫ বছর পর শ্রমিকদের আত্মবলিদানের ইতিহাস মেকি চেতনায় আন্দোলিত হবে গোটা বিশ্ব। শ্রমিক শোষণকারীরাই শ্রমিক অধিকারের চেতনার বয়ানে সমৃদ্ধ করবেন সভা মঞ্চ। হাততালিও জুটবে নেহাত কম নয়। বাহবা কুড়াবেন, নেতা নেতা নেতা… বলে। আবার দিনটি পেরিয়ে গেলে তারাই আবার শ্রমিক শোষণের অভিনবত্ব দেখাবেন। শ্রমিক শোষণের নতুন কৌশল নির্ধারণ করবেন। অর্থাৎ শ্রমিকের অধিকার প্রশ্ন সেই তিমিরেই থাকবে, বছর ঘুরবে।
লেখার শুরুতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে শ্রমজীবী মানুষের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম তাঁদের সততার কথা। বাস্তবতা আসলেই তেমনটিই। হাজার কোটির টাকার রাজস্ব ফাঁকির তালিকায় নেই আমাদের কোন কৃষক, নেই কোন শ্রমিকের নাম। আজ যারা প্রয়োজনের তুলনায় মাঠে ফসল ফলাচ্ছেন, তাদের নামে কী দুর্নীতির মামলা রয়েছে, তারা কী ত্রাণের চুরির তালিকায় আছেন? বোধকরি এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য পান না। তাদের পণ্য নিয়ে দুর্ভোগের কথা কম শোনা যায় না। অথচ লুটেরা পূঁজিপতিরা দিন দিন পূঁজির মালিক হন। ফুলে ফেঁপে কোটি টাকা, হাজার কোটি টাকার মালিক হন, এসবই শ্রমজীবী মানুষের ঘামের মূল্য ফাঁকির ফসল। শ্রমিকের রক্ত শোষণের পূঁজি। তাই শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না, তারা নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হন। এ চক্র চলছে, চলবেই। সত্যিকার অর্থে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি মিলবে কবে। কবে এ শোষক মুক্তির অবসান ঘটবে কেউ জানে না। এ জন্য প্রয়োজন শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য, শ্রমিক-কৃষক ঐক্য। সেই ঐক্যের জন্য আমাদের লড়তে হবে। মুখোশের আড়ালে থাকা মুখোশধারী লুটেরা-শোষণকারীদের চি‎হ্নিত করতে হবে। তবেই মুক্তি, তবেই টিকে থাকা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।