সিলেট ২১শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:১৪ অপরাহ্ণ, মে ২, ২০২১
১লা মে দিনটি পৃথিবীর অনেক দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা মে দিবস নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এ দিনটি সরকারীভাবে ছুটির দিন। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মাহুতিকে এদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরন করা হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশে পালিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এইদিনটি পালিত হয় না।
‘শ্রমিক’ – সভ্যতার প্রতিটি ইট,বালু, পাথরে যাদের ফোটা ফোটা ঘাম জড়িয়ে আছে তারা কিন্তু কখনোই সভ্যতার আশীর্বাদধন্য শ্রেনী ছিলনা, এখনো নয়। আজকের এই নিবন্ধে ১৮৮৬ সালের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক সেই আন্দোলন নিয়েই লিখব বলে ঠিক করেছি।
দুনিয়াজোড়া শ্রমিক আন্দোলনের বীরোচিত ও গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা যাতে এসব আন্দোলনের তাৎপর্য না বুঝতে পারে, এজন্য এসব আন্দোলন নিয়ে মালিকেরা মিথ্যাচার ছড়িয়েছে বিপুল পরিমাণে। আবার এসব ইতিহাস চাপা দেয়ার চেষ্টা তো আছেই। তাই শ্রমিকরা আজ তাদের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে জানে না, যা জানে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল। এজন্য শ্রমিক আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। যার কাছে যেখানে এই লেখা পৌঁছাবে, তার দায়িত্ব এই সত্যগুলো শ্রমিকদের জানান। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
কাজের ঘন্টা কমাবার, আন্দোলনের সঙ্গে মে দিবসের জন্ম-কাহিনী অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। কাজের ঘন্টা কমাবার এই যে দাবি, শ্রমিকশ্রেণীর কাজে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য খুবই বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা ব্যবস্থা চালু হবার পর থেকে কাজের ঘন্টা কমাবার এই আন্দোলনের প্রকাশ সেখানে দেখা যায়।
প্রধানত মজুরি বাড়াবার দাবিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোড়ার দিকের ধর্মঘটগুলো হয়, কিন্তু যখনই তাঁরা নিজেদের দাবি দাওয়ার কোনো দলিল রচনা করেছেন, কাজের ঘন্টা কমানো এবং সংগঠনের অধিকারের প্রশ্ন তখনই সে দলিলের প্রথম দিকে স্থান পেয়েছে। একদিকে শোষণের মাত্রা বাড়তে লাগল, কাজের ঘন্টার অমানুষিক চাপে শ্রমিকরা পিষ্ট হতে লাগলেন, অন্যদিকে কাজের ঘন্টা কমাবার দাবিও জোরদার হয়ে উঠতে থাকল।
“সূর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত”- এই ছিল তখনকার দিনের কাজের ঘন্টা। উনিশ শতকের ঘোড়ার দিকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। চৌদ্দ, ষোল এমনকি আঠারো ঘন্টার কাজের দিনও তখন চালু ছিল। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা-শ্রমিকদের নেতাদের বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা চলছিল, তখন প্রকাশ পায় যে, শ্রমিকদের উনিশ থেকে কুড়ি ঘন্টা পর্যন্তও খাটানো হচ্ছিল।
১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাজের ঘন্টা কমাবার দাবিতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট হয়। দৈনিক দশ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করবার সুনির্দিষ্ট দাবিও অনেক শিল্পকেন্দ্রে তোলা হয়। ইংল্যান্ডের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নও দু’বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এবং দুনিয়ার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন বলে খ্যাত ফিলাডেলফিয়ার মেকানিকদের ইউনিয়নের জন্ম হয় ১৮২৭ সালৈ, গৃহনির্মাণশিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের এক ধর্মঘটের মারফত, তাও এই দশ ঘন্টা কাজের দাবিতেই। ১৮৩৪ সাল নিউইয়র্কে রুটি কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট চলতে থাকাকালে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট মেহনতী মানুষের মুখপত্র) নামক পত্রিকা খবর দেয়, “মিশর দেশে যে ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত আছে তার চাইতেও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকেন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গড়ে আঠারো থেকে কুড়ি ঘন্টাই তাঁদের খাটতে হয়!”
এসব অঞ্চলে দশ ঘন্টা কাজের দিনের আওয়াজ দ্রুতবেগে একটা আন্দোলনের আকার ধারণ করল। ১৮৩৭ সালের সঙ্কটে এই আন্দোলন ব্যাহত হয়: কিন্তু তা সত্ত্বেও এরই ফলে রাষ্ট্রপতি ভ্যান ব্যুরেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য দশ ঘন্টা, কাজের দিন বেঁধে দিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, এই আইন সমস্ত ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করবার সংগ্রাম পরবর্তী যুগে একটানা গতিতে চলতে থাকে। কয়েকটা শিল্পে এই দাবি স্বীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকরা দৈনিক আট-ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করবার দাবি তোলেন। ১৮৫০ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়বার ব্যাপারে প্রবল কর্মোদ্দীপনা দেখা দেয়, তারফলে এই দাবিও ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সঙ্কটের ফলে এই সংগ্রাম বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে সঙ্কট শুরু হবার আগেই কয়েকটি সুসংগঠিত শিল্পে এই দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। কাজের ঘন্টা কমানোর এই আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছিল, তা নয়, উদীয়মান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেখানেই শ্রমিকেরা শোষিত হচ্ছিলেন, সেখানেই এই আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল। তাই দেখা যায় যে, অষ্ট্রেলিয়ার মতো সুদূর দেশের গৃহ-নির্মাণ শ্রমিকরাও আওয়াজ তুলছিলেন “আট-ঘন্টা কাজ, আট-ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ, আট-ঘন্টা বিশ্রাম”, এবং এই দাবি আদায় করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
আমেরিকায় আট-ঘন্টা কাজের আন্দোলনের সূচনা
—————————————————
যে সমস্ত সংগ্রাম মে দিবসের জন্মের সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত, তার সূচনা হয় ১৮৮৪ সালে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আট-ঘন্টা কাজের দিনের আন্দোলনের মধ্যে অব্যশ এরও একপুরুষ আগে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’ নামে একটি জাতীয় শ্রমিক সংগঠন কাজের ঘন্টা কমাবার দাবিটি উত্থাপন করে এবং দাবির সমর্থনে একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলবার প্রস্তাব করে। প্রথমদিকে এই সংগঠনটি আমেরিকায় শ্রমিকশ্রেণীর একটি সংগ্রামশীল সংগঠনী কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। গৃহযুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরে, ১৮৬১-৬২ সালে- যদ্ধের ঠিক আগেই গঠিত এমন কয়েকটি ‘জাতীয় ইউনিয়ন’ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এগুলো মধ্যে মোল্ডারদের ইউনিয়ন এবং মেসিনিস্ট ও ব্ল্যাকস্মিথের ইউনিয়নের নাম উল্লেখযোগ্য। গৃহযুদ্ধের ঠিক পরেই কয়েকটি স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন জাতীয় পর্যায়ে মিলিত হলো। এই সমস্ত ইউনিয়ের মধ্যে কয়েকটি জাতীয় সম্মিলিত সংগঠন বা ‘ফেডারেশন’ গড়বার আগ্রহ প্রকট হয়ে উঠল। ১৮৬৬ সালের ২০ শে আগস্ট ষাটটি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি বালটিমোরে মিলিত হয়ে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করলেন। জাতীয় সংগঠন গড়ার এই আন্দোলনের পরিচালক ছিলেন মোল্ডারদের (ঢালাই শ্রমিকদের) পুনর্গঠিত ইউনিয়নের নেতা উইলিয়ম এইচ সিলভিস। সিলভিস যদিও বয়সে ছিলেন তরুণ, কিন্তু সে যুগের শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর স্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনস্থ প্রওথম আন্তর্জাতিকের নেতাদের সঙ্গে সিলভিস যোগাযোগ রেখে চলতেন। ‘আন্তর্জাতিক’-এর সাধারণ পরিষদের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে, তাঁর প্রভাব অনেকটা কাজ করেছিল।
‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে যে সম্মেলন ডাকা হয়েছিল তাতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
“এই দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে পুঁজিবাদীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করবার জন্য এই মুহূর্তের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হলো এমন একটি আইন পাশ করা- যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যেই সাধারণ কাজের দিন হবে আট-ঘন্টা। এই মহান লক্ষ্য পূর্ণ করার পথে সমগ্র শক্তি নিয়োগ করবার সঙ্কল্প আমরা গ্রহণ করছি।”
ঐ একই সম্মেলনে আট-ঘন্টা কাজের দিনের দাবি আইন হিসেবে আদায় এবং “শিল্পে নিযুক্ত শ্রেণীগুলির স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্ব করবার সঙ্কল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্যক্তিদের নির্বাচনের” জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’ এর আন্দোলনের ফলে অনেক ‘আট ঘন্টা-শ্রম সমিতি’ স্থাপিত হলো। এই সংগঠনের পরিচালনায় যে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা সৃষ্টি হলো, তার চাপে অনেকগুলো রাজ্য সরকারই, সরকারী কর্মক্ষেত্রে আট ঘন্টা কাজের দিনের দাবি মেনে নেয়, ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা এই মর্মে একটি আইন পাস করে। আট-ঘন্টা শ্রম-আন্দোলনের উৎসাহী নেতা ছিলেন বোস্টনের মেশিন-কর্মী ইরা স্টুয়ার্ড।
প্রথম যুগের শ্রমিক-আন্দোলনের বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচী ছিল আদিম এবং কখনও অবৈজ্ঞানিক। তাহলেও তার বুনিয়াদ ছিল সর্বহারা শ্রেণীর সুস্থ সহজাত প্রকৃতির মধ্যে। এই শ্রমিক আন্দোলনই পরবর্তীকালে সংগ্রামী শ্রমিক-আন্দোলনের রূপ পেতে পারত, কিন্তু এই আন্দোলনের সংস্কারবাদী ধুরন্ধররা এবং পরবর্তী যুগের পুঁজিবাদী রাজনীতিকরা একে ভুল খাতে পরিচালিত করেন। দেখা যাচ্ছে, আজ থেকে চার পুরুষ আগে আমেরিকায় শ্রমিকদের জাতীয় সংগঠন ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’, পুঁজিবাদী দাসত্বের বিপক্ষে এবং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মধারার সপক্ষে আওয়াজ তুলেছিল। লন্ডনে ‘আন্তর্জাতিক’-এর সঙ্গে যোগাযোগ সিলভিস বরাবরই রেখে চলেছেন। ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর সভাপতি হিসাবে তাঁর যে প্রভাব ছিল, সেই প্রভাবের বলেই ১৮৬৭ সালে উক্ত সংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রমিক-আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতার প্রস্তাব এবং ১৮৬৯ সালে ‘সাধারণ পরিষদ’-এর আমন্ত্রণের জবাবে আন্তর্জাতিকের বেল কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যক্রমে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’-এর সম্মেলনের আগেই সিলভিসের মৃত্যু হয় এবং তাঁর জায়গায় শিকাগো থেকে প্রকাশিত ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভেকেট’ পত্রিকার সম্পাদক এ সি ক্যামেরন প্রতিনিধি হিসাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন।
‘আন্তর্জাতিক’- এর সাধারণ পরিষদ একটি বিশেষ প্রস্তাবে আমেরিকার এই তরুণ উদীয়মান শ্রমিক নেতার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে। “সকলেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সিলভিসের উপরে। বিপুল কর্মক্ষমতা ছাড়াও শ্রমিকশ্রেণীর সেনানায়ক হিসাবে তাঁর ছিল দীর্ঘ দশ বছরের অভিজ্ঞতা। -সেই সিলভিস আর নেই। সিলভিসের মৃত্যু ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ; এই বিপর্যয় কিছুদিন বাদেই শুরু হলো এবং ক্রমে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর বিলুপ্তি ঘটল।
আট ঘন্টা আন্দোলন সম্পর্কে মার্কস
————————————-
১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’, আট-ঘন্টা কাজের দিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ঐ বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক’- এর জেনেভা কংগ্রেস উক্ত দাবির সমর্থনে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রকাশ করেঃ
“কাজের দিন আইন করে সীমাবদ্ধ করে দেবার ব্যাপারে একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা; এই ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণীর উন্নতি ও মুক্তির পরবর্তী সব প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হতে বাধ্য।…. কাজের দিন আট-ঘন্টা আইন করে বেঁধে দেবার প্রস্তাব কংগ্রেস উত্থাপন করছে।”
১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ‘কাজের দিন’ নামক অধ্যায়ে মার্কস ‘ন্যাশনাল লেবর ইউনিয়ন’- এর উদ্যোগে পরিচালিত আট-ঘন্টা কাজের দিন কায়েম করবার এই আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। নিগ্রো এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের শ্রেণীস্বার্থের অভিন্নতা সম্পর্কে যেখানে দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেই বিখ্যাত অনুচ্ছেদেই মার্কস লিখেছেন: “ক্রীতদাসের দরুন মার্কিন প্রজাতন্ত্রের একটি অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে থাকায় এতদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বতন্ত্র শ্রমিক-আন্দোলন একেবারে পঙ্গু হয়েছিল। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক যেখানে ক্রীতদাস, শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক সেখানে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। ক্রীতদাসত্বের সমাধির উপরই নবজীবনের অভুদ্যয় ঘটে। গৃহযুদ্ধের প্রথম অবদান হলো দৈনিক আট-ঘন্টা আন্দোলন- অবাধ গতিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত নিউ ইংল্যান্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অবধি।”
প্রায় একই সময় মাত্র দু-সপ্তাহের ব্যবধানে ব্যালটিমোরের এক শ্রমিক সম্মেলনে আট-ঘন্টা দৈনিক কাজের পক্ষে ভোট দেওয়া হয়। আর অন্য দিকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঠিক এই মর্মেই এক প্রস্তাব গৃহীত হয়: এই ঘটনার দিকে মার্কস সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন: “এইভাবে উৎপাদন অবস্থার স্বতঃস্ফূর্ত পরিণতি হিসাবে আটলান্টিকের দুই পারেই আজ ‘শ্রমিক-আন্দোলন’ কাজের ঘন্টা কমানোর দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং আট-ঘন্টা কাজের আওয়াজ তুলে এই দাবিকে সুনির্দিষ্ট আকার দিয়েছেন।”
জেনেভা কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ও মার্কিন সিদ্ধান্তের মধ্যেই যে সঙ্গতিসাধন করা হয়েছিল, তা নিম্নের প্রস্তাব থেকেই বোঝা যাবে: “কাজের ঘন্টাকে এইভাবে সীমাবদ্ধ করে দেবার দাবি যেহেতু উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়েছে, সেহেতু কংগ্রেস এই দাবিকেই সারা দুনিয়ার শ্রমিকদের সাধারণ দাবি হিসাবে গ্রহণ করছে।”
তেইশ বছর পরে আর একটা আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের উপরে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন ঠিক এইভাবেই এবং ঠিক একই আদর্শের জন্য আর একবার আরও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- মে দিবসের জন্মভূমি
————————————–
১৮৭২ সালে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে সদর দপ্তর স্থানান্তরের পরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’- এর অস্তিত্ব লোপ পায়, অবশ্য ১৮৭৬ সালের আগে সরকারিভাবে একে ভেঙে দেওয়া হয়নি। পুনর্গঠিত ‘আন্তর্জাতিক’- এর পরে যার নাম হয় ‘দ্বিতীয় আন্তÍর্জাতিক’- তার প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় পারিতে, ১৮৮৯ সালে। ঐ কংগ্রেসের ১লা মে তারিখটিকে বিশেষ দিবস হিসেবে উদযাপনের জন্য চিহ্নিত করা হয়। ঐ দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংগঠিত সারা দুনিয়ার শ্রমিকরা আট-ঘ্টা কাজের দিন ধার্য করার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করবেন। প্যারিসের এই সিদ্ধান্তের পিছনে পাঁচ বছর আগে শিকাগোতে গৃহীত আমেরিকার একটি তরুণ শ্রমিক সংগঠনের প্রস্তাবের প্রভাব কাজ করেছিল।
আমেরিকার এই সংগঠনটির নাম ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সংগঠিত ট্রেড ও লেবর ইউনিয়নের ফেডারেশন’। পরবর্তী যুগে এই সংগঠনের সংক্ষিপ্ত নাম হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’; ১৮৮৪ সালের ৭ই অক্টোবর উক্ত সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি পাশ হয় “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সংগঠিত ট্রেড ও লেবর ইউয়িনের ফেডারেশন এই প্রস্তাব প্রহণ করেছে যে ১৮৮৬ সালে ১লা মে তারিখ থেকে দৈনিক আট-ঘন্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এই সঙ্গে আমরা সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের কাছে সুপারিশ করছি যে তাঁরা যেন উপরোক্ত তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ এলাকায় আইনকানুন পরিচালনা করেন।”
আট-ঘন্টা কাজের দিন বেঁধে দেবার দাবি কোন কায়দায় কায়েম করা হবে সেই সম্পর্কে ‘ফেডারেশন’-এর প্রস্তাবে কিছু বলা হয়নি; তুবও এ কথা স্বভাবতই স্পষ্ট যে পঞ্চাশ হাজারের মত সদস্েযর আনুগত্য দাবি করতে পারে, এমন একটি সংগঠনের পক্ষে ‘দৈনিক আট-ঘন্টার কাজের দিন’ বলে আইনত গণ্য করার ঘোষণা জারি করা সম্ভব নয়, যদি এর সদস্যরা নিজ নিজ শপ, মিল ও খীনতে লড়াই শুরু না করেন এবং যদি আরও বেশি বেশি সংখ্যায় শ্রমিকদের এই দাবির লড়াইয়ে শামিল না করতে পারেন। ফেডারেশনের “সিদ্ধান্তের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের আইন কানুন পরিচালনা” করবার যে নির্দেশ সংশিষ্ট ইউনিয়নগুলোর উপর দেওয়া হয়েছিল, তার অর্থ হলো ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখের ধর্মঘট করার দরুন যে সমস্ত সদস্যকে দীর্ঘকাল কর্মস্থান থেকে বাইরে থাকতে হবে তাদের জন্য ধর্মঘটকালীন সাহায্যের ব্যবস্থা করা। যেহেতু এই ধর্মঘটের পরিধি সারা দেশজোড়া এবং যেহেতু সংশ্লিষ্ট সংগঠনই এ ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত এবং যেহেতু ইউনিয়নের কানুন অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়নকেই ধর্মঘটের সপক্ষে তার সদস্যবৃন্দের অনুমোদন সংগ্রহ করতে হবে, এই অনুমোদন বিশেষভাবে প্রয়োজন কারণ ইউনিয়নের টাকা খরচ করার ব্যাপারও এর সঙ্গে জড়িত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আজকের দিনের ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’- এর মতো সে সময়ও ফেডারেশন ছিল স্বেচ্ছামূলক সম্মেলনের ভিত্তিতে সংগঠিত; এই অবস্থায় জাতীয় সম্মেলনের কোনো সিদ্ধান্ত কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলো ঐ সিদ্ধান্ত মঞ্জুর করে।
মে দিবসের ধর্মঘটের প্রস্তুতি
—————————–
১৮৭৭ সালের মহান ধর্মঘট সংগ্রামগুলোতে লক্ষ লক্ষ রেল ও ইস্পাত শ্রমিক কর্পোরেশন এবং সরকারের ধর্মঘট ভাঙা সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যান; এই সংগ্রাম সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনের উপর ছাপ রেখে যায়; দেশজোড়া ভিত্তিতে আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর এই প্রথম বড়ো রকমের গণ-সংগ্রাম। যদিও রাষ্ট্রপুঁজির সম্মিলিত শক্তির কাছে তাঁদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল, তবুও এই সংগ্রামের ভিতর দিয়েই শ্রেণীগত অবস্থান সম্পর্কে অধিকতর সচেতন, অধিকতর সংগ্রামী চেতনাসম্পন্ন , অধিকতর দৃঢ়িপ্রতিজ্ঞ এক শ্রমিকশ্রেণীর অভ্যুদয় আমেরিকায় ঘটে। একদিক থেকে এই অভ্যুদয় পেনসিলভ্যানিয়ার কয়লাখনি মালিকদের অপচেষ্টার জবাব; কয়লাখনির এই মালিকরা ১৮৭৫ সালে খনি অঞ্চল থেকে খনিশ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করবার অভিসন্ধিতে দশ জন সংগ্রামী খনিশ্রমিককে (মলি ম্যাগুইরাস) ফাঁসিকাঠে লটকিয়েছিল।
১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সাল, এই দশ বছরে মার্কিন শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারের অভুতপূর্ব বিকাশ ঘটে; কিন্তু এরই মধ্যে ১৮৮৪-৮৫ সালে আমেরিকায় মন্দার প্রাদুভার্ব দেখা দেয়; ১৮৭৩ সালের সঙ্কটের পরে এই মন্দার প্রাদুর্ভাব ঘটে চক্রাকারে; কাজের ঘন্টা কমানোর আন্দোলন এই সময়কার বেকারী ও দুঃসহ দুরবস্থার ফলে আরও জোরদার হয়ে ওঠে।
‘ফেডারেশন’ তখন সবেমাত্র গঠিত হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, আট ঘন্টা কাজের দাবিকে কেন্দ্র করে ‘ফেডারেশন’ ও ‘নাইটস অব লেবর’-এর বহির্ভূত শ্রমিকদেরও সম্মিলিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘নাইটস অব লেবর’ ‘ফেডারেশন’- এর তুলনায় পুরানো এবং একটি বর্ধিষ্ণু প্রতিষ্ঠান। ‘ফেডারেশন’ বুঝতে পারল, সমস্ত সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মারফতেই কেবল অনুকূল ফল লাভ করার সম্ভাবনা আছে। তাই তাঁরা ‘নাইটস অব লেবর’ – এর কাছে আবেদন করলেন যাতে করে তাঁরা আট-ঘন্টার দাবি আন্দোলনের পেছনে সমর্থন জানান।
১৮৮৫ সালে ‘ফেডারেশন’-এর সম্মেলন থেকে পরবর্তী বছরে ১লা মে ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত পুনরায় ঘোষণা করা হয়। কয়েকটি জাতীয় ইউনিয়ন আসন্ন সংগ্রামের জন্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে কার্পেটার ও সিগার-মেকারদের ইউনিয়ন দুটো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মে দিবসের আন্দোলন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফল ফলতে আরম্ভ করে। ইউনিয়গুলোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ‘নাইটস অব লেবর’ দ্রুত বেগে প্রসার লাভ করতে থাকে; ১৮৮৬ সালে এই সংগঠন উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করে। ‘ফেডারেশন’- এর তুলনাতেও তখন ‘নাইটস্্ অব লেবর’ অধিক পরিচিত ছিল; আর তখন একে একটি সংগ্রামী সংগঠন বলেই মনে করা হতো। এই সময়ের মধ্যে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২ লক্ষ থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৭লক্ষ। আট-ঘন্টা কাজের আন্দোলনের সূচনা করেছিল ‘ফেডারেশন’; আর তাছাড়া এই দাবি পূরণের জন্য ধর্মঘটের তারিখ ঠিক করেছিল ফেডারেশন’, কাজে কাজেই এই সদস্য সংখ্যা খুব বেড়ে গেল; বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে বৃদ্ধি পেল এর মর্যাদা। ধর্মঘটের দিন যতই ঘনিয়ে এলো, ততই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল যে ‘নাইটস অব লেবর’-এর নেতারা বিশেষ করে টেরেন্স পাউডারলি, আনেদালনকে সাবোতাজ করছে; এমন কি ‘নাইটস অব লেবর’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলিকে ধর্মঘট না করার গোপন পরামর্শ দিতেও তারা পেছপা হয়নি। এর ফলে ফেডারেশনের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা আরও অনেক বৃদ্ধি পেল। উভয় সংগঠনের সাধারণ কর্মীরাই উৎসাহের সঙ্গে ধর্মঘটের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শহরে শহরে আট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতি গড়ে উঠল; অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যেও এর ছোঁয়াচ লাগল; আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাসে নতুন ভোরের আরো দেখা দিল।
শ্রমিকদের তখনকার মনোভাব বুঝবার জন্য সব চাইতে ভালো উপায় হলো তাদের বিভিন্ন সংগ্রামের গুরুত্ব এবং ব্যাপকতা লক্ষ্য করা। শ্রমিকদের সংগ্রামী মনোভাবের সুন্দর একটি মাপকাঠি হলো তাঁদের ধর্মঘটের সংখ্যা। ১৮৮৫-৮৬ সালে যতগুলো ধর্মঘট হয়েছে তার সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরের ধর্মঘটের সংখ্যা তুলনা করলেই বোঝা যায় কী এক অপূর্ব সংগ্রামী চেতনা তখন শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করছিল। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে মাত্র ৫০০ ধর্মঘট ও তালাবন্ধ হয়, আর এগুলোতে অংশগ্রহণ করেন ১লক্ষ ৫০ তাজার শ্রমিক। ১৮৮৫ সালে ধর্মঘট ও তালাবন্ধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ এবং সেগুলিতে যোগদানকারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার। ১৮৮৬ সালে ধর্মঘট ও তালাবন্ধের সংখ্যা ১৮৮৫ সালের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়, সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৭২; যোদগানকারী শ্রমিকদের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়; তাঁদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ । ধর্মঘটের ফলে ১৮৮৫ সালে যেখানে জড়িয়ে পড়ে মাত্র ২৪৬৭টি প্রতিষ্ঠান, ১৮৮৬ সালে সেখানে জড়িয়ে পড়ে ১১৫৬২টি; এ থেকে আঁচ করা যায় ১৮৮৬ সালে ধর্মঘট আন্দোলন কী দারুণ ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ‘নাইটস অব লেবর’- এর নেতাদের খোলাখুলি সাবোতাজ সত্ত্বেও, হিসেব করে দেখা যায় যে ৫ লক্ষ শ্রমিক আট-ঘন্টা-শ্রম-আন্দোলনের ধর্মঘটগুলোতে সরাসরিভাবে অংশগ্রহণ করেন।
ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। ধর্মঘটের আন্দোলন সেখানে সবচাইতে ব্যাপকতা লাভ করে; কিন্তু অন্যান্য অনেক শহরও ১লা মে তারিখের সংগ্রামে সামিল হয়। নিউইয়র্ক, বালটিমোর, ওয়াশিংটন, মিলওয়াকি, সিনসিন্নাটি, সেন্টলুই, পিটারসবার্গ, ডেট্রয় এবং আরও অনেক শহর ধর্মঘট করে বেরিয়ে অসার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। ধর্মঘট আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে অকুশলী এবং অসংগঠিত শ্রমিকেরা এই সংগ্রামের আবর্তে এসে গিয়েছিলেন। সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট এই যুগে প্রায় একটা রেওয়াজেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সারা দেশ জুড়ে একটি বিদ্রোহী মনোভাবের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা, এই যুগের মনোভাবকে ‘সামাজিক যুদ্ধ’, ‘পুঁজির প্রতি ঘৃণা’ প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। এই আন্দোলনে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে যে উদ্দীপনার জোয়ার দেখা দেয়, সেই সম্পর্কেও তাঁরা লিখে গিয়েছেন। হিসাব কষে দেখা যায় মে দিবসে যারা ধর্মঘট করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের মতো আট-ঘন্টা কাজের দাবি আদায় করতে সফল হন; এবং যেখানে তাঁরা পুরোপুরি সফল হননি সেখানেও কাজের ঘন্টা কমাতে তাঁরা যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন।
শিকাগো ধর্মঘট এবং হে মার্কেটের ঘটনা
——————————————
সেকালে বামপন্থী সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। স্বভাবত এই শিকাগোতেই ১লা মে’র ধর্মঘট খুব জঙ্গী চেহারা ধারণ করে। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এমন অনেকগুলো রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও সে সময়কার আন্দোলন বাস্তবিক পক্ষে সংগ্রামী আন্দোলনই ছিল। শ্রমিকদের সংগ্রামের ময়দানে সামিল করতে জীবন ও জীবিকার অবস্থার আশু উন্নয়নের জন্য লড়াইয়ের মারফত তাদের সংগ্রামী চেতনা গড়ে তুলতে সে সময়কার আন্দোলন সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। সংগ্রামী শ্রমিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতার ফলে শিকাগোর ধর্মঘট বিরাট আকার ধারণ করল। ধর্মঘট শুরু হবার অনেক আগেই ধর্মঘটের প্রস্তুতি চালাবার জন্য সেখানে একটি আট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতি ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ মোর্চার প্রতীক। এই সমিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল ‘ফেডারেশন’, ‘নাইটস অব লেবর’ এবং আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ‘সোস্যালিস্ট লেবর পাটি’র অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়গুলো। সমস্ত বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘সেন্ট্রাল লেবর ইউনিয়ন’। এই আট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতিকে সমর্থন জানায়। ১লা মে’র ঠিক আগেকার রবিবারে ‘সেন্ট্রাল লেবর ইউনিয়ন’ একটি সমাবেশ সংগঠিত করে; ২৫০০০ শ্রমিক এই জমায়েত অংশগ্রহণ করেন।
১লা মে তারিখে শিকাগোতে শ্রমিকদের এক সুবিশাল সমাবেশ হয়; শহরে সংগঠিত শ্রমিক-আন্দোলনের ডাকে এই সমস্ত শ্রমিক কাজ বন্ধ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। শ্রমিক-আন্দোলনের ইতিহাসে এর আগে শ্রেণীসংহতির এত বলিষ্ঠ প্রকাশ আর দেখা যায়নি। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে আট-ঘন্টা কাজের এই আওয়াজ এবং ধর্মঘটের বিস্তৃতি ও চরিত্র সমগ্র আন্দোলনকেই গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্যে মন্ডিত করেছিল। ১৮৮৬ সালে ১লা মে’র ধর্মঘটে-আট-ঘন্টা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে; আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামী ইতিহাসে এই আন্দোলন রচনা করে এক গৌরবময় অধ্যায়।
শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুরাও সে সময় নিস্ক্রিয় ছিল না। মালিক এবং শিকাগো সরকারের সম্মিলিত শক্তি সংগ্রামী নেতাদের ধ্বংস করে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল; তারা ভেবেছিল এর ফলে শিকাগোর সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনকে মারাত্মক আঘাত হানা সম্ভব হবে, বৃহত্তর ক্ষমতার বলে তারা শিকাগোর শ্রমিক অভিযানের গতি রোধ করে। এই ১লা মে তারিখের ঘটনারই প্রত্যক্ষ পরিণতি হলো ৩রা ও ৪ঠা মে তারিখের ঘটনাগুলো- হে মার্কেটের ঘটনা বলে যা পরিচিত। ৩রা মে তারিখের ‘ম্যাক-কর্মিকরিপার কারখানা’র ধর্মঘটী শ্রমিকদের এক সভায় পুলিস জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ’জন শ্রমিককে হত্যা এবং অনেককে আহত করে। পুলিসের এই পাশব আক্রমণের প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে মার্খেট স্কোয়ারে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল এবং সেদিনকার মতো স্থগিত হতে যাচ্ছিল, এমন সমায় সমবেত শ্রমিকদের উপর পুলিস আবার আক্রমণ করে, ভিড়ের মধ্যে একটি বোমা এসে পড়ে এবং তার আঘাতে একজন সার্জেন্ট নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই লড়াই শুরু হয়ে গেল: সে লড়াইয়ে মুত্যু হয় সাতজন পুলিসের আর চার জন শ্রমিকের। হে মার্কেটে রক্তের প্লাবন, পার্সনস, স্পাইজ, ফিসার এবং এঙ্গেলের ফাঁসির মঞ্চে নির্বিচারে প্রাণহরণ, শিকাগোর সংগ্রামী শ্রমিক নেতাদের কারাগারে প্রেরণ- এই হলো শ্রমিকদের প্রতি মলিকপক্ষের জবাব। সারা দেশ জুড়ে মালিকদের কাছে এটা হলো শ্রমিকদের উপর আক্রমণ চালানোর সঙ্কেত হিসাবে। ১৮৮৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে শ্রমিকদের উপর চললো মালিকদের সুসংহত আক্রমণ, ১৮৮৫-৮৬ সালের ধর্মঘট আন্দোলনে যে ক্ষমতা তারা হারিয়েছে তা আবার উদ্ধার করাই হলো মালিকদের লক্ষ্য।
শিকাগোর শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির এক বছর পরে ১৮৮৮ সালে বর্তমানে আমেরিকায় ‘ফেডারেশন অব লেবর’ বলে যা পরিচিত সেই ‘ফেডারেশন’ সেন্ট লুই সম্মেলনে আট-ঘন্টা কাজের আন্দোলন আবার শুরু ও সংগঠিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। পর পর দু’বছর ধরে একটি রাজনৈতিক শ্রেণী দাবির উপর সংগঠিত শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুর ভূমিকা গ্রহণ করে যে তারিখটি স্বকীয় ঐতিহ্য রচনা করেছে, সেই ১লা মে তারিখটিকেই বেছে নেওয়া হলো আট-ঘন্টা কাজের আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের দিন হিসাবে। ১৮৯০ সালের ১লা মে কাজের সময় কমাবার দাবিতে সারা দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ঢেউ বয়ে গেল। অবশ্য ১৮৮৯ সালের সম্মেলনে স্যামুয়েল গমপার্স-এর নেতৃত্ব ‘ফেডারেশন অব লেবর’ ধর্মঘট আন্দোলনের পরিধিকে সঙ্কুচিত করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে, ধর্মঘটের জন্য সব চাইতে ভালোভাবে প্রস্তুত ‘কার্পেন্টার্স ইউনিয়ন’ ধর্মঘট শুরু করবেন। সেখানে যদি ধর্মঘট সফল হয়, তাহলেই অন্যান্য ইউনিয়ন ধর্মঘটের পথে পা বাড়াবে।
মে দিবস আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হলো
———————————————
মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিশ্রেণীর পবিত্র দিবসে উন্নীত করবার ব্যাপারে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’- এর অবদানের কথা গমপার্স তাঁর আত্মজীবনীতে এইভাবে বর্ণনা করেছেন: “আট-ঘন্টা আন্দোলনের পরিকল্পনা যতই অগ্রসর হচ্ছিল, ততই আমরা উপলব্ধি করছিলাম কীভাবে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যাপক থেকে আরও ব্যাপক করা যায়। প্যারিসের আসন্নপ্রায় আন্তর্জাতিক ‘ওয়ার্র্কিং মেন্স কংগ্রেস’ (মেহনতী মানুষের সম্মেলন) ঘনিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে এই ধারণা জন্মাল যে উক্ত কংগ্রেস থেকে দুনিয়াজোড়া সহযোগিতার অভিব্যক্তি দ্বারা আমাদের আন্দোলনকে সাহায্য করতে পারি।” পরবর্তী যুগে যে সংস্কারবাদ ও সুবিধাবাদ শ্রেণীসহযোগিতার নীতি গ্রহণের মারফত চূড়ান্তভাবে প্রকট হয়েছিল তার সমস্ত লক্ষণই ইতিমধ্যে গমপার্সের মনোভাব ও আচরণে ধরা পড়েছিল। যে সমাজতন্ত্রী শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম চালাতেন, তারই সমর্থন জোগাড় করবার জন্য গমপার্স এখন তৎপর হয়ে উঠলেন।
১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতনের শতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা দেশের সংগঠিত সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ পারিতে জড়ো হন; তাঁদের লক্ষ্য ছিল পঁচিশ বছর আগে তাঁদের মহান শিক্ষাগুরু কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরই ছাঁচে আর একটি সগঠনের ভিত্তি স্থাপন করা। পরবর্তী যুগে যার নাম হয় “দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক”। সেই সংগঠনের উদ্বোধনী সভায় দেশ বিদেশের প্রতিনিধিরা আমেরিকার প্রতিনিধিদের কাছে থেকে শুনতে পেলেন ১৮৮৪-৮৬ সালের আট-ঘন্টা আন্দোলনের এবং তার সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবনের কাহিনী। আমেরকিার শ্রমিকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হযে পারিতে কংগ্রেস নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করেঃ
“যাতে করে একটি নির্দিষ্ট দিবসে সমস্ত দেশের সমস্ত শহরের মেহনতী মানুষ তাদের নিজ নিজ সরকারের কাছে আট-ঘন্টা কাজের সময় আইন করে বেঁধে দেবার দাবি উত্থাপন করতে এবং এই কংগ্রেসে গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে এই কংগ্রেস একটি বিশাল আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। যেহেতু ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সেন্ট লুই সম্মেলনে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’ ১৮৯০ সালের ১লা মে তারিখে অনুরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত ইতিপূর্বে গ্রহণ করেছে, সেহেতু উক্ত তারিখটিকেই আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ প্রদর্শনের দিন হিসাবে নির্দিষ্ট করা হলো। নিজ নিজ দেশের অবস্থা অনুযায়ী বিক্ষোভ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের অবশ্য কর্তব্য।”
১৮৯০ সালের ইউরোপের অনেক দেশেই মে দিবস উদযাপন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রী পিটার ম্যাকগুই এর নেতৃত্বে ‘কাপেন্টার্স ইউনিয়ন’ এবং অন্যান্য নির্মাণ শিল্পের কর্মীরা অট-ঘন্টা কাজের দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট প্রতিপালন করেন। সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিশেষ আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও জার্মানির বিভিন্ন শিল্প অঞ্চলে মে দিবস উদযাপিত হয়। এইভাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজধানীতেও কর্তৃপক্ষের হুঁশিয়ারি ও দমনমূলক ব্যবস্থাদি উপেক্ষা করে সভা-শোভাযাত্রায় ব্যবস্থা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো এবং নিউইয়র্কের শোভাযাত্রার বিশেষ তাৎপর্য ছিল। হাজারে হাজারে মেহনতী মানুষ ৮ ঘন্টার দাবিতে পথে পথে মার্চ করেন: এই অভিযান শেষ হয় খোলা ময়দানে, বিরাট কেন্দ্রীয় সমাবেশের মধ্যে।
১৮৯১ সালের ব্রাসেলস- এ অনুষ্ঠিত পরবর্তী কংগ্রেসে আট-ঘন্টা কাজের দাবির যে মূল লক্ষ্য মে দিবসের দাবি হিসাবেই ইতিপূর্বে ঘোষিত হয়েছিল, তা আবার ঘোষণা কর হয়; এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং জাতিতে-জাতিতে শান্তি সংরক্ষণের দাবির সমর্থনে একটি শোভাযাত্রার নির্দেশও জারি করা হয়। ‘আট-ঘন্টা কাজের দিনের দাবি’ এবং অন্যান্য সব দাবি, যার ফলে ‘শ্রেণী-সংগ্রাম আরও গভীর’ হবে, তা পূরণের জন্য ‘১লা মে-র সভা শোভাযাত্রার শ্রেণী চরিত্রের’ উপর গুরুত্ব দিয়ে সংশোধিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই প্রস্তাবে এই নির্দেশও দেওয়া হয়, ‘যেখানে সম্ভব সেখানেই’ কাজ বন্ধ রাখতে হবে। মে দিবসে ধর্মঘটের উল্লেখ যদিও শর্ত দ্বারা সীমায়িত ছিল, তথাপি সভা-শোভাযাত্রার উদ্দেশ্যকে ব্যাপকতর ব্যাখ্যা এবং বাস্তবরূপ দান করতে ‘আন্তর্জাতিক’ সচেষ্ট ছিল। ব্রিটিশ লেবরপন্থীরা মে দিবসের এই শর্ত সাপেক্ষে ধর্মঘটের প্রস্তাব গ্রহণ করতেও অস্বীকৃতি জানায় এবং এইভাবে তাদের সুবিধাবাদী মনোভাবের উদাহরণ দেয়। জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রাটদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা ১লা মে’র রবিবারের জন্য মে দিবসের ধর্মঘট ঝুলিয়ে রাখবার প্রস্তাবে ভোট দেয়।
আন্তর্জাতিক মে দিবস সম্পর্কে এঙ্গেলস
—————————————-
১৮৯০ সালের ১লা মে কমিউনিস্ট ইশতেহারের চতুর্থ জার্মান সংস্করণে ভূমিকা লিখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলির ইতিহাস পর্যালোচনা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবসের তাৎপর্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছেনঃ
“এই লাইনগুলো আমি যখন লিখছি, ঠিক তখনই ইউরোপ ও আমেরিকায় শ্রমিকশ্রেণী তাঁদের শক্তি সামর্থ্যের হিসেব নিকেশ করছেন: ইতিহাসে এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণী একটি সৈন্যবাহিনী হিসেবে, একই পতাকাতলে একটিমাত্র লক্ষ্য পূরণের জন্য সংগ্রাম করছেন: সেই লক্ষ্য হলো আট-ঘন্টা কাজের দিনকে আইনের স্বীকৃতির উপরে প্রতিষ্ঠিত করা… আজ আমরা যে চিত্র প্রত্যক্ষ করছি তা থেকে সমস্ত দেশের পুঁজিবাদী আর জমিদাররা বুঝতে পারবে, সমস্ত দেশের শ্রমিকরা আজ সত্যি সত্যিই ঐক্যবদ্ধ। হায়, আজ যদি মার্কস আমার পাশ থেকে এই চিত্র প্রত্যক্ষ করতে পারতেন।”
একই সময় দেশে দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশের এই তাৎপর্য ক্রমশই ব্যাপকতরভাবে সারা দুনিয়ার মেহনতী মানুষের কল্পনা ও বৈপ্লবিক চেতনাকে অধিকার করে ফেলেছিল; এবং প্রত্যেক বছরেই আগের বছরের তুলনায় জনসাধারণ বিপুলতর সংখ্যায় সভা-শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৮৯৩ সালে আন্তর্জাতিকের জুরিখে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে ১লা মে প্রস্তাবের সঙ্গে এঙ্গেলস-এর উপস্থিতিতে যে অংশ যোগ করা হয়, তা থেকেই বোঝা যাবে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে কী পরিমাণে সাড়া তখন জেগেছিল:
“আট-ঘন্টার দাবিতে ১লা মে তারিখে যে শ্রমিক সমাবেশ, তা শ্রমিকশ্রেণীর সুদৃঢ় সঙ্কল্পের অঙ্গীকার; এই সঙ্কল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের মারফত শ্রেণী-বৈষম্যের বিলোপ সাধন করা; এবং এইভাবে শ্রেণী-বৈষম্যের বিলোপের ম্যাধমে সমস্ত জাতির শান্তির পথে আন্তর্জাতিক শান্তির একমাত্র সড়কে পদার্পণ করা।”
বিভিন্ন দলের সংস্কারবাদী নেতাদের চেষ্টা হলো সংগ্রামের দিনের পরিবর্তে বিশ্রাম ও আমোদ-প্রমোদের দিনে পরিণত করে মে দিবসের সমাবেশকে প্রাণহীন করে দেওয়া। এই জন্য তারা চেষ্টা করত, মে দিবসের পরবর্তী প্রথম রবিবার অবধি সভা-সমাবেশ ঝুলিয়ে রাখতে। রবিবার শ্রমিকদের ধর্মঘট করবার প্রয়োজন হবে না, কারণ রবিার কাজ করতে হয় না। সংস্কারবাদী নেতাদের চোখে মে দিবস হলো নিছক একটা আন্তর্জাতিক ছুটির দিন: পার্কে পার্কে বা শহরতলীর কোনো পল্লীতে আমোদ-প্রমোদ আর খেলা-ধুলার দিন। জুরিখ কংগ্রেসের প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছিল যে, মে দিবস হবে “শ্রেণী-বৈষম্য বিলোপের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর সুদৃঢ় সঙ্কল্পের অঙ্গীকার” অর্থাৎ শোষণ এবং মজুরি-দাসত্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদের জন্য সুদৃর সঙ্কল্পের অঙ্গীকার: সংস্কারবাদী নেতারা কিন্তু এতে করে এতটুকুও বিব্রত হননি, কারণ আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের সিদ্ধান্তগুলোকে তাদের উপর প্রযোজ্য বলে তারা মনে করতেন না, যুদ্ধের আগে ইউরোপের রাজধানীতে মাঝে মাঝে নানা ধরনের কংগ্রেসের রেওয়াজ ছিল; সংস্কারবাদী নেতাদের চোখে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী কংগ্রেসও সেগুলোর মতো আন্তর্জাতিকে মৈত্রী ও শুভেচ্ছা দেখাবার জন্য আনুষ্ঠানিক সভা ছাড়া আরও কিছুই নয়। শ্রমিকশ্রেণীর সম্মিলিত আন্তর্জাতিক আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত ও ব্যাহত করতে তাঁরা সবরকমের অপচেষ্টা করতেন, আন্তর্জাতিক কংগ্রেসগুলোর যে সমস্ত প্রস্তাব তাঁদের মনমতো হতো না, সেগুলোকে তাঁদের কাছে কাগুজে প্রস্তাব হিসাবে থেকে যেত। ২০ বছর পরে এইসব সংস্কারবাদী নেতাদের ‘সমাজতন্ত্র’ এবং ‘আন্তর্জাতিকতার’ মুখোশ একেবারেই খুলে পড়ল। ১৯১৪ সালে ‘আন্তর্জাতিক’ বিপর্যস্ত হয়ে গেল, কেননা জন্ম থেকে এর অভ্যন্তরেই এর ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল- এই ধ্বংসের বীজ হলো শ্রমিকশ্রেণীর সংস্কারবাদী ধুরন্ধররা।
১৯০০ সালে পারিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আগেকার কংগ্রেসগুলোর মে দিবসের প্রস্তাব আবার গৃহীত হলো; কাজ বন্ধ করে দিলে মে দিবসের বিক্ষোভ প্রদর্শন আরও ফলপ্রসূ হবে এই মর্মে এই বিবৃতি দেবার ফলে পারি কংগ্রেসের প্রস্তাব আরও জোরদার হলো। ক্রমে ক্রমে মে দিবসের বিক্ষোভগুলো শ্রমিকশ্রেণীর শক্তিমত্তার অঙ্গীকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল; মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদানকারী এবং ধর্মঘটী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল: ১লা মে লাল দিনে পরিণত হলো; বছরের পর বছর ১লা মে ঘুরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে উঠতে লাগল।
মে দিবস সম্পর্কে লেনিন
—————————
রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে তার কর্মজীবনের গোড়ার দিকেই রাশিয়ার শ্রমিকদের কাছে মে দিবসকে বিক্ষোভ ও সংগ্রামের দিবস হিসাবে তুলে ধরেন লেনিন। ১৮৯৬ সাল থেকে জেলে আটক থাকাকালে তিনি রাশিয়ার প্রথম মার্কসীয় রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর অন্যতম ‘সেন্ট পিটার্সবার্গ ’ ‘ইউনিয়ন অব স্ট্রাগল ফর লিবারেশন অব দি ওয়ার্কিং ক্লাস’ (শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের ইউনিয়ন) নামক সংগঠনের জন্য একটি মে দিবসের ইশতেহার রচনা করেন। সেই ইশতেহার গোপনে দেশের বাইরে চালান করা হয় এবং এর ২০০০ কপি ৪০টি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করা হয়। ইশতেহারখানা খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল এবং যাতে করে অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রমিকও পড়ে বুঝতে পারেন সে জন্য লেনিনের অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অর্থাৎ সহজ এবং সরাসরি কায়দায় লেখা ছিল। উক্ত ইশতেহার প্রকাশের কাজে সহায়তা করেছিলেন এমন একজন সমসাময়িক ব্যক্তি ঐ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “এক মাস পরে যখন ১৮৯৬ সালের বিখ্যাত সুতাকলের ধর্মঘট ফেটে পড়ল, তখন শ্রমিকরা আমাদের বলেছিলেন যে ছোটো সাধাসিধে ইশতেহারখানাই প্রথম তাঁদের প্রেরণা যুগিয়েছিল।”
কলকারখানায় কীভাবে মালিকের স্বার্থে মজুরদের শোষণ করা হয় এবং কীভাবে অবস্থা উন্নয়নের দাবি তুললে সরকার তাদের নির্যাতন করে তা বলবার পরে, উক্ত ইশতেহারে লেনিন মে দিবসের তাৎপর্য বর্ণনা করেছেনঃ
ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ যেখানে শ্রমিকরা ইতিপূর্বেই শক্তিশালী সব ইউনিয়নে সংগঠিত হয়েছেন এবং নিজেদের জন্য অনেক অধিকার আদায় করেছেন- সেই সমস্ত দেশ উনিশে এপ্রিল তারিখটিকে (১লা মে)(পশ্চিম ইউরোপের ক্যালেন্ডার থেকে রাশিয়ার ক্যালেন্ডারের তারিখ ১৩ দিন পিছিয়ে ছিল) শ্রমিকশ্রেণীর সর্বজনীন কর্মবিরতির দিন হিসাবে ঠিক করেছে। কলকারখানার গুমোট পেছনে ফেলে নিশান উড়িয়ে সঙ্গীতের তালে তালে তাঁরা মার্চ করেন শহরের বড় বড় সড়কে; মালিকরা দেখতে পায়, তাঁদের ক্রমবর্ধমান শক্তি। শ্রমিকরা জমায়েত হন বিরাট গণসমাবেশে মালিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিগত বছরের জয়ের সালতামামি দিয়ে সেখানে বক্তৃতা হয়; সেইসব সমাবেশে শ্রমিকরা ভবিষ্যতের সংগ্রামের পরিকল্পনাও হাজির করেন। সেইদিন থেকে কাজ না করার জন্য মালিকরা শ্রমিকদের জরিমানা করতে সাহস পায় না। কারণ ধর্মঘটের ভয় আছে। এই দিনেই আবার শ্রমিকরা মালিকদের স্মরণ করিয়ে দেন তাঁদের প্রধান দাবি: ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, এই আওয়াজই আজ অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের দাবি।”
মে দিবসকে রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলন খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিল। ১৯০০ সালের নভেম্বর মাসে ‘খারকভে মে দিবস’ নামক পুস্তিকার ভুমিকায় লেনিন লেখেনঃ
“আর ছ’মাসের মধ্যেই নতুন শতকের প্রথম বছরের মে মাসের প্রথম দিনটি রাশিয়ার শ্রমিকরা উদযাপন করবেন। সময় হয়ে গেছে, যখন আমাদের কাজ শুরু করে দেওয়া দরকার- যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক কেন্দ্র এবং যথাসম্ভব চিত্তাকর্ষকভাবে অনুষ্ঠানাদি সংগঠিত করার কাজ; চিত্তাকর্ষক কেবল যোগদানকারী শ্রমিকদের সংখ্যার মাপকাঠিতে নয়; চিত্তাকর্ষক তাঁদের সংগঠিত চরিত্রের, “তাঁদের শ্রেণীচেতনার মাপকাঠিতে; চিত্তাকর্ষক রাশিয়ার মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি তথা শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগতি ও সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের অপরাজেয় সংগ্রাম শুরু করার সংকল্পের মাপকাঠিতে।”
মে দিবসের ছ’মাস আগে লেনিন মে দিবসের অনুষ্ঠানাদির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; এই থেকেই বোঝা যায়, তিনি মে দিবসের অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তাঁর কাছে মে দিবস ছিল, “রাশিয়ার মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য অপরাজেয় সংগ্রাম” এবং “শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীগত অগ্রগতি ও সমাজতন্ত্রের জন্য সরাসরি সংগ্রাম” এর কেন্দ্রবিন্দু।
মে দিবসের অনুষ্ঠানগুলো “কীভাবে বিরাট বিরাট রাজনৈতিক সমাবেশে পরিণত হতে পারে।” সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেনিন প্রশ্ন করেন, ১৯০০ সালের খারকভের মে দিবস অনুষ্ঠান “কেন একটি অনন্যসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।” লেনিন নিজেই এর প্রশ্নের জবাবে বলেন, “ধর্মঘটে শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ, পথে পথে বিরাট বিরাট জনসভা, লালঝান্ডা-উত্তোলন, ইশতেহারে ইশতেহারে আট-ঘন্টা কাজের দিন ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবি উত্থাপন এবং এইসব দাবির বিপ্লবী চরিত্র” (এইসব কারণেই খারকভের মে দিবস একটি অনন্যাসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা)।
আট-ঘন্টা কাজের দাবির সঙ্গে অন্যান্য ছোটোখাটো এবং নিছক অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া জুড়ে দেবার জন্য লেনিন খারকভের পার্টি নেতাদের ভর্ৎসনা করেছেন, কারণ তিনি চাননি যে, মে দিবসের রাজনৈতিক চরিত্র কোনওরকমে ঢাকা পড়ে যায়। ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেনঃ
“এই দাবিগুলো প্রথম দাবিটি (আট-ঘন্টা কাজের দিনের দাবি) সব দেশের শ্রমিকশ্রেণী সাধারণ দাবি। এই দাবিটি যে তোলা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয় খারকভের অগ্রসর শ্রমিকেরা আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের যে একত্ব আছে তা অনুভব করে থাকেন। কিন্তু ঠিক এই কারণেই ফোরম্যানদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার, শতকরা দশভাগ মজুরি-বৃদ্ধির মতো ছোটো-খাটো দাবিদাওয়ার সঙ্গে এই দাবিটিকে জুড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। আট-ঘন্টা কাজের দাবি সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর দাবি, এই দাবির লক্ষ্য ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন মালিক নয়; লক্ষ্য সরকার, কারণ সরকার হলো আজকের দিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি; লক্ষ্য সমগ্র পুঁজিবাদী, সমস্ত রকমের উৎপাদনী হাতিয়ারের মালিকরা।”
মে দিবসের রাজনৈতিক স্লোগান
———————————
আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর কাজে মে দিবসগুলো হয়ে উঠল এক একটা কেন্দ্রবিন্দু। আট-ঘন্টা কাজের দিনের মূল দাবির সঙ্গে আরও সব তাৎপর্যপূর্ণ দাবি যুক্ত হলো- এই সমস্ত দাবির উপর মে দিবসের ধর্মঘট ও সভা-শোভাযাত্রায় সংহত হয়ে দাঁড়াবার জন্য শ্রমিকদের আহ্বান জানানো হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর একতা- সর্বজনীন ভোটের অধিকার; সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরোধিতা, মিছিলের অধিকার, রাজবন্দীদের মুক্তি, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন গড়বার অধিকার প্রভৃতি দাবি এই সমস্ত দাবির অন্তর্ভুক্ত।
মে দিবসের প্রশ্নের উপর পুরনো ‘আন্তর্জাতিক’ শেষবারের মতো আলোচনা করে ১৯০৪ সালে আমস্টার্ডাম কংগ্রেস। মে দিবসের সভা-শোভাযাত্রায় যে সমস্ত স্লোগান তোলা হয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা এবং কোনো কোনো দেশে যে তখনও পর্যন্ত ১লা মে’র পরিবর্তে রবিবার মে দিবস উদযাপন করা হয়, সে সম্বন্ধে উল্লেখের পর, উক্ত প্রস্তাব এইভাবে শেষ করা হয়:
“আট-ঘন্টা কাজের দিন আইন হিসাবে কায়েম করার দাবিতে, শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণীগত দাবিদাওয়া আদায়ের দাবিতে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১লা মে তারিখে জোরালোভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য আর্মস্টার্ডামে অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক কংগ্রেস সমস্ত দেশের সমস্ত পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। বিক্ষোভ প্রদর্শনের সব চাইতে জোরদার কায়দা হলো কাজ বন্ধ করে দেওয়া। শ্রমিকদের স্বার্থ ব্যাহত না করে যেখানে সম্ভব সেখানেই ১লা মে তারিখে কাজ বন্ধ রাখবার জন্য এই কংগ্রেস সমস্ত দেশের শ্রমিকশ্রেণীর উপর নির্দেশ জারি করেছে।”
১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে সাইবেরিয়ার লেনা সোনার খনিতে ধর্মঘটীদের হত্যাকান্ডের ফলে বিপ্লবী গণ-সংগ্রাম রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর আশু কর্মসূচীতে পরিণত হলো আর তখন এই মে দিবসেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ রুশ শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। তাঁরা বেরিয়ে এলেন প্রতিক্রিয়াশীল জারতন্ত্র্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসাবে; যে জারতন্ত্র ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পর থেকে দোর্দন্ডপ্রত্যাপে বিরাজ করছিল। এই মে দিবস সম্পর্কে লেনিন লিখেছেনঃ
“সারা রাশিয়ার জুড়ে মে দিবসের মহান ধর্মঘট, উক্ত ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত মিছিল সমূহ, বিপ্লবী ঘোষণাবলী, মেহনতী মানুষের জমায়েত, বিভিন্ন বিপ্লবী বক্তৃতা- এইসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে রাশিয়া পুনরায় এক ঘনায়মান বিপ্লবী পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছে।”
প্রথম মহাযুদ্ধের আমলে মে দিবস
————————————–
যুদ্ধের আমলে সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা ১৯১৫ সালের মে দিবসে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ল। ১৯১৪ সালের সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলোর সঙ্গে যে শ্রেণী-শান্তি তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, এই বিশ্বাসঘাতকতা তারই স্বাভাবিক পরিণতি। জার্মানির সোশ্যাল-ডেমোক্রাটরা শ্রমিকদের আহ্বান জানালো কাজে লেগে থাকেত; ফ্রান্সের সোশ্যালিস্টরা একটি বিশেষ ইশতেহার বার করে কর্তৃপক্ষকে আশ্বাস দিল মে দিবস সম্পর্কে সস্ত্রস্ত না হবার জন্য। অন্যান্য যুদ্ধরত দেশে সংখ্যাগুরু সোশ্যালিস্টরাও একই মনোভাবের পরিচয় দিল। একমাত্র রাশিয়ার বলশেভিকরা আর অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘু বিপ্লবীরা সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত রইলেন। লেনিন, লুক্সেমবার্গ এবং লিবনেখট- এর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মদমত্ত জাত্যভিমানের বিরুদ্ধে। ১৯১৬ সালের মে দিবসে সমস্ত যুদ্ধরত দেশেই আংশিক ধর্মঘট এবং খোলাখুলি সংঘর্ষ ঘটে। এ থেকে এই সত্য প্রমাণিত হয় যে বেইমান নেতাদের বিষাক্ত প্রভাব থেকে শ্রমিকরা নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছেন। লেনিনের মতে- যেমন সকল বিপ্লবীদের মতে- ‘সুবিধাবাদের এই ‘বিপর্যয়’ (অর্থাৎ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই বিপর্যয়) শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে কল্যাণকর। বিশ্বাসঘাতকদের স্পর্শমুক্ত নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার জন্য লেনিনের আহ্বানে সেদিনকার যুগদাবি মূর্ত হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার জন্য লেনিন যে স্লোগান তুলেছিলেন তারই পতাকাতলে বিপ্লবী আন্তর্জাতিক পার্টি ও সংখ্যালঘু সংস্থাগুলোকে স্বতন্ত্র রুপদান করল। ১৯১৫ সালের সিমেরভালভ এবং ১৯১৬ সারের কিয়েস্থাল সমাজতন্ত্রী সম্মেলন। ১৯১৬ সালের মে দিবসে কার্ল লিবনেখট এবং সমাজতন্ত্রী আন্দোলনে তাঁর অনুগামীরা বার্লিনে যে বিরাট বিরাট শোভাযাত্রা সংগঠিত করেন তা শ্রমিকশ্রেণীর জীবন্ত শক্তিরই অঙ্গীকার, পুলিসের নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারী নেতৃত্বের বিরোধিতা ভেঙেচুরে এই শ্রমিকশ্রেণী বেরিয়ে আসছিলেন।
১৯১৭ সালে যুদ্ধ ঘোষণার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবসকে পরিত্যাগ করা হয়নি। এপ্রিল মাসে সেন্ট লুইয়ের বিশেষ সম্মেলনে গৃহীত যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাবকে সোস্যালিস্ট পার্টির সর্বহারা শক্তিগুলো বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন; মে দিবসকে তাঁরা কাজে লাগালেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রতিবাদ করার জন্য। ১৯১৯ সালের মে দিবসকে তখনকার সোস্যালিষ্ট পার্টির স্থানীয় সম্পাদক এবং পরের যুগে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক চার্লস ই রুদেনবার্গ ক্লীভলান্ডের যে সমাবেশের আয়োজন করেন, তার চেহারা ছিল বিশেষভাবে সংগ্রামী। প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিক বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে পাবলিক স্কোয়ারে হাজির হন, সেখানে আরও বহু সহস্র শ্রমিক তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। পুলিস জানোয়ারের মতো সেই সভার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন শ্রমিককে খুন ও একজনকে জখম করে।
১৯১৭ সালের মে দিবস, জুলাইয়ের দিনগুলো এবং শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের দিনগুলো রাশিয়ার বিপ্লবের পূর্ণ পরিণতির দিকে বিভিন্ন পর্যায় মাত্র। রাশিয়ার বিপ্লব মানুষের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করে এবং মে দিবসের ঐতিহ্যকে নতুন প্রেরণা ও তাৎপর্যে মন্ডিত করে। ১৮৯০ সালে ১লা মে নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কোয়ারে প্রথম মে দিবসের সমাবেশে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’ যে আকাংক্ষা প্রকাশ করে সেই আকাংক্ষাই বাস্তবে রূপায়িত হলো জগতের ছ’ভাগের একভাবেশ্রমিকশ্রেণীর বিজয়লাভের ঘটনায়। “আট-ঘন্টা কাজের দিনের দাবি পূরণের সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব- কিন্তু কখনও ভুলব না, আমাদের শেষ লক্ষ্য হলো (পুঁজিবাদী) মজুরি-ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন”- উক্ত দিবস ধর্মঘটী শ্রমিকদের কাছে উত্থাপিত প্রস্তাবে লেখা ছিল এই বাণী। এই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রাশিয়ার শ্রমিকরাই সর্বপ্রথম বিজয় লাভ করেছেন। কিন্তু ১৯১৬ সালের মধ্যে ‘আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার’- এর নেতারা তাদের ১৮৯০ সালের ঘোষিত লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন। তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতির পথ সাফ করে দেওয়া। মে দিবস হলো শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি এবং পুঁজিবাদী শোষণ ও মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘোষণার দিন আর এই দিবসের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে নুতন তাৎপর্য দিয়েছে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক সাফল্যগুলো, অথচ ‘ফেডারেশন’ নেতারা চান না যে আমেরিকার শ্রমিকেরা রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক সাফল্যগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
সাপ্তাহিক ‘ওয়ার্কার’ (মজদুর)-এর ১৯২৩ সালের মে দিবস সংখ্যায় চার্লস রুদেনবার্গ লেখেন: “মে দিবস পুঁজিবাদের বুকে জাগায় আশঙ্কা আর শ্রমিকদের- সারা দুনিয়ার শ্রমিকদের বুকে জাগায় আশা, মে দিবস এবার দেখতে পারে ইতিহাসের যে কোনো অধ্যায়ের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিস্ট আন্দোলন এাবরের ঢের বেশি শক্তিশালী।…… বৃহত্তম সাফল্যের পথ এখন পরিষ্কার, জগতের অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভবিষ্যৎ রয়েছে কমিউনিজম-এর”।
এক পুরুষ আগে ১৯০৭ সালের ২ শে এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ওয়ার্কার’-এর মে দিবস সংখ্যায় ইউজিন ভি ডেবাস্ লেখেন: “এই হলো প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। এই দিনটি হলো শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব দিন: বিপ্লব লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত দিন।”
মে দিবসের ক্রমবর্ধমান সংগ্রামী ঐতিহ্যের পালটা প্রতিষেধক হিসেবে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’ কেবলমাত্র সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারটিরকে ‘শ্রম দিবস’ হিসাবে পালন করার জন্য প্ররোচনা দিতে লাগল। এই দিনটিকে প্রথম ঠিক করা হয়েছিল ১৮৮৫ সালে নেহাতই স্থানীয়ভাবে উদযাপনের জন্যে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ-রাজ্যের সরকার এই দিনটিকে স্বীকৃতি দান করল মে দিবসের অনুষ্ঠান প্রভৃতির প্রতিষেধক হিসেবে। ১লা মে’কে শিশু স্বাস্থ্য দিবস বলে ঘোষণা করে হুভারের আমলে মে দিবসের আর একটা পালটা ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হয়েছিল- এবং এটাও করা হয়েছিল ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’- এর সহযোগিতায়। শিশু কল্যাণ সম্পর্কে আচমকা এই আগ্রহ দেখাবার আসল অর্থ-বোঝা যাবে উক্ত ফেডারেশনের ১৯২৮ সালের সম্মেলনে তার কার্যকরী পরিষদ কর্তৃক উপস্থাপিত বিবরণীতে: “কমিউনিস্টরা এখনও ১লা মে’কে শ্রমদিবস হিসাবে উদযাপন করে। এরপর থেকে ১লা মে পরিচিত হবে শিশু স্বাস্থ্য দিবস হিসাবে, যেমন কংগ্রেস রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দিয়েছে ১লা মে’কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিশু স্বাস্থ্য দিবস হিসাবে পালন করবার জন্য জনসাধারণের উপর ঘোষণা জারি করতে, উদ্দেশ্য সারা বছর ধরে শিশু স্বাস্থ্য রক্ষার স্বপক্ষে মনোভাব তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ। আরও উল্লেখযোগ্য যে এখন থেকে মে দিবস আর ধর্মঘট দিবস বা কমিউনিস্ট দিবস হিসাবে পরিচিত হবে না।”
১৯২৯ সালের সঙ্কট
———————-
লক্ষ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং পুঁজিবাদ শ্রমিকদের উপর যে বিপর্যয় ঘনিয়ে আনছে, সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করা দূরে থাক অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পরাঙ্মুখ প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রায় দশ বছর ধরে পুঁজিবাদের আমলে চিরস্থায়ী সমৃদ্ধির মিথ্যা মোহ সৃষ্টি করবার কাজে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিল। ১৯২৯ সালের শেষাশেষি অর্থনৈতিক বিপর্যয় যখন ফেটে পড়ল, এবং ট্রাস্ট আর একচেটিয়া পুঁজিবাদীরা চেষ্টা করতে লাগল সঙ্কটের সমস্ত বোঝাটাই মেহনতী মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিতে, তখন ধর্মঘট এবং বেকারদের গণ সংগ্রাম ছাড়া শ্রমিকশ্রেণীর আর কোনো অবলম্বন ছিল না। এই সমস্ত গণ-সংগ্রামে কমিউনিস্টরা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন; এইসব লড়াইয়ের ফলে আমেরিকার শ্রমিকরা গভীরতর বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলেন, ১৯৩০ সাল থেকে যে দশক শুরু হয় সেই দশকেই ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবর’ এবং ‘কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন’- এই দুটি সংগঠনেই আমেরিকার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাসের বৃহত্তর অগ্রগতি ঘটে। ১৯৩৫ সালে ‘কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন’-এর প্রতিষ্ঠা এবং বড় বড় শিল্পোৎপাদন- ক্ষেত্রে এর দ্রুত সংগঠন সমস্ত শ্রমিক আন্দোলনের এবং গোটা দেশের পক্ষে ঐতিহাসিক গুরত্বসম্পন্ন একটি বিরাট সাফল্য। আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনে এই জাগরণের ফলে নিগ্রোদের সমান অধিকারের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির ক্ষেত্রেও তৈরি হয়ে গেল। এইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মোর্চা আরও জোরদার হয়ে উঠল।
মাত্র পনেরো বছরের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, বিপ্লবী এবং অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র স্পষ্টতই সাধারণ সঙ্কটের যুগে প্রবেশ করল। সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর বিশ্বযুদ্ধের ফলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে উঠল আরও তীব্র। এর উপর আবার পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ, উপনিবেশের দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্নিবার অগ্রগতি এবং জীবনমান উন্নয়নের জন্য ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিধি বজায় ও বিস্তারের জন্য অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান সঙ্কল্পনিষ্ঠা পুঁজিবাদের এই সাধারণ সঙ্কটকেই কেবল বাড়িয়ে তুলল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কব্জা বজায় রাখবার এবং ফ্যাসিবাদী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইতিহাসের অনিবার্য অগ্রগতি রোধ করবার ব্যাপারে ট্রাস্টের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা তৎপর হয়ে উঠল। পরাজিত জার্মানি এবং অন্যান্য সব দেশ যেখানে শ্রমিকশ্রেণীর ও অপরাপর প্রগতিশীল শক্তিগুলোর অনৈক্য ও দুর্বলতা ফ্যাসিবাদীদের বিজয়ের পথ সাফ করে দিয়েছিল সেকানে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্ররোচনা দিতে, ফ্যাসিবাদীদের সংগঠন ও অর্থসংস্থাপন করতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা সর্বশক্তি নিয়োগ করছিল। এই শত শত বছরের গণতান্ত্রিক সাফল্যগুলোর ধ্বংস করে ফেলবার, আর একটা বিশ্বযুদ্ধের নিশ্চিত সড়ক তৈরি করে দেবার দুনিয়াজোড়া যে অপচেষ্টা একচেটিয়া পুঁজিপতিরা করছিল- এইসব ঘটনা তারই স্বাক্ষর।
ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
——————————-
১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত জার্মান ফ্যাসিবাদই দুনিয়াজোড়া প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির বর্শামুখ হিসাবে কাজ করে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অভিসন্ধি ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশেগুলোর বিরুদ্ধে প্রলয়ঙ্কর এক যুদ্ধ চালানোর জন্যে নাৎসী জার্মানিকে গড়ে তোলা, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে প্ররোচনা পেয়ে এবং ক্রমে ক্রমে বিশ্ব জয় করার নিজস্ব অভিসন্ধি দ্বারা প্রণোদিত হয়ে জার্মান ফ্যাসিবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগল, ওদিকে আবার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করবার উদ্দেশ্য নিয়ে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীরা এই চক্রান্ত যোগ দিল। যুদ্ধের প্রকৃতিটাই এমন ছিল যে, জগতের প্রত্যেকটি দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তা পরিচালিত হতে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে এই সত্য ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে মানবজাতির অগ্রগতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সমস্ত দেশের কৃষকসমাজ এবং নিপীড়িত ঔপনিবেশিক জাতিগুলির সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণীর হাতে। একমাত্র শ্রমিকশ্রেণীই পারে তার উদ্যোগ, ঐক্য ও প্রতিরোধ ক্ষমতার সাহায্যে একচেটিয়া পুঁজিবাদীদের দ্বারা প্ররোচিত প্রতিক্রিয়ার সর্বনাশা গতিকে রোধ করবার কাজে জাতির সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতাকে সংহত করতে। ১৯৩০ সাল থেকে সমগ্র দশক জুড়েই মে দিবস ধ্বনিত করল ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান, ধ্বনিত করল সম্ভাব্য বিশ্বব্যাপী হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ও মানুষের কাছে প্রতিরোধের আহ্বান।
শ্রমিকশ্রেণীই যে বাস্তবিকপক্ষে জাতির মেরুদন্ড, এই সত্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। ফ্যাসিবাদ যে ক্ষমতা দখল করতে এবং জগতকে সর্বনাশা যুদ্ধে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হলো, তার কারণ শ্রমিকশ্রেণী ছিল তখন বিভক্ত; ফ্যাসিস্টরা জয়লাভ করতে পারত না কিছুতেই যদি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ এবং সংগ্রামের অভিজ্ঞাতায় অভিজ্ঞ শ্রমিকশ্রেণী সমস্ত জায়গায় ফ্যাসিস্টত বীভৎসতার বিরুদ্ধে মানবজাতির গণতন্ত্রপ্রিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে সংহত করে গণতন্ত্র ও প্রগতিরক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী বাহিনী হিসাবে বেরিয়ে আসতে পারত। এই জীবনমরণ যুদ্ধে সারা দুনিয়ার গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ স্বপক্ষে দেখতে পেল যে, জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের পুরোভাগে এসে দাঁড়য়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, দাঁড়িয়েছে মেহনতী জনতা।
যুদ্ধের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী মে দিবস উদযাপন করেন সর্বত্র কাজ চালু রেখে এবং ফ্যাসিস্ট দুস্যুবাহিনীকে ধ্বংস করবার জন্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর মে দিবস সমবেত করল কোটি কোটি মেহনতী মানুষকে, বিশেষ করে ইউরোপের বিজয়ী ও মুক্ত দেশগুলোতে; কোটি কোটি মানুষের, এই সমাবেশে মূর্ত হয়ে উঠল তাদের ওসংগ্রাম চালিয়ে যাবার- সঙ্কল্প, চিরদিনের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে অন্যান্য প্রগতিশীল অংশের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবার, যাতে করে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা তাদের হিংস্র শাসন বজায় রাখবার হাতিয়ার হিসেবে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে আর না পারে- সঙ্কল্প, গণতন্ত্র তথা জনতার সার্বভৌম ক্ষমতা বজায় রাখবার ও বিস্তার করবার- সঙ্কল্প, স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবার এবং শোষণ পীড়ণমুক্ত সমাজতন্ত্রী দুনিয়ার দিকে পথ প্রস্তুত করবার।
সমগ্র মানবজাতির শান্তি ও সুখী ভবিষ্যতের দাবিতে সংগ্রামরত প্রত্যেকটি দেশের শ্রমিকশ্রেণী মে দিবসে সেলাম জানায় দুনিয়ার জনগণকে আন্তর্জাতিক সংহতি ও সহযোগিতার অনুপ্রেরণায়।।
হাফিজ সরকার
তথ্যসুত্রঃ
(১) ট্রাকটেনবার্গএর লেখা
(২) সাম্যবাদী
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D