কারশেদ আলম

প্রকাশিত: ৪:৪৫ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২১

কারশেদ আলম

।।|| লিনু হক ||।।

আরিফ ভাই কে যে মঞ্চে হত্যা করা হয়েছিলো, সে মঞ্চের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। যে উপস্থাপন এর দায়িত্বে ছিলো। আরিফ ভাই এর লাশ ওর শরীরের উপর ছিলো।ওর কাছে জানলাম ঐ আরিফ ভাইকে নিয়ে হাসপাতাল গিয়েছিলো।
বেশ কদিন ধরে ও আরিফ ভাই এর উপর একটা লেখা দাবী কোরছিলো। অর্ধেক লিখে বসেছিলাম, অর্ধেক লেখাটা ফেরদৌস( মধুদা) ভাইকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস কোরেছিলাম, দেখেন তো কিছু হচ্ছে নাকি? উওরে বললেন ঠিকইতো আছে– শেষ করো।আমি বললাম, চর্বিতচর্বণ কোরতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তিনি দিক নির্দেশনা দিলেন।তাঁর সহযোগিতায় লেখা শেষ করলাম। খোরশেদ ফেসবুকে তাঁর বই এর লেখা গুলো শেয়ার কোরছে।আজ দেখলাম আমার লেখাটা ওর পোস্টে।আমি আমার বন্ধুদের জন্য লেখাটা শেয়ার কোরলাম।
বেবী আপা মাহবুব ভাই এর উপর লেখা চাচ্ছিলেন, দেবো বলেছিলাম।কিন্ত ডাক্তার অসুস্থ হওয়াতে শুরু করেছিলাম শেষ করতে পারিনি। আরিফ ভাইকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা।আরেফ ভাই কে আমরা আরিফভাই ডাকতাম।

“কাজী আরেফঃ মেঘে ঢাকা তারা”

আরেফ শব্দগত অর্থ বুদ্ধিমান, যে বেশী জানে,বেশী বোঝে যে নেত্রীত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখে।নামের নাকি প্রভাব পরে জীবনে –।আমাদের আরিফ ভাই এর জীবনে তাঁর প্রভাব পড়েছিলো।টিকাটুলির অভয় দাস লেনে থাকতেন আরিফ ভাই।আদি নিবাস কুষ্টিয়া। জন্ম নানাবাড়ি সদর উপজেলা সাউদিয়া গ্রাম -১৯৪২ এর ৮ এপ্রিল।
প্রাথমিক শিক্ষা পগোজ স্কুল,পরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। মেট্রিক পাশ করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। সেখান থেকে বি এস সি ডিগ্রি নেন। এম এসসিতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগে।
জগন্নাথ কলেজে পড়াকালীন তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।ছাএ রাজনীতির সাথে জড়িত হবার আগে তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সাহসিকতার সাথে পুরনো ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলা করেন।জগন্নাথ কলেজে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাথে জড়িত হন।ছোট বেলা থেকে তিনি ছিলেন একজন পরিশুদ্ধ মানুষ। প্রচার বিমুখ, নির্মোহ,মৃদু অল্পভাষী আন্তরিক হাস্যজ্জল।

কবিতায় কবি যে আদর্শ ছেলে দেশের জন্য কামনা করেছিলেন —আমাদের আরিফ ভাই, সেই ছেলে হয়ে উঠেছিলেন—

“আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন মানুষ হইতে হবে।
বিপদ আসিলে কাছে, হও আগওয়ান, নাই কি শরীরে তব রক্ত মাংস প্রাণ–
হাত পা সবারি আছে,মিছে কেন ভয়,চেতনা রয়েছে যার,সেকি পড়ে রয়? সে ছেলে কে চায় বলো- কথায় কথায় আসে জ্বল,মাথা ঘুরে যায়।
সদা প্রাণে হাসি মুখে এই করো পণ–মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।
কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার, সবারই রয়েছে কাজ-এ বিশ্ব মাঝার, হাতে প্রাণে খাটো সবে, শক্তি করো দল।তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ।

আমার সাথে আরেফ ভাই এর পরিচয়- উওাল মার্চে।ছোট বয়সে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র
লীগের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি।ঘনিষ্ঠতা কাজের সুত্রে ৭২ এ। ৭০ এর দেশ ও কৃষ্টি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্রী – ছাত্রলীগের পতাকাতলে সমবেত হয়।ছাত্রী সংগঠন এর দায়িত্বে ছিলেন আরিফ ভাই, মনি ভাই( মার্শাল) টুলুভাই।অবস্থান গত কারণে আমি মার্শাল এর ছায়াতলে ছাত্র লীগের কর্ম কান্ডে সম্পৃক্ত হই।

৭২ এ ছাত্রলীগ দ্বিধা বিভক্ত হলে আমি জড়িয়ে পড়ি, বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক ছাত্র লীগের সাথে।সেই সুত্রে আরেফ ভাই কে, আমার, কাছ থেকে দেখা — সম্পৃক্ততা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণ তিনি কালো তালিকা ভুক্ত হন- এবং ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।আন্দোলন সংগ্রামের পাশা পাশি সংস্কৃতি কর্মকান্ডে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো।
দেশ ভাগ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জাতি গত নিপিড়ন তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনেন।
ষাটের দশকে “ছয় দফা” আন্দোলন কে জনপ্রিয় করতে তিনি সাহসী ভুমিকা রাখেন।
১৯৭০সালে জয়বাঙলা
বাহিনী গঠন ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ তৈরিতে ভুমিকা রাখেন।এই পতাকা পরে জাতীয় পতাকায় রুপান্তরিত হয়।
১৯৭১ তিনি ছিলেন মুক্তি যুদ্ধে বি এল এফ বা মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ এর প্রধান ও ছাত্র লীগের সমন্বয়কের দায়িত্বে নিয়োজিত।
১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক (জাসদ গঠনের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। জাতীয় দৈনিক ” গণকন্ঠ “ব্যাবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অবৈধ ক্ষমতা দখলদার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কাতারে তার ভুমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভুমিকা রাখার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।নয় মাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান।
আরেফ ভাই ছিলেন- বাস্তব চিন্তার দিক থেকে অগ্রসর, যা আমি লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি, সেটা তার নামের প্রভাবে প্রভাবিত কোরেছিলো।তিনি বিশ্বাস করতেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিপক্ষের শক্তি কখনই এক হতে পারে না।প্রবাদ আছে” তৈলে জ্বলে কখনো এক হবার নয়।” তাই তিনি ৯০ দশকের শুরুতে” মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে”ও ঘাতক দালার নির্মুল জাতীয় সমন্বয় কমিটি,’মুক্তি যুদ্ধ ছাত্র কমান্ড গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।মুক্তিযুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি তিনি ছিলেন দৃঢ় অবিচল।১৯৯১সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী, পাকিদের গোলাম,
গোলাম আযম জামায়েত আমির নিযুক্ত হওয়াতে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষেপে ওঠে।কাজী আরেফ অনেকের সহযোগিতায় ৯ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল,বুদ্ধিজীবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তি যোদ্ধা সংগঠন, মুক্তি যোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সামাজিক সংগঠন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাচেতনা বাস্তবয়ন কমিটি গঠনে প্রধান ভুমিকা রাখেন।এই সময় শহীদ জাহানারা ঈমাম এর নেতৃত্বে কর্নেল নুরুজ্জামানের উদ্যেগে ‘ ৭১ ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি গঠিত হয়।১১জানুয়ারী উভয় কমিটি ঐক্য বদ্ধ হয়ে তাহের মিলনায়তনে জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করেন।জাহানারা ইমাম আহ্বায়ক অধ্যাপক মান্নান চৌধুরী সদস্য সচিব করে ২৬ মার্চ সোহরোয়ার্দি উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

৬০ দশক থেকে পর্দার অন্তরালে থাকা আরেফ ভাই কে ৯০ দশকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে, জনতার সম্মুখে নিয়ে আসে।মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি যে এক হতে পারে না সে ব্যাপারে অনেকেে দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে আরিফ ভাই তাঁর বিশ্বাস এর প্রতি অনঢ় দৃঢ় ছিলেন।তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ কোরেছেন। ঐতিহাসিক গণআাদালতে গোলাম আজমের বিচারে, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারে গণ মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠে– তার পরিণতি নবম সংসদে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার এর প্রস্তাব গৃহীত হয়।নবম সংসদে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হওয়া এবং তারপর কয়েক বছর পরই একাত্তরের চিহ্নিত খুনীদের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠন সবই একটি ধারাবাহিক আন্দোলনের যৌক্তিক পরিনতি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সারা বাঙলায় ঘাতক দালালদের প্রতিহত করার জন্য যে গণজোয়ার শুরু হয়েছিলো,সেই আন্দোলন সংগঠন তৈরির অন্যতম প্রধান পুরুষ ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।এটা অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার বিষয় যে,তার নিজের হাতে গড়া বিশাল ফলবতী এই আন্দোলনের বিজয় তিনি দেখে যেতে পারেননি।জাতীয় দুশমন,জনগনের দুশমনদের একটি গুপ্ত ঘাতক দল প্রকাশ্যে তাকে হত্যা করে ১৯৯৯ সালে।তাঁর সংগে আরও চারজন সাথীও প্রাণ হারায়।কুষ্টিয়ায় একটি সন্ত্রাস বিরোধী জনসভায় তিনি ভাষন দিতে গিয়েছিলেন।
পরবর্তী কালে আমরা যারা গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিদিনকার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে ছুটে যেতাম শাহবাগে,তাদের হ্নদয়ের গভীরতম প্রদেশে প্রিয় আরেফ ভায়ের অভাব অনুভব করতাম।ভাবতাম,আহা যদি আজ তিনি বেচে থাকতেন তাহলে তিনি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে আরো বৃহত্তর, আরো গভীর আরও তাৎপর্যময় আন্দোলনে পরিনত করার জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তা বুদ্ধি দিয়ে একজন প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন।কারণ তার ছিলো বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং তার পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
কিন্ত তাতো আর হবার নয়। যে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র তৈরি করতে গিয়ে যিনি তার সমস্ত আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিলেন,সেই রাষ্ট্র তার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস,ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন এবং এর পরবর্তী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে জনজোয়ারের সূচনা হয়েছিলো,সেই আন্দোলনের সাথে সাথে নেপথ্যের কাজী আরেফ জনগনের সামনে প্রকাশিত নয় শুধু উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলেন। আর এখানেই তিনি টার্গেট হয়ে উঠেছিলেন।
কাজী আরেফ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু যতদিন বাঙলাদেশ নামের এই জাতি রাষ্ট্র বিশ্বের বুকে টিকে থাকবে ততদিন তিনিও বেঁচে থাকবেন,কারন রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পেছনে তার ছিল দীর্ঘ স্থায়ী কর্মপরিকল্পনা এবং কষ্টকর নিরলস সাধনা।তাই কাজী আরেফের মৃত্যু নেই।আমাদের মধ্যে,এ জাতির হ্নৎ স্পন্দনের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন।
অবনত মস্তকে আজ স্মরণ করি তাকে।
জয় বাঙলা।

লিনু হক

<script data-ad-client=”ca-pub-6525836010359137″ async src=”https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js”></script>