যে জীবন দোয়েলের

প্রকাশিত: ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ, মে ১০, ২০২১

যে জীবন দোয়েলের

।।|| জিয়াউল হক মুক্তা ||।।

অন্য অনেকের মতো আমার পড়াশোনারও একটা নিজস্ব ঢঙ আছে। আমি গান শুনি খুব ডেডিকেটেডলি, একে একটি স্বতন্ত্র কাজের মর্যাদা দিয়ে; তবে পড়ার সময়ও মাঝে মাঝে শুনি— একই ট্র্যাক বাজতে থাকে অনবরত— মূলত এক স্থিতপ্রশান্ত মুড নিশ্চিত করতে। পড়তে পড়তে আমি ভাবি অনেক বেশি; কুইক রিড আমার হয়না। বইয়ে দাগাদাগি করি প্রচুর, ফলে ধার করে বই পড়া আমার হয়ে ওঠেনা; দাগানোর সুবিধার্থে আমাকে বই কিনতেই হয়। পড়ার সময় মাঝে মাঝে ওঠে হাঁটাহাঁটি করি; বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি; বর্ষা হলে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখি; চাঁদ আর তারা দেখি; গায়ে অন্ধকারও মাখি। এটা সেটা খাই, পানি আর বিবিধ পানীয়ও থাকে। পড়ার রুম থেকে ৪০ ফুট দূরে পুত্র ঐতিহ্যের রুমে ওর সাথে আর ওর মায়ের রুমে গিয়ে কন্যা দ্যোতনার সাথে দেখা করে ফিরে আসি। আবার বসি। এই সব; এ রকম।

তবে কোন কোন বই এসবের পরিমাণ কমিয়ে দেয়; আমাকে টেনে রাখে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় ডেডিকেটেড পরিভ্রমণে। অনেক দিন পর সেরকম একটা বই পড়লাম গতকাল ৯ মে; যদিও প্রথম সাত পৃষ্ঠায় জনৈক সাংবাদিকের লেখা ভূমিকাটি পড়তে গিয়ে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছি অনুচ্ছেদের অপরিপক্কতা, পরম্পরা-বিচ্যুতি আর পুনরুক্তির কারণে। এ বইটি লিখেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির এক সময়ের দফতর সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। নাম: যে জীবন দোয়েলের।

বইটির নামকরণের মধ্যেই রয়েছে এক বেদনাহত আশ্চর্য দ্যোতনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘আট বছর আগের একদিন’-এর ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’ থেকে তিনি তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থের নাম দিয়েছেন— যে জীবন দোয়েলের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যোদ্ধা সাইফুল ইসলাম মুক্তির ও স্বাধীনতার— দোয়েলের নাচ আর গান যার মেটাফোর— আস্বাদন-বঞ্চনার বিবরণী উপস্থাপন করেছেন এ আত্মজীবনীতে।

এর ব্যাপ্তি ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল— তের বছরের: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের তের বছরের।

সাধারণভাবে প্রায় সবসময় আমি জাতীয় রাজনীতির থিওরিটিক্যাল ও অ্যানালিটিক্যাল আলোচনার অনুসঙ্গ হিসেবে বা সমর্থন হিসেবে এক ধরনের স্যোসিও-অ্যানথ্রোপলজিক্যাল বিবরণী পেয়ে থাকি সাইফুল ইসলামের লেখা থেকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের জাতীয় পরিসরের যে অখণ্ড আন্দোলন-সংগ্রাম, তার গ্রামীণ ও মফস্বল সংস্করণ ও সমরূপতার নিদর্শন হলো তার লেখা।

‘যে জীবন দোয়েলের’ হলো মূলত স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে নিবেদিত একটি জীবনের তের বছরের পথবিবরণীর— যাতে অন্তর্গত আছে আরো অনেকগুলো ছোট ছোট পথবিবরণী। কোন কোনটিতে বাস বা নৌকোর মতো বাহনের ব্যবহার থাকলেও অধিকাংশ হলো পায়ে হাঁটার গল্প— দিনের পর দিন মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটার গল্প। এখানে তিনটি বিশেষ পথবিবরণীর কথা বলা যেতে পারে— যার প্রতিটি হলো মায়ের কাছে যাবার এক একটি উন্মুখগতি। প্রথমটি, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল পাবনার পতনের পর পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জ হেঁটে যাবার; দ্বিতীয়টি, ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর নৌকোয় ও হেঁটে বাড়ি ফেরার; ও তৃতীয়টি, ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের তথাকথিত পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বাহনী-প্রত্যাবর্তনের।

তৃতীয় প্রত্যাবর্তনের এক মেটাফোরিক বিবরণী দিয়ে শেষ হয়েছে এ আত্মজীবনী, “উন্মুখ হয়ে থাকি কখন ভিড়বে লঞ্চ সিরাজগঞ্জের ঘাটে, সে লঞ্চঘাট কি আগের সেখানে আছে? নাকি তাকে বিলীন করে দিয়েছে যমুনা নদীর ভাঙন? তখনো তার কিছুই জানিনা।” [যে জীবন দোয়েলের (যেজীদো); পৃষ্ঠা ১৪১] পুনর্বাসন কেন্দ্র নামের কারাগার থেকে সদ্যমুক্ত এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যেন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন জিয়াউর রহমান বাংলা নামের জনপদের কী সর্বনাশটি করেছেন তার অনুমানে। এর আগের অনুচ্ছেদে রয়েছে সে বিবরণীও।

“ভাবতে ভালো লাগে, দীর্ঘদিন পর মুক্ত মানুষ, ফিরছি গ্রামের মা-বাবার কাছে, যাদের কাছে এক দিনের কথা বলে বিদায় নিয়ে ফিরছি প্রায় দু’বছর পর। দেখা হবে রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে, তবে তখনো জানি না যে কে কোথায় কী অবস্থায় আছে। জানি না, সিরাজগঞ্জের রাজনীতি কী পরিমাণ এলোমেলো করে দিয়েছে সামরিক শাসক। দেখা হবে গ্রামের দেহাতী মানুষের সঙ্গে, যারা আমার রাজনীতির সহকর্মী, আমার রাজনীতির শিক্ষক। তারাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, কথা বলতে হয়।” [যেজীদো; পৃ. ১৪১]

দ্বিতীয় বাড়ি ফেরা রণাঙ্গন থেকে ছেলের বিজয়ীর বেশে ফেরা, তাড়া কম। “তারপর আবার একা হাঁটতে থাকি। বাগবাটী এলাকায় পাক-সেনাদের অত্যাচারের চিহ্ন তখনো দগদগে হয়ে ফুটে আছে। কোনও কোনও বাড়ি পুড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কেউ কেউ সে পোড়া ঘরবাড়ি আবারও গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ হয়তো বিমর্ষ হয়ে সে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধছে যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, অত্যাচারীদের অত্যাচারও শেষ হয়ে গেছে, এবার শুধুই ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।

“পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের পথ দেখতে হাঁটি। তবে এবারের তাড়া কম, একটু দূরেই তো আমাদের গ্রাম, আমাদের বাড়ি, যেখানে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন আছে। হাঁটতে হাঁটতে, হরিণা, দত্তবাড়ি পার হয়ে সড়ক থেকে নামি। ভেওয়ামারা মামার বাড়ি না হয় পরেই যাবো। আলপথ ধরে চলে আসি আমাদের গ্রামের খনকারপাড়ার কাছে। খেয়া নৌকায় উঠি— নৌকার মাঝি দাদা বলেন— তোমার মা গতকাল এই খেয়াঘাটে এসে অনেকক্ষণ বসেছিলেন, আজো মনে হয় কাছাকাছি কোথাও আছেন।

“খেয়াঘাট থেকে নেমে খনকারপাড়ার সামনে নদীর তীর দিয়ে হাঁটতে থাকি। এবারে পায়ের গতি বেড়ে যায় কাছাকাছি এসে, যেমন জনতা হাঁটে জোর কদমে। কিছুদূর হাঁটতেই দেখতে পাই, মা দক্ষিণ পাড়ার কান্দু ভাইয়ের বাড়ি থেকে ঢাল বেয়ে নামছেন। তার পেছনে আরো অনেকে, হয়তো তারাও দেখতে পেয়েছেন আমাকে। মা হাঁটছেন প্রায় দৌড়ে, আমিও দৌড়াই। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরি। একটু দূরে বাবা চোখ মুছছেন। সবাই এসে ঘিরে ধরে আমাদের। আমি আর মা পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে থাকি। গ্রামবাসী আমাদের পথ করে দেয় এগিয়ে যাওয়ার । মনে হয়, বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা আর তার মায়ের নেতৃত্বে জনতার বিজয় মিছিল।” [যেজীদো; পৃ. ৯৯—১০০]

কেমন চোখ ভিজে আসে! না! যদিও সংস্কৃত রামায়নসূত্রে রামের প্রতি ভরদ্বাজ মুনিভাষ্যে অথবা লক্ষণের প্রতি রামভাষ্যে আমরা সকলে খুব ভালো জানি আমাদের চিরায়ত-সনাতনবোধ: জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।

আর প্রথম পথবিবরণী হলো ১১ এপ্রিল মুক্তাঞ্চল পাবনার পতনের পর ভারতে যাবার আগে সিরাজগঞ্জ গিয়ে মা-বাবার সাথে তাঁর দেখা করতে যাবার পথের গল্প। পথের শেষের দিকে, “এখন হাঁটা ছাড়া পথ নাই। বাহিরগোলা দিয়ে শহর থেকে বের হয়ে রেলপথে হাঁটা দিলাম। তারপর ওয়াপদা বাঁধ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ভাটপিয়ারী হাটখোলা পর্যন্ত। সেখান থেকে নদী পার হয়ে চলে এলাম ডিগ্রিপাড়া ফুপুর বাড়িতে। সেখানে ফুপু, খালেক ভাইদের সাথে দেখা করলাম। তারপর আবার হাঁটা। আলপথে হাঁটতে হাঁটতে চরপাড়া পার হয়ে মামা বাড়ি ভেওয়ামারা। সে বাড়িতে দেখা করার জন্য ঢুকতেই মালেক মামা এসে জড়িয়ে ধরলেন। এলো অন্য মামা, খালা আর নানিও। নানি বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও, তোমার মা খুব কান্নাকাটি করছে। মালেক মামা আর দাঁড়াতে না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে এনে স্কুল ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম গজারিয়ার খনকার বাড়ির খেওয়া ঘাটে। খেওয়ার মাঝি বদ্ধুদাও বলল, তোমার মায়ের সঙ্গে আগে দেখা করো। তারপর এসো খেওয়াঘাটে, পাবনার গল্প, যুদ্ধের গল্প শুনবো।

“খেওয়া নৌকা থেকে নেমে খনকার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করল, পাবনার খবর, দেশের খবর। আমি হাঁটি আর জবাব দেই। এভাবেই খনকার পাড়া পার হয়ে দূর থেকেই দেখলাম, মা বসে আছে গ্রামের একদম দক্ষিণের বাড়ির তেতুলতলায়। বসে আছেন নিশ্চয়ই আমার পথ চেয়ে। আমি মাকে দেখেই জোরে হাঁটা দিলাম, সে হাঁটা প্রায় দৌঁড়ে হাঁটা।

“এক সময় মা আমাকে হয়তো দেখলেন। দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। ধাতস্থ হয়ে তিনিও এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। কাছে যেতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে শুরু করলেন কান্না, যে কান্না থামানো মুশকিল। আমার চোখেও পানি এসে গেল। আব্বাকেও দেখলাম আমাদের দেখছেন দূর থেকে। হয়তো তিনিও আমার আসার অপেক্ষায় ছিলেন আশেপাশেই কোথাও।” [যেজীদো; পৃ. ৫৫—৫৬]

জন্মভূমির পথে হাঁটার নামরূপ তো জননীর পথে হাঁটা। এরপর সত্যি তিনি আবারও হাঁটলেন জন্মভূমির পথে; তাঁর যে হাঁটার সূচনা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, শুরুতে স্বাধীকার হয়ে স্বাধীনতার দিকে, আর এবারে স্বাধীনতা রক্ষায় সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে। পূর্ব বাংলায় এ হাঁটায় যেমন ছিল স্থলে পায়ে হাঁটা, তেমন ছিল জলে খেয়া ও নৌকাযোগে পথপরিক্রমণ। ভারতে কিছু বাস ভ্রমন হয়েছিল বটে। তবে বারবার বাংলার ক্ষীণধারায় খেয়ায় বা স্রোতস্বিনীতে নৌকোতেও তাঁকে হতে হয়েছে গতিময়।

সাইফুল ইসলামের অঞ্চলের আরো এক বীর মুক্তিযোদ্ধা— কুয়াত ইল ইসলাম— যিনি তার নিজের দল নিয়ে লড়াই করেছেন সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে, আমাকে বলেছেন, সে কালাতিপাত তো কেবল হাঁটার আর হাঁটার, অনবরত হাঁটার; আলোয় আর আঁধারে হেঁটে হেঁটে করেছেন শত্রুনিকেশ আর জনমানসে দেখেছেন স্বাধীনতার উদ্ভাস ও উন্মেষ। দলনেতা তিনি বলেছেন, ভাইরাসের আক্রমণে চোখ আক্রান্ত, চোখের পাতা মেলা যায়না, তবুও কেবল হেঁটেছেন, এমনকি চোখ বন্ধ করেও হেঁটেছেন আল-মেঠোপথ-জলাভূমি-ধানক্ষেত-পাটক্ষেত ধরে— কারণ সামনে ছিল স্বাধীনতা নামের এক আশ্চর্য-নিশ্চিতি। আমি শিওরে ওঠেছি শুনে।

যে জীবন দোয়েলের— সে দোয়েল-জীবন লিখছেন— মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতের পথে তাঁর যাত্রা বিষয়ে, “রাতেই নৌকা ছেড়ে দিল যমুনার শুভগাছা ঘাট থেকে। অন্ধকারে কিছুই বোঝার উপায় নেই কোন দিকে যাচ্ছে নৌকা। শুধু দাঁড়ের বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বোঝা যায় যে আমরা ভেসে চলেছি স্বাধীনতার দিকে।” [যেজীদো; পৃ. ৬৫]

দাঁড়ের বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মানে যে স্বাধীনতার দিকে ভেসে চলা— এমন বিস্ময়কর মেটাফোর আমি আমার সারা জীবনেও কখনো কোথাও পড়িনি! এখানে এরকম মেটাফোর সাচিত্যচর্চার কোন কষ্টকল্পনা নয়, দোয়েলী-সহজাত যেন— মুক্তি যার আরাধ্য, তাঁর।

আত্মজীবনীতে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বহুমাত্রিকতার বহু বিষয়ই এসেছে। তবে বাংলার নদ-নদী-জলা-ঘাট-মাঠ-দিন-রাতসমেত প্রকৃতি এসেছে ঘুরেফিরে বারেবারে, কষ্টকল্পনায় নয় বরং সহজিয়া-বিবরণে; কেননা এ প্রকৃতির মধ্যেই যে দোয়েলের বাস— আর তার শ্বাস আর নাচ আর শিস!

অবিরাম পথহাঁটার এ বিবরণীতে আছে পথের ধারের বাড়ির মায়েদের, কোথাও কোথাও দোকানদারদের, অগণন সাধারণ মানুষের আর খেয়া নৌকার মাঝিদের আদর-আপ্যায়ন-সহযোগিতা-সমর্থনের চিরায়ত বাঙালি আতিথেয়তার অশ্রুসজল বিবরণী।

এতে আছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে সামান্য অস্ত্র ও অসংখ্য জনতার কণ্ঠের জয়বাংলা ধ্বনির মাধ্যমে পাকহানাদার নিশ্চিহ্নকরণের বিবরণী। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও পাকহানাদারের বিরুদ্ধে পরিচালিত কিছু অপারেশনের ঘটনাও স্থান পেয়েছে এতে। স্থান পেয়েছে পুরো পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোয় চাকুরিরত অনেক বাঙালি আমলার মধ্যে যে মাত্র ৫/৬ জন স্বাধীন বাংলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁদের দুই জনের মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত কার্যক্রমের কথা।

তিনি শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের কথাও বলেছেন কিছুটা। “জাসদ নেতা হিসেবে কর্নেল তাহেরের নাম জানত না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বগাঁথা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে। তার প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতার কারণ, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রৌমারীতে। তিনি এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীর স্পেশাল কমিশনড র‍্যাংকে রিক্রুট করতে। আমিও সে লাইনে দাঁড়ানোর পর তিনি বলেছিলেন, এমনও হতে পারে যে যারা কমিশনড র‍্যাংকে রিক্রুট হবে, তাদের প্রশিক্ষণ হতে হতে মুক্তিযুদ্ধই শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই যারা মুক্তিযুদ্ধ করতে চাও তারা লাইন থেকে বের হয়ে যেতে পারো। তাঁর এই স্পষ্ট কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, আমি বের হয়ে এসেছিলাম লাইন থেকে।” [যেজীদো; পৃ. ১৩১]

এ দোয়েল-জীবন আমাদের শুনিয়েছে বাংলার স্বাধীকার-স্বাধীনতা ও জাতীয় সমাজতন্ত্রপন্থি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মাস্কোভাইট কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়নের [মতিয়া] আর পিকিঙাইট ন্যাপ সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়নের [মেনন] নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যার আঞ্চলিক ঘটনাবলী। শুনিয়েছে পিকিঙাইট মেননপন্থিদের হাতে আওয়ামী লীগের সদ্যনির্বাচিত স্বাধীনতাপন্থি এমপিএ আহমেদ রফিককে হত্যার কাহিনী। শুনিয়েছে পাক হানাদারের অগ্নিকাণ্ড-হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। শুনিয়েছে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ছাত্রলীগের স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রপন্থি ও জাসদের সাথে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যার কাহিনী। আরও শুনিয়েছে জাসদের ওপর মোশতাক-জিয়ার সম্মিলিত পাকিস্তানপন্থার আক্রমণের কাহিনী।

এ দোয়েল একদিকে যেমন জাসদকে ছিন্নভিন্ন নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার কমিউনিস্ট-আওয়ামী-বিএনপি’র মনোবিকলনজাত রক্তাক্ত উন্মাদনার হোলিখেলার মতো বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের সকরুণ ব্যালাডগুলো গেয়েছে; অন্যদিকে তেমন ক্ষেত্রবিশেষে সাথে সাথে জানিয়েছে এসবের প্রতিরোধ আন্দোলনের কথাও। তবে সাধারণভাবে জাসদ নিশ্চিহ্নকরণের আওয়ামী কৃতকর্মের বিবরণীই অধিকতর সহজলভ্য, খুনি জিয়াউর রহমানের কৃতকর্মের বিবরণী লিখেছেন কমজনই। যে জীবন দোয়েলের-এর দোয়েল আমাদের প্রায় এথনোগ্রাফিক বিবরণী দিয়েছেন জাসদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে খুনি জিয়াউর রহমানের বর্বর আক্রমণের। এখানে প্রসঙ্গক্রমে খুনি জিয়ার একটি হাস্যকর কর্মকাণ্ড দেখা যাক।

“ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেফ হাউসে থাকতেই একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে। সেখানে আবার জিজ্ঞাসাবাদের পালা। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দেখে বুঝতে পারছিলাম না যে আমাদের হাসতে হবে নাকি কাঁদতে হবে। আমাদের চারজনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নেতা করিম ভাই। প্রথমে জিজ্ঞাসা করা হলো নামধাম, শিক্ষাগত যোগ্যতা। আমরা আগেও যা বলেছি, এবারও তাই বললাম। আমি রোগাপটকা সাইজের। দাঁড়ি-গোঁফও ঠিক মতো গজায়নি। দেখতে-শুনতে মনে হতো আমি সর্বকণিষ্ঠ। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আমি বিএ পাশ করেছি, বললাম। পুলিশের একজন আশ্চর্য হওয়ার ভাব দেখিয়ে বলল, তুই কি মায়ের পেট থেকেই লেখাপড়া শুরু করেছিলি? আমার মাথা নিচু করা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে। করিম ভাই, সাইদ ভাই তাদের লেখাপড়ার কথা জানালো, দেখা গেল ওরা দু’জনই তখনো বিএ পাশ করেনি। জয়নালকে জিজ্ঞেস করা হলো লেখাপড়ার কথা, সে জানালো যে লেখাপড়া করেনি। জয়নালের পেশা তাঁতশ্রমিক। রাজনীতি করতে এসে দলের কর্মীদের কাছে লেখাপড়া শিখে এখন খবরের কাগজ পড়তে পারে। ও লেখাপড়া করেনি শুনে পুলিশ কর্মকর্তা আমার আর জয়নালের দিকে মনযোগ দিলেন। দু’জনকে পাশাপাশি বসালেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুই লেখাপড়া শিখে কেন রাজনীতি করিস, বুঝিস না রাজনীতি কী জিনিস? এই বলে আমাকে লাগালেন এক থাপ্পড়। আবার জয়নালকে জিজ্ঞেস করেন, তুই রাজনীতির কী বুঝিস? অশিক্ষিত, গণ্ডমূর্খ! ও না হয় লেখাপড়া করেছে, বোঝে, তুই কেন এসেছিস? ওকেও লাগালেন এক থাপ্পড়। মানে ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে লেখাপড়া করাও খারাপ, না করাও খারাপ।” [যেজীদো; পৃ. ১৩৫-১৩৬]

আশা করি যে জীবন দোয়েলের দ্বিতীয় ব্যালাড সংকলনও আমরা হাতে পাবো শিগগিরই— ১৯৭৮ পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রাম ও মফস্বল পরিমণ্ডলে জাতীয় রাজনীতির অভিঘাতের বিবরণীভরে— স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে। লেখকের প্রতি বিগতকৃত্যের জন্য অভিবাদন; আগামীর খণ্ডের জন্যও বটে।

এ দোয়েল গীতগান প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। ৮ মে বিকেলে এটা আমাকে কিনে দিয়েছেন আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম। ৯ মে বৈকালিক বিরতিসমেত সারাদিন এটা পড়লাম। ১০ মে লিখলাম আমার এ পাঠপ্রতিক্রিয়া। কেবল নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকদের জন্যই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মীর ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের অবশ্যপাঠ্য একটি আত্মজীবনী হতে পারে— যে জীবন দোয়েলের।

* জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।