অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার : একজন মানবিক চিকিৎসকের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ২:৫৪ অপরাহ্ণ, জুন ৫, ২০২১

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার : একজন মানবিক চিকিৎসকের চিরবিদায়

ড. মতিউর রহমান ও শিশির রেজা

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে বিশেষ করে শিশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে অতি পরিচিত মুখ। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তার সব রোগী ও ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও ডা. সাহিদা আখতার উৎকর্ষ মানবিক গুণাবলির জন্য সমাদৃত ছিলেন। দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ০১ মে ২০২১ সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার ফুলার রোডের বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর।

তিনি ১৯৬১ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের সবাই তাকে আনজু বলে ডাকতেন। অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষাতেই তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই মানবিক ব্যক্তিত্ব স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এম.বি.বি.এস ডিগ্রী অর্জন করেন। সাহিদা আখতার এই কলেজের পঞ্চম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ানস ও সার্জনস থেকে সফলতার সাথে এফ.সি.পি.এস ডিগ্রি লাভ করেন। পরে পেশাগত অনেক উচ্চতর প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।

তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন প্রথিতযশা শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে কর্মরত থেকে অবসরে যান। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছেন তিনি। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল (এসিসট্যান্ট সাজর্ন, ইন সার্ভিস ট্রেইনি), ঢাকা শিশু হাসপাতাল, আই.পি.জি.এম.আর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়), ডা. কাশেমস ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কুষ্টিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (লেডি ডাক্তার), ইত্যাদি।
সাহিদা আখতার ছিলেন বাংলাদেশের একজন অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন শিশু বিশেষজ্ঞ, যিনি বিগত প্রায় তিন দশক যাবত নবজাতক শিশুদের জন্য অক্লান্তভাবে সেবা দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন এদেশে নিউবর্ন স্ক্রীনিং টেস্ট-এর একজন অন্যতম পথিকৃৎ। নিউবর্ন স্ক্রীনিং হলো জেনোমিক মেডিসিনের একটি অংশ যার মাধ্যমে শিশুর জন্মের পরপরেই নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগের বিশেষ করে যেগুলোর চিকিৎসা আগে আগে শুরু করলে সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব সেসব রোগের জন্য পরীক্ষা করে দেখা হয়। নিউবর্ন স্ক্রিনিং টেস্টের মধ্যে রয়েছে: টিএসএইচ, ১৭ ওএইচ-পি, জি৬-পিডি, টোটাল গ্যালাকটোজ, পিকেইউ, এমএসইউডি, আইআরটি স্ক্রিনিং, বিটিডি স্ক্রিনিং, ইত্যাদি।

শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, হাঁপানি, বুকের দুধ খাওয়নোর অনুশীলণ, নবজাতকের প্রয়াজনীয় যত্ন, জন্মের সময় নবজীবন সঞ্চার, উন্নত কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট, এইচবিবি (শিশুদের শ্বাস নিতে সহায়তা করা), ইসিডি (প্রাথমিক শৈশব বিকাশ), পিএনডিএ (পেরিনিটাল ডেথ অডিট) সম্পর্কিত নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রভৃতি একজন চিকিৎসক হিসেবে তার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি এগুলো তার গবেষণার ক্ষেত্রও সমৃদ্ধ করে।
শিশু-বিশেষজ্ঞ ডা. সাহিদা আখতারের চিকিৎসা-বিজ্ঞানে দক্ষতার কারণে তো বটেই, তাকে সবাই মনে রাখবেন একজন ‘মানবিক-চিকিৎসক’ হিসেবে। গত প্রায় তিন দশক ধরে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন নবজাতক-শিশুদের রোগাক্লান্ত মুখে হাসি ফোটাতে। নিয়মিত চিকিৎসা-সেবার পাশাপাশি, নিবিড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সদা সক্রিয়।

শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মাতৃদুগ্ধ পানে মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ সচেতনায়নমূলক কর্মসূচিতে ডা. সাহিদা আখতারের রয়েছে বিশেষ অবদান। শিশু স্বাস্থ্যের নানান বিষয় ছাড়াও একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, এন্ডোক্রাইনোলোজি, এবং জিনোমিক্স-ও ছিল তাঁর আগ্রহের জায়গা।
গতানুগতিক চিকিৎসাসেবা ধারার বাইরে তিনি ছিলেন একজন অনুসন্ধানী-চিকিৎসক। শিশুদেরকে শুধু রোগী হিসেবেই দেখতেন না; দেখতেন একজন মানুষ হিসেবে। সে যে ধর্মেরই হোক, যে জাতেরই হোক, যে পেশারই হোক কিংবা ধনী অথবা গরিব। তার কাছে সবাই ছিল সমান। তিনি একই রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন, বুঝার চেষ্টা করতেন তাদের সমস্যা। যতক্ষণ পর্যন্ত শিশুটি ভালো না হতো ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শিশুটির জন্য তাঁর সর্বশক্তি, শ্রম, মেধা, এমনকি অর্থ দিয়ে তদের পাশে দাঁড়াতেন।

চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সাহিদা আখতার ছিলেন একজন খ্যাতিমান গবেষক। চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা ব্যতীতও তিনি ছিলেন একজন সচেতন সমাজ গবেষক। ডা. সাহিদা আখতার দেশে এবং দেশের বাইরে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুইয়ে, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্নদেশে চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং মৌলিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন।
তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে এদেশের গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়োশন-এর নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন । এছাড়াও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম-এর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি-এর নিবার্হী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, বাংলাদেশ এ্যাজমা এসোসিয়েশন-এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস-এর জীবন সদস্য, ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন-এর জীবন সদস্য, ইয়ং ডায়াবেটিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটি-এর জীবন সদস্য। এসব সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এদেশের শিশু চিকিৎসা শাস্ত্রকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

ব্যক্তি জীবনে তিনি স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন এদেশের বরেণ্য গবেষক ও অর্থনীতিশাস্ত্রের অধ্যাপক, শোভন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আবুল বারকাতকে। মৃত্যুর কদিন আগে আবুল বারকাতের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ‒ ২০১২ সালে গবেষণায় প্রমাণিত‒ ২০২১ সালে দৃশ্যমান বাস্তবতা’ বইটি সাহিদা আখতারকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গে অধ্যাপক বারকাত লিখেছেন,‘আমার জ্ঞানানুসন্ধান কাজে অনুপ্রেরণার উৎস আমার সহধর্মিণী অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারকে।’

তাদের তিন সুযোগ্য কন্যা অরণি বারকাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্ট’স ডক্টরাল স্কলার এ্যাওয়ার্ড নিয়ে পিএইচডি গবেষণারত, আনোখি বারকাত, ভারতের চেন্নাইয়ে প্রখ্যাত সুরকার এ আর রহমান প্রতিষ্ঠিত কেএম মিউজিক কনজারভেটরিতে অর্নাসে অধ্যয়নরত এবং অবন্তি বারকাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী।

প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া সবসময়ই কষ্টের। এই প্রিয় মানুষটির অকাল মৃতুতে অনেকেই নীরবে-নিভৃতে অশ্রুসজল নয়নে সময় পার করছেন। করোনা মহামারিকালেও শতশত মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারের অকাল মৃত্যুতে তার নিকট চিকিৎসাধীন অগণিত রোগী, ছাত্রছাত্রী, শুভ্যানুধায়ি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গভীর শোক প্রকাশ, তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

ডা. সাহিদা আখতারের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন মানবিক চিৎিসককে। তার সদা-হাস্যোজ্জ্বল মুখ, মানবিকতা, জীবনের সবক্ষেত্রে মূল্যবোধের চর্চা, অনবদ্য অতিথিপরায়ণতা এবং অক্লান্ত মানবিক-চিকিৎসাসেবার জন্য মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে পরম শ্রদ্ধায়। আমরা এই দরদি চিকিৎসকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা ও সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি