কোভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই উপেক্ষিত: প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় ওয়ার্কার্স পার্টি

প্রকাশিত: ১:৩৮ অপরাহ্ণ, জুন ৬, ২০২১

কোভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই উপেক্ষিত: প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় ওয়ার্কার্স পার্টি

সৈয়দ আরমান জামী, বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ০৬ জুন ২০২১ : বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো ২০২১-২২-এর বাজেটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় বলেছে প্রস্তাবিত বাজেটকে জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে প্রণীত হওয়ায় কথা বলা হলেও কোভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই উপেক্ষিত। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন প্রধান অস্ত্র হলেও সাধারণ্যে তার প্রাপ্তি অনিশ্চিত। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী মাসে পঁচিশ লাখ ভ্যাকসিন দেয়া হলে ন্যূনতম চার বছর লাগবে সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে। ভারতের একমাত্র উৎস থেকে আমদানি করা ভ্যাকসিন দিয়ে গণটিকা কার্যক্রম সাফল্যজনকভাবে শুরু হলেও, ভ্যাকসিন নিয়ে বাণিজ্য, কূটনীতি ও রাজনীতির কারণে কবে সেই টিকা আসবে জানা নাই। সর্বশেষ চীন থেকে টিকা কেনা নিয়ে চুক্তির গোপনতথ্য সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে ফাঁস করে দেয়ার যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেটা আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এটা যারা করেছে কেন করেছে তা জানা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য যেখানে সাংবাদিককে জেলে যেতে হয় সেখানে এ ধরনের গর্হিত কাজের জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা জাতিকে জানাতে হবে। তাছাড়া বাজেটে টিকা দানের কোনো রোডম্যাপ মন্ত্রী উল্লেখ করেন নি। বরং টিকা সরবরাহের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সম্পূর্ণ বিপরীত।

অপরদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ কিছুটা বৃদ্ধি হলেও, করোনায় গত এক বছরে যে আড়াই কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছে তাদের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। এই আড়াই কোটি দরিদ্র মানুষ বাজেটে পরিপূর্ণভাবে উপেক্ষিত। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বাজেটকে ব্যবসা বান্ধব বলে দাবি করে বলেছেন যে ‘ব্যক্তিখাতকে ড্রাইভিং সিটে বসাতে হবে’ এবং ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বাড়ার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়বে- যে বিনিয়োগ গত বছরগুলোতেও বাড়েনি, বরং কমেছে এবং আগামীতে বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর সংবিধানে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ব্যক্তিখাতকে ড্রাইভিং সিটে বসানোর কথা বলে মন্ত্রী সংবিধানের উল্টো কথাই বললেন। অথচ কোভিডকালে এমনকি পুঁজিবাদের নেতৃত্ব দানকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষকে দেয়ার জন্য বাজেটে দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনার প্রথম বছরে পঞ্চাশ লাখ লোকের জন্য ২৫০০ টাকা করে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তার এক তৃতীয়াংশই অব্যয়িত থেকে গেছে। এবারও ঈদে তিনি ৩৫ লাখ লোককে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন, যা ঐ আড়াই কোটি মানুষের স্বল্পাংশ। সামাজিক নিরাপত্তার অর্থের এক অংশ সরকারি কর্মচারিদের জন্য পেনশন আর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা।

স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ সম্পর্কে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রস্তাবে বলা হয় গত বছরের চাইতে কয়েক হাজার কোটি টাকা এ খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও, তা সামগ্রিক জিডিপি-র ১ শতাংশের কিছু উপরে, যা প্রতিবেশি নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানের চাইতেও কম। অর্থমন্ত্রী গত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতিকে মোটেই আমলে নেন নাই। কোভিডকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে দুর্নীতি ও দূরবস্থা বেরিয়ে এসেছে তার থেকে উত্তরণের কোন পরিকল্পনা বা দিক নির্দেশনা বাজেটে নাই।

শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাজেটের ১৫.৪ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ১১% শতাংশের কিছু উপরে। প্রযুক্তি খাতকে যুক্ত করে এই বাড়তি বরাদ্দ দেখান হয়েছে। কোভিড যেখানে সমগ্র শিক্ষা জীবন দেড় বছর পিছিয়ে যে পড়েছে সেখানে অনলাইন শিক্ষাসহ বিকল্প শিক্ষার জন্য যে সকল প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন ছিল তা অনুপস্থিত বরঞ্চ বাজেটে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর উপর নতুন করে করারোপ করা হয়েছে যা শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অযৌক্তিক।

কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও কৃষক সন্তুষ্ট নয়। কোভিডের দু’বছর পরপর বাম্পার ফলন ফলালেও কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ সেই পুরান ছকে বাধা। সরকার গত বছর লক্ষ্যমাত্রার বহু নীচে সংগ্রহ করতে পেরেছে। ফলে সরকারী গুদাম শুন্যের পর্যায়ে। খাদ্যশস্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছে সিন্ডিকেটের হাতে যার ফলশ্রুতিতে ফসলের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েই চলেছে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে।

কৃষি যান্ত্রিকীরণের সুবিধা ভোগ করছে বড় চাষী। এই বাজেটে পূর্ব প্রতিশ্রুত ২৪০টি উপজেলায় প্যাডিসাইলো প্রতিষ্ঠা, সমবায়ী পরিচালনা ব্যবস্থার কোন কথা নাই। আর খেতমজুরদের পেনশনের প্রশ্নটি উপেক্ষিত। এমনকি ইউনিভার্সাল পেনশন স্কীম নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য নাই।

করোনা প্রাথমিকভাবে শহরভিত্তিক থাকলেও এখন দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে যা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যে শহরে করোনা সংক্রমণে কাজ হারিয়ে মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীন কর্মসংস্থানের উপর চাপ পড়ছে। তার মোকাবিলার কৌশল বাজেটে নাই।

শিল্পের ক্ষেত্রে পাটকলকে ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেয়ার বিষয়টি বাজেটে এবার স্পষ্ট করা হয়েছে। অথচ কথা ছিল পিপিপি-র মাধ্যমে তার আধুনিকায়ন ও পুন:চালুকরণ। একই কথা চিনিকলের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও সরকার সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর গৃহীত ব্যবস্থার উল্টোপথে হাটছে। তিস্তাসহ নদী ব্যবস্থাপনার ব্যপারে বাজেট নীরব। নীরব অর্থনৈতিক বৈষম্য ও উত্তরাঞ্চলে আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে।

ওয়ার্কার্স পার্টির প্রস্তাবে সর্বশেষে বলা হয়, যে কোভিডকালে দু’টি বাজেটে যেটা স্পষ্ট তা’হল জনগণের জীবন ও জীবিকা নয়, ক্ষমতার বলয়ে অতি ধনী-সামরিক-বেসামরিক আমলার, যে শক্ত আঁতাত গড়ে উঠেছে তাদের স্বার্থরক্ষায় বাজেটে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কার্স পার্টি ৬ জুনের পলিব্যুরোর বাজেট পর্যালোচনা সভায় ও তার ভিত্তিতে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক জননেতা কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা, পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক, কমরেড মাহমুদুল হাসান মানিক, কমরেড নুর আহমেদ বকুল, কমরেড কামরূল আহসান, কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপ, কমরেড নজরুল ইসলাম হক্কানী, কমরেড আলী আহমেদ এনামুল হক এমরান প্রমুখ।
করোনা মহামারীতে যে বহুমুখী অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসা জনগণের অর্থনৈতিক ও মানবিক জীবন নিশ্চিত করাকেই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত, সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, খাদ্য-কর্মসংস্থান এবং কৃষি ও গ্রামীণ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে; গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে; উন্নয়ন বাজেটে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে; মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শিল্পোদ্যোক্তাদের পরিকল্পিতভাবে প্রণোদনা দিতে হবে; বেকারদের কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার এবং আত্মকর্মসংস্থানে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে; নিম্নআয়ের আড়াই কোটি পরিবারের জন্য আগামী ছয় মাস প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নগদ অর্থ প্রদানে বরাদ্দ থাকতে হবে।”

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ