জীবন-জীবিকা রক্ষা হবে তো!

প্রকাশিত: ৬:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২১

জীবন-জীবিকা রক্ষা হবে তো!

বিশেষ প্রতিবেদন ॥ ঢাকা, ০৯ জুন ২০২১: এবারের বাজেটের শিরোনাম-‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। প্রস্তাবিত এই বাজেটে জীবন-জীবিকা রক্ষায় বহুমুখী পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষকে বিনামূল্যে টিকাদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চাকরিপ্রার্থীদের সহয়াতা সর্বপরি কর ছাড়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপগুলো কী মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে পারবে!-প্রশ্ন সেখানেই।

বাজেটে করোনার কবল থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। টিকা সংগ্রহের জন্য বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার (১২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা) ঋণ সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকে টিকা কেনায় ৫০ কোটি ডলার ও অন্যান্য সহায়তা বাবদ ১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার ঋণ পাওয়া যাবে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক থেকে আরও টিকা ক্রয়ে ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার পেতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া টিকা কিনতে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক থেকেও ঋণ পাওয়া যাবে। আর টিকা কিনে মানুষকে বিনামূল্যে দেওয়া হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে। এ জন্য প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেওয়া হবে। বেশির ভাগ মানুষ টিকার আওতায় এলে করোনা মোকাবেলা করা সহজ হবে।
এছাড়া করোনার মোকাবিলায় সরকার স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক থেকে ৬০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ডলার এবং এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ডলার অর্থ পাচ্ছে। এসব অর্থে হাসপাতালের জন্য অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন, পিপিই, মাস্ক স্যানিটাইজার তৈরির শিল্প স্থাপন করা হবে। করোনা রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে নার্স ও ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
জীবন রক্ষায় স্বাস্থ্য খাতের এই উদ্যোগগুলোর কথা শুনলে বেশ ভালই লাগে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা পুরোটাই বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এই ঋণ কবে পাওয়া যাবে তা কিন্তু বাজেটে উল্লেখ নেই। ঋণ পেতে দেরি হলে অতি জরুরি কাজগুলো করা যাবে না। এ বছর কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে গত বছরের সমান বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ এবারের পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারপ। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার মধ্যেই করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশ আঘাত করেছে। এই ভাইরাসের কারণে সীমান্তের বেশ কয়েকটি জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে এই ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার হলেও তা করা হয় নি।
অন্যদিকে মানুষের জীবিকা রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। করোনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য সরকার ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কর ছাড়ের কথা বলা হয়েছে। চাকরি প্রার্থীদের সহায়তা করতে সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) উদ্যোগে ইন্টার্নশীপ চালুর কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে বেকারদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। ফলে তারা চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়াতে জিন প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়বে। ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে আরো ১০ লাখের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে এ খাতে ১০ হাজার কর্মী কর্মরত আছে। আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ কর্মীকে দক্ষ করা হবে। ১১টি খাতে ২৮টি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এসব কাজ করবে।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান তৈরি, সরবরাহ চেইনকে ঠিক রাখতে ১৩০টি গ্রোফ সেন্টার করার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় গ্রামীণ হাট বাজারকে উন্নয়ন করা হবে। হাটবাজারের উন্নয়ন হলে ওইসব স্থানে মানুষের আত্মকর্মসংস্থান বাড়বে।
বাজেটের এই উদ্যোগ সম্পর্কে বিশ্লেষকদের বক্তব্য হলো-প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এটা কতজন এবং কারা পাচ্ছে? প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত যারা তারা কি প্রণোদনা পাচ্ছে না; যাদের ক্ষমতা আছে বা যারা ক্ষমতাসীনদের আর্শিবাদপুষ্ট তারা পাচ্ছেন? ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে গত বছরের বাজেটে যাদের প্রনোদনা প্যাকেজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আরা প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ায় কথা বলা হয়েছে। এতে নাকি বিনিয়োগ বাড়বে এবং বিনিয়োগ বাড়লে কমংস্থানও বাড়বে। কিন্তু কর ছাড় দিলেই বিনিয়োগ বাড়ে না। এরজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। বাজেটে কিন্তু সেই সংস্কারের ব্যাপারে কিছু বলা হয় নি। বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে কাঙ্খিত মাত্রায় বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। আর বিভিন্ন খাতে যে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর অধিকাংশই উচ্চবিত্তরা পাবে। মধ্যবিত্তদের জন্য তেমন কিছু নেই। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হলেও করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো হয় নি। বাজেটে অন্যতম দর্শন হলো আয়, ভোগ ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনা। কিন্তু এবারের বাজেটে সে রকম কোনো পদক্ষেপ নাই। ফলে আবারো দুর্র্বৃত্তদের দৌড়াত্ম্য বাড়বে। বাড়বে বৈষম্যও।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ