নির্ঘুম শহরে জ্বলে লন্ঠন (পর্ব-৪) : হিরোশিমা কথা বলে

প্রকাশিত: ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, জুন ১১, ২০২১

নির্ঘুম শহরে জ্বলে লন্ঠন (পর্ব-৪) : হিরোশিমা কথা বলে

।।|| ফারহিম ভীনা ||।।

সুগিয়ামা সান বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন কাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। সব লাগেজ নিয়ে সকাল সাড়ে ছয়টায় আমাদের হোটেল ছাড়তে হবে। অত সকালে হোটেলে নাশতা খাওয়ার উপায় নেই, ‘শিনকানসেন’ মানে বুলেট ট্রেনে আমাদের নাশতা খেতে হবে। ভ্রমণে সবচেয়ে বড় সমস্যা বড় লাগেজ। ছোট লাগেজ আমার পছন্দ হলেও এবার সাথে দুটো লাগেজ। সুগিয়ামা সান ও সান বড় লাগেজগুলো হোটেল লবী থেকে মাইক্রোবাসে ওঠানোর জন্য হাত লাগাচ্ছেন। বুলেট ট্রেনে আমরা হিরোশিমা যাব। আনন্দ ও উত্তেজনায় আমি ও ফাতেমা ভোর পাঁচটায় উঠে একদম তৈরি।

টোকিও স্টেশনে পৌঁছে দেখি ও বাবা ষ্টেশনে মানুষ গিজ গিজ করছে। কিন্তু কোথাও কোন শব্দ নেই, হৈ-চৈ নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে। এখানে লাইন ভেঙে সামনে যাওয়ার হীন মানসিকতা কারুর নেই।

পথে কেউ কৌতুহলী হয়ে বলল না ‘হোরা গাইজিন দা। দেখ দেখ বিদেশী’। একজন বয়স্ক জাপানী আমাদেরকে দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, কন্নিচিউআ অর্থাৎ ‘গুডডে’। কিন্তু তাৎক্ষণিক মনে করতে পারলাম না, কি জানি অর্থ। যাই হোক ‘হ্যালো’ বলে মাথা মুড়ে ‘বো’ করে তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। জাপানি ভাষায় যা বললেন-মাথায় ঢুকলো না। কানে এলো- সুনিমাসেন। অর্থাৎ ইনি আগে যাবেন না, বয়সের জন্য বড়তি সুবিধা বা সৌজন্য তিনি প্রত্যাখান করলেন। ভাঙ্গা চোরা বুড়ো মানুষটি নুব্জ দেহে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন উনি পরে যাবেন। আমি মনে মনে অভিবাদন জানালাম জাপানের আত্মসম্মানবোধকে। ‘অভিবাদন জাপান’।

মনে পড়ল ‘জাপান প্রবাস’ এর লেখক মন্মথনাথ ঘোষ চমৎকার বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘জাপানিদিগের আর একটি গুণ নবাগত ব্যক্তি মাত্রেরই দৃষ্টিপথে পতিত হয়। রেল কিংবা ট্রেনের যাত্রি সংখ্যা অত্যন্ত অধিক হইলেও টিকিট লইবার কিংবা গাড়িতে আরোহন করিবার সময় একটু মাত্র গোলমাল হয় না। যিনি আগে আসিবেন তিনিই আগে টিকিট পাইবেন এবং গাড়ি চড়িবেন। সাধারণ যাত্রিগণ সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া থাকেন। ইচ্ছা করিলেই অনায়াসে একজন আর একজনকে ঠেলিয়া আগে যাইতে পারেন, কিন্তু জাপানীদের কি অদ্ভুত ধৈর্য্য এবং আত্নসম্মান জ্ঞান তাহারা কখনোই তাহা করিবেন না, অনেক সময় টিকেট ঘরের বাহিরে ৫/৬ রশি আন্দাজ জমি জুড়িয়া সারি দিয়া যাত্রিগণকে দাঁড়াইয়া থাকিতে, কখনো বা রৌদ্রে পুড়িতে, আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজিতে দেখা যায়, তথাপি তাহারা স্ব স্ব স্থান ছাড়িয়া আগে কিংবা পশ্চাতে যাইতে প্রয়াস পান না। সেই সমস্ত কারণে যতই ভিড় হউক না কেন, পুলিশের কোন প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে যাত্রিগণের ব্যবহার কিরূপ তাহা হাবড়া ষ্টেশনে গেলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়’।

বুলেট ট্রেনের টিকেট আগেভাগেই অনলাইনে কেটে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। ষ্টেশনে এসে টিকেট কাটার তাই ঝামেলা নেই। আমরা লাগেজ নিয়ে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে দেখি জাপানি বাচ্চারা নিজেদের ছোট স্মার্ট ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে পরিবারের সাথে। বুলেট ট্রেন দাঁড়ালো মাত্র মিনিট তিনেক। এই সময়রে মধ্যে হাজার হাজার যাত্রি নি:শব্দে পিল পিল করে ম্যাজিকের মত ট্রেনে ঢুকে নির্ধারিত আসনে বসে পড়ল। বুলেট ট্রেনের কেবল গল্পই শুনেছি। আজ দেখলাম সত্যি কি ঝকঝকে সুন্দর। ভেতরটা অনেকটাই প্লেনের মত সুন্দর, বসার চেয়ারগুলো আরামদায়ক, দুইসারি চেয়ারের মাঝে ফোল্ড করা টেবিল, তাতে বইপত্র রাখা যায়, খাওয়া যায় কফি আর স্যান্ডউইচ।

ট্রেনের কামরায় ডিজিটাল তথ্য বোর্ডে দেখা যাচ্ছে স্পীড, জায়গার নাম ও পরবর্তী স্টেশনের নাম। পুরো ট্রেনে আমরা বাঙালিরাই কেবল কলকল করতে থাকি। কি সুন্দর অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ‘একেবারে যেন প্লেন’ আমাদের কথায় মুগ্ধতা ঝরে পড়ে। এসময় সুগিয়ামা সান হেসে আমাদেরকে বলেন,
‘তোমাদের ফুজিয়ামা পাহাড় দেখার শখ ছিল। আজকে আবহাওয়া ঝকঝকে, পাহাড় দেখতে পারবে ট্রেনের জানালা থেকে’।
আমরা একটু আফসোস করি, দূর বুলেট ট্রেন থেকে ফুজি দর্শন!
জহিরুল উৎসাহী হয়ে সুগিয়ামা সানকে তার চেয়ারে বসায়। টোকিওতে কিছু দেখি নাই, শুধু পড়লাম। হিরোশিমায়ও কি শুধু ক্লাস?
কাগজ কলম নিয়ে তিনি বলেন, এই যে তোমাদের শিডিউল-এখানে পড়া ও সাইট সিইং দুইই আছে। এই যে এখানে সোকো ডেসু। হিয়ার ইট ইজ। তার জাপানি সহকর্মী কথার মাঝখানে বলেন, ‘ও জামা ইতাশিমাশিতা’ আমি তোমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি।
তিনি মনে করিয়ে দেন, তোমরা তো নাশতা খাওনি। কোল্ড স্যান্ডউইচ আর পানি নাও। কাপে কফিও পাবে। ওদিকে ট্রেন ছুটে চলেছে জনপদ, বাড়ি আর কলকারখানা ফেলে। এত দ্রুত তার গতি কিন্তু কোথাও ঝাঁকুনি বা দুলুনি নেই। জাপান পর্বতময় দেশ। পাহাড়গুলোকে দূর থেকে নীল আর রহস্যময় দেখাচ্ছে। এত দ্রুত সব জায়গা ফেলে ট্রেন চলেছে যে এই আছে এই নেই এরকম অবস্থা। রাতে আমাদের তিন/চার ঘন্টাও ঘুম হয়নি। সকালের নাশতা সেরে কখন যে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই না। হঠাৎ শুনি ঐঐ ফুজি। তাইতো সবাই জানালা দিয়ে দেখাচ্ছে ফুজিয়ামা পাহাড়। দূর থেকে দেখি জাপানের সর্বোচ্চ পাহাড় ফুজিয়ামা ধ্যানে বসে আছেন। ফুজিয়ামার মাথায় রয়েছে বরফ টুপি। মোবাইল ফোনে সবাই ধরতে চায় এ দৃশ্য।

ফুজিয়ামা শুধু পাহাড় নয়, জাপান দেশটির আইকন। এই পাহাড় সৃষ্টি নিয়ে সহস্র বছর আগের গল্প শুনেছি। কোন এক সকালে বিরাট শব্দে এক কাঠুরের ঘুম ভেঙে গেলে দেখে সমতল জায়গা থেকে হঠাৎ আচানক উঠে দাঁড়িয়েছে এক আজদাহা পাহাড়। এটাই জাপানের সর্বোচ্চ পাহাড়, ফুজিয়ামা। জাপানিরা সম্মান করে ডাকে ‘ফুজিয়ামা সান’। এ পাহাড় কিন্তু সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। কোন কোন উপকথায় তাই একে অগ্নি দেবতা বলা হয়েছে। ফুজিয়ামাই বোধ করি একমাত্র শঙ্কু আকারের নি:সঙ্গ পর্বত, এরকম আর আছে কিনা আমার জানা নেই। আমরা শুনেছি ফুজি দর্শন নির্ভর করে আবহাওয়ার মেজাজের ওপর। মেঘ বা কুয়াশা ঢাকা দিন বা বরফ পড়া দিন ছাড়া গ্রীষ্ম বা বসন্তের ফুরফুরে দিনে ফুজিয়ামা সান দর্শনের উপযুক্ত সময়। যাক তবু নমো নমো করে ফুজি সানকে দেখা হল। আজকের দিনটি সত্যি ঝকঝকে।

ফুজিয়ামা সানকে নিয়ে সব চমকপ্রদ গল্প শুনি। গল্পটি অবশ্য ঠিক পাহাড়কে ঘিরে নয়, পাহাড়ের পাদদেশের রহস্যময় জঙ্গলকে ঘিরে। মাউন্ট ফুজির নীচে লেক ছাড়াও রয়েছে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এই জঙ্গলে একবার ঢুকলে আর বেরুবার উপায় থাকে না, তখন একমাত্র পরিণতি মৃত্যু। জাপানের প্রাচীন উপকথা বলে মানুষ আত্মহত্যা করে গাছ হয়ে যায় এই আত্মহত্যা অরণ্যে। খুব দূর ইতিহাসে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের সময় বয়সের ভারে নত পিতা মাতাকে এই জঙ্গলে রেখে এসেছে হয়ত কোন সন্তান। সেই সন্তানের পরিবারের কোন না কোন সদস্য ঐ অরণ্যে চলে যায়। পিতা মাতার আত্মা তাদের ডাকে। পাপের শাস্তি কেউ না কেউ ভোগ করে। ‘নাহ্ এটা সত্য নয়’ সুপিয়ামা সান নিশ্চিত করেন। তবে জাপানিদের বিশ্বাস, যদি কোন মানুষ রাগ, ক্ষোভ ও হতাশার কারণে আত্মহত্যা করে তবে তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই জঙ্গলে।

এই রহস্যময় অভিশপ্ত জঙ্গলে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়েছে বহু জাপানি। আত্মহত্যার জন্য এটি নাকি জনপ্রিয় স্পট। এই সহস্যময় অভিশপ্ত জঙ্গলের নাম ‘আও কি গিহাবা’। সাধারণ লোকজন একে ডাকে ‘গাছের সাগর’ বা ‘জুকাই’ নামে। বলা হয় জাপানি উপন্যাস ‘কুরোই জাকাই’ প্রেমিক প্রেমিকার বিচ্ছেদের প্রভাব ফেলেছিল এই উপত্যকায়। প্রেমে ব্যর্থ তরুণ তরুণীরা আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয় এই স্পট।

হিরোশিমা শহরের হোটেল এস প্লাসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। হোটেলগুলো পাশ্চাত্য কায়দায় সাজানো। জাপান থেকে কি তবে জাপান বিদায় নিচ্ছে? রাস্তায় পাশ্চাত্য পোশাকে নারী, পুরুষ। হোটেল সজ্জাও পাশ্চাত্য। আমি কল্পনা করেছিলাম তাতামি নামের জাপানি মাদুর বিছানো থাকবে ঘরে, জানালায় কাগজের পর্দা আর ঘরের বড় দেয়ালের পাশে থাকবে তোকোনাসা বা নীচু টেবিল তাতে ইকোবেনো কায়দায় সাজানো ফুল দেয়ালে ঝুলবে একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের পেইন্টিং। এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে হোটেল রুমের আয়তনে। সবই খুব হিসেব করে মাপা, রুমে অল্প আলো, বিছানাবাদে সামান্য একটু জায়গা, টয়লেটের কলে ঝরে ধীরলয়ের পানি। সজ্জায় পাশ্চাত্য প্রভাব থাকলেও জীবনযাত্রায় জাপানিভাব ও দর্শন ষোলআনা। কোথাও অপচয় নেই, লোক দেখানো মিছে চাকচিক্য নেই।

হিরোশিমা আজ কেবল জাপানের হনশু দ্বীপের নগর নয়, এটি গোটা বিশ্বের শান্তির রাজধানী। ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পারমানবিক বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল এ শহর।কিন্তু যুদ্ধ পারমানবিক বোমা বোঝে, বোঝে না মানুষকে। আজ সেই হিরোশিমা শহরটি পরিণত হয়েছে জাপানের অন্যতম পর্যটক আকর্ষক স্পটে। বিশ্ব দেখে অবাক হয়েছে কত অল্প সময়ে জাপান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্কুলে আমরা সবাই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পৃথিবীর বর্বরতম পারমানবিক বোমার আঘাতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা পড়েছি। জেনেছি হিরোশিমা ও নাগাসাকি জাপানের ভারী শিল্পের জন্য ছিল প্রসিদ্ধ। শুধু জাহাজ নির্মাণ কেন, প্লেন থেকে ভারী শিল্পের যন্ত্রাংশের সব কিছুই নির্মাণ হতো এদুটো নগরে। আমেরিকানরা হিসাব কষেছিল ভারী শিল্পের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী এই দুটি নগরী ধ্বংস করতে পারলে পরাস্ত হবে জাপান। কিন্তু সত্যি কি পরাস্ত করতে পেরেছিল এই দেশটিকে। দেশটি ঠিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমানচিত্রে।

হিরোশিমায় সেদিন কি ঘটেছিল? একটু ফিরে তাকানো যাক। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে পৃথিবী জুড়ে। হিরোশিমায় সেদিনটা ছিল অন্য সব দিনের মত ঝকঝকে। নগরীর ঘুম ভেঙেছে। বাচ্চারা স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। কারখানায় ভোঁ শব্দে বাঁশি বেজে গেছে। বাবারা দৌড়াচ্ছে যে যার কাজে। হঠাৎ হিরোশিমা নগর কেঁপে উঠল বুম! বু-ম। বু-ম। এ এক আচানক শব্দ, মহাপ্রলয়ের ঝংকার ধ্বণি তাতে বেজে ওঠে। অজানা অশ্রুত ভয়ংকর ধ্বণিতে কেঁপে ওঠে নগর। চারপাশ অদ্ভুত সব রঙে রঙিন হয়ে ওঠে-যেন হাজারটা সূর্য একসাথে নেমে এসেছে হিরোশিমায়। প্রচন্ড বিস্ফোরণে মানুষ উঠে গিয়ে ছিটকে পড়েছে। তার ওপর বিল্ডিংগুলো পালকের মত খসে পড়ছে। সকাল বেলায় যেন রাত নেমে এলো, মানুষের আর্তনাদে কেঁদে উঠেছে হিরোশিমা- রাস্তায় কংক্রীট গলে খসে পড়েছে। ট্রেন লাইন উপড়ে চলে গেছে কোথায়।

হিরোশিমায় বসবাসকারী লেখক তামিকি হারা ছিলেন পারমানবিক বোমা দুর্ঘটনার মধ্য দিযে বেঁচে যাওয়া মানুষ, জাপানী ভাষায় হিবাকুশা। তিনি পরবর্তীতে Summer flowers বই এর জন্য খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর সেদিনের চাক্ষুষ বর্ণনার খানিকটা অংশ যোগ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেদিনের হিরোশিমা চিত্র। ‘মুহূর্তের মধ্যে পুরো শহর ধ্বংস হয়ে গেল, আমি তখন বাথরুমে ছিলাম। শুনলাম প্রচন্ত বিস্ফোরণের শব্দ। দেয়ালে আমার মাথা ঠুকে গেল। পরমুহূর্তে সকালটা অন্ধকার হয়ে গেল, আমি শুনলাম চারপাশে ভবন ধ্বংসে পড়ছে। হালকা আলোয় দেখলাম আমাদের বাসাটাও ভেঙে পড়ে গেল। আমার চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি ম্যাপল ট্রি উপড়ে পড়ে আছে, পাশেই ধ্বসে পড়া ভবন। আমি পালাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি কয়েকটা ধ্বসে পড়া ভবন থেকে আগুন লেগে গেছে। বাগানের উপড়ে পড়া গাছ ডিঙ্গিঁয়ে পার হচ্ছি, নদীতীরে পৌঁছে আমার ভাইসহ কয়েকজন স্কুল ছাত্রকে পেয়ে যাই। নদীতে প্রবল স্রোতে টর্নেডো বয়ে যাচ্ছে। সেন্তেই বাগানের গাছগুলো আকাশে উড়ে গেল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমরা বর্তমানে ফিরে আসি। হোটেল লাগেজ গুছিয়ে আমরা দ্রুত লাঞ্চ করি। সবজী, ভাত, সিঙ্গাঁরা আর দই দিয়ে আজকের লাঞ্চ। এবার আমাদের আবার দৌড়াতে হবে হিরোশিমা প্রদেশের ট্রেনিং সেন্টারে। ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান অহুচিমান সিভিল সার্ভিসের মেধাভিত্তিক নিয়োগ, কর্মকর্তাগণের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে কর্মমূল্যায়ণ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বেতন নির্ধারিত হয়। আসলে ট্রেনিং মানে ট্রাডিশনাল পড়াশোনা নয়, নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিতির মাধ্যমে ব্যক্তি পরিবর্তনের এক আশ্চর্য প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়। গ্রহণ ও বর্জনের প্রক্রিয়ায় সে একটু একটু করে গড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে।

ট্রেনিং সেন্টারে আমরা জানতে চাই পারমানবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের পর জাপান দেশটি ঘুরে দাঁড়ালো কি করে? নিদির্ষ্ট বিষয়ের বাইরে কথা হয় বিস্তর। জাপান বর্তমান বিশ্ব মানচিত্রে একটি অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল শোচনীয়, বিধ্বস্ত এবং দুর্বল। দারুন খাদ্যাভাব, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, চোরাকারবার ব্যবসা দেশটির অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দিয়েছিল।

মার্কিন প্রশাসনের কারণে দেশটির বর্হিবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ফলে রপ্তানী আয় হ্রাস পায়। ওদিকে বোমা হামলায় কলকারখানাও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কয়লা ও ইস্পাত শিল্পে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দীর্ঘ ৯ বছর পর জাপান সরকার অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়। সরকার ঘোষণা দেয়, যুদ্ধোত্তর কালের অবসান ঘটেছে। যুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে অর্থনীতি যেখানে ছিল, আমরা এখন সেখানে পৌঁছুতে পেরেছি। অতি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, মোট ভূখন্ডের ৩০% বাস ও চাষযোগ্য জমি এবং ভূমিকম্পসহ দুযোর্গপ্রবণ দেশ জাপানের উত্থানের পেছনে রয়েছে দেশটির সাধারণ মানুষের কর্মনিষ্ঠা, সম্মানবোধ ও সততা।