চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ: চির উড্ডীন থাকুক বিপ্লবী লাল নিশান

প্রকাশিত: ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২১

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ: চির উড্ডীন থাকুক বিপ্লবী লাল নিশান

॥|| এমএইচ নাহিদ ||॥

‘সাংহাই’ থেকে ‘বার্ড নেস্ট’-চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) শতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাস জানলো দুনিয়া। ১৯২১ সালের ১ জুলাই সাংহাইয়ের প্রথম কংগ্রেসে নানা বাধার মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ২০২১ সালে চীনের ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ‘বার্ড নেস্ট’-এ জমকালো আয়োজনে অনুষ্ঠিত সিপিসি শতবর্ষ উৎসব বিশ্বকে দেখিয়ে দিলো সমাজতন্ত্রই সেরা। বুঝিয়ে দিলো ‘পুঁজিবাদ নয়, সমাজতন্ত্রই বৈষম্য নিরসন ও শোষণমুক্তির একমাত্র পথ।’ একশো বছর আগে সামন্ত শাসকদের দাসত্বের শৃঙ্খল, নিত্যনৈমিত্তিক গৃহযুদ্ধ, তার সাথে উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সরাসরি আগ্রাসন থেকে চীনা জনগণকে মুক্তির যে লক্ষ্য নিয়ে সিপিসি জন্ম নিয়েছিল, তা থেকে এক বিন্দুও সরে নি। বরং ১০০ বছরের উৎসবে নতুন করে জনগণের পাশে পার্টি সভ্যদের দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শি জিং পিং বললেন, “সবকিছু, এমনকি আপনার জীবনও দল এবং জনগণের জন্য উৎসর্গ করুন।” কেবল তাই নয়, জমকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই গানের মাধ্যমে সিপিসি শপথ নিয়েছে, ‘উইদাউট দ্য কমিউনিস্ট পার্টি, দেয়ার উড বি নো নিউ চায়না।’

এই একশো বছরে সিপিসি যেমন এগিয়েছে তেমনি এগিয়েছে গণচীন। প্রথম কংগ্রেসে পার্টি সভ্য শতকের নিচে থাকলেও এখন তা ৯ কোটি ১৯ লাখ। পাশাপাশি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা মঙ্গা, খরার কবলে থাকা চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় রাষ্ট্র। কমিউনিস্ট পার্টির গণচীন এখন বৈশ্বিক চীনে রূপান্তরিত হয়েছে। নতুন আলোতে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়ে কমিউনিস্ট শাসিত চীন এখন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমারা চীনের অর্থনীতিকে যতটা না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায় কমিউনিজমকে। কারণ এই একশো বছরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কেবল চীনকেই এগিয়ে নেয় নি, ইউরোপীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং তাদের অত্যাচারের বিপরীতে বিশ্ববাসীকে সভ্য জাতিতে পরিণত করতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে চীনের কমিউনিজম। মহামারী করোনায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যখন দিশেহারা, তখন সমাজতান্ত্রিক চীন নিজের দেশকে করোনার ছোবল থেকে রক্ষা করে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে ছুটেছে দুনিয়ার দেশে দেশে। সমালোচকদের নিন্দাকে উপেক্ষা করে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে চীন দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে।

‘সাম্য ও সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন’-শ্লোগানে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা। শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না। সাংহাই শহরের তৎকালীন ১০৮ ওয়াংঝি রোডে বাড়িতে মিলিত হয়েছিলেন ৫০ জনের কিছু বেশি সভ্য কমিউনিস্ট গ্রুপের প্রতিনিধিরা। পুলিশ খবর পাওয়ায় ১০০ কিলোমিটার দূরে জিজঙ প্রদেশের জাসিঙ শহরে গা ঢাকা দিয়ে নানহু লেকে ভাড়া করা বোটে অধিবেশন করেন। ওই ‘রেড বোট’ থেকে যাত্রা করা ‘সিপিসি’ শতবর্ষ উৎসব পালন করছে কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণে। পৃথিবীর ইতিহাসে সূচনা করেছে এক নতুন অধ্যায়। জন্মের মাত্র ২৮ বছরের মাথায় বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের ক্ষমতায় বসেন সিপিসি। শুরু হয় পরিবর্তনের নতুন যাত্রা। নেতৃত্বে কমরেড মাও সেতুং। এই একশো বছরে চীনের অর্থনীতি এগিয়েছে ১৮৯ গুণ। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে চীনে ট্রাক্টরও তৈরি হতো না। এখন জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত সকল পণ্য তৈরি করে গণচীন। একশো বছরে কম্পিউটার অটোমোবাইল থেকে ২০০ ধরণের শিল্পপণ্য তৈরি করেছে। পণ্য উৎপাদনে বিশ্বে এখন চীন’ই সেরা। বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৭ শতাংশ’ই চীনের অবদান অভ্যান্তরীণ উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১৫ লক্ষ কোটি ডলার। মাথাপিছু জাতীয় আয় এখন ১০ হাজার ডলারের বেশি। দারিদ্র্যতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে ৭৭ কোটি মানুষ। গোটা দুনিয়ার দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসা মানুষের ৭০ শতাংশই চীনে। কেবল অর্থনীতি নয়, এই একশো বছরে চীনের মানুষের জীবন মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। প্রত্যেকে পেনশন ও স্বাস্থ্য সেবায় ভর্তুকি পান। চীনের গড় আয়ু ৩৫ বছর থেকে ৭৪ বছরে নিয়েছে কমিউনিস্ট শাসিত সরকার। চীনের এই অগ্রযাত্রায় কি কোনো ম্যাজিক কাজ করেছে! ‘না’। অভিন্ন সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ভারসাম্য রক্ষা, শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন-নীতির ভিত্তিতে এগিয়েছে সমাজতান্ত্রিক গণচীন। কমরেড মাও সর্বপ্রথম প্রচলিত ভূমি মালিকানা আইন বাতিল করেন, সাথে জমিদারি প্রথাও নিষিদ্ধ করেন। এর পরিবর্তে দরিদ্র ও বর্গাচাষীদের মধ্যে ভূমির মালিকানা বণ্টন ব্যবস্থা করেন। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন চীনে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে। এই পদক্ষেপের ফল চীনের জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ মধ্যম শ্রেণির কৃষকে পরিণত হয় তিনি মুদ্রাস্ফীতি ও দামবৃদ্ধিকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে আনেন।

১৯৭০ সালের দিকে কমরেড মাও ও তার সরকার এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেন। এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল, পূর্বের অর্থনৈতিক কৌশল থেকে চীনকে সরিয়ে আনা এবং জাতীয় অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো। এই পরিবর্তনই চীনকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সময়ে নব নব পরিকল্পনায় চীনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কমরেড শি জিং পিং ও তার সরকার। বৈশ্বিক ঋন প্রদান ও ওয়ানবেল্ট ওয়ান রোড তাদের সুস্পষ্টভাবে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন এক পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক চীন এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বিশ্ব মানবতার কল্যাণেও এগিয়ে আসবে চীন। কারণ চীনের আকাশে বিপ্লবের লাল পতাকা। দ্বীপ্তিমান শিখায় উড্ডয়ন থাকুক পাচঁ তারকা খচিত সেই লাল নিশান।#

এমএইচ নাহিদ
নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক নতুন কথা

সাবেক ছাত্র নেতা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ