সিলেট ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২১
মানুষ একবারই জন্মগ্রহণ করে। জন্মগ্রহণের তারিখ যদি ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়, তাহলে তিনি যে মিথ্যা দিয়ে জীবন শুরু করলেন-তা একজন অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও একমত হবেন। জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে সঠিক জন্ম তারিখের কথা শুধু আধুনিক রাষ্ট্রই বলছে না, বহু বছর আগে থেকে বিভিন্ন ধর্মও সে কথা বলে অাসছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অামাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত ত্রুটির কারণে এবং রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে অামরা অধিকাংশ( বিশেষ করে বয়স্করা) ভুল জন্ম তারিখ বয়ে বেড়াচ্ছি। জন্ম নিবন্ধনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মধ্যযুগে( ১৪২৫-২৬ খ্রিস্টাব্দে) খ্রীস্ট সমাজে গীর্জার পাদ্রীরা শিশুদেরকে সাময়িকভাবে পানিতে ডুবিয়ে খ্রিস্ট সমাজে দীক্ষিতকরণ ও খ্রিস্টান নামকরণ করাতেন( যাকে ইংরেজিতে Baptism বলে)। পরবর্তী অামলে সেখানে জন্ম নিবন্ধনের বিষয়টি স্থানীয় কমিউনিটিতে ন্যস্ত করা হয়। ভারতবর্ষে দীর্ঘকাল আগে থেকে বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র বিদ্যমান। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে শিশুর জন্মের সময় কোনো না কোনো গ্রহের প্রভাব থাকে। গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের উপর ভিত্তি করে কুন্ডলী বা কুষ্ঠি মিলন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বিশেষ করে বিবাহের সময় জাতকদের কুষ্ঠির গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলী বিশ্লেষণ করে বলা হয়, নব দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে। কুষ্ঠি মিলন পদ্ধতির স্বার্থেই শিশুর নাম, জন্ম তারিখ, দিন, মাস, বৎসর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। হিন্দু সমাজের কুষ্ঠিনামা দেখে স্বচ্ছল মুসলমান পরিবারেও শিশুর জন্ম তারিখ লিখে রাখার রেওয়াজ চালু ছিল।
এরই অংশ হিসেবে একসময় ভারতবর্ষে পঞ্জিকা ব্যবহার শুরু হয়। শিশুদের নাম ও জন্ম তারিখ লিখে রাখার বিষয়ে একেক দেশে একেক নিয়ম চালু রয়েছে। ইংল্যান্ডে ও ওয়েলসে পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানের জন্মের ৪২ দিনের মধ্যে একটি নাম নির্ধারণ করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে শিশুর নাম স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধন না করলে বড় অঙ্কের জরিমানা গুণতে হয়। সুইডেনে নাম বাছাই করার জন্য ৩ মাস ও ডেনমার্কে ৬ মাস সময় পেয়ে থাকে। সেখানে স্থানীয় সরকারের অফিস ও গীর্জায় শিশুদের জন্য নামের তালিকা দেওয়া থাকে। জার্মানীতে এমন নাম রাখতে হয়, যা দেখে বুঝা যায় শিশুটি ছেলে না মেয়ে। এখানেও স্থানীয় নিবন্ধন অফিস( স্ট্যান্ডেসান্ট) থেকে বাছাইকৃত নামের অনুমোদন নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পিতামাতা শিশুর নাম রাখার ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। তবে সেখানে একেক রাষ্ট্রে একেক রীতি প্রচলিত রয়েছে। মিশরে শিশুর জন্মের এক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাম চুড়ান্ত করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে জ্বালানো হয় তিনটি মোমবাতি। একেকটি মোমবাতি একেকটি নামের প্রতিনিধিত্ব করে। শেষ পর্যন্ত যে মোমবাতি দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলে সেটি বিজয়ী হয়। বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে সন্তান জন্মের ৭ দিন পর, অথবা ১৪তম দিনে, অথবা ২১তম দিনে একটি পশু জবাই করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হয়। একে অাকিকা বলে। ওই দিন সন্তানের মাথা মুন্ডন করে নাম রাখা হয়। তবে জন্ম তারিখ লিখে রাখার প্রচলন দেখা যায় না। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা অাছে- ‘শিশুর জন্মগ্রহণের পর নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে নিবন্ধীকরণ করতে হবে। জাতীয়তা অর্জন, নামকরণ, পিতামাতার পরিচয় জানবার এবং তাদের হাতে পালিত হবার অধিকার অাছে।’ বৃটিশ সরকার এদেশের মানুষের জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে অমনোযোগিতা লক্ষ্য করে ১৮৭৩ সালের ২ জুলাই অবিভক্ত বাংলায় জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত অাইন জারী করে। প্রথমে জন্ম নিবন্ধনের কার্যক্রমটি স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়। পরে অবশ্য এটিকে স্থানীয় সরকারের অধীনে দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১১৮ বছরে অাইনের নানান পরিবর্তন সত্বেও দেশের শতভাগ মানুষ জন্ম নিবন্ধনের অাওতায় না অাসায় ২০০১- ২০০৬ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২৮টি জেলায় ও ৪টি সিটি কর্পোরেশনে জন্ম নিবন্ধনের কাজ নতুনভাবে অারম্ভ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৩ সালের অাইন রহিত করে সরকার ২০০৪ সালের ৭ ডিসেম্বর জন্ম ও মুত্যু নিবন্ধন অাইন’ ২০০৪ প্রবর্তন করে। অাইনটি ২০০৬ সালের ৩ জুলাই হতে কার্যকর হয়। ২০০১- ২০০৬ সালের পাইলট প্রকল্প শেষে প্রকল্পটি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্প( ২য় পর্যায়) নামে অারম্ভ হয়ে ২০১২ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটির ৩য় পর্যায়ের কার্যক্রম জুলাই’২০১২ থেকে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে শেষ হয়। সারাদেশে ১৬ কোটি ৮৮ লক্ষের অধিক লোকের জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। বর্তমানে সারাদেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশনের ১২৪টি অাঞ্চলিক অফিস,৩২৯টি পৌরসভা, ৪৫৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১৫ টি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও ৪৪টি দেশের ৫৫টি দুতাবাস/মিশনসহ মোট ৫১০৭টি নিবন্ধক অফিসে সরাসরি ও নিয়মিত যোগাযোগ সমন্বয় করে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে।
সরকার ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যমান জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম অব্যাহত ও গতিশীল রাখার স্বার্থে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অাইন সংশোধন করে রেজিস্ট্রার জেনারেল, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধক অফিস স্থাপন করে( সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। বর্তমান সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অাইন ২০০৪( ২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের পুর্নাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য,২০০১-২০০৬ সালে যখন প্রকল্পটি চালু হয় তখন নিযুক্ত অস্থায়ী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাপানো ফরমের মাধ্যমে জন্ম তারিখ সংগ্রহ করে এবং ইউনিয়ন পরিষদে রক্ষিত ভলিউম বহিতে লিপিবদ্ধ করে। ২০১০ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য প্রতি ইউনিয়নে ইউঅাইএসসি( ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার) নামে অস্থায়ী অফিস চালু করে সেখানে ২ জন কর্মী( ১জন মহিলা ও ১ জন পুরুষ) নিযুক্ত করে; যা পরবর্তীতে ইউডিসি( ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার) নামকরণ করা হয়। কিন্তু তারা দক্ষ না হওয়ায় কম্পিউটারে দক্ষ এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তিতে( প্রতি ব্যক্তির এক টাকা করে) ভলিউম বহিতে লিপিবদ্ধ নামগুলো অনলাইনে এন্ট্রি করার ব্যবস্থা করা হয়। যে কোনো প্রকল্পের শুরুতে বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধনের বিষয়টিও ব্যতিক্রম নয়। কোনো কোনো কেন্দ্রে দেখা গেছে, চুক্তিভিত্তিক ব্যক্তিরা দ্রুত কাজ শেষ করতে গিয়ে বহু ব্যক্তির নাম,জন্ম তারিখ এন্ট্রি করতে গিয়ে ভুল করে। বর্তমানে ৫১০৭টি কেন্দ্রে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ১৮ কোটি মানুষের জন্ম নিবন্ধন করার জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষের জন্ম নিবন্ধন হওয়ায় পুরো প্রকল্পটির স্বচ্ছতার বিষয়ে প্রশ্ন অাসা শুরু হয়েছে। ধারণা করা হয়, একজন ব্যক্তি একাধিকবার জন্ম নিবন্ধন করায় এমনটি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সকল অনিয়মের পিছনে রয়েছে, শিশুর জন্মের৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন না করা। রেজিস্ট্রার জেনারেল একাধিক জুম মিটিংএ ৪৫ দিনের মধ্যে শতভাগ শিশুর জন্ম নিবন্ধন করার জন্য কঠোরভাবে তাগাদা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের নিবন্ধকদের বক্তব্য, ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর জন্ম নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন, শিশুটির পিতামাতার জন্ম নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুইজনের জন্ম নিবন্ধন নাই, কিংবা একজনের অাছে। তাদের জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মটি সহজিকরণ না হওয়ায় একদিনে তারা শিশুর জন্ম নিবন্ধন করতে পারছে না। অনেকে দিনমজুরি কাজ করায় দ্বিতীয় দিন কেন্দ্রে অাসতে অনাগ্রহী হয়ে থাকে। তাছাড়া বার বার সার্ভার পরিবর্তন হওয়ায় পিতা মাতা পুর্বে জন্ম নিবন্ধন করেছেন কি না, তা দ্রুত সার্চ দিয়ে খোঁজ করা যায় না। কিন্তু জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন করতে অনাগ্রহীদের অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার ক্ষমতা দেয়া অাছে। অথচ বর্তমানে বিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকুরিতে নিয়োগ, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয় পত্র সহ ১৯টি ক্ষেত্রে জন্ম সনদ অাবশ্যক করা হয়েছে। যাহোক,বর্তমানে নিবন্ধকেরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়ায় ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর জন্ম নিবন্ধনের হার ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ অাশা করা যায়, এ ধারা বজায় থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে ৫০ ভাগ উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন প্রয়োজন,অভিভাবক শ্রেণী, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মী, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সার্বিক সহযোগিতা।
লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক। সেল- ০১৭১২৬৩৮৬৮২
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D