সিলেট ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২১
ইতিহাসের কয়েকজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন অন্যতম। তিনি একজন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও জীববিজ্ঞানী। যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে। গাছেরাও উত্তেজনায় সাড়া দেয়। তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা উদ্ভিদদেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শন করে। ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ তিনিই আবিষ্কার করেন। তাঁর বিভিন্ন গবেষণা আজ আধুনিক যুগেও টেলিভিশন ও মহাকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু। মা বামা সুন্দরী দেবী।
তাঁর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এর পূর্বে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। তিনি চাইতেন ইংরেজি শেখার আগে তাঁর সন্তান ভালো করে মাতৃভাষা শিখুক; দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে চেতনায় দেশপ্রেম গড়ে উঠুক। তাঁর পিতার এই চেষ্টা যে বিফলে যায়নি তা জগদীশ চন্দ্র বসুর পরবর্তী জীবনের নানা ঘটনাবলী; বিশেষ করে বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো প্রমান করে।
জগদীশ চন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে।যেখানে বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা তাঁর সহপাঠী ছিলেন। এরপর কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশুনো করেন; ১৮৬৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ভর্তি হন। এখানে তিনি ইউজিন ল্যাফন্টের সঙ্গে পরিচিত হন যিনি তাঁর মধ্যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি করেছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি বিএ পাশ করেন।
তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে তার মেডিকেল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি বাবার ইচ্ছায় প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞান সাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। সেখানে তাঁর সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সাথেও তাঁর পরিচয় হয়, যার সাথে তিনি ভাল বন্ধুত্ব গড়েছিলেন।
১৮৮৫ সালে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতে ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। প্রথম চাকরিতেই তিনি বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন এবং তাঁর বেতন ব্রিটিশ অধ্যাপকদের তুলনায় অনেক কম নির্ধারিত হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে প্রতিবাদের পরই তাঁর বেতন ব্রিটিশদের সমতুল্য করা হয়েছিল। কলেজে ২৪ বর্গফুট একটি ছোট ঘরে অত্যন্ত প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
প্রতিদিন তাঁর কলেজের অধ্যাপনার পাশাপাশি যেটুকু সময় থাকত তিনি গবেষণার কাজ করতেন। আঠারো মাসের অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করে ১৮৯৫ সালে একটি ৫ মিমি থেকে স্বল্পতম রেডিও-তরঙ্গ তৈরি করেছিলেন। যা বলা হয় অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ। আধুনিক টেলিভিশন এবং মহাকাশের ক্ষেত্রে এই ধরণের তরঙ্গের ভুমিকা অনস্বীকার্য।
তিনি ১৮৫৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর সামনে তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র- “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” উপস্থাপন করেন। ১৮৯৬ সালে তাঁর গবেষণাগুলি লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞানী মার্কোনি রেডিও আবিষ্কারের আগেই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বিনাতারে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য-সংকেত বিনিময়ে সক্ষম হয়েছিলেন এবং প্রদর্শনও করেছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বেতার সংকেত প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন মার্কারি কোহেরার। যন্ত্রটি কলকাতা বসেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন। যন্ত্রটিতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন তার নাম “সলিড স্টেট ডায়োড”। ১৮৯৯ সালের বিভিন্ন সময়ে এই কোহেরার যন্ত্রটি প্রদর্শিত হয়েছিল। এই সলিড স্টেট ডায়োড ডিটেক্টর এবং মাইক্রোওয়েভ প্রজাত অদৃশ্য আলোর জনক তিনি।
১৯০১ সালে মার্কোনি যে ডায়োড ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারে বেতার সংকেত পাঠিয়েছিলেন, তা ১৮৯৭ সালে লন্ডন রয়্যাল সোসাইটিতে প্রদর্শিত জগদীশচন্দ্রের নির্মিত যন্ত্রের হুবহু নকল। যদিও মার্কোনি ওয়্যারলেস সিগন্যালিং এবং টেলিগ্রাফি নিয়ে কাজ করতেন। ১৯০৯ সালে মার্কনিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হলো। আর বাঙালি বিজ্ঞানী বেতার তরঙ্গের সৃষ্টির আবিষ্কারক হিসাবে অজ্ঞাত থেকে গেলেন।
আসলে নিরহংকারী এই মহাত্মা গোটাকয়েক যন্ত্রের আবিষ্কার করলেও পেটেন্টের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না। এমনকি রেডিও সিগনাল শনাক্তকরণে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার বিষয়ে তাঁর করা গবেষণাপত্র তিনি উন্মুক্ত করে দেন যেন অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
জগদীশ চন্দ্র বসু লন্ডন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে এবং বিজ্ঞান ফোরামে সাড়া জাগানো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব।”
এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতির সদস্য মনোনীত হন।
বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯২৭ সালে; লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা।
পরাধীন ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া শত শত স্বদেশ প্রেমিকদের মধ্যে এই ভারতীয় বাঙালি বৈজ্ঞানিক ছিলেন অন্যতম। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় বারবার তাঁর এই স্বদেশপ্রেমের দিকটি উন্মোচিত হয়েছে৷ আমাদের সৌভাগ্য যে পরাধীন ভারতবাসীর স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই তা সমভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিল৷
এই বাঙালী বিজ্ঞানী যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ”গাছের প্রাণ আছে”। তিনি প্রথম গবেষণা করেছিলেন উদ্ভিদ প্রাণীর মতোই উত্তেজনায় সাড়া দেয় অর্থাৎ তারা ব্যথা অনুভব করতে এবং স্নেহ অনুভব করতে সক্ষম। এছাড়াও তিনি এটাও প্রমান করে দেন উদ্ভিদের জীবন চক্র রয়েছে এবং তাঁর এই গবেষণা লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি প্রকাশ করেন।
গবেষণা ছাড়াও তিনি একজন লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : Responses in the Living and Non-living (1902), Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (1906),
Comparative Electro physiology (1907),
Physiology of Photosynthesis (1927),
Nervous Mechanism of Plants (1925), Motor Mechanism of Plants (1928), Growth and Tropic Movement in Plants (1929) & others। ১৮৯৬ সালে তাঁর রচিত “নিরুদ্দেশ কাহিনী” বাংলা বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের প্রথম প্রধান কাজ ছিল। এটি পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল।
তিনি ধারাবাহিকভাবে ক্লকওয়ার্ক গিয়ার্স ব্যবহার করে উদ্ভিদের বৃদ্ধি পরিমাপের জন্য ক্রিস্কোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। প্রথম ওয়্যারলেস সনাক্তকরণ ডিভাইস আবিষ্কারেরও তাঁর কৃতিত্ব। তবে জগদীশ চন্দ্র বসু নিজের গবেষণার জন্য জীবদ্দশায় কোনো পেটেন্ট গ্রহণ করেন নি।
তিনি ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার থেকে “নাইটহুড” উপাধি পান। ১৯২০ সালে
রয়েল সোসাইটির ফেলো,
ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য, ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। ১৯২৮ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের তিনি সভাপতিত্ব করেন। বিবিসি জরিপে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় সপ্তম স্থান লাভ করেন।
মহাবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এমিরিটাস প্রফেসর পদ লাভ করেন। ১৯১৭ সালে তিনি উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য কলকাতায় ‘‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তাঁর আজীবন সঞ্চিত ১৭ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৩ লক্ষ টাকা ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’কে দান করেন।
আলবার্ট আইনস্টাইন; বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে নিজেই বলেছেন,- “জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত ”
১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে ৭৮ বছর বয়সে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে। বাঙালির গর্ব এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।
© হারুন-অর-রশীদ।
(Source – “Jagadish Chandra Bose” (PDF)। Pursuit and Promotion of Science: The Indian Experience (Chapter 2)। Indian National Science Academy. 2001, জগদীশচন্দ্র সেরা রচনা সম্ভার, পত্র ভারতী, কলকাতা, ১৯৬০, a2qbn.ask2q com,Progotir Bangla)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D