নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর দাবিতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সমাবেশ

প্রকাশিত: ৫:৫১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৬, ২০২১

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর দাবিতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সমাবেশ

বিপ্লব চাকমা, নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ২৬ নভেম্বর ২০২১ : মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ রুখে দাঁড়াও, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিশ্চিত করাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর দাবিতে আজ শুক্রবার (২৬ নভেম্বর ২০২১) বেলা ৩টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সমাবেশ, গণসঙ্গীত ও সমাবেশ শেষে শিখা চিরন্তন পর্যন্ত র‌্যালি ও র‌্যালি শেষে বীর শহীদানের প্রতি শ্রদ্ধ নিবেদন করা হয়।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সানোয়ার হোসেন, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারী নেত্রী রোকেয়া কবির, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ সদস্য সচিব ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রী রেখা চৌধুরী, সংগঠনের সাধারণ সাম্পাদক সালেহ আহমেদ।
ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন সংগঠনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট পারভেজ হাসেম।
সভা সঞ্চালনা করেন, সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যৌথভাবে সানোয়ার হোসেন সামছি ও এ কে আজাদ।
সমাবেশের ঘোষণায় বলা হয়, ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়েছিল সব মানুষের রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র – এই চার মূলনীতি সামনে রেখে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিপীড়ন, বৈষম্য, শোষণ, গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই পাকিস্তানী ভাবধারায় হাঁটতে শুরু করে এবং এই হাঁটা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন; পরে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করা, সমাজতন্ত্র কার্যত বাদ দেয়া এবং গণতন্ত্র শুধুমাত্র সংবিধানেই আছে, বাস্তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দূর্বলতার অনুশীলন কিংবা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নামমাত্র বললে ভুল হবে না।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনগণকে লড়তে হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন ও বিজ্ঞানভিক্তিক একমূখী শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য। কমপক্ষে ৩ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে ক্রমশ বিভক্ত ও পশ্চৎপদ করছে। গত ৫ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেছে ১৩.৪৭ শতাংশ। অপরদিকে এবতেদায়ী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৪.৪২ শতাংশ। হেফাজতের পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনে মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষাকে প্রায় একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। মূলত এই শিক্ষা একটি পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতি তৈরি করার অপচেষ্টা বলে আমাদের কাছে প্রতিয়মান হয়েছে।
সব শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। নিরাপত্তাহীনতা ও ইভটিজিং এবং সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া বাড়ছে, ফলশ্রুতিতে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। নারী-শিশু নিপীড়ন ও ধর্ষনের মতো বেদনাদায়ক ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেশে। আমরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
স্বাধীন বাংলাদেশ সংঘ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালেই সাম্প্রদায়িক সংহিসতার ঘটনা ঘটে। এরপর ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন, নির্যাতন ও বিতাড়ন চলছে। এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপর সংহিসতার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা এখন পর্যন্ত নিস্পত্তি হয়েছে কিংবা অপরাধীদের শাস্তি হয়েছে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ত্রমশ কমছে। ১৯৭৫ সালে প্রথম আমদশুমারীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫ শতাংশ, ২০১১ সালের আদমশুমারীতে তা দাঁড়িয়েছে মোট জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ। ২৪ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোরই বাস্তাবায়ন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা ভূমি। এটি সমাধানের জন্য একটি কমিশন হলেও কার্যত এর অগ্রগতি নেই। পাহাড়-সমতল সর্বত্রই আদিবাসীরা ক্রমশ তাদের ভূমি হারিয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।
ন্যায়বিচার, অধিকার, সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু গত ৫০ বছরে এর কোন সূচকই আশাব্যঞ্জক নয়। বৈষম্য সর্বত্র বিদ্যমান; গ্রাম-শহর, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ সবক্ষেত্রেই এটি দৃশ্যমান। শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আরো শক্তিশালী হচ্ছে। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিরাজনীতিকরণ, রাজনীতিতে লুটেরা ধনীক ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য গণতন্ত্র ও সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে।
ধর্মের রাজনীতি ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বর্তমানে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে ধর্মের ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে দেশে জঙ্গিবাদের বাতাবরণ করতে শুরু করেছে। ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সারাদেশে একসঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ঐদিন সকাল ১১টা থেকে ১১:৩০ এর মধ্যে ৬৩ জেলায় ৪০০ স্পটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এরই ধারাবাহিকতায় ২১ শে আগষ্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে, উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, গীর্জায় কাদিয়ানীদের উপাসনালয়, আদালত, রমনার বটমূল, শোলাকিয়া ঈদের জামাতসহ আরো অনেক বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। জঙ্গিরা হত্যা করেছে সেকুলার ব্লগার, লেখক, প্রকাশক এবং এমনকি ভিন্ন মাজারের ধর্মীয় অনুসারিদেরকেও।
জঙ্গিবাদী তৎপরতা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মূলত এরা আন্তর্জাতিক বলয় তৈরি করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে দেশে দেশে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে পুরো বিশ্ব ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এরা বোমা হামলা, মানুষ হত্যা ও হুমকী দিয়ে বিশ্ব নিরাপত্তাকে বিঘ্ন করে চলেছে। এই অপশক্তি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা-সহ দেশে দেশে মানুষ হত্যার মধ্যদিয়ে বর্বরতায় মেতে উঠে। ইতোমধ্যে এই উপমহাদেশে জঙ্গিবাদী শাসন কায়েমের হুমকী দিয়ে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এরা ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠনের আড়ালে ভারতের মুম্বাই শহরের তাজ হোটেলে আক্রমন চালিয়ে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে এরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। ২০১৬ সালের রাজধানীর উপকন্ঠ গুলশানে কুটনৈতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারীতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে দেশী ও বিদেশী নাগরিকদের হত্যার মধ্যদিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করারও অপচেষ্টা চালিয়েছে। মূলত এরা আমাদের দেশকে আধা-পাকিন্তান বা আফগানিস্তান বানানোর অপচেষ্টায় এখনো গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। এই অপশক্তিসমূহ মূলত একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা। এদের দেশী ও বিদেশী গডফাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানাই।
নানান অজুহাতে বিভিন্ন সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া মানুষের টিকে থাকাকে আরো কঠিন করেছে।
আমাদের দাবী :
১. জ্বালানী তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খ্যাদ্য দ্রব্যের দাম ও গণপরিবহণের বর্ধিত ভাড়া কমাতে হবে।
২. সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিক্তিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

৪. পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।