সিলেট ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০২১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে যেমন গৌরবের অধ্যায় রয়েছে, তেমনি রয়েছে অগৌরবের অধ্যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্য দেখা গিয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তা ছিল অতুলনীয়। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিরোধিতায় যারা ছিল, তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের ওই জাতীয় ঐক্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল, তারা অন্য কোনো দল ও সংগঠনের সহযোগিতা নিতে রাজি ছিল না। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ঐক্যকে সংগঠিত রূপে নিতে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান কোনো সাড়া পায়নি।
অপরদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন বামপন্থিদের মোর্চা ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতার প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। ফলে এসব দল ও সংগঠনকে নিজ নিজভাবে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখতে পাই স্বাধীনতা-উত্তরকালেও। পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু তার প্রথম বক্তৃতাতেই জনগণকে একতাবদ্ধ থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার এ ঐক্যের আহ্বানের কোনো বাস্তব রূপরেখা ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ডিসেম্বর মাসে মোজাফ্ফর ন্যাপের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের যে আহ্বান ছিল, তা রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠনের আহ্বানও।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে দু’দিনের মাথায় দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। নিজে রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের আওয়ামী লীগের সত্তরের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এটা সংগতিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে বাস্তবতার সৃষ্টি করেছিল, তার সঙ্গে এটা সংগতিপূর্ণ ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্র কাঠামোগতভাবেই বিরোধী দলকে স্বীকার করে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকালে গঠিত গণপরিষদে বিরোধী দলের কার্যত কোনো অবস্থান ছিল না। মাঠের বিরোধিতাই দেশের রাজনীতির প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই মাঠের রাজনীতিতে সরকারের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খোদ আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে নতুন বিরোধী দলের জন্ম হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অতি ডান ও অতি বামের বিরোধিতা তো ছিলই। স্বাধীনতাবিরোধী অতি ডানপক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে উল্টে দিতে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র করে চলেছিল। অন্যদিকে অতি বাম সশস্ত্র বিপ্লবীরা বহুদিন ধরে বাংলাদেশকে স্বীকারই করতে রাজি হয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল- বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ হয়ে গেছে। সুতরাং জাতীয় মুক্তির লড়াই চালাতে হবে।
তবে এই অতি ডান ও অতি বাম বিরোধিতাকারীদের কর্মকাণ্ড জনমনে বিশেষ সাড়া ফেলতে পারেনি, যেটা পেরেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিভাজনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দলীয় ব্যক্তিদের অভিযোগে দুর্নীতি, দখলবাজি ও দলবাজির ঘটনাবলি। সে সময়টা যারা দেখেছেন তারা লক্ষ্য করেছেন, কীভাবে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি এত দ্রুততার সঙ্গে বিভক্ত হয়ে গেল!
বঙ্গবন্ধু এটা উপলব্ধি করেছিলেন। তার ওই উপলব্ধি থেকেই তিনি সম্ভবত পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন তার দ্বিতীয় বিপ্লবের স্লোগানে। তিনি এক ছাতার নিচে সব রাজনৈতিক দলকে আনতে চেয়েছিলেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের স্বতঃস্ম্ফূর্ততার পথে নয়। বরং আইন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিলোপ করার মধ্য দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে; জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করে; সংবাদপত্রের সংখ্যা সীমিত করে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
তার ওই দ্বিতীয় বিপ্লবের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মসূচি অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমতা বিধান ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকে খর্ব করে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এদিকে ষড়যন্ত্রের শক্তি সংহত হয়ে গেছে। জাতির মধ্যে বিভক্তি ও জনগণের সঙ্গে শাসক সরকারের বিচ্ছিন্নতা তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্য থেকেই তারা সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছে। আর এ কারণে ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তখন কাঙ্খিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। বরং তার লাশ ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায়ই তার সহযোগীরা ঘরের শক্র বিভীষণ খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন, শপথ নিয়েছেন।
অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী যে সামরিক শাসকরা শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেছে, তাদের শাসনেরও মূল ভিত্তি ছিল জাতীয় ঐক্যের বিভাজন। তারা এ ক্ষেত্রে ধর্মকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সৃষ্টি করেছে ধর্মীয় বিভাজন, যা এখন ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে পুরো সমাজকেই বিভক্ত করেছে এবং করে চলেছে। এই শাসকরা অর্থনীতি ক্ষেত্রেও তাদের লুটপাটের অর্থনীতির মাধ্যমে এক লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী তৈরি করেছে। রাষ্ট্রের সব সম্পদকে কেন্দ্রীভূত করেছে এই ধনিক গোষ্ঠীর হাতে। অর্থনীতিতে আর দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণ থাকেনি; ক্ষমতায় অংশগ্রহণ দূরে থাক।
ইতোমধ্যে পৃথিবীতেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিলুপ্ত হয়েছে। পুঁজিবাদ তার নয়া চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বে। তার সর্বশেষ রূপায়ণ ঘটেছে নয়া উদারপন্থি অর্থনীতিতে। এর ফলে পৃথিবীর দেশে দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, নগ্ন শোষণই বাড়েনি; পৃথিবীর সব সম্পদের মালিকানা একত্রিত ও কেন্দ্রীভূত হয়েছে উপরতলার ক্ষুুদ্র ৬ শতাংশের হাতে।
বাংলাদেশও এর থেকে বাইরে থাকেনি। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনে দেশ নতুন পরিবর্তনের আশা দেখলেও এই নয়া আর্থনীতিক উদারবাদের নীতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বৈষম্যের। এ অর্থনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে প্রসার ঘটেছে দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ-সম্পদ পাচার এবং এর সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের পাশাপাশি ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার, ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান। শাসনক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী আচরণ।
বাংলাদেশের ৫০ বছরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে চেনার বিশেষ উপায় নেই। পাকিস্তান আমলের দুই অর্থনীতি আজ আবার নতুনভাবে দৃষ্ট হচ্ছে ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরের দুই সমাজের বিভক্তিতে। আর মাঝে প্রবাহিত হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজনের আন্তঃস্রোত।
বাংলাদেশের ৫০ বছরে অতি দরিদ্র দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যে উত্তরণ ঘটেছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য- সন্দেহ নেই।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল, তা আজ বিভাজিত। সে বিভাজন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে।
জাতির এ ধরনের বিভাজন নিয়ে কোনো উন্নয়ন- তা যতই অসাধারণ হোক; জনগণকে স্পর্শ করে না, জনকল্যাণ ঘটায় না। তা জনগণের ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করে না শুধু; তার মৌলিক মানবিক অধিকারকেও ক্ষুণ্ণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানে তার রূপায়ণ ঘটেছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ- এ চার মূলনীতিতে। বাংলাদেশের ৫০ বছরে তা থেকে দেশ কত দূরে দাঁড়িয়ে- তাই আজ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পর্যালোচনা করা প্রয়োজন নানাভাবে বিভক্ত এ সমাজকে নিয়ে নতুন ৫০ বছরে আর কত দূর এগোনো যাবে?
রাশেদ খান মেনন :সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D