বিশ্ববন্দিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সখ্যতা

প্রকাশিত: ৪:২৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০২২

বিশ্ববন্দিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সখ্যতা

অনুসন্ধিৎসু | ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি ২০২২ : বিশ্ববন্দিত দুই ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জগদীশচন্দ্র বসুর সখ্য সারাজীবন অটুট ও অমলিন ছিল৷ প্রথম দিকের ‘আপনি’ সম্বোধন কিছুদিনের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ ‘তুমি’ হয়ে যায়৷ বয়সে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্রের থেকে আড়াই বছরের ছোট৷ প্রথমবার বিজ্ঞান সফর শেষে ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে বিজ্ঞানী দেশে ফিরে উঠেছিলেন ধর্মতলায় ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর বাড়ি৷ সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান গবেষণার সফলতার খবর প্রকাশ হচ্ছিল, তাঁর অসাধারণ সম্মানলাভ দেশের শিক্ষিত মহলে বেশ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে৷ সেই এপ্রিল মাসের এক সকালে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করতে এলেন রবীন্দ্রনাথ,তবে দু’জনের দেখা হয়নি, বিজ্ঞানী বাড়িতে ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ তাঁর টেবিলে একটি ম্যাগনোলিয়া ফুল রেখে আসেন৷ ৮৫নং আপার সার্কুলার রোড জগদীশচন্দ্রের ভাড়া বাড়িতে অনেক বিখ্যাত মানুষ আসতেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার থেকে রবীন্দ্রনাথ৷ এক চিঠিতে বিজ্ঞানীকে রবি কবি লিখেছিলেন ‘তোমার সার্কুলার রোডের এই ক্ষুদ্র কক্ষটি এবং নীচের তলার মাছের ঝোলের আস্বাদন সর্বদা মনে পড়ে’৷

আবার রবীন্দ্রনাথ যখন পদ্মাপারে তাদের জমিদারির শিলাইদহে থাকতেন তখন প্রতি মাসের শেষ শনিবার সেখানে গিয়ে দু’রাত কাটিয়ে সোমবার কলকাতায় ফিরতেন জগদীশচন্দ্র বসু, সঙ্গে থাকতেন সহধর্মিণী অবলা ৷ বিজ্ঞানীর জন্য থাকত আলাদা একটা বজরা৷ সন্ধ্যায় দুই বন্ধু বোটের মধ্যে নানা আলোচনা করতেন৷
জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে আবদার করতেন প্রতিবার একটি নতুন গল্প শোনাতে হবে,বন্ধুর সেই দাবি মেনে রবি কবি নতুন গল্প পড়ে শোনাতেন৷ অন্যদিকে জগদীশচন্দ্র তাঁর নতুন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতেন৷
দ্বিতীয়বার জগদীশচন্দ্র বিদেশে কিছু সমস্যার সন্মুখীন হয়েছিলেন, সেখানে আরও কিছুদিন থাকার প্রয়োজন হয়,পাশে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ৷ বারবার চিঠি লিখে উৎসাহ দিতেন, এক চিঠিতে তিনি লিখলেন ‘যেমন করিয়া হোক তোমার কার্য অসম্পন্ন রাখিয়া ফিরিয়া আসিওনা৷ তুমি তোমার কর্মের ক্ষতি করিও না, যাহাতে তোমার অর্থের ক্ষতি না হয় সে ভার আমি লইব’.. (১২ডিসেম্বর,১৯০০)৷
শুধু চিঠি নয়, বিদেশে থাকার প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য জগদীশচন্দ্রের কাছে পৌঁছে গিয়েছে৷ নিজের আর্থিক সমস্যার জন্য ত্রিপুরার মহারাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে জগদীশচন্দ্র কে পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ৷ ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠায় রবি কবির অসমান্য অবদান আছে, নিজে অর্থ সাহায্য করেছেন, পরিচিতদের থেকে অর্থ ভিক্ষা করে এনেছেন৷ ‘বোস ইনস্টিটিউট’ উদ্বোধনের দিন বিদেশে থাকার জন্য নিজে উপস্থিত না থাকতে পারলেও লিখে পাঠিয়েছিলেন বিখ্যাত সেই গান ‘ মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন/করো মহোজ্জ্বল আজ হে!/শুভ শঙ্খ বাজ’হ বাজ’ হে’ ৷
আবার রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনকে আরো বড় করতে উদ্যোগী তখন বন্ধুবর জগদীশচন্দ্র একই ভূমিকা নিয়েছেন,পরামর্শ থেকে আর্থিক সাহায্য করে রবীন্দ্রনাথের পাশে থেকেছেন৷ জগদীশচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনের পরিচালনা পরিষদের সহ সভাপতির আসনে রবীন্দ্রনাথ যেমন বসিয়েছিলেন ঠিক তেমন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রথম গভর্নিং বডির অন্যতম সদস্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী ও বিশ্বকবির গুনগ্রাহী বন্ধুত্বের আরেক নিদর্শন পরস্পরকে নিজের লেখা গ্রন্থ উৎসর্গ৷ রবীন্দ্রনাথ ‘কথা’,’খেয়া’, কাব্যগ্রন্থ সহ অনেক বই জগদীশচন্দ্রকে উৎসর্গ করেছিলেন, তেমন বিজ্ঞানী তাঁর লেখা ‘ The Nervous Mechanism of plsnt’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে৷ কবি নোবেল পেলেন ১৯১৩সালে, বন্ধু গর্বে গর্বিত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র লিখলেন ‘পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্য ভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি৷ আজ সেই দুঃখ দূর হইল’৷ জগদীশচন্দ্র তাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন ‘ আমার সমুদয় চেষ্টার মধ্যে আমি কখনও সম্পূর্ণ একা ছিলাম না৷ আমরা উভয়েই অপ্রসিদ্ধ ছিলাম, তখন আমার চিরবন্ধু রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গে ছিলেন৷ সেইসব সংশয়ের দিনেও তাঁহার বিশ্বাস কোন দিন টলে নাই’৷

গ্রন্থঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার
সংগ্রামী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র,সুনীতিকুমার মণ্ডল