কিংবদন্তির কবি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ খানের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী কাল

প্রকাশিত: ১২:১২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২

কিংবদন্তির কবি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ খানের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী কাল

| সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে পিতার কর্মস্থল বিভিন্ন মহকুমা ও জেলা শহরে। তবে ছুটিতে, বিশেষ করে গরমের ছুটিতে প্রায়ই যেতেন গ্রামের বাড়ি বাহেরচরে। সেখানে বাড়ির উঠানে ভাইবোন আর গ্রামের ছেলে মেয়েদের নিয়ে মেতে উঠতেন নাটক, গান, কবিতা আবৃত্তিতে। কিশোর বয়স থেকেই তার কবিতা লেখার শুরু। যে প্রকৃতি আর মানুষ তার কবিতার উপজীব্য হিসেবে বারবার উঠে এসেছে তাকে তিনি প্রথমে প্রত্যক্ষ করেছেন এই গ্রামেই। ১৯৫১ তে তার বয়স মাত্র সতের বছর। সেইসময় বাহেরচরে গ্রামের বাড়ি থেকে তার এক কিশোর সাথীকে চিঠিতে লিখেছিলেন- “সত্যিই বর্ষাকালটা বড় অভিমানী। একটুকুতেই মান, একটুকুতেই কান্না। কালো মেঘের মুখ ঢেকে আষাঢ়ের বিরতী আকাশ যখন আমার জানালার ধারে কাঁদতে থাকে তখন আমাদের বুকও হু হু করে কেঁদে ওঠে। … কিন্তু বর্ষা নিয়ে কবিত্ব করা সোজা। অন্তত আমাদের কাছে। জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসে আমিও এতক্ষণ করছিলাম। অথচ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাছের ডালে কাকের সাথে কিষাণরাওতো ভিজছে। ভিজে জুপসে তো পরের ক্ষেতে কাজ করছে।” প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে কিশোর বয়সেই এই পর্যবেক্ষণ তার ভবিষ্যত মানসগঠনে প্রভাব ফেলেছে। ছাত্রজীবনে তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন বামপন্থী রাজনীতির দিকে। তবে রাজনীতিতে যাননি। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই ছিল তার মূল অঙ্গন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে সাংস্কৃতি সংসদ গড়ে তুলেছেন। বায়ান্ন’র একুশেতে দশজন দশজন করে মিছিলে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করা হয়। তার একটি মিছিলের সামনে ছিলেন তিনি। পুলিশ তাদের ট্রাকে তুলে নিয়ে ঢাকার বাইরে রেখে এসেছিল। সেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণেই বাংলা কবিতায় তার স্পর্ধিত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ‘মাগো’, ওরা বলে কবিতায়। সেই কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আবির্ভাবেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তার স্ফুরণ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, সুস্পষ্ট বিকাশ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহ্যে, স্বাধীনতা উত্তর উন্মাতাল সময়ে তিনি স্থিত হন আত্মমগ্নতায়। মাঝখানে তিনি কিছুদিন কবিতা লেখায় বিরতি দিয়েছিলেন। তার নিজের কথায়, কিছুটা প্রাত্যহিক প্রয়োজনের জড়তায়, কিছুটা অভিমানে কবিতার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সত্তরের মাঝামাঝি আবার যখন ফিরেছেন তখন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। তার কবিত্ব শক্তি লক্ষ্য করে স্তম্ভিত হয়েছেন সমসাময়িক কবিরা। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ পড়ে এদেশের প্রধান কবি শামসুর রহমান নিঃসংকোচে বলেছিলেন, ‘তিনি যদি আর কোন কবিতা নাও লিখেন তবুও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন শক্তিশালী কবি হিসেবে’। আর পশ্চিম বাংলার অন্যতম প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য ছিল, ‘এমন কবিতা বাংলা ভাষায় লেখা সম্ভব সেটা আমার জানা ছিল না’। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর পরিচিতি কেবল কবিতায় নয়। ইংরেজি সাহিত্যে একজন মেধাবী ছাত্র আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এম এ পরীক্ষার ফল বেরুনোর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তখনকার ধারা অনুসারে এবং বিশেষ করে পরিবারের আগ্রহে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। এরপর দক্ষ প্রশাসক হিসেবে মহকুমা ও জেলা পর্যায় অতিক্রম করে সরকারের সচিব, টেকনোক্রেট মন্ত্রী হিসেবে এদেশের কৃষি ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো গড়ে তোলেন তিনি। ঢাকার খামারবাড়ী, কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বরিশালের রহমতপুরের কৃষি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও প্রতিষ্ঠান তার স্বাক্ষর বহন করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেশ বিদেশের কৃষি বিষয়ক অভিজ্ঞতাকে তুলে এনেছেন তার লেখায়। এদেশের কৃষি উন্নয়নে পথনির্দেশ করেছেন। কৃষির সাথে জড়িত মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ভূমি সংস্কার, খেতমজুর ও কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ও কাজের নিশ্চয়তা বিধানে তার করা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত করা গেলে এদেশের কৃষি আরো অনেকদূর এগিয়ে যেত। গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য স্বশাসিত স্থানীয় সরকার, নারী অধিকারের প্রশ্নে তিনি কেবল সোচ্চার ছিলেন না, সেই লক্ষ্যে কাজও করে গেছেন। শেষ দিকে এসে প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যম সমূহে তার লেখাগুলো কেবল তার বিদগ্ধ মনেরই নয়, মানবসমাজ ও পৃথিবীর প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসার পরিচয় দেয়। কবি ও সফল কর্মময় জীবনের অধিকারী এই মানুষটিকে তার জীবনের কাজ পূর্ণ করার আগেই তার প্রিয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। গভীর অভিমানে নিজেই যেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেলেন। মৃত্যুর আগে একটি বছর বাকহারা নিশ্চল বিছানায় শুয়ে দিন অতিক্রান্ত করেছেন। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ তার কাছে পৌঁছায়নি। তার কবিতার খাতাগুলো শূন্য থেকেছে। সেই গভীর শূন্যতা তার কোন ক্ষতি করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের কবিতার ভূবন। পিতার কবরে তার বক্ষেই তাকে চিরনিদ্রায় শয়ন করানো হয়েছে। তারপরও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বেঁচে আছেন ও থাকবেন সন্তানহারা মায়ের শিশির ভেজা চোখে, সাহসী পুরুষের সহিষ্ণু প্রতীক্ষায়, কিংবদন্তীর কথামালায়।
কবির জীবনপঞ্জি
জন্ম : ৮ ফেরুয়ারি ১৯৩৪ বরিশাল। পিতা : মরহুম বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান, সাবেক বিচারপতি, পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট, সাবেক স্পীকার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ।
মাতা : মরহুমা সালেহা খাতুন।শিক্ষা : ইংরেজিতে বিএ (অনার্স) ও এমএ, এসএম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রশাসন ও উন্নয়ন অর্থনীতিতে ডিপ্লোমা, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।সম্মাননা : ফেলো, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র,পোয়েট ইন রেসিডেন্ট, ইস্ট ওয়েট সেন্টার,হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র।পেশাগত জীবন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) এর সদস্য হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান। মহকুমা, জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন ও বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ।টেকনোক্রেট মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি মহাপরিচালক। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সেন্টার অফ এ্যাডভান্সড স্টাডিজ। পুরস্কার : বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক ও অন্যান্য নানা সংগঠনের পুরস্কার।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: সাতনরীরহার, কখনো রং কখনো সুর, কমলের চোখ, আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা, আমার সময়, আমার সকল কথা, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। অন্যান্য গ্রন্থ : ইয়েলো স্যান্ড ডিউন-চায়না থ্রু চায়নীজ আইজ। রুরাল ডেভলপমেন্ট: প্রবলেমস এ্যান্ড প্রসপেক্টাস, ক্রিয়েটিভ ডেভলপমেন্ট, ফুড এ্যান্ড ফেইথ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে অসংখ্য লেখা।

#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : rpnewsbd@gmail.com
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ