কৃষকের পানির অধিকার

প্রকাশিত: ৯:০৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২২

কৃষকের পানির অধিকার

ফজলে হোসেন বাদশা |

এবার ২২ মার্চ পানি দিবসের মূল বিষয় ছিল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে। পানি দিবসের দুদিন পর রাজশাহীতে দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। পরিবার বলেছে, সেচের পানি না পেয়ে তাঁরা আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি ঘটে স্বাধীনতার মাসে। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তির-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সাহস দেখিয়েছিল। এই বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন। তাঁরা স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন। পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করলেন দুজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দরিদ্র কৃষক।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ হাজার গভীর নলকূপ পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির সমস্য বেশি। অভিযোগ আছে, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিএমডিএ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কৃষক পানি না পেয়ে হতাশায় বেছে নিচ্ছেন স্বেচ্ছা মৃত্যু। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এটা আইনি প্রক্রিয়ায় চলতেই থাকবে। গোটা উত্তরাঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ফাঁদ ও দুর্বৃত্তায়ন দেখে মনে হয়েছে, বরেন্দ্র প্রকল্প ১৬টি জেলায় নতুন এক শোষকশ্রেণির জন্ম দিয়েছে। এরা অনেকটা একদিকে ভূমি সামন্ত, অন্যদিকে পানি সামন্তে পরিণত হয়েছে। এটা একটা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন পাম্পচালক এর আসামি হলেও প্রকৃতপক্ষে বিএমডিএর প্রতিটি স্তরের স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দুর্নীতি এর জন্য দায়ী। কার্যত বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ এখন আসামির কাঠগড়ায়।

খবর পাওয়া মাত্র আমি নিজে ঘটনাস্থল ও এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি পরিদর্শন করি। গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘুটু গ্রামে অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডির বাড়িতে যাই। তাঁদের স্বজনেরা অভিযোগ করেন, ১২ দিন ধরে পানির জন্য অনুরোধ করেও পানি না পেয়ে রাগে, অভিমানে ও ক্ষোভে যে জনগোষ্ঠী বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষির প্রাণ, সেই জনগোষ্ঠীর কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডিকে আত্মহত্যা করতে হলো।

এটা পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ওই দুটি আত্মহত্যা সামগ্রিক ঘটনার যে ভয়াবহতা ও অমানবিকতা তার একটি প্রকাশ মাত্র। বিএমডিএর অব্যবস্থাপনা এই অঞ্চলের সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনা ও কৃষিক্ষেত্রে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ভয়াবহ ভবিষ্যতের সতর্ক বার্তা। আমাদের সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বৈষম্যহীন আচরণের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়, পানি ব্যবস্থাপনার আইন ও নীতি এড়িয়ে একধরনের রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টি সামনে এসেছে। পাম্পচালকের রাজনৈতিক পরিচয় এর বাস্তবতা প্রমাণ করে।
পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানিনীতি ঘোষিত হয়েছে। ২০১৩ হয়েছে পানি আইন। আর ২০১৮ সালে এর বিধিমালাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে তাদের নিজস্ব মর্জি অনুসারে এক অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করেছে।

এই আইন অনুসারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদও যুক্ত থাকার কথা। পানি আইনের নীতি-নির্দেশনা অনুসারে পানিসম্পদের সমন্বিত ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এই সরকারের আমলে প্রণীত আইনও বাস্তব ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। সমন্বিত উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার পথ বেছে নেওয়া যেত, যা আমাদের সংবিধানে আছে। আজ আমাদের প্রশ্ন জাগে, প্রশাসন কার নির্দেশে, কোন পথে চলছে?

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ১৬ হাজার গভীর নলকূপ থাকার পরও দুই বিভাগেই পানির সমস্যা প্রকট। বলা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চল পানিসম্পদের অভাবে মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সারা দেশের তুলনায় এই অঞ্চলে ৪০ ভাগ বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বর্ষাকালেও এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচকাজ চালাতে হয়। প্রতিবছর ১ ফুট করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এক দশক আগেও তা ছিল ৬ ইঞ্চি। এখানে পানির স্তরের যে বৈশিষ্ট্য তাতে ১৬০ ফুট নিচেই কেবল পানি পাওয়া যায়। ফলে সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে।

বরেন্দ্র প্রকল্পের এই নেতিবাচক দিক নিয়ে বর্তমান সরকারের সময়েও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে জাতীয় সংসদে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের এই জেলাগুলোতে খাল-বিল, নদী-নালা এমনকি পুকুর, অগভীর নলকূপের ওপর যে প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। উত্তরাঞ্চলজুড়ে পদ্মা-যমুনা-তিস্তা-আত্রাই-মহানন্দা ইত্যাদি নদী প্রবহমান। আমরা সহজেই উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচকাজে ব্যবহারের পথ বেছে নিতে পারি। সংসদে আমরা উত্তর-পশ্চিম সেচ প্রকল্পের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব বারবার উপস্থাপন করেছি। সেই প্রস্তাব হয়তো ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে আছে।

দুই কৃষকের মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিল রাষ্ট্র সব মানুষের সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সংবিধান উপেক্ষিত হয়েছে। আজ বাস্তবতা—রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের প্রতিপত্তির ফলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর মুনাফালোভী ও স্বার্থবাদীদের হুমকির মুখে রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকের পানির ন্যায্য অধিকার।

সময় এসেছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে উত্তরাঞ্চলকে নদী-জলাশয়ের পানি এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীলতা নিশ্চিত করা। নিশ্চিত করতে হবে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকার। পানি ব্যবস্থাপনায় ছোট-বড় সব কৃষকের সমবায় সৃষ্টি করে সবার জন্য পানির অধিকারের ন্যায্যতা গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই এই দুই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ ও তাঁদের ঋণ পরিশোধ সম্ভব।

#
ফজলে হোসেন বাদশা এমপি
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি