সিলেট ১৮ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:১১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২২
বিশেষ প্রতিনিধি | রাজশাহী, ২৪ এপ্রিল ২০২২ : ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস আজ।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট রাজবন্দীদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে ঝরে যায় সাতটি বিপ্লবী প্রাণ। বন্দী অবস্থায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী সুধীন ধর, বিজন সেন, হানিফ শেখ, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, দেলোয়ার হোসেন, কম্পরাম সিং ও আনোয়ার হোসেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন বাড়তে থাকে, জেলে ভরা হয় কমিউনিস্টদের। অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে জেলের মধ্যেই আন্দোলন শুরু করেন কমিউনিস্ট বন্দীরা। সরকার বন্দীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলে কমিউনিস্ট বন্দীরা অনশন করতে থাকেন।
২৪ এপ্রিল, সোমবার আনুমানিক সকাল সোয়া ৯টায় রাজশাহী জেল সুপারিনটেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল দলবল নিয়ে হঠাৎ করেই খাপড়া ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। একপর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে এডওয়ার্ড বের হন ও দরজা বন্ধের নির্দেশ দেন। বিল বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। বিলের নির্দেশে সিপাহিরা বাঁশ দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে, জানালার ফাঁকের মধ্যে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড। ঘটনাস্থলেই পাঁচজন শহীদ হন। দুজন রাতে মারা যান।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ সাত কমিউনিস্ট বিপ্লবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান।
২৪ এপ্রিল ১৯৫০ রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে জেল পুলিশের গুলিতে নিহত শহিদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
কম্পরাম সিংহ
কম্পরাম সিংহ ছিলেন দিনাজপুরের সর্বজনপ্রিয় কৃষকনেতা। তিনি নিজেও ছিলেন কৃষকের সন্তান। দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়াডাঙ্গী গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে দিনাজপুরে যেসব কৃষক আন্দোলন হয়েছে, তার পুরোভাগে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তোলাবাটি আন্দোলন, আধিয়ার আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন এবং বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
যুবক বয়সে ১৯২১-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলন থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৩০-৩২ সালের আন্দোলনে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৪৬-৪৭ সালের বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ওই আন্দোলনের সময় কর্তৃপক্ষ তাঁর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে এবং চিরিরবন্দরে কৃষক-জনতার ওপর পুলিশ যে গুলি চালায়, তাতে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র শহিদ হন।
পাকিস্তান হওয়ার পর কৃষক আন্দোলন করার অপরাধে ১৯৪৮ সালে তিনি আবার বন্দী হন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে তিনি শহিদ হন।
সুধীন ধর
বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের এই বিপ্লবী ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন এবং একটানা দীর্ঘদিন কারাগারে কাটান। তাঁর রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র প্রধান ছিলো কলকাতা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর স্বেচ্ছায় রেলশ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানেব চলে আসেন। এরপর পূর্ব বাংলার রেল শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তখন থেকে সৈয়দপুর ছিলো সুধীন ধরের প্রধান কর্মস্থল। তাঁকে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁকে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়। কারাদ-ের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তাঁকে রাজবন্দী হিসেবে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়।
১৯৪৯ সালের শেষ দিকে তাঁকে রাজশাহী কারাগারে আনা হয়। আর পরের বছর ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকা-ে তিনি শহিদ হন।
বিজয় সেন
তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী একজন বিপ্লবী। তাঁর বাড়ি রাজশাহী জেলায়। কিশোর বয়সে অস্ত্র আইনে তাঁর কারাদ- হয় এবং সন্ত্রসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেয়। আন্দামানের বন্দিশিবিরেই তিনি স্যাবাদী মতবাদ গ্রহণ করেন।
১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই উত্তরবঙ্গ কর্মচারী সমিতি গঠিত হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে তিনি পূর্ব বাংলার রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত কার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫০ সালে খাপড়া ওয়ার্ডে শহিদ হন।
হানিফ শেখ
হানিফ শেখ কুষ্টিয়া জেলার আড়–য়াপাড়া গ্রামের এক গরিব শ্রমিক পরিবারে সন্তান। তাঁর বাবা মোহিনী মিলে কাজ করতেন। ১০-১২ বছর বয়স থেকেই হানিফ মোহিনী মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি ১৯৩৭ সাল থেকেই ছিলেন মোহিনী মিল শ্রমিক ইউনিয়নের একজন কর্মী। দুবার তিনি শ্রমিক মিল ধর্মঘটে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তিনি কলকাতার কাছে পদ্মা মিলে চাকরি নেন। কিন্তু ইউনিয়ন করার অপরাধে সেখান থেকেও তিনি বিতাড়িত হন। এরপর তিনি আবার ঈশ্বরদীতে এসে কাপড় ছাপার কারখানায় যোগদেন। ঈশ্বরদীতে রেলওয়ে ওর্য়াকার্স ইউনিয়নের সংগঠন হিসেবে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশ রাজবন্দীদের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালালো তিনি শহিদ হন।
সুখেন্দু ভট্টাচার্য
সুখেন্দু ভট্টাচার্য ময়মসিংহ শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্কুলে তিনি নিয়মিতভাবে দেয়াল পত্রিকা বের করতেন। কলেজে প্রবেশ করে বিভিন্ন বিষয়ে বির্তক সভা ও সাহিত্য আলোচনার জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজজীবনে তিনি ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের বিশিষ্ট একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে তাঁদের পাড়ার লাইব্রেরি ও ক্লাবটি শহরে জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন।
১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। সে সময় তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের স্নাতক পরীক্ষার্থী। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশে গুলি চালালে তিনি শহিদ হন।
দিলওয়ার হোসেন
দিলওয়ার হোসেন কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার দামুকদিয়া গ্রামের এক গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান। ১৯-২০ বছর বয়সে তিনি রেলশ্রমিক হিসেবে ঈশ্বরদীতে রেলের ইঞ্জিন পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন। এ কাজ করার সময়ই তিনি লাল ঝান্ডা ইউনিয়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় এবং তিনি পার্টিতে যোগদান করেন।
১৯৪৯ সালে দিলওয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের ঠিক আগেই দিলওয়ারের বিয়ে হয়েছিল। খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে তিনি শহিদ হন।
আনোয়ার হোসেন
খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার বুধহাটা গ্রামের দরিদ্র এক পরিবারে আনোয়ার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। মা ছাড়া সংসারে আপন বলতে তাঁর আর কেউ ছিলেন না। আনোয়ার হোসেন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি পান। স্কুলজীবনেই আনোয়ার হোসেন প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। তিনি যে স্কুলে অধ্যয়ন করতেন সে স্কুলে ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠন ছিলো। তিনি ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং ছাত্র সংগঠনের অন্যতম নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
১৯৫০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তিনি দৌলতপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে রাজশাহী করাগারে নিয়ে আসা হয়। ওই বছরের ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে তিনি শহিদ হন।
খাপড়া ওয়ার্ড আহতদের তালিকা:
১. সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ (বর্ধমান), ২. আবদুশ শহীদ (বরিশাল), ৩. আশু ভরদ্বাজ (ফরিদপুর), ৪. সত্যেন সরকার (সিলেট), ৫. নুরুন্নবী চৌধুরী (বর্ধমান), ৬. প্রিয়ব্রত দাস (সুনামগঞ্জ), ৭. অনন্ত দেব (সিলেট), ৮. ডা. গণেন্দ্রনাথ সরকার (দিনাজপুর), ৯. নাসির উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা), ১০. আব্দুল হক (যশোর), ১১. আমিনুল ইসলাম বাদশা (পাবনা), ১২. শচীন্দ্র চক্রবর্তী (দিনাজপুর), ১৩. সাইমন ম-ল (পশ্চিম বাংলা), ১৪. কালীপদ সরকার (দিনাজপুর), ১৫. অনিমেষ ভট্টাচার্য (মৌলভীবাজার), ১৬. বাবর আলী (সিরাজগঞ্জ), ১৭. প্রসাদ রায় (পাবনা), ১৮. গারিসউল্লাহ সরকার (কুষ্টিয়া), ১৯. ভূজেন পালিত (ঠাকুরগাঁও), ২০. ফটীক রায় (বগুড়া), ২১. সীতাংশু মৈত্র (রাজশাহী), ২২. সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার (বরিশাল), ২৩. ডোমারাম সিংহ (দিনাজপুর), ২৪. সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য (বগুড়া), ২৫. লালু পা-ে (নওগাঁ), ২৬. মাধব দত্ত (জলপাইগুড়ি), ২৭. খবীর শেখ (দিনাজপুর), ২৮. আভরণ সিংহ (ঠাকুরগাঁও), ২৯. সুধীর সান্যাল (কুষ্টিয়া), ৩০. শ্যামাপদ সেন (সিলেট), ৩১. পরিতোষ দাশগুপ্ত (খুলনা), ৩২. হীরেন সেন (যশোর)।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D