”ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটি সৃষ্টির নেপথ্যের ইতিহাস

প্রকাশিত: ৫:২২ পূর্বাহ্ণ, মে ৩, ২০২২

”ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটি সৃষ্টির নেপথ্যের ইতিহাস

Manual5 Ad Code

তাসবির ইকবাল | ঢাকা, ০৩ মে ২০২২ : একদিন শ্যামা সংগীতের রেকর্ডিং শেষে নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছেন। পথে সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা। তিনি নজরুলকে সম্মান ও সমীহ করতেন। নজরুলকে ‘কাজীদা’ বলে ডাকেন। সেদিন তিনি নজরুলকে বললেন, ‘কাজীদা, একটি কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। দেখুন না, পিয়ার কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’ বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিল শ্যামা সংগীতের। শ্যামা সংগীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দু নাম ধারণ করেন। মুন্সী মুহম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপনকুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সংগীত গাইলে গান চলবে না। কিন্তু নজরুল ইসলাম স্রোতে গা ভাসাননি বলে আব্বাস উদ্দীনের প্রস্তাবটি তার ভালোই লাগলো। তবে তিনি বললেন, ‘আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারিনা।’ ভগবতী ভট্টাচার্য ছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ। ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে আব্বাস উদ্দীন অনুরোধ করলেন নজরুলের গানের কথার। কিন্তু ভগবতী বাবু ঝুঁকি নিতে রাজী নন। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। তাই আব্বাস উদ্দীন আহমদ যতোই তাকে অনুরোধ করছেন, ততোই তিনি বেঁকে বসছেন। ওদিকে আব্বাস উদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এতো বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না। অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয়মাস চললো অনুরোধ প্রয়াস। এ যেন পাথরে ফুল ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা! তারপর একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাস উদ্দীন আহমদ বললেন, ‘একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?’ ভগবতী বাবু আর কতো ‘না’ বলবেন।

Manual1 Ad Code

এবার হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।’ খুশিতে আব্বাস উদ্দীনের চোখে পানি আসার উপক্রম। যাক, সবাই রাজী। এবার একটা গান নিয়ে আসতে হবে। কবি নজরুল চা আর পান খেতে পছন্দ করতেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাস উদ্দীন কাজী নজরুলের কাছে গেলেন। নজরুলকে ভগবতীবাবুর সম্মতির কথা জানালেন। একথা শুনে নজরুল পান মুখে খাতা কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাস উদ্দীন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মত সময় যেন থমকে আছে। সময় কাটানোর জন্য ভীষণ অস্থির আব্বাস উদ্দীন পায়চারী করতে লাগলেন। প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেলো। বন্ধ দরজা খুলে কবি নজরুল বের হলেন। পানের পিক ফেলে আব্বাস উদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন। এই কাগজ তার আধ ঘন্টার সাধনা। আব্বাস উদ্দীন আহমদের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল। আব্বাস উদ্দীন কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’ আব্বাস উদ্দীন পড়ছেন, চোখ পানিতে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেলো। আব্বাসউদ্দীন জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তার মুখস্তও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কিনা এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি শঙ্কায় আছে। তবে নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কিভাবে সুর দিতে হবে দেখিয়ে দিলেন। হারমোনিয়ামের উপর আব্বাস উদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন নজরুল নিজেই। সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে রিলিজ হলো— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ ঈদের সময় এই গানের এ্যালবাম বাজারে আসবে। আপাতত সবাই ঈদের ছুটিতে।

Manual6 Ad Code

রমজানের রোজার পর ঈদ এলো। আব্বাস উদ্দীন বাড়িতে ঈদ কাটালেন। কখন কলকাতায় যাবেন এই চিন্তায় তাঁর তর সইছে না। গানের কী অবস্থা তিনি জানেন না। তাড়াতাড়ি ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। ঈদের ছুটির পর প্রথমবারের মত অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যতো এগুচ্ছেন, বুকটা ততো ধ্বক ধ্বক ধ্বক ধ্বক করছে। অফিসে গিয়ে কী দেখবেন? গানটা ফ্লপ হয়েছে? গানটা যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর জীবনেও ইসলামি গানের কথা ভগবতী বাবুকে বলতে পারবেন না। ভগবতী বাবু কেন, কোনো গ্রামোফোন কোম্পানি আর রিস্ক নিতে রাজি হবে না। সুযোগ একবারই আসে। আব্বাস উদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলো— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ এই যুবক গানটি কোথায় শুনলো? নাকি আব্বাস উদ্দীন আহমদ ভুল শুনছেন না তো ? তিনি আবারো শুনলেন যুবকটি ওই গানই গাচ্ছে।

Manual4 Ad Code

এবার তার মনের মধ্যে এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো। অফিস ফিরে বিকেলে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে এবার দ্বিগুণ অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে। তারমধ্য থেকে একটা ছেলে গেয়ে উঠলো— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…আব্বাস উদ্দীন এতো আনন্দ একা সইতে পারলেন না। তাঁর সুখব্যথা হচ্ছে। ছুটে চললেন নজরুলের কাছে। গিয়ে দেখলেন নজরুল দাবা খেলছেন। তিনি দাবা খেলা শুরু করলে দুনিয়া ভুলে যান। আশেপাশে কী হচ্ছে তার কোনো খেয়াল থাকে না। অথচ আজ আব্বাস উদ্দীনের গলার স্বর শুনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল বললেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে! তরুণ, বৃদ্ধ, যুবা- সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘এলো খুশির ঈদ’ গানটি।’ কাজী নজরুল তখন ইসলামি গানের রেকর্ড নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলেন। তাঁর অন্যান্য গানের মতো ইসলামি গানও সাফল্যের বৈতরণি পার হওয়ায় তাঁর চোখেমুখে সে কী আনন্দ! ওদিকে ভগবতী বাবুও খুশি। প্রকাশনার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়ে গেছে। যে ভগবতী বাবু ইসলামি গানের রেকর্ডের কথা শুনতেই চোখ-মুখ পাকিয়ে না করে দিয়েছিলেন, এবার তিনিই অনুরোধ করছেন এরকম আরো কয়েকটি ইসলামি গান রচনার জন্য! শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ। বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড। শুরু হল ইসলামি সংগীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে সব ধর্মের মানুষকে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ