সিলেট ১৩ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ, মে ৯, ২০২২
জয়ন্ত ভট্টাচার্য | মুম্বাই (ভারত), ০৯ মে ২০২২ : পাঠ্যপুস্তকের দৌলতে আদি মধ্যযুগের ভারতের গ্রন্থাগার সম্পর্কে কথা উঠলেই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় নালন্দা মহাবিহারের ছবি। আরও অতীতের তক্ষশিলার কল্পনা হয়তো অনেককে উদ্বোধিত করে। কিন্তু অন্ত মধ্যযুগের ভারতের গ্রন্থাগারের কথা উল্লেখ করলে আমাদের স্মৃতিপটের কোনও কোণেই কোনও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া অন্ত মধ্যযুগের ভারতের এমনই এক গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারের নির্মাতার উপর আলোকপাতের উদ্দেশে এই নিবন্ধের উপস্থাপনা।
কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতী সপ্তদশ শতকে মোগল বাদশাহ শাহ জাহানের আমলের বারাণসীর এক সমৃদ্ধ বিদ্বান সন্ন্যাসী। তাঁর জীবন সম্পর্কে জানার জন্য দুটি প্রধান উত্স – শ্রীকৃষ্ণ উপাধ্যায় কৃত ৬৯ জন সমসাময়িক বিদ্বানের তাঁর প্রতি প্রশস্তিমূলক সংস্কৃত রচনার সংকলন ‘কবীন্দ্রচন্দ্রোদয়’ এবং তাঁর নিজের লেখা সংস্কৃত কাব্য ‘কবীন্দ্রকল্পদ্রুম’। এ ছাড়া ৩৩ জন সমসাময়িক বিদ্বানের ব্রজভাষায় লেখা তাঁর প্রতি প্রশস্তিমূলক রচনার সংকলন ‘কবীন্দ্রচন্দ্রিকা’ এবং তাঁর ব্রজভাষায় রচিত কাব্য ‘কবীন্দ্রকল্পলতা’ থেকেও তাঁর জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়।
কবীন্দ্রাচার্যের জন্ম গোদাবরী নদীর তীরে পুণ্যভূমি (বা পণ্যভূমি, সম্ভবত নাশিক) শহরে ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন শাখার অনুসারী এক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে। স্বল্প বয়সে সন্ন্যাস নেওয়ার পর তিনি বারাণসী চলে আসেন। কবীন্দ্রাচার্য বারাণসীর তৎকালীন সংস্কৃত বিদ্বানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে পরিগণিত। তাঁর রচিত সংস্কৃত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখনীয় ‘জগদ্বিজয়ছন্দস’ কাব্য, ‘পদচন্দ্রিকা’ নামের দণ্ডীর দশকুমারচরিতের টীকা, ‘যোগভাস্কর’, শতপথব্রাহ্মণের একটি ভাষ্য এবং ‘মীমাংসাসর্বস্ব’। শেষ তিনটি গ্রন্থের সম্পর্কে অবশ্য এখনও পর্যন্ত কিছুই জানা যায়নি। তিনি ব্রজভাষায় ‘যোগবাশিষ্ঠসার’ (বা ‘জ্ঞানসার’) নামে যোগবাশিষ্ঠের একটি সংক্ষিপ্তসারও রচনা করেছিলেন।
সমসাময়িক বিদ্বানদের মধ্যে কবীন্দ্রাচার্যের প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ মোগল সম্রাট শাহ জাহানের সঙ্গে তাঁর এক সাক্ষাৎকার। কবীন্দ্রাচার্য বারাণসী ও প্রয়াগে তীর্থকর রদ করানোর জন্য তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে আগ্রার মোগল দরবারে উপস্থিত হন। সেখানে ‘দিওয়ান-ই-আম’-এ তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণে শাহ জাহান ও দারা শিকোহ অভিভূত হন, এবং তীর্থকর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরপর শাহ জাহান তাঁকে ‘সর্ববিদ্যানিধান’ উপাধি প্রদান করেন ও বাৎসরিক ২ হাজার রূপয়া পারিতোষিক প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মুহাম্মদ ওয়ারিস, তাঁর ‘পাদশাহনামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শাহ জাহান, তাঁর রাজত্বকালের ২৪তম বর্ষে, তাঁর ৬১তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবীন্দ্র সন্ন্যাসী অর্থাৎ কবীন্দ্রাচার্যকে তাঁর ধ্রুপদ সঙ্গীত ও হিন্দি কাব্য রচনায় পারদর্শিতার জন্য তাঁকে একটি অশ্ব, একটি সাম্মানিক বস্ত্র ও এই পারিতোষিক প্রদান করেন। শাহ জাহান ও দারা শিকোহকে প্রশংসা করে কবীন্দ্রাচার্যের ব্রজভাষায় লেখা কবিতামালা তাঁর ‘কবীন্দ্রকল্পলতা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
কবীন্দ্রাচার্য কাশীতে বরুণা নদীর তীরে বেদান্তী বাগ এলাকায় অবস্থিত তাঁর বাসগৃহে সংস্কৃত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার নির্মাণ করেন। এই গ্রন্থাগারে সংগৃহীত প্রতিটি গ্রন্থের প্রতিলিপি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লিপিবদ্ধ ও প্রায় ত্রুটিহীন। তিনি তাঁর গ্রন্থাগারের জন্য অনুলিপি প্রস্তুত করার কাজে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী অনুলিপিকরদের নিযুক্ত করেছিলেন। এমনই এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী অনুলিপিকর আল্লাবখশ ‘বামনসূত্রবৃত্তি’ গ্রন্থের একটি প্রতিলিপি প্রস্তুত করেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থাগারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলির প্রথম পৃষ্ঠায় বলিষ্ঠ অক্ষরে দেবনাগরী লিপিতে লেখা থাকত ‘শ্রী সর্ববিদ্যানিধান কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতীনাং পুস্তকম’।
ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার ১৬৬৭ সালে লেখা তাঁর একটি পত্রে বারাণসীতে কবীন্দ্রাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছেন। আওরঙ্গজেব ক্ষমতাসীন হবার পর কবীন্দ্রাচার্যের পারিতোষিক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কবীন্দ্রাচার্য এই পারিতোষিক আবার চালু করার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছে সুপারিশ করার অনুরোধ নিয়ে ভারতে বার্নিয়ারের আশ্রয়দাতা দানিশমন্দ খানের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। দানিশমন্দ খান আওরঙ্গজেবের দরবারে বিভিন্ন সময়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। বার্নিয়ার কবীন্দ্রাচার্যের আমন্ত্রণে তাঁর গ্রন্থাগারে গিয়ে বারাণসীর ৬ জন বিদ্বানের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি এই গ্রন্থাগারে বেদের পাণ্ডুলিপি দেখতে পান। বার্নিয়ার তাঁর ভ্রমণকথায় সংস্কৃতে রচিত চিকিত্সাশাস্ত্র, দর্শন ও অন্য অনেক বিষয়ের গ্রন্থে সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ একটি বড় কক্ষের উল্লেখ করেছেন।
বিশ শতকের গোড়ায় বারাণসীর একটি মঠ থেকে মারাঠি ভাষায় লেখা কবীন্দ্রাচার্যের গ্রন্থাগারে সংগৃহীত গ্রন্থসমূহের একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকাটি ১৯২১ সালে বরোদা থেকে ‘কবীন্দ্রাচার্য সূচীপত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। এই তালিকায় কবীন্দ্রাচার্যের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ২১৯২টি গ্রন্থের পুথির নামের উল্লেখ রয়েছে। কবীন্দ্রাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, উনিশ শতকে তাঁর সংগ্রহের বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি স্থান পায় বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলির রাজকীয় গ্রন্থাগারে। কবীন্দ্রাচার্যের বাসগৃহ ও গ্রন্থাগারের বর্তমান অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য কোনও প্রয়াস হয়েছে কিনা জানা নেই।
অন্ত মধ্যযুগে কবীন্দ্রাচার্যের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার নির্মাণ ও গ্রন্থসূচি রচনার পরিকল্পনার সঙ্গে আধুনিক গ্রন্থাগার ভাবনার মিল তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য আজও আগ্রহ জাগায়।
তথ্যসুত্র:
১. Allison Busch, “Hidden in Plain View: Brajbhasha Poets at the Mughal Court” in Modern Asian Studies, Volume 44, Issue 02, March 2010, pp 289-309.
২. Archibald Constable tr., Travels in the Mogul Empire A.D. 1656-1668 by Francois Bernier. Westminster: Archibald Constable and Company, 1891, pp. 335-336.
৩. Audrey Truschke, Culture of Encounters: Sanskrit at the Mughal Court. Gurgaon: Penguin Random House, 2017.
৪. বলদেব উপাধ্যায়, কাশী কী পাণ্ডিত্য পরম্পরা. বারাণসী: বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশন, ১৯৮৩, পৃ. ৭৭-৮৫.
৫. Bimal Kumar Datta, Libraries and Librarianship of Ancient and Medieval India. Delhi: Atma Ram & Sons, 1970, pp. 86-87.
৬. Har Dutt Sharma and M.M. Patkar ed. Kavīndracandrodaya. Poona: Oriental Book Agency, 1939.
৭. লক্ষ্মীকুমারী চুণ্ডাবত সম্পা., শ্রীমদ কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতী সর্ববিদ্যানিধান বিরচিত কবীন্দ্রকল্পলতা. জয়পুর: সঞ্চালক, রাজস্থান পুরাতত্ত্বান্বেষণ মন্দির, ১৯৫৮, পৃ. ১-৭.
৮. P.K. Gode, “Some evidence about the location of the MSS Library of Kavindracharya Sarasvati in Benares” in C. Kunhan Raja ed. Jagadvijayacchandas of Kavindracharya. Bikaner: Anup Sanskrit Library, 1945, pp. xlvii-lvii.
৯. P.K. Gode, “Bernier and Kavīndrācārya Sarasvatī at the Mughal Court” in Studies in Indian Literary History, Vol. II. Bombay: Singhi Jain Śāstra Śikshāpīth, Bhāratīya Vidyā Bhavan, 1954, pp. 364-379.
১০. R. Ananta Krishna Sastrty, Kavindracharya List, Baroda: Central library, 1921.
১১. V. Raghavan, “Kavīndrācārya Sarasvatī” in B.C. Law ed. D.R. Bhandarkar Volume. Calcutta: Indian Research Institute, 1940, pp. 159-166.
১১. V. Raghavan, “The Kavīndrākalpalatika of Kavīndrācārya Sarasvatī” in Indica: The Indian Historical Research Institute Silver Jubilee Commemoration Volume. Bombay: St. Xavier’s College, 1953. pp. 335-341.
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D