রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস ভাবনা : সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, মে ৯, ২০২২

রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস ভাবনা : সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ

দীপরাজ দাশগুপ্ত | কলকাতা (ভারত), ০৯ মে ২০২২ : রবীন্দ্র গবেষক ও সুলেখক অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী একবার বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখায় মহাকবির হাতের রচনা। তাঁর প্রত্যেকটি লেখা নতুন করে ভাবতে শেখায়।”
কবিগুরু তাঁর বিপুল রচনার মাধ্যমে আমাদের ভাব জগতের নানা দ্বার উন্মোচন করে রেখে গেছেন। প্রয়োজন ও অভিরুচি অনুসারে আমরা সেই অসামান্য ভাণ্ডার থেকে মণিরত্ন আহরন করতে পারি। উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, গান, নাটকের পাশাপাশি রবীন্দ্র প্রতিভার অসামান্য স্বাক্ষর কবিগুরুর রচিত বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধাবলী।

শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, সমাজ ভাবনা, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের উপর রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ তিনি ইতিহাস বিষয়ে রচনা করেছেন। মানবীয় প্রজ্ঞা ও জ্ঞান চর্চার একটি প্রাচীন উপকরণ ‘ইতিহাস’___অতীতচর্চা। সেই অতীতচর্চার ধরণ ও পদ্ধতি নিয়ে হেরোডোটাস থেকে শুরু করে হালের উত্তর আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকরা তাদের অধীত জ্ঞান সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছেন। এর সাথে ইতিহাসের নতুন-নতুন আবরণ উন্মোচিত হয়ে চলেছে। এ যেন এক নিরন্তর প্রক্রিয়া।

আঠারোটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইতিহাস চিন্তাকে ব্যক্ত করেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা, শিবাজী ও মারাঠা জাতি, শিবাজী ও গুরু গোবিন্দ সিংহ, ভারত ইতিহাস চর্চা, কাজের লোক কে, বীরগুরু, শিখ স্বাধীনতা, ঝাঁন্সির রাণী, ঐতিহাসিক চিত্র, ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ইতিহাসকথা প্রভৃতি।
এই ইতিহাসমূলক প্রবন্ধগুলো এক অসামান্য কবির মানষলোকে ইতিহাসের স্থান কোথায় তার উদাহরণ। এক কবির চিন্তায় ও দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্যা কেমন হতে পারে তাঁর প্রকৃষ্টতম নিদর্শন রবীন্দ্র রচিত ইতিহাস বিষয়ক কতিপয় প্রবন্ধাবলী।

বিশেষ করে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ ও ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ এই প্রবন্ধ দুটি আমাদের ইতিহাস ভাবনার জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম। খ্যাতিমান ঐতিহাসিক অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর – “রবীন্দ্রনাথ ও ইতিহাস চিন্তা” শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্র প্রতিভার এই বিশেষ দিক দিয়ে আলোচনা করেছেন। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস বিষয়ক ভাবনাকে তাঁর বহুমুখী ও বহুদর্শী প্রতিভার অবিস্মরণীয় বিকাশ হিসেবে দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের জ্ঞান সাধনা ও ইতিহাস দৃষ্টির স্বাক্ষর ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন …… “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর-একদল উঠিয়া পড়ে পাঠান-মোঘল পর্তুগিজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে জটিল করিয়া তুলিয়াছে।
কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায়, এ-সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না। যেন ভারতবাসী নাই, কেবল যাহারা কাটাকাটি খুনোখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে।” …

রবীন্দ্রনাথ রাজবৃত্তের ইতিবৃত্তকে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলে মনে করেননি। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের অপূর্ণতা নির্দেশ করে কবি ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস রুপে এই ভূখণ্ডের গণ মানুষের ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষ জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের ইতিহাস যতদিন না রচিত হবে, ততদিন পর্যন্ত এই জাতির উন্নতির আশা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নির্বাচিত ইতিহাস পড়ানো হয়, তা জাতির মেধা ও মননশীলতার পথে প্রতিবন্ধক স্বরূপ বলে কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।

‘শিবাজী ও মারাঠা জাতি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর মধ্যে ভারতীয় জাতীয় বিকাশের স্বরূপ লক্ষ্য করেছেন। গুরু গোবিন্দ সিংহকে ত্যাগ ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক রুপে বর্ণনা করেছেন। ‘কাজের লোক কে’ প্রবন্ধে গুরু নানকের অসামান্য জীবনাদর্শকে উদ্ধৃত করেছেন। বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ‘সিরাজদৌল্লা’ গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি তৎকালীন সময়ের বাস্তবতার উপর নিজের মতামত দিয়েছেন।

ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধগুলো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কখনো গ্রন্থ সমালোচনা রুপে, কখনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকা রুপে। কখনো বন্ধু ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র অনুরোধে। এছাড়া কবির বহু কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্পে ও ভ্রমণকাহিনীতে ইতিহাসের সুগভীর স্পর্শ পাওয়া যায়। বৌঠাকুরানীর হাট, রাজর্ষি, বিসর্জন, পারস্যের যাত্রী, জাভাযাত্রীর পত্র, কালান্তর, প্রাচীন সাহিত্যের ছত্রে-ছত্রে ইতিহাসের নির্যাস ছড়িয়ে রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস রচনার কথায় উৎসাহী হয়ে রবীন্দ্রভক্ত ঐতিহাসিক লিখলেন “বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব” এবং “ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসার” মতো অসামান্য ইতিহাস গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তা অনেকাংশে পূর্ণতা লাভ করেছিল নীহাররঞ্জনের ইতিহাস গবেষণার মাধ্যমে। এক মহাকবি এক মহান ঐতিহাসিকের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে গেছেন একান্ত নিভৃতে। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, দর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের ক্ষেত্রেও যুগপ্রবর্তন করেছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন রাবীন্দ্রিক ইতিহাস ভাবনাকে। এক কবির মাঝে এক ইতিহাসবেত্তার সত্ত্বা লুকিয়েছিল, তা যারা অনুধাবন করবেন তারা ভারত ইতিহাস চর্চার ধারায় ‘রাবীন্দ্রিক’ অনুষঙ্গকে বুঝতে সক্ষম হবেন।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকার, সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন রাবীন্দ্রিক ইতিহাস চিন্তা ও চেতনাকে। স্যার যদুনাথ তাঁর “রবীন্দ্রনাথের চোখে ভারতের প্রাচীন অতীত” প্রবন্ধে এ বিষয়ক আলোচনা করেছেন। আজ আমরা বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইতিহাস – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ পাঠ করে তা পরোক্ষভাবে হলেও অনেকাংশে অনুধাবন করতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিময় ধ্যানগম্ভীর ভাবপ্রজ্ঞা দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাসকে কখনো প্রাচীনত্বের পটভূমিকায়, কখনো মধ্যকালীন পরিপ্রেক্ষিতে, কখনোবা আধুনিককালের আবর্তে ইতিহাসের বিবর্তনকে অবলোকন করেছেন। আজ আমরা তাঁকে আবার নতুন করে বুঝতে চেষ্টা করছি মাত্র। একদিন হয়তো ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী, নিম্নবর্গীয় ধারার পাশাপাশি নতুন করে রাবীন্দ্রিক ধারাকে মাধ্যম রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে পাবো। যে ধারার সঙ্গমে ঘটবে সমস্ত কিছুর সমন্বয়।

□ এই ক্ষুদ্র লেখা রবীন্দ্র ইতিহাস চিন্তাকে ব্যাখার জন্য উপযুক্ত নয়। এটা সেই চর্চার ভূমিকাংশ মাত্র। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস ভাবনাকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধের আকারে লিখবো। আপাতত আজ এটুকুই আমার কবি প্রণাম হয়ে রইলো।

তথ্যসূত্র:
* ইতিহাস
* জাভাযাত্রীর পত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
* ভারতীয় ঐতিহ্য ও রবীন্দ্রনাথ
* ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা : নীহাররঞ্জন রায়,
* রবীন্দ্র সঙ্গমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ : সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,
* রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস ভাবনা : সত্যেন্দ্রনাথ রায়।

ছবি: শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা। বর্তমানে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সংরক্ষিত।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ