সিলেট ২২শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৩৯ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২২
সুচেতনা মুখোপাধ্যায় | কলকাতা (ভারত), ১২ মে ২০২২ : ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা চিত্রসংবাদিক ও ক্যামেরা কথক হোমাই ব্যায়ারাওয়ালা।
হোমাইয়ের নিম্নবিত্ত বাবা দোসাভাই নিজে বেশিদূর পড়েননি বটে, কিন্তু লেখাপড়ায় তাঁর ভারী আগ্রহ ছিল। তিনি ছিলেন একটি ভ্রাম্যমাণ উর্দু নাটক দলের সদস্য। সে যুগে থিয়েটার ও থিয়েটারজীবিদের সমাজে মোটেই সম্মানের চোখে দেখা হতো না। তাই তাঁর স্ত্রী সুনাবাঈকে তিন সন্তান সহ বোম্বাই শহরে পাঠিয়ে দিলেন দোসা। সুনাবাঈ বাচ্চাদের ভর্তি করে দিলেন নামকরা ইংরেজি স্কুলে।
কিন্তু শুধু ইংরেজি শেখাই যথেষ্ট ছিলনা বড় মেয়ে হোমাইয়ের ক্ষেত্রে। একটু বড় হতেই পার্সি ধর্মের রীতিনীতিগুলি শেখানো শুরু করলেন মা ও পরিবারের অন্যরা। তাকে স্কুলে পাঠানো হোত পারম্পরিক পার্সি পোশাকে সর্বাঙ্গ মুড়ে। ঋতুমতী হওয়ার পর তাকে মানতে বাধ্য করা হোত নানা অস্বাস্থ্যকর ও অযৌক্তিক কুসংস্কার। কিন্তু বালিকা হোমাই ছিল তীব্র স্বাধীনচেতা, তাই মা চোখের আড়াল হলেই সে অমান্য করত তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শেকলগুলোকে।
তথাকথিত প্রগতিশীল হোমাইদের পার্সি সমাজে মেয়েদের বিদ্যার্জনের ধারণা সহজ ছিলনা ১৯২০র দশকেও। কিন্তু হোমাই যে একদম আলাদা। তাই পার্সি প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের ভ্রুকুটি আর তুমুল অর্থকষ্ট উপেক্ষা করতে পড়াশুনায় মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল কিশোরী মেয়ে। তার স্কুলের ৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে একা সে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা। এরপর পারিবারিক তরফে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু হোল। কিন্তু স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে অবিচল হোমাই সেসব চাপ অগ্রাহ্য করে, অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর পাঠের জন্য ভর্তি হল বোম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে।
স্কুলেই ১৯২৬ নাগাদ তার বন্ধুত্ব হয়েছিল মানেকশ ব্যায়ারাওয়ালা নামের এক লাজুক কিশোর সহপাঠীর সঙ্গে। মানেকশ’র ছিল ছবি তোলার শখ। বন্ধুর মাধ্যমে এসময় পৃথিবী বিখ্যাত কিছু পত্রিকার পুরনো কয়েকটি কপি হাতে পায় হোমাই। পত্রিকার পাতায় পাতায় মুদ্রিত নানা ধরনের ফটোগ্রাফ তাকে গভীরভাবে আকর্ষিত করতে শুরু করে। ছবির দুনিয়া সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান আগ্রহে হোমাই মানেকশর পরামর্শে ফটোগ্রাফি প্রকৌশল সম্পর্কে আরো জানতে বোম্বাইয়ের জে জে স্কুল অফ আর্টস-এ ডিপ্লোমা কোর্স করে।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মানেকশ টাইমস অফ ইন্ডিয়া নামক বিখ্যাত সংবাদপত্রের দপ্তরে হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি আরো বিকশিত হতে থাকে তার ছবি তোলার পুরনো নেশাটিও। বন্ধু হোমাইকে সঙ্গে নিয়ে মানেকশ বোম্বাই শহরের পথে পথে দৈনন্দিন জীবনের নানা ছবি তুলে বেড়াতেন। এসময় তাদের কাঁধে থাকত একটি ভারী রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। তাদের তোলা ছবিগুলি সেসময়ের নানান নামীদামী পত্রিকায় প্রকাশিত হোত। নিজস্ব স্টুডিও ছিলনা, আর বাড়িতেও ছিল যথেষ্ট জায়গার অভাব। তাই দুইবন্ধু মানেকশ’র বাড়ির অন্ধকার বাথরুমেই ছবির নেগেটিভ প্রস্ফুটনের কাজটি করতেন।
এবার হোমাইয়েরও ইচ্ছে হলো নিজের তোলা ছবিগুলি পত্রিকা দপ্তরে পাঠানোর। কিন্তু ১৯৩০-এও বহির্জগতের বাকি সব ক্ষেত্রের মতোই পেশাদারী ফটোগ্রাফির দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ ছিল। মহিলা হওয়ার কারণে যাতে তাঁর তোলা ছবি বাতিল না হয়ে যায় সেই দ্বিধায় তাঁরা ইলাস্ট্রেটেড উইক অফ ইন্ডিয়ার মত নামকরা পত্রিকাগুলির জন্য পাঠানো হোমাইয়ের ছবিগুলিতে চিত্রগ্রাহকের নামের পাশে লিখতেন মানেকশর নামের আদ্যক্ষর জে. এম. ভি। বম্বে ক্রনিক্যাল পত্রিকা প্রথম হোমাইয়ের স্বপরিচয়ে তোলা দুর্দান্ত কিছু ছবি প্রকাশ করেছিল। তবে এর পরেও যথারীতি তাঁকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অথবা বিনোদন সংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠানের ছবি তোলার দায়িত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু সেই ছবিগুলিতেও নিজস্ব প্রতিভার ম্যাজিকে হোমাই এনেছিলেন এক অপূর্ব অভিনবত্ব।
১৯৪২ সালে বিয়ে করলেন হোমাই ও মানেকশ। এর পর বোম্বাই ছেড়ে পাকাপাকিভাবে তাঁরা দিল্লিতে চলে আসেন। রাজধানীতে হোমাই ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইনফরমেশন সার্ভিসের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক রূপে যোগ দেন। সে ছিল এক উত্তাল সময়। একদিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ইংরেজ সরকারি মহলে চলছে দেশভাগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের তোড়জোড়। চিত্র সাংবাদিক হিসেবে সমকালীন প্রায় সব উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনারই প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকতেন হোমাই ব্যায়ারাওয়ালা ও তাঁর ক্যামেরা।
দিল্লিতে ১৯৪২ পরবর্তী বছরগুলিতে স্বাধীনতার দাবিতে সংঘটিত গণ বিক্ষোভ সমূহ, দেশভাগের দলিলে ইংরেজ ও ভারতীয় পক্ষের স্বাক্ষর, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়কার অজস্র বৈঠক, লালকেল্লায় প্রথমবার ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকার উত্তোলন, দিল্লির পথে পথে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন-উল্লাস, বোম্বাই বন্দর থেকে জাহাজে করে ব্রিটিশ সৈন্য ও কর্মচারীদের ভারত ত্যাগ, নাথুলাপাস দিয়ে চতুর্দশ দলাই লামার ভারত প্রবেশের বিখ্যাত ছবি, মহাত্মা গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুর মত মহতী জননায়কদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা সহ এই যুগসন্ধিক্ষণের অসংখ্য-অগণন ঐতিহাসিক মুহূর্ত চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে গিয়েছিল হোমাইয়ের সাদাকালো ছবিগুলির অনন্য আলো-ছায়ায়। তাঁর তোলা অবিস্মরণীয় অসংখ্য ছবি বর্তমানে দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টে সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
১৯৪৭-এর পরবর্তী তিন দশক জুড়ে ভারতীয় চিত্রসাংবাদিকতার দুনিয়ায় এক অবিসংবাদী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন হোমাই। সর্বার্থেই চ্যালেঞ্জিং ও পুরুষপ্রধান এই পেশায় নিজের নারীত্বকে স্বভাবসিদ্ধ নীরব দৃঢ়তায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা করা ছিল হোমাইয়ের অন্যতম লক্ষ্য। সেকারণে সচেতনভাবেই কাজের পোশাক হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশজ খাদি শাড়িকে। কাঁধে নিজের নয় কিলো ওজনের ক্যামেরাটি নিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি তো বটেই দেশের সকল প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন শাড়ি পরিহিতা এই চিত্রসাংবাদিক। ছবি তোলার জন্য মধ্যরাতে একলা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছেন বহুবার। মুখোমুখি হয়েছেন বহু বিপদজনক পরিস্থিতিরও। কিন্তু ভয় পাননি কোনদিনও।
কোন শৈশবেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বালিকা হোমাই। সে অভ্যাস তাঁর বজায় ছিল আজীবন। সাধারণতঃ ১৩ সংখ্যাটি অনেকের কাছেই দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক। কিন্তু তিনি ১৩কেই নিজের সৌভাগ্য সংখ্যা বলতেন। কারণ ১৯১৩ সালে জন্মেছিলেন হোমাই, ১৩ বছর বয়সেই তাঁর পরিচয় হয়েছিল বন্ধু ও জীবন সঙ্গী মানেকশর সঙ্গে, ব্যক্তিগত পরিসরে নিজেকে পরিচয় করাতেন ‘ডালডা১৩’ নামে, আবার নিজের গাড়ির নম্বর প্লেটেও যুক্ত করেছিলেন ১৩ সংখ্যাটিকে। তৎকালীন চিত্রসাংবাদিক মহলে মাম্মি অর্থাৎ মা নামে সুবিদিতা ছিলেন স্নেহময়ী হোমাই। ১৯৭০-এ প্রিয়বন্ধু ও স্বামী মানেকশ’র মৃত্যুর পর চিরতরে বন্ধ দিয়েছিলেন নিজের ক্যামেরার লেন্স। জীবদ্দশায় পরবর্তী ৪০ বছরে আর কখনো ছবি তোলেন নি। সংবাদিকতার দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে একমাত্র ছেলে ফারুখের সঙ্গে দিল্লি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ১৯৭০ এর দশকেই।
১৯৮৯ তে ছেলের মৃত্যুর পর গুজরাটের বদোদরা শহরে একক জীবন শুরু হয় বৃদ্ধা হোমাইয়ের। নিঃসঙ্গতা নয়, বরং নিজের বাগান, পাখি ও প্রতিবেশীদের নিয়ে পরিপূর্ণ ছিল ভারতের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিকের শেষ জীবনটি। জরা তাঁর মনের উদ্যমকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। আত্মজীবনীকার সাবিনা গাডিহোকের সাথে মার্কিনমুলুক সফরকে পুরোদমে উপভোগ করেছিলেন অশীতিপর হোমাই। বদলায়নি তাঁর সহজাত স্পষ্টবাদীতা আর রসবোধও। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতীয় চিত্রসাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’-এ ভূষিত করেন। এসময় বার্ধক্যকালীন অসুস্থতার ফলে দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল তাঁর আর সেকারণেই ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রয়াত হয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথমতমা মহিলা চিত্রসাংবাদিক তথা কিংবদন্তি ক্যামেরাশিল্পী হোমাই ব্যায়ারাওয়ালা। ।
উৎস সূত্রঃ
১) India In Focus : Camera Chronicles of Homai Vyarawalla – Sabeena Gadihoke
২) The Many Lives Of Homai Vyarawalla: Revisiting A Historical Archive : Part 1 And 2 – ASAS Events Youtube
৩) Interview Of Homai Vyarawalla – Khonjstudios Youtube
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D