ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামড়া থেকে নামছেন কিংবদন্তি নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ

প্রকাশিত: ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২৩

ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামড়া থেকে নামছেন কিংবদন্তি নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিবেদক | ঢাকা, ১৭ মার্চ ২০২৩ : সংসদ সদস্য হয়েও ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামড়া থেকে নামছেন তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও কিংবদন্তি কমিউনিস্ট বিপ্লবী হাজী মোহাম্মদ দানেশ!
হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯০০ সালের ২৭ জুন দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত কৃষক নেতা যিনি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাকে তেভাগা আন্দোলনের ‘জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি পূর্ব বাঙ্গলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা ছিলেন। তার নামে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুরের কৃষি কলেজ ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ উন্নীত হয়।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনে নেতৃত্বদানকারী যে ক’জন বরেণ্য ব্যক্তির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাঁদের মধ্যে হাজি মোহাম্মদ দানেশ অন্যতম। ঠাকুরগাঁও তথা বৃহত্তর দিনাজপুরের মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এই বিপ্লবী নেতা।
কমরেড দানেশ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এখান থেকে তিনি ১৯৩১ সালে স্নাতকোত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং দিনাজপুর জেলা আদালতের বারে যোগ দেন।

নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করেন। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং আইনে বি.এল ডিগ্রী লাভ করেন। ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

দিনাজপুর এস.এন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসায় আরম্ভ করেন। কৃষক, বর্গা চাষী, ভাগ চাষী, ক্রান্তি চাষীদের ওপর জমিদার ও জোতদারের সীমাহীন অত্যাচার দেখে শিশু বয়সে মোহাম্মদ দানেশের মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্র জীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার কল্পে কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং বৃহত্তর কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। আন্দোলনকালে তিনি কারাভোগ করেন। নীলফামারি জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। তিনি দু’কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক।

রাজনীতি

১৯৩০ এর দশকে কমরেড দানেশ বাংলার কমিউনিস্ট সংগঠনে সক্রিয় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার সাথে যুক্ত হন। তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ১৯৩৮ সালে তিনি দুইবার গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি তোলাবাটি আন্দোলন, সুসংদবদ্ধ আন্দোলন, গান্ডি আদায় বন্ধ আন্দোলন, ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলন করেন ও গ্রেফতার হন। ১৯৩৮ সালে তিনি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯৪২ সালে তিনি বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং ১৯৪৫ সালে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ও ভারতে পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় ৬০ লাখ বর্গাচাষী নিয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ আদায়ের জন্য জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংগ্রাম করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কৃত হয়ে তিনি কারাভোগ করেন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ঐ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

এই দল পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্ট্রে যোগ দিলে তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দিনাজপুর জেলা থেকে পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অতপর কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিলে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দলকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাথে যুক্ত করেন। ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মজলুম নেতা বলে খ্যাত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। দানেশ ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরে জেনারেল সেক্রেটারি হন।

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর আইয়ুব খানের সামরিক সরকার কর্তৃক দানেশ গ্রেপ্তার হন। তিনি আইয়ুব খানের শাসনের একজন খ্যাতনামা সমালোচক হয়ে উঠেন। শাসনব্যবস্থা কর্তৃক গণতন্ত্র দমন এবং এর যুক্তরাষ্ট্র পন্থি নীতিকে তিনি আক্রমণ করেন। ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় দানেশ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। পূর্ব বাংলার কৃষকদের বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় এবং ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করার বিচ্ছিন্নতাবাদি ধারণা রয়েছে দাবি করে তিনি এর সমালোচনা করেন। পরে মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বের বিরোধিতা করে তিনি ন্যাপ থেকে পদত্যাগ করেন। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দানেশের সাথে মাওলানা ভাসানির মতপার্থক্য ছিল। তার পদত্যাগের পর ন্যাপের অনেক নেতৃস্থানীয় কর্মী দল ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দানেশ জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন গঠন করেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ছাড়া অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর দানেশ বাকশালে যোগ দেন এবং এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৬ সালে তিনি গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরায় গঠন করেন। পর ১৯৮০ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি নামক দল গঠনের জন্য ইউনিয়ন বিলুপ্ত করেন। ১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে যুক্ত করা হয়।

তেভাগা আন্দোলন

উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা আন্দোলনের সুতিকাগার। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের উদ্ভব হওয়ার কারণ ছিল উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আন্দোলনকে সার্থকতার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার মরণপণ সংগ্রাম করেন সেই নেতারা অধিকাংশই ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী। তারা হলেন দিনাজপুরের হাজী মো. দানেশ, রিপন রায়(পার্বতীপুর থেকে), গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ন রায়, হেলেকেতু সিং প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। তার মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মো. দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন। তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে দাবি ছিল ১। উৎপন্ন ফলের তিন ভাগের দু’ভাগ চাই। ২। জমিতে চাষীর দখল স্বত্ব দিতে হবে। ৩। শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশি অর্থাৎ মণকরা ধানের পাঁচ সেরের বেশি সুদ নেই। ৪। হরেক রকমের আবোয়ারসহ বাজে কোনো কর আদায় করা চলবে না। ৫। রশিদ ছাড়া কোনো আদায় নেই। ৬। আবাদযোগ্য সব পতিত জমি আবাদ করতে হবে। ৭। জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষীদের খোলানে ধান তুলতে হবে।

তারা ৩টি স্লোগান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল (ক) নিজ খোলানো ধান তোল। (খ) আধা নয় তেভাগা চাই। (গ) কর্জ ধানে সুদ নাই। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা, তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার বাহের খালী গ্রামের রাসমনি, দিনাজপুরের কৌশলা কার্মায়নী, যশোদা রাণী, ঠাকুরগাঁয়ের রাণীশংকৈলের ভান্ডারিয়া, দিনাজপুরের ঠুমনিয়ার সুরমা সিং, সুকুর চাঁদ, নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির রাজবধুর নেতৃত্বে নাচোলের সাঁওতাল, মুড়িয়াল সর্দার, রাজবংশী মাহাতো হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের বর্গাচাষীরা অস্তিত্বের প্রশ্নে একাত্ম হয়েছিলেন। এ আন্দোলন বিস্তার লাভ করে বেশিরভাগ ভাবপ্রবন কোচ রাজবংশী ও সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে। তারাই ছিল বেশিরভাগ শোষিত ও বঞ্চিত সম্প্রদায়। নেতাদের উস্কানিতে যখন থেকে জোতদারের সম্মতি ব্যতিরেকে কাটা ধানের পুঞ্জ জোতদারের খামারের পরিবর্তে আধিয়ারে নিজ নিজ বাড়ির উঠানে তুলতে শুরু হয় এবং মাড়াই ধান তিন ভাগ করে দুই ভাগ নিজের জন্য রেখে বাকি ভাগ জোতদারদের দিতে শুরু করে তখনই জোতদার শ্রেণির কলিজায় আঘাত পড়ে। কিন্তু জোতদারদের পক্ষে কিছু করবার উপায় ছিল না সমবেত ক্রুদ্ধ আধিয়ারগণের উত্থানের বিরুদ্ধে। তেভাগা আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকার দলন নীতির পথে অগ্রসর হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো উত্তেজিত কৃষক শ্রমিক জনতার উপর গুলি চালানের নির্দেশ দেয়। ফলে কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ জন নিহত এবং বহু মিছিলকারীর আহত হবার মধ্য দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবটি সংগঠিত হয়। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় বিপ্লব সংগঠিত হয়। সরকার তখন নাচোলের ১২ টি গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অসংখ্য রমণীকে বলাৎকার করে, গুলি করে হত্যা করে নির্বিচারে, ইলা মিত্র গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ অধিগ্রহণ ও প্রজাতন্ত্র আইন প্রজাস্বত্ত্ব আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল তেভাগা আন্দোলন।তিনি তেভাগা আন্দলনের অন্যতম নেতা ছিলেন।বিশেষ করে রংপুর ও দিনাজপুরের কৃষকদের মর্ম বুঝেছিলেন।এ সমায় রিপন, হাজী মো.দানেস এর পক্ষে আন্দলনে যোগ দেন।

১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন

হাজী মুহাম্মদ দানেশ দিনাজপুর সেন্ট্রাল আসন থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। তিনি ১৯,০৮৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি ছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী খোরশেদ আলী আহমেদ। তিনি পেয়েছিলেন ৬৩৯৮ ভোট।

মৃত্যু ও স্মৃতি

হাজি মুহাম্মদ দানেশ ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। পূর্বে এটি কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছিল।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ