সিলেট ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২৩
★ মিস্ত্রি ★ প্রশ্নটা ছিল, “তাজমহল কে তৈরি করেন?”
তারিফ উত্তর লিখেছিল, “মার্বেল মিস্ত্রিরা।”
পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন মানিকবাবু। অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার খাতায় এটা কি উত্তর ! প্রথমে এক চোট হাসলেন। তারপর রাগ হল এত কষ্ট করে ইতিহাস পড়ানোর এই রেজাল্ট ! লাল কালির পেনটা দিয়ে লাইনটা কেটে একটা বড় করে শূন্য বসিয়ে দিলেন মানিকবাবু। হোপলেস! কিস্যু হবে না। খাতা ঘুরিয়ে নামটা দেখলেন তারিফ আহমেদ।
ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে স্কুলের, বাকি খাতাগুলো স্কুল থেকে এসে দেখতে হবে আর দেরি করলে ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে। খাতার বান্ডিলটা বেঁধে তাকের উপর রেখে স্কুলে যাওয়ার জন্য উঠলেন মানিকবাবু।
টিফিনের পর অষ্টম শ্রেনীতে ক্লাস ছিল মানিকবাবুর। ক্লাসে ঢোকার সময়ই মনে পড়ে গেলো সকালের খাতা দেখার কথা, হ্যাঁ ছেলেটির নাম মনে আছে তারিফ আহমেদ, মনে থাকবে না! ছিঃ ছিঃ কি উত্তর, এতদিন ইতিহাস পড়ানোর ফল তার? ছেলেটি কে চেনেন মানিকবাবু। কালো করে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কান দুটো একটু খাড়া খাড়া।
ক্লাসে ঢুকে চক, ডাস্টার রেখে চেয়ারে বসেই বললেন, “তারিফ কোথায়? এসেছে আজ?” বাকি ছাত্ররা সমস্বরে উত্তর দিল, “না স্যার।” মানিকবাবু মনে মনেই বললেন, “এদের দিয়ে কিস্যু হবে না, আমারই পণ্ডশ্রম।”
তারপর ৫ দিন কেটে গেলো, তারিফ স্কুলে আসছে না। টিচার্স রুমে এসে মানিকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কেউ ক্লাস এইটের তারিফ আহমেদের ব্যাপারে জানেন? ১০ দিন হয়ে গেলো আসছে না।” অঙ্কের স্যার দিলীপবাবু মোবাইল খুটখুট করতে করতে বললেন, ” দেখুন স্কুল-টুল ছেড়ে কোথাও কাজে ঢুকেছে হয়ত, ওই বাসস্ট্যান্ডের ওখানে মফিজুলের চায়ের দোকান, ও যেন কি একটা হয় তারিফের, গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসুন।”
ছুটির পর স্কুল থেকে বেরিয়ে সটান মফিজুলের চায়ের দোকানে হাজির হলেন মানিকবাবু।
আরে আসেন আসেন মাস্টারমশাই, বুসেন…
-না গো আমি চা খেতে আসিনি, পরে একদিন আসব। বলছি তুমি তারিফ কে চেন? আমাদের স্কুলে পড়ে, দিন দশেক হল আসছে না। কি হয়েছে কিছু…
আর বুলেন না মাস্টারমশাই, ওর বাপ পাথর খাদানে কাজ করত, ফিরেছে কি সব রোগ নিয়ে সিলিকুসিস না কি যেন একটা, আর বেশিদিন বাঁচবে না মুনে হয়…
কথাটা শুনে যেন ধাক্কা লাগল মানিকবাবুর, অতটুকু একটা ছেলে। এবার পড়বে কি করে ও? আসার পথে ট্রেন বেশ ফাঁকা ছিল। মানিকবাবুর মন খচখচ করছে, কি এমন রোগ যে বাঁচবে না তারিফের বাবা?
স্মার্টফোনটা খুলে মানিক বাবু সার্চ করলেন, সিলিকুসিস, সার্চ রেজাল্ট এল সিলিকোসিস। অসংখ্য আর্টিকেল, একের পর এক পড়তে লাগলেন মানিকবাবু। বাড়ি ফিরেও পড়ে চললেন। অনেক ওয়েবসাইট, ব্লগ পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সিলিকোসিস কে বলা যেতে পারে শ্রমঘটিত রোগ, যারা পাথর খাদানে পাথর ভাঙার কাজ করেন তাঁদের ফুসফুসে দীর্ঘদিন ধরে সিলিকা জমতে জমতে এই রোগ হয়। শুধুমাত্র ভারতবর্ষে এই রোগে ৫০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত! কোনো রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই অল্প মজুরীতে বেশি লাভ করার জন্য খাদানের মালিকরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় পড়াশোনা না জানা সরল গ্রামের মানুষদের।
মানিকবাবু তাকিয়ে রইলেন বাড়ির দেওয়ালের দিকে, এই যে এতো ইমারত, রাস্তা, ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, তৈরি হয়ে এসেছে শ্রমিক দের রক্ত ঘাম আর প্রাণের বিনিময়ে, এক মাস আগে ক্লাস ফাইভের প্রশান্তর বাবা মুম্বাইয়ে বহুতলে কাজ করতে গিয়ে পড়ে মারা যায়। অথচ এ যেন সাধারণ মৃত্যু, কেউ সাজা পাবে না। কেউ এদের কথা বলবে না, লিখবে না। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলেন একদল মানুষ, হাড় সর্বস্ব, ধুঁকছে, ক্রমাগত কেশে চলেছে তবুও একটা বিরাট পাথর বয়ে নিয়ে চলছে। কারোর পক্ষাঘাত, কেউ দৃষ্টি হারিয়েছে, কারোর হাত নেই পা নেই…এদের পিষে দিয়ে ছুটে চলেছে অত্যাধুনিক গাড়ি, মাথা তুলছে শপিং মল…
মানিকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তাক থেকে লাল পেনটা নিলেন। নিচ থেকে পরীক্ষার খাতার বান্ডিলটা বের করলেন। হ্যাঁ, এই তো রোল নং ২৩, তারিফ আহমেদ, ১ এর ছয় নম্বর কোশ্চেনর উত্তর। পাঁচ দিন আগে তারিফের এই উত্তরটাই প্রচণ্ড রাগ করে কেটে দিয়েছিলেন মানিকবাবু। আসলে তিনি ইতিহাস ভুল শিখেছেন, বরং বলা ভালো ভুল শেখান হয়েছে। দেশের কোটি কোটি ছাত্রকে যেভাবে ভুল শেখান হয়। মানিকবাবু নিজের দেওয়া ক্রস চিহ্নটা কে ভালো করে কাটলেন, তারপর বড় করে একটা রাইট দিলেন, পাশে ফুল মার্কস ১
প্রশ্নটা ছিল, “তাজমহল কে তৈরি করেন?”
তারিফ উত্তর লিখেছিল, “মার্বেল মিস্ত্রিরা।”
কিছু মানুষ হয়ত কিছু তৈরি করে টাকা লাগিয়ে শ্রমকে ক্রয় করে, তারপর শ্রমিককে ভুলে যায়। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সমস্ত শ্রম দিয়ে একদিন মৃত্যুশয্যায় পড়ে যায়, তবুও তার কোন প্রশংসা হয় না, এটাই সমাজের নীতি, এবং আমাদের নীতি . . .. . ……
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D