সিলেট ১৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৩৪ অপরাহ্ণ, জুন ৩, ২০২৪
বিশেষ প্রতিবেদক | ঢাকা, ০৩ জুন ২০২৪ : বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে। এটি চলতি অর্থবছরের জন্য সমিতির দেওয়া বিকল্প বাজেটের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কম। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য অর্থনীতি সমিতি ২০ লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছিল।
সোমবার (৩ জুন ২০২৪) সকাল ১১টায় রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কার্যালয়ে ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৪-২৫: উন্নত বাংলাদেশ অভিমুখী বাজেট’ উপস্থাপন করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন।
কয়েক বছর ধরে সরকারের বাজেট ঘোষণার আগে অর্থনীতি সমিতি বিকল্প বাজেট ঘোষণা করছে। এ বছরই প্রথম আগের বছরের তুলনায় বিকল্প বাজেটের আকার কমালো অর্থনীতি সমিতি।
পরিচালন ও উন্নয়ন মিলে আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থনীতি সমিতি প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটের মোট আকার ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে সরকার প্রস্তাবিত বাজেটের দেড় গুণের বেশি। সমিতি তাদের বিকল্প বাজেটে বৈষম্য, অসমতা ও দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, মূল্যস্ফীতি কমানো, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণনির্ভরতা কমাতে মোট ৩৪১টি সুপারিশ করেছে।
অর্থনীতি সমিতি মনে করে, সরকার এখন যে ধরনের বাজেট দিচ্ছে, তাতে বৈষম্য বাড়ছে। প্রচলিত ধারার বাজেট অর্থায়নে সরকার প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর আহরণে বেশি জোর দেয়। অর্থনীতি সমিতি এর বিপরীতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিতে বলছে এবং দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষকে সামনের কয়েক বছর আয়কর বেষ্টনীর বাইরে রাখার প্রস্তাব করেছে। এর বিকল্প হিসেবে অতীতে কখনও হাত দেওয়া হয়নি অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী হাত দেওয়া হয়নি– এমন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সমিতির মতে, এর অন্যতম হতে পারে সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর, অর্থ পাচার ও কালো টাকা উদ্ধার, বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর ইত্যাদি।
অর্থনীতি সমিতি মনে করে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সৃষ্ট কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করে তা বাজেট বাস্তবায়নে ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে সমিতি।
অর্থনীতি সমিতি বলেছে, তাদের প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেট বাস্তবায়নে সরকারকে দেশি বা বিদেশি উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে না। বিকল্প বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দের ৯২ শতাংশ রাজস্ব আয় থেকে আসবে। ঘাটতি ১ লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার মধ্যে বন্ড বিক্রি করে ৯৫ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং পিপিপি প্রকল্প থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করা সম্ভব। অর্থাৎ ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণের কোনো প্রয়োজন দেখছে না সমিতি। অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে উন্নয়ন বাজেট পরিচালন বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি, যা সরকারের উল্টো।
অর্থনীতি সমিতি তাদের বিকল্প বাজেটের ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু বিকাশ, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ রাখারও প্রস্তাব সমিতির।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মতে, ধারকর্জ করে ঘি খাওয়ার কোনো অর্থ নেই। সরকারের রাজস্ব আয়ে বড় শক্তি হবে সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর। সম্পদ কর থেকে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর থেকে ৭৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি অনেক কর্মী। সব জায়গায় বিরাজ করছে দুষ্টচক্র। যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে চাই, তাহলে আগে এই দুষ্টচক্রকে রোধ করতে হবে। তা না হলে তারা যেভাবে বিভিন্ন বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আমাদের অগ্রগতি হবে না। সরকার যেটা চাচ্ছে, সেটাও হবে না। আমরা চাই দুষ্টচক্রকে দমন করে এগিয়ে যেতে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিংয়ে যারা ঋণ দেন, যারা ঋণ নেন তাদের মধ্যেও এ চক্র আছে। এ ছাড়াও কোনো কোনো ব্যক্তি অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। এদের দমন করতে হবে। আমরা পরামর্শ দিই, কিন্তু আমরা তো আর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাস্তবায়ন করেন, তারা কাজটি করছেন কি না, সেটা দেখতে হবে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি শূন্য, কিন্তু দেশে দুর্নীতি বহুল বিস্তৃত। এই জঞ্জাল না সরাতে পারলে কাঙ্ক্ষিত পথে দেশ এগিয়ে চলা কঠিন হবে। সম্প্রতি দু-একজন রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কারণে শুরু করা পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই।’ তিনি বলেন, ‘আশা করি তা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে, অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, সে রকম এবারের অভিযান যেন মাঝে থেমে না যায়। বড় বড় দুর্নীতিবাজকেও জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।’
বিকল্প বাজেট অর্থায়নে সরকারের আয়ের ২৭টি নতুন উৎস প্রস্তাব তুলে ধরে অর্থনীতি সমিতি। এগুলো হলো (১) কালোটাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, (২) অর্থ পাচার উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, (৩) সম্পদ কর, (৪) অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর (অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ), (৫) বিলাসী দ্রব্য বা পণ্যের ওপর কর, (৬) সংসদ সদস্যসহ গাড়ির ওপর শুল্ক মওকুফ বাতিল থেকে কর, (৭) বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর, (৮) সেবা থেকে প্রাপ্ত কর, (৯) বিমান পরিবহন ও ভ্রমণ কর, (১০) পণ্যের ওপর রয়্যালটি ও সম্পদ থেকে আয়, (১১) প্রতিরক্ষা বাবদ প্রাপ্তি, (১২) রেলপথ, (১৩) ডাক বিভাগ, (১৪) সরকারের সম্পদ বিক্রয়, (১৫) সেচবাবদ প্রাপ্তি, (১৬) তার ও টেলিফোন বোর্ড, (১৭) টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, (১৮) এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, (১৯) ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন, (২০) সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, (২১) বিআইডাব্লিউটিএ, (২২) পৌর হোল্ডিং কর, (২৩) ডিজি হেলথ: বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমতি ও নবায়ন ফি (২৪) ডিজি ড্রাগস: ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি লাইসেন্স এবং নবায়ন ফিস, (২৫) বিউটিপার্লার সেবালব্ধ কর, (২৬) আবাসিক হোটেল/গেস্ট হাউস ক্যাপাসিটি কর এবং (২৭) বিদেশি পরামর্শ ফি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারাকাত বলেন, দুর্নীতি রোধ, কালোটাকা ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে আমরা বিইএ-এর পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছি। এ কমিশনে কোনো আমলা, সামরিক বা পুলিশ বাহিনীর কেউ, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক দলের সদস্য ও গণমাধ্যমের মালিক সদস্য হতে পারবেন না। এ কমিশনের কাজ হবে দুর্নীতি, কালোটাকা ও অর্থ পাচার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান ও জনগণের কাছে গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রতি তিন মাস পরপর কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রতিবেদন নিয়ে সরাসরি হাজির হওয়া। এতে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, পুঞ্জীভূত কালোটাকা ও পাচারকৃত অর্থ ছড়িয়ে আছে জমি, বাড়ি ও সোনাদানায়। আমরা গবেষণা করে দেখেছি যে, ৪৬টি বিভিন্ন ধরনের ও পর্যায়ের গোষ্ঠী এতে জড়িত।
তিনি জানান, কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ৩৩ থেকে ৬৬ শতাংশ হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একবার কালোটাকা নিয়ে একটি গবেষণা বা স্টাডি হয়েছিল। ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। আমরা জানি, কালোটাকা আছে। আবার এটাও জানি যে, সেসব উদ্ধারও কঠিন।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ইতোপূর্বে গঠিত কমিশনের ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। তাই এখন কোনো কমিশন গঠন করা হলে কমিশনের নখ থাকতে হবে, যেটা তারা কাজে লাগাতে পারবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, অর্থনীতিকে পরিচালনা করেন রাজনীতিকরা। তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে কালোটাকা বন্ধ করা বা উদ্ধার করার বিষয়টি। আমাদের পরামর্শ হলো, সব লেনদেন ডিজিটাল করতে হবে। তাতে সব লেনদেনের রেকর্ড থাকবে। লেনদেন যদি সন্দেহজনক হয়, তা শনাক্তকরণ সহজ হবে।
বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন ‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথা’র বিশেষ প্রতিনিধি, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ অামিরুজ্জামান সহ দেশের ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা এবং ৪৫টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা।
উল্লেখ্য, আগামী বৃহস্পতিবার চলতি অর্থবছরের তুলনায় মোট ব্যয় মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় আট লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি