সহজবোধ্য ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে: ড. কামাল হোসেন

প্রকাশিত: ৯:৪১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

সহজবোধ্য ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে: ড. কামাল হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ : বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং মৌলিক অধিকারের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি কীভাবে মৌলিক অধিকারের ক্ষুণ্ণতা একটি জাতিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এজন্য আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোকে আরো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং এ অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে। সহজবোধ্য ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়েও নতুন সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ফৌজদারি আইনের মানহানি বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো যে অপরাধগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার এবং সবার মত প্রকাশের জন্য প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে, সেগুলোকেও বাতিল করতে হবে।

মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪) সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত এ আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়ে সংবিধান রচনা করেছিলাম, যেখানে এবারের আন্দোলন আবারো বৈষম্য নিরসনের বিষয়ে সামনে নিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে সে আলোকে সংবিধানের সংশোধনীর সুপারিশ তৈরি করতে হবে।

ড. কামাল হোসেন বলেন, আবুল মনসুর আহমদ কখনোই সংবিধানকে একটি নিশ্চল দলিল হিসেবে দেখেননি। তিনি একে একটি গতিশীল পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেছেন যা সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের দাবি রাখে। আজ আমরা যে সংবিধানের সংশোধন নিয়ে আলোচনা করছি, তা আবুল মনসুরের এ চিন্তারই প্রতিফলন।

তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব হলো সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করা ও চর্চা করা, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না হয়। আমরা যেন এ শিক্ষাগুলোকে আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোতে গেঁথে দিতে পারি, যাতে কোনো নাগরিকের সঙ্গে অন্যায়, অবিচার আবার না ঘটে। এটাই হবে আমাদের সংবিধানের সত্যিকারের পরীক্ষা।

ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ওপর গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টির বিরোধিতা করে এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষপাতী ছিলেন আবুল মনসুর। তিনি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টকে অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল মনে করতেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে, এখন এমন একটি সময় এসেছে যখন আমরা দ্বিতীয় কক্ষের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে পারি। এটি করা গেলে সরকার পরিচালনায় বাংলাদেশের পেশাজীবী ও নাগরিকদের বিভিন্ন অংশ সরাসরি অবদান রাখার পথ খুলে দেবে। আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্টের বিদায় করেছি, এটিই কিন্তু শেষ কথা নয়। এটিকে অর্থবহ করতে আমাদেরকে ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক ফ্রেমিং তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো সংবিধান তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে মাহাত্ম্যের সঙ্গে টিকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। কারণ সংবিধান বানানো সহজ কিন্তু টিকিয়ে রাখা কঠিন। পৃথিবীতে সংবিধানের গড় বয়স ১১ বছর, এখানে আমাদের সংবিধান তেপ্পান্ন বছর ধরে টিকে আছে। এর জন্য আমাদের সংবিধান একটা ধন্যবাদ হয়তো পেতেই পারে, একে কৃতিত্ব বলা যায় সংবিধানের।

বাহাত্তরের সংবিধানের নিন্দুক বেশি, প্রশংসাকারী কম দাবি করে তিনি বলেন, অনেকেই এটিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চায়। তারা এটিকে একটি দলীয় দলিল বলে খারিজ করে দিতে চায়, কিন্তু এটি ভুল ধারণা। এটি শুধু দলীয় দলিল ছিল না, এটি আমাদের একটি জাতীয় অর্জন। বাংলাদেশের সংবিধানে গৃহীত সমাজতন্ত্রকে কমিউনিজমের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কিন্তু আসলে সেটি না। সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা আছে। এটি কার্ল মার্ক্সের কমিউনিজম না, এটি হলো সম্পদের সুষম বণ্টন।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে তৈরির প্রস্তাব নিয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রস্তাব এসেছে, কোনোটিই অভিনব নয়, এগুলো অতীতে কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পার্লামেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. জালাল ফিরোজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, লেখক ড. জাহেদ উর রহমান ও লেখক সারোয়ার তুষার।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ