আমি দেশপ্রেমিক, কিন্তু জাতীয়তাবাদী নই- কেন

প্রকাশিত: ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪

আমি দেশপ্রেমিক, কিন্তু জাতীয়তাবাদী নই- কেন

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম |

সাধারণ বুদ্ধিতে শব্দ দু’টিকে সমার্থবোধক বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ‘দেশপ্রেম’ (patriotism) ও ‘জাতীয়তাবাদ’ (nationalism) এক জিনিস নয়। আমি নিজেকে একজন ‘দেশপ্রেমিক’ বলে ভাবি, কিন্তু কখনোই নিজেকে একজন ‘জাতীয়তাবাদী’ বলে মনে করি না। এর কারণটি এখানে সংক্ষেপে ব্যক্ত করব। সেজন্য, প্রথমে দেশপ্রেম সম্পর্কে, আর পরে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছু কথা এখানে তুলে ধরব।

যেকোনো মানুষের জন্য দেশপ্রেম হলো একটি মহৎ গুণ। এই গুণ থাকাটা একজন মানুষের জন্য পরম গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয়। নিজের জাতি ও নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসাই হলো দেশপ্রেম। দেশপ্রেমিক মানুষের স্বার্থবোধ ও চিন্তার পরিমণ্ডল ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তার গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। ব্যক্তি ও পরিবারের সংকীর্ণ জগতকে অতিক্রম করে একজন দেশপ্রেমিক মানুষ দেশ ও জাতির স্বার্থ ও সত্তার সাথে নিজেকে একাকার করে ফেলে। বিশ্ব জগতে সে তখন আর একক একটি ব্যক্তি মাত্র হয়ে থাকে না, সে হয়ে ওঠে সমষ্টির অঙ্গীভূত। শুধু একটি একক ‘মানুষসত্ত্বা’ নয়, সে একই সাথে হয়ে ওঠে ‘মানবসত্ত্বার’ পরিচয় বহনকারী বৃহত্তর সমষ্টিগত সামাজিক সত্তার একজন। অন্তত, সেরকম হয়ে ওঠার পথে তার ঘটে এক তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরণ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের ক্ষেত্রে এই উত্তরণের প্রক্রিয়া ও সমষ্টিগত বোধ তাকে স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে পৌঁছে দেয় বিশ্ব মানবতার চেতনায়। এ কারণে তার নিজের দেশপ্রেম কখনোই অন্য আরেক ভিন্ন দেশ ও জাতির মানুষের দেশপ্রেমের বৈরী বা প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে না। সব জাতির মানুষের নিজ নিজ দেশপ্রেম হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাছে তার স্বদেশ ও স্বজাতি হয়ে ওঠে বিশ্বলোকের মহামানবের একটি অংশ, তারই সৌরভিত ফুলবনের অন্যতম অলঙ্কার। দেশপ্রেমিকের স্বদেশ-প্রেমের স্বরূপ ঠিক এমনটাই।

কবিগুরু তাই আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন-
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জাতীয়তাবাদের’ তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ব-মানবের কবি। একই সাথে তিনি ছিলেন প্রচণ্ডভাবে একজন দেশপ্রেমিক। কবিগুরু বলে গেছেন যে, ‘বিশ্ব-মানবের প্রতি ভালোবাসা-বোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেমন কিনা প্রকৃত দেশপ্রেমের নিখুঁত স্ফুরণ ঘটতে পারে না, ঠিক তেমনি প্রগাঢ় দেশপ্রেমকে উপেক্ষা করে সত্যিকার মানবপ্রেম জাগরিত হতে পারে না।’

স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসাই হলো দেশপ্রেম। এখন প্রশ্ন হলো, এই স্বজাতি ও স্বদেশ ব্যাপারটি আসলে কী? এটা কি মানবসত্ত্বার অন্তর্গত একটি অন্তর্নিহিত উপাদান? নাকি তা ইতিহাসের ধারায় আবির্ভূত একটি সামাজিক উপাদান? পরের কথাটি যদি সত্য হয় তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কীভাবে ঘটেছে তার উদ্ভব? এসব প্রশ্নগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক।

জাতিসত্তা-বোধ হলো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা একটি উপলব্ধি, একটি চেতনা। বিস্তৃত ভুমণ্ডলে মানুষের উপস্থিতি বহুকালের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষরা ক্রমে পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছে, জীবন ধারণের প্রয়োজনে গোষ্ঠীবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ হয়েছে। ইতিহাসের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হলো এই যে, নানা উত্থান-পতন, বাঁধা-বিঘ্ন, দ্বন্দ্ব -সংঘাত সত্তেও মানুষ ক্রমাগতই একে অপরের নিকটবর্তী হয়েছে ও হচ্ছে। মানুষসত্ত্বা অধিকতরভাবে রূপ পাচ্ছে মানবসত্তায়। এই ক্রমধারাবাহিকতাতেই স্বজাতি-বোধের উদ্ভব। ইতিহাসের ধারাতেই নৃতত্ত্বগত, ভূগোল ও প্রাকৃতিক পরিবেশগত, জলবায়ু ও আবহাওয়াগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, জীবনাচারগত, অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থাগত প্রভৃতি নানা উপাদানের যুগ যুগ ব্যাপী ধারাবাহিক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানব সমাজের পৃথক পৃথক গোষ্ঠীর মধ্যে নিজ নিজ স্বজাতি-বোধ গড়ে ওঠেছে। নিজের জাতির সামগ্রিক পরিবেশগত পরিমণ্ডল, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, ভাষা-সংস্কৃতি, জীবনাচারের সাথে প্রতিটি মানুষের নিবিড় বন্ধন সূত্রটি জন্মলগ্ন থেকেই স্থাপিত হয়। নাড়ির বন্ধনের মতোই এই সংযোগ। একজন মানুষের জন্য এই স্বজাতি-বোধটা যেন তার মায়ের কোল, তার স্বাভাবিক শারীরিক-মানসিক আশ্রয়স্থল। শরীরতাত্ত্বিক, ভাষা-সাহিত্য-ভাবজাগতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্ততাত্ত্বিক প্রভৃতি নানা সূত্রের এক অদৃশ্য কিন্তু বস্তুগত গাঁথুনি দ্বারা স্বজাত্যবোধের এই অনুভূতির সৃষ্টি।

স্বজাতি-বোধের এই অনুভূতি মানুষের রক্তপ্রবাহে আজন্ম প্রবিষ্ঠ। এই বোধের উৎপত্তি মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ। কিন্তু এই বোধের সৃজন অথবা তার পচন অনেকটাই মানুষের হাতে। সেটা নির্ভর করে যেমন নিজের উপর, তেমনি তা নির্ধারিত হয় স্বদেশ ও সমাজের চরিত্রের দ্বারা। চেতনায় স্বজাতি-বোধের এই অনুভব ইতিহাসের ধারায় গড়ে ওঠা অগণন বাস্তব উপাদানের ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। সমাজ বিকাশের ধারায় স্বজাত্যবোধের এই চেতনা ও অনুভব সময়ের পরিক্রমায় গভীরতর ভিত্তি পেয়েছে।

স্বাভাবিক কারণেই একটি ভৌগলিক গণ্ডির মধ্যে বসবাসরত মানুষদেরকে নিয়েই পৃথক পৃথক স্বজাত্যবোধ বিকশিত হয়েছে। এভাবে জাতি-পরিচয় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকার সাথে। রাজ্য-সাম্রাজ্যের ভাঙা-গড়া সত্ত্বেও জাতীয় আত্মপরিচয় নিয়ে পৃথিবীর একেকটি এলাকায় একেকটি জাতিসত্তার মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করেছে ও নিজ নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভবের পর বিকাশ ঘটেছে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এভাবে স্বদেশ অনেকটা পরিমাণে একটি স্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক রূপ অর্জন করেছে। এভাবেই স্বজাতির চেতনার সাথে সংযুক্ত হয়েছে স্বদেশের অনুভূতি। স্বজাতির প্রতি নিবিড় আকর্ষণ ও ভালোবাসার আবেগ ক্রমেই রূপ পেয়েছে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসায়। সেই ভালোবাসার নামই হলো দেশপ্রেম।

স্বজাতির ভূ-রাজনৈতিক স্বরূপ হলো স্বদেশ। কিন্তু এই স্বদেশ শুধু চিহ্নিত একটি ভূখন্ড, তার গাছ-পালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, জলবায়ু-মৃত্তিকা প্রভৃতির সমাহারই কেবলমাত্র নয়। স্বদেশের শ্রেষ্ঠতম ও অমূল্য উপাদান হলো স্বদেশের মানুষ। স্বদেশের মানুষ নিয়েই স্বজাতির গঠন। তাই, দেশপ্রেমের প্রধান উপাদান, তার মর্মকথা হলো দেশের আপামর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশকে ভালোবাসতে হলে সর্বাগ্রে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়।

কিন্তু দেশের সব মানুষ তো একটি অখন্ড সত্ত্বা নয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজের সময়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাস হলো শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। এক সময় সমাজ বিভক্ত ছিল মুষ্টিমেয় দাস মালিক ও অগণিত ক্রীতদাস- এই দুই শ্রেণীতে। তারপরে সমাজ বিভক্ত হয়েছে সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাস অথবা প্রজাকুল হিসেবে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও সমাজে রয়েছে প্রধানত দুটি পরস্পর স্বার্থবিরোধী শ্রেণী- পুঁজিপতি ও শ্রমজীবী। রয়েছে শোষক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণী। শোষকরা মুষ্টিমেয়, হাতেগোনা গুটিকয়েক। শোষিতরাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রায় পনের-সাড়ে পনের আনা। শোষক আর শোষিত- দু’পক্ষকেই একই সাথে ভালোবাসা যায় না। শোষিত মানুষকে ভালোবাসতে হলে যারা তাদেরকে শোষণ করে, সেই শোষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। শোষক শ্রেণীর শোষণকে ঘৃণা করতে হয়।

দেশপ্রেমের অভিপ্রকাশ যদি হয় স্বদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাহলে তার মূর্ত রূপ হতে হবে এই পনের-সাড়ে পনের আনা শোষিত দেশবাসীর প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু, সেই ভালোবাসা নিরর্থক ও নিষ্ফল-বন্ধ্যা হয়ে থাকবে যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী চিরদিন পুঁজিবাদের শোষণ জালে আবদ্ধ হয়ে থাকে। তারা যদি মজুরি-দাসত্বের শিকলে বাঁধা পড়ে থাকে। পনের-সাড়ে পনের আনা মানুষের জন্য অমানবিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের জিঞ্জির মেনে নিয়ে দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। শোষণমূলক সামাজিক ব্যবস্থার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা মেনে নিয়ে, সেই ব্যবস্থার গায়ে শুধু উপরভাসা সংস্কারের মলম লাগিয়ে মানুষের যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা দিয়েও নির্ভেজাল ও পরিপূর্ণ দেশপ্রেম প্রদর্শিত হতে পারে না। প্রকৃত দেশপ্রেম দাবি করে শোষিত দেশবাসীর প্রতি ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসা দাবি করে শোষণমুক্তির সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা। প্রকৃত দেশপ্রেম তাই স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার তাড়নাতেই আমাদেরকে যে একই সাথে বিশ্ব মানবতার প্রতি উদার ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় জাগরিত করবে এবং সাথে সাথে শোষণমুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে-এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এসবই হলো প্রকৃত দেশপ্রেমের অন্যতম মর্মবাদী ও উপাদান। তদ্রুপ বিচারে আমি নিজেকে অতি নগণ্য হলেও একজন দেশপ্রেমিক বলে বিবেচনা করি।
এখন দেখা যাক, ‘জাতীয়তাবাদ’ কী? জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যেখানে জাতীয় পরিচয়কে সামাজিক ঐক্যের সর্বোচ্চ ও শীর্ষরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মতাদর্শে একথা ধরে নেয়া হয় যে, ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলে এমন কিছু আছে যার কাছে শ্রেণীস্বার্থ, শোষণ ব্যবস্থা থাকা বা না থাকা, সামাজিক বিভাজনজনিত সবরকম স্বার্থবোধ ইত্যাদি সবকিছু অধীনস্ত থাকে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমি নির্বিশেষ স্থান-কালের বিবেচনার ঊর্ধ্বে, একটি অনাদিকালের জন্য স্থায়ী ভাবাদর্শ ও ব্যবস্থারূপে উপস্থাপন ও বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

বস্তুত, জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের বিষয়গুলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে নতুন সংযোজন। কালক্রমে, যখন মানব সমাজের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটল, তখন আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে স্বতন্ত্র স্বজাতি-বোধের উপাদানকে নতুন মাত্রিকতা ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়াটা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ল। স্বজাতি-বোধের স্বাভাবিক উপলব্ধিকে রূপান্তর করা হলো জাতীয়তাবাদের মতাদর্শে। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকল আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো।

চার-পাঁচশ’ বছর আগেও রাজনীতি ও সমাজে জাতি-রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলে তেমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। মানুষের মধ্যে ছিল স্বজাতি-বোধ। কিন্তু তার সাথে ভূ-রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক আদর্শের কোনো শক্তিশালি ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। রাজা-মহারাজারা যে ভূখন্ড দখল করতে সক্ষম হতো, সেটাই হতো রাজ্যের (অর্থাৎ রাষ্ট্রের) ভূ-সীমানা ও ভৌগলিক গন্ডি। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাস সমাজ ও সামন্তবাদী সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করত না। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভবের সাথে সাথে পুঁজির নিজস্ব স্বার্থেই নিজ নিজ বাজার সংরক্ষণ ও বাজার দখল-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠল। পুঁজিবাদের বাজার কর্তৃত্বের এই অন্তর্নিহিত তাগিদই জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের উন্মেষ ও জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব অনিবার্য করে তুলল।

সাধারণ বিচারে একথা বলা যায় যে, উদ্ভবের প্রথমাবস্থায় জাতীয়তাবাদের প্রগতিবাদী ভূমিকাই ছিল এই মতাদর্শের প্রধান মর্মকথা। কিন্তু এই ভূমিকা ক্রমেই স্থান-কাল-ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিতে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে উত্তরণের ক্ষেত্রে যেসব জাতি ও জাতি-রাষ্ট্র অগ্রবর্তী থাকতে সক্ষম হয়েছিল, তারা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলোকে পদানত করে সেখানে তাদের উপনিবেশ বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। এসব প্রভু-দেশ তাদের ঔপনিবেশিক শোষণ বিস্তারের জন্য জাতীয়তাবাদের মতাদর্শকে কাজে লাগায়। এটি ছিল বৃহৎ শক্তির জাতীয়তাবাদ। আবার পদানত ও ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ জাতিগুলোর ক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদী মতাদর্শই সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী বন্ধন মোচন করে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইতিবাচক আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। তাই, এভাবে এবং আরো অন্য নানাভাবে জাতীয়তাবাদের দ্বিমুখী ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়।

নির্দিষ্ট স্থান, কাল ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক এবং একটা প্রগতিশীল ভূমিকা থাকার ব্যাপারটি অনস্বীকার্য। কিন্তু ভাবাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের নেতিবাচক ও এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল অভিঘাতের বিপদের আশঙ্কার কথা ভালোভাবে হিসেবে রাখাটাও বাঞ্ছনীয়। জাতীয়তাবাদের কতগুলো নেতিবাচক দিক ও সম্ভাব্য বিপদের কথা এখানে উল্লেখ করছি।

জাতীয়তাবাদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো জাত্যাভিমান। জাতি পরিচয়ই কেন্দ্রিক বিষয়, এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তা এগিয়ে নিতে অপর আরেকটি তত্ত্বও তার সাথে সাথে সহজেই হাজির হয়ে যায় যে, ‘আমাদের জাতিই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি’। এই যুক্তিতে অন্যান্য ‘অনগ্রসর, অসভ্য জাতিগুলোকে মানুষ করার’ ইতিহাস প্রদত্ত দায়িত্ব এই শ্রেষ্ঠতর বা শ্রেষ্ঠতম জাতির দাবিদাররা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। জাতীয়তাবাদের এহেন প্রয়োগ ঔপনিবেশিক মতবাদ ও ব্যবস্থাকে লালন করে। জাত্যাভিমানের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকাশ হলো ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, জিয়নবাদ ইত্যাদি। আমাদের দেশেও বাঙালিদের মাঝে জাত্যাভিমানের প্রকাশ দেখা যায়। তা দেখা যায় পার্বত্য এলাকার জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে। জাত্যাভিমানে আচ্ছন্ন জাতি নিজের দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা-ঘাটতি-অপরাধগুলোকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখায়, আর নিজের শক্তি-সামর্থ্য-ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে দেখে। ফলে, জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ও প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে গিয়ে এরূপ জাত্যাভিমানে আচ্ছন্ন জাতি নানা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় পিছিয়ে পড়ে। জাত্যাভিমান থেকেই উৎসারিত হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ। নিজ জাতির তথাকথিত স্বার্থরক্ষায় কোনো অন্যায় কাজই তখন অন্যায্য মনে হয় না। নিজের আধিপত্য অন্যের ওপর প্রয়োগ করতে উগ্র জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়া হয়। পৃথিবীতে জাতিতে জাতিতে সহ-অবস্থান ও শান্তি-ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো তার অন্তর্নিহিত রক্ষণশীলতা। জাতীয় ঐতিহ্য ও জাতীয় ভাবধারা রক্ষার নামে নানা ধরনের বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমন্ডকতাকে সে উস্কে দিতে সক্ষম। জাতীয়তাবাদ এক ধরনের আত্মমুখীনতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতা ধারণ করে, যা কিনা বিশ্ব সভ্যতার অর্জন থেকে জাতির দূরত্বকে বাড়িয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতার সাধারণ সর্বমানবিক ঐশ্বর্যময় সম্পদ থেকে আধার গ্রহণ করে স্বজাতিকে সমৃদ্ধ করার বদলে, ‘শ্রেষ্ঠ জাতির শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের’ নামে নিজের অতীত ও স্ব-গন্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলার বিপদ ধারণ করে। এমনকি, তা একটি জাতির মধ্যে ‘অতীতে ফিরে যাওয়ার’ (revivalism) প্রবণতার জন্ম দেয়। তার ফলে, জাতি প্রগতিমুখীন না হয়ে রক্ষণশীল ও এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে।

জাতীয়তাবাদ অন্ধ একমুখীনতা ও সংকীর্ণতাবাদী প্রবণতাও লালন করে। জাতীয়তাবাদ দাবি করতে চায় যে- সমাজের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন, শ্রেণী সচেতনতা, ইতিহাস ও সমাজ রূপান্তরে শ্রেণীর ভূমিকা, শোষক ও শোষিতের মধ্যে মৌলিক অমোচনীয় দ্বন্দ্ব, শোষিত মানুষের ঐক্য, মানবিক ও শোষণমুক্ত নতুন সভ্যতা নির্মাণে বিশ্বের শ্রমিক সংহতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে যে সুপ্রিম বিষয়টি, তা হলো জাতির সার্বজনীন স্বকীয়তা। জাতীয়তাবাদ একটা পর্যায়ে শ্রমিক শ্রেণীর শোষণমুক্তির সংগ্রামের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার বিপদ ধারণ করে। এদেশেও আমরা বহু দিন ধরে দেখে এসেছি জাতীয়তাবাদী শক্তি কীভাবে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের বিপরীতে ‘বাংলার মজদুর এক হও’ স্লোগান উত্থাপনের জন্য চেষ্টা করেছে। কিংবা তাদের মুখে অতীতে শুনেছি এবং বর্তমানে আবার খুব বেশি করে উচ্চারিত হতে শুনছি ‘শ্রমিক-মালিক ভাই-ভাই, বাঙালির একতার বিনাশ নাই’ ইত্যাদি ধরনের নসিহত। অন্যদিকে, বৃহৎ ও শক্তিমান জাতির ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ যে আগ্রাসী, আধিপত্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী ও নয়া-উপনিবেশবাদী এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ফ্যাসিবাদী, নাৎসিবাদী, জিয়নবাদী, তালেবানি জঙ্গিবাদী, প্যান-ইসলামবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের চরম প্রতিক্রিয়াশীলতায় পর্যবসিত হতে পারে তা ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

এত তাত্ত্বিক কথায় না গিয়েও বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদের’ যে বাস্তব চেহারা আমরা দেখে চলেছি তা থেকেও এই আদর্শের স্বরূপ অনেকটাই স্পষ্ট হয়। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’- সেটা তো পাকিস্তানি ভাবাদর্শের একটি নরম সংস্করণ বৈ অন্য কিছু নয়। সে বিষয়ে বেশি আলোচনা না করলেও চলে। আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ অনেক রকম ভূমিকাই আমরা দেখেছি, দেখে চলেছি। নিঃসন্দেহে একথা সত্য যে, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও জাতীয়তাবাদী শক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তার শীর্ষ অধ্যায়ে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদী শক্তিরই কোনো কোনো অংশ ’৭০-’৭১ সালেও হিটলারের মতো করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে বলে প্রচার চালিয়েছে, ডান হাত সামনে প্রলম্বিত করে নাৎসি কায়দায় শপথ গ্রহণ করার পদ্ধতি চালুর চেষ্টা করেছে, আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতার পাশে থাকবে বলে শেষ মুহ‚র্ত পর্যন্ত মোহগ্রস্ত থেকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সহায়তায় ‘স্বাধীনতা’ আনা যায় কিনা সেজন্য চেষ্টা করেছে। এসব ঘটনার সাক্ষী রয়েছে ইতিহাসে। এখনো সাম্রাজ্যবাদের মন যুগিয়ে চলার জন্য তাবেদারির প্রতিযোগিতায় তারা ব্যস্ত। আর মাঠে-ময়দানে উভয় ঘরানার জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের বাস্তব কার্যকলাপ তো আমরা কয়েক দশক ধরেই দেখছি। হালুয়া-রুটির ভাগবাটোয়ারা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজি, দখলবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে অসৎ পথে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ-বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে এবং একই জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে দ্ব›দ্ব-সংঘাত-সমঝোতার খেলা চলছে। জাতীয়তাবাদীদের অব্যাহত খাই-খাই তৎপরতায় সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিঃশ্বাস উঠছে। লুটেরা পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ করে তারা দেশকে অবাধ লুটপাটের রাজত্বে পরিণত করেছে। ‘বাজার-অর্থনীতি’-র পথ ধরে দেশকে ‘বাজার-রাজনীতির’ পক্ষে নিমজ্জিত করেছে।

মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি- এর কোনোটা সম্পর্কেই মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সকলের কাছে এ বিষয়টিও পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে ‘জাতীয়তাবাদী’ আদর্শ অনুসরণ করা বা না করার প্রসঙ্গ ও জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিৎ-এই দুই প্রসঙ্গ একই প্রসঙ্গ নয়। ‘জাতীয়তাবাদের‘ আদর্শ আমি অনুসরণ না করলেও আমি মনে করি যে এদেশে জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক ভূমিকা এখনো সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়নি। তাই কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট ইস্যুতে তাদের সাথে, যার যার স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখে, এক সাথে কাজ করা প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে একই সাথে সতর্ক থাকাটাও জরুরি। তাই, নিজের সম্পর্কে আমার বিনীত উচ্চারণ- আমি দেশপ্রেমিক বটে, কিন্তু জাতীয়তাবাদী মোটেও নই।