সমাজতন্ত্র কেন?

প্রকাশিত: ৮:০৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪

সমাজতন্ত্র কেন?

আলবার্ট আইনস্টাইন |

যদি কেউ অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হন তাহলে তার পক্ষে কি সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে মতামত দেয়া উচিত হবে? আমার বিশ্বাস অনেক কারণবশত এই মতামত প্রকাশ করা যেতে পারে।
প্রথমেই বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে
বিবেচনা করা যাক। আপাতভাবে মনে হতে পারে জ্যোতির্বিদ্যা ও অর্থনীতি বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো পদ্ধতি বা প্রকরণগত পার্থক্য নেই। দুটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীরা চারপাশের ঘটনাবলী অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করে পারষ্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস করেন। অবশ্যই এই সম্পর্ক সকলের পরিষ্কারভাবে বোধগম্য এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে, যাতে বিষয় সম্বন্ধে একটি স্বচ্ছ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের দুটি শাখার আলোচনায় ও গবেষণায় পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে, অর্থনৈতিক ঘটনাবলী বহু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিষয়গুলির পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ করা বেশ কঠিন। তাই অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমস্ত ঘটনাবলী আলাদাভাবে পর্যালোচনা করে কোন গ্রহণযোগ্য সাধারণসূত্র নির্ণয় করা অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক। সর্বোপরি আমাদের জানা আছে তথাকথিত সভ্যতার ঊষাকাল থেকে মানব ইতিহাস কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ডের ফলেই প্রভাবিত হয়নি। যেমন প্রধান প্রধান বৃহৎ রাষ্ট্রের পত্তনের মূলে রয়েছে সামরিক অভিযান। বিজয়ীরা বিজিতের বেশে তাদের সুবিধামত শ্রেণীতে পরিগণিত করেছে। তারা ভূমির ওপর একচেটিয়া অধিকার
প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের মনের মত এক পুরোহিততন্ত্রের সৃষ্টি করেছে। এই পুরোহিতরা আবার সামাজিক শিক্ষাদীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছিল। সমাজের মধ্যে শ্রেণীবিভাগকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে এমন মূল্যবোধই পরবর্তীকালে সাধারণ জনগণের সামাজিক আচার ব্যবহারের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ঐতিহাসিক পরষ্পরায় প্রকৃতপক্ষে আমরা কি
দেখতে পাই? থোরস্টিন ভেবলেঁর ভাষায় বলতে
হয় যে, মানুষের তথাকথিত উন্নয়নের সাথে লুন্ঠন
ব্যবস্থার সম্পর্ক আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনি। যে
সমস্ত অর্থনৈতিক তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি তা এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই এসেছে এবং এই পর্যায়ের উপস্থাপিত সূত্রগুলি অন্য কোন স্তরে প্রযোজ্য নয়। যেহেতু সমাজতন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য অধিকতর উন্নত
ব্যবস্থার প্রচলন করা তাই উল্লিখিত পর্যায়ের
অর্থনীতি-বিজ্ঞান বা তার নিয়ম কানুনগুলো ভবিষ্যত
সমাজতান্ত্রিক সমাজের ব্যাপারে তেমন আলোকপাত করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার লক্ষ্য সামাজিক ও
নৈতিক সততা অর্জন। বিজ্ঞান নিজে থেকে কোনও লক্ষ্য সৃষ্টি করতে অক্ষম। মানুষই লক্ষ্য নির্ধারণ করে, বিজ্ঞান কেবল লক্ষ্য পূরণের সহায় মাত্র। যুগে যুগে মহান ব্যক্তিত্ববান নৈতিক শক্তির অধিকারী মহামানবগণ জীবন বা সমাজের উদ্দেশ্য কল্পনা করেন এবং তারাই কখনো বা অচেতনভাবে কখনো বা অবচেতনভাবে একটি সঞ্জীবনী প্রাণবন্ত সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির পথে ধীরে ধীরে সমাজ বিবর্তনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন। এই সব কারণেই মানবিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অতিমূল্যায়ন করে এর উপরে গভীর আস্থা রাখা সঙ্গত নয়। অতএব একমাত্র বিশেষজ্ঞগণই সমাজ গঠনের
প্রশ্নে মতামত জাহির করতে পারেন, এমন ধারণা করা
অনুচিত।
সম্প্রতি অসংখ্য কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে যে মানব সমাজ
এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে চলেছে এবং এই সমাজের স্থায়িত্ব অসম্ভব নড়বড়ে হয়ে উঠেছে, এই ধরনের পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সাধারণ মানুষ হয় সব ব্যাপারেই উদাসীন হয়ে পড়ে অথবা তাদের নিজের নিজের সমাজব্যবস্থার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এই বক্তব্যের সারোদ্ধারের জন্য আমি একটি
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করতে পারি।
সম্প্রতি আমি একজন খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির সঙ্গে আর একটি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতার কথা
আলোচনা করছিলাম। আমার ধারণা আর একটি মহাযুদ্ধ মানবসমাজের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে এবং একমাত্র অতিপ্রাকৃত কোন শক্তিই এই সংকট রোধ করতে পারে। আমার অতিথি আমার বক্তব্য শুনে খুবই শান্ত ও ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলেন ”আপনি মানবজাতির অবলুপ্তির এমন কড়া বিরোধী কেন? ”
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আজ থেকে একশ
বছর আগে কোন ব্যক্তি হালকাভাবেও এমন মন্তব্য করতেন না। মনে হয় এটি একটি হতোদ্যম ব্যর্থ চেষ্টা করা ব্যক্তির ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন। আজকের দিনে বহু মানুষ এক যন্ত্রনাদায়ক একাকীত্বের শরিক। এই উদাসীনতা বোধহয় এমন একাকীত্বের বহিঃপ্রকাশ। এর কারণ কি? এবং এর থেকে নিষ্কৃতির পথই বা কি?
এই প্রশ্নটি খুব সরল। কিন্তু সঠিক এবং নিশ্চিত উত্তর
পাওয়া বড়ই কঠিন। আমি অবশ্য সাধ্যমত উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করব, যদিও আমার বিশ্বাস আমাদের
বাস্তব পরিস্থিতির উপলব্ধি ও অতিক্রম করবার প্রচেষ্টা প্রায়শই পরষ্পরবিরোধী। পুরো ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে যে খুব সহজ এবং সাধারণভাবে প্রকাশ করা প্রায় দুঃসাধ্য।
মানুষ একাধারে একা এবং সামাজিক জীব। ফলে সে
একা তখন তার নিজস্ব এবং নিকটতম ব্যক্তির অস্তিত্ব
টিকিয়ে রাখবার, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা পূরণের এবং সহজাত সামর্থ্য বজায় রাখবার প্রচেষ্টা চালায়। সামাজিক প্রাণীর ভূমিকায় সে সমাজ থেকে স্বীকৃতি,
স্নেহ-ভালোবাসা প্রার্থনা করে। সমাজবদ্ধ ভূমিকায়
সে সকলের আনন্দের অংশীদার, দুঃখের ভাগীদার তথা মানুষের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নের প্রয়াস চালায়। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও প্রায় পরষ্পরবিরোধী আশা আকাঙ্খাই মনিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। বিপরীত ধারার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঠিক সমন্বয় সাধনই ব্যক্তির মধ্যে স্থৈর্য আনে ও ব্যক্তি তখনই সামাজিক উন্নয়নে আবদান রাখতে সমর্থ হয়। একথা সত্যি যে এমন চারিত্রিক গুনাবলী মানুষ কিছুটা হয়ত উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ হয় মানুষ যে পরিবেশে বাস
করে সেই পরিবেশের প্রভাব, সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক পরম্পরা, নির্দিষ্ট আচার-অচরণের মূল্যায়ন, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের টানাপোড়েনের ফলশ্রুতিতে। একজন ব্যক্তির কাছে তার সমসাময়িক ও পূর্বতন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ সকল রকম সম্পর্কের বা আত্মীয়তার সামগ্রিক ছবিই সমাজ সম্বন্ধে বিমূর্ত ধারণার সৃষ্টি করে। ব্যক্তি অনুভব করতে পারে, চেষ্টা করতে পারে, নিজেই নিজের কাজ করতে পারে, কিন্তু তার শারীরিক ও মানসিক আবেগের চালিকাশক্তি হচ্ছে সমাজ। একজন ব্যক্তির চিন্তার গতিপথ সামাজিক কাঠামোর বাইরে অনুমান করা, তার সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করা বোধহয় অসম্ভব। সমাজই ব্যক্তিকে খাবার-দাবার, জামা-কাপড়, বসবাস করার জায়গা, কাজ করার সামগ্রী, ভাবনা-চিন্তার রূপ, ভাষা ও উপকরণ যোগায়। সংক্ষিপ্ত মানবজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অসংখ্য বর্তমান ও অতীত কর্মকান্ডের সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাবদ্ধ
সম্পাদনের মধ্যেই ছোট শব্দ ‘সমাজ’ এর অর্থ
নিহিত আছে।
অতএব, পরিষ্কার কথাটা হচ্ছে পিঁপড়ে ও মৌমাছিদের
মতই মানুষের সমাজের উপরে নির্ভরশীলতা একটি
সত্য। পিঁপড়ে ও মৌমাছিদের জীবনের সূক্ষ্তম
কর্মকান্ডগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সুদৃঢ় সহজাত
শৃঙ্খলা ও প্রবৃত্তির উপর নির্ভর করে, কিন্তু
মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক গঠন ও পারষ্পরিক
সম্পর্ক সতত পরিবর্তনশীল, মানব সমাজের উন্নয়ন
কেবলমাত্র জৈবিক প্রয়োজনের জন্যই সংগঠিত
হয়নি, স্মরণ রাখার ক্ষমতা নতুনভাবে সংঘবদ্ধ হবার
প্রচেষ্টা, ভাষার মাধ্যমে পারষ্পরিক ভাব প্রকাশের
সুযোগের মধ্য দিয়েই এই উন্নতি সম্ভব
হয়েছে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে পরম্পরা, প্রতিষ্ঠান,
সংগঠন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্পকলা ইত্যাদি।
এর থেকে কিছুটা বোঝা যায় মানুষ তার নিজের
আচরণের দ্বারা নিজের জীবনকে প্রভাবিত
করতে পারে, জাগ্রত চিন্তা ও বিভিন্ন চাহিদাই আসল
চালিকাশক্তি।
জন্ম ও উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষের জৈবিক গঠন
সাধারণত অপরিবর্তনীয়। প্রাকৃতিক বা জৈবিক
চাহিদাগুলো প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে।
এছাড়া জীবনকালের মধ্যে সামাজিক পরিমন্ডল
থেকে ভাবের আদান প্রদান ও অন্যান্য প্রভাবের
ফলে মানুষ একটি সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টিমূলক ধ্যানধারণা
প্রাপ্ত হয়। এই সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণাই সময়ের সঙ্গে
পরিবর্তনশীল, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক
এই ভাবের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আধুনিক নৃতত্ত্ব
তথাকথিত আদিম সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনায়
দেখিয়েছে যে, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো এবং প্রধান
প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন
সামাজিক ব্যবহারের নিয়ামক। যারা মানুষের উন্নতির জন্য পরিশ্রম করেচেন তারা যুগ যুগ ধরে পরিপুষ্ট
সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির উপর আশা রাখতে পারেন। মানুষ মূলত তাদের জৈবিক গঠনের জন্য এখনও এমন বাতিলের পর্যায়ে চলে যায়নি যে তারা পরষ্পরকে নিম্চিহ্ন করতে চাইবে বা একটি নিষ্ঠুর নিজের তৈরি ভাগ্যের হাতে নিজেকে
সমর্পণ করবে।
আমরা যদি নিজেদের প্রশ্ন করি যে, মানবজীবন
সহনীয় ও সুন্দর করে তুলতে সামাজিক কাঠামো ও
সাংস্কৃতিক দৃস্টিভঙ্গির কেমন ধরনের পরিবর্তন
করতে হবে, তাহলে আমাদের ভাবা দরকার যে কিছু
কিছু ঘটনা সংশোধনের অতীত। উদাহরণ হিসেবে
আবার বলা যেতে পারে যে মানুসের জৈবিক
গঠনের আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। আরও বলা
যায় যে, গত কয়েক শতাব্দীর প্রযুক্তিগত উন্নতির
ফলে সমাজে যে পরিবর্তন হয়েছে তাও
অনেকাংশে অপরিবর্তনীয়। আপেক্ষিকভাবে ঘন
বসতিপূর্ণ অঞ্চলে শ্রমের সুস্পষ্ট বিভাগ ও কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। আমাদের সেই নির্দোষ সুখের ও সারল্যের অতীত অতিক্রান্ত, তখন বোধকরি একজন ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী স্বনির্ভর
হতে পারত। এটা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে
উৎপাদন ও উৎপাদিত পণ্যভোগের নিরিখে এই
গ্রহের সকর মানুষকে নিয়েই হয়েছে বর্তমান
সমাজ।
এ পর্যন্ত আলোচনার পর আমি আমাদের সময়ের
আসল সংকট নির্ণয়ের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি।
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের
সম্পর্কের দ্বন্দ্ব বা টানাপোড়েন। ব্যক্তি এখন
সমাজের উপর নির্ভরশীলতার ব্যাপারে আগের
থেকে অনেক বেশি সজাগ, কিন্তু এই
নির্ভরশীলতাকে সে একটি ইতিবাচক সম্পদ হিসাবে
ভাবে না। যেমন মানুষে-মানুষের আত্মিক বন্ধন এক
রক্ষাকারী শক্তি রূপে ভাবার বদলে তার স্বাভাবিক
অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিঘ্নকারী বলে
মনে করে। ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান এমন অবস্থায়
এসেছে যে সে ক্রমাগত আমিত্ব প্রতিষ্ঠার
প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে সামাজিক প্রেরণা বা
সমাজের জন্য কিছু করার প্রেরণার ক্রমাবনতি
ঘটছে। ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন
প্রায় সব ধরনের মানুষই এই অবনয়নের স্বীকার।
অজান্তে অহংবোধের বন্ধনে বন্দী মানুষ
নিরাপত্তাহীনতা ও নিঃসঙ্গতায় ভোগে ও সরর
অনাড়ম্বর আনন্দে পরিপূর্ণ জীবনরসে বঞ্চিত
হয়। এই সংক্ষিপ্ত এ বিপদসংকুল জীবনে সমাজের
প্রতি আত্মনিয়োগের মাধ্যমেই জীবনের
সার্থকতা বা প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
আমার মতে বর্তমান কালের সকল সংকটের মূরে
রয়েছে ধনতান্ত্রিক সমাজের অর্থনৈতিক নৈরাজ্য।
আমরা দেখতে পাচ্ছি উৎপাদকরা তাদের সংঘবদ্ধ ও
শ্রমলব্ধ ফল পরষ্পরকে বঞ্চিত করার জন্য নিরলস
প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টা কোন বল
প্রয়োগে হচ্ছে না। নানারকম সুবিধামতো আইন-
কানুন প্রতিষ্ঠা করে ও তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপের
মধ্যে দিয়েই এই কার্যকলাপ চলছে। এই প্রসঙ্গে
উল্লেখ করা দরকার যে উৎপাদনের উপকরনগুলি
অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য ও মূলধনী শিল্পের সমগ্র
উৎপাদন ক্ষমতা আইনসঙ্গতভাবে ব্যক্তির নিজস্ব
সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।
সোজা কথায় আমি বলব যাদের উৎপাদনের
উপকরণের উপরে মালিকানা নেই, তারাই হচ্ছে
শ্রমিক, যদিও তা প্রচলিত অর্থের সঙ্গে
অসঙ্গতিপূর্ণ। উৎপাদনের উপকরণের উপরে যার
মালিকানা আছে সে শ্রমশক্তি কিনে নিচ্ছে। এই
উপকরণগুলি ব্যবহার করে শ্রমিকরা যা উৎপাদন করে
সেই সব সামগ্রীর মালিক হচ্ছে পুঁজিপতিরা।
উৎপাদনের প্রকৃত মূল্য ও শ্রমিকের শ্রমমূল্যের
মধ্যের সম্পর্কই হচ্ছে এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ
অংশ। যদিও শ্রমিকের সঙ্গে তথাকথিত ‘স্বাধীন
চুক্তি’ হয়, তথাপি শ্রমিকের শ্রমমূল্য নির্ধারণ হয়
প্রধানত শ্রমিকের নুন্যতম প্রয়োজন, পুঁজিপতির
শ্রমশক্তির প্রয়োজন ও সরবরাহের উপর ভিত্তি
করে, শ্রমিক যা উৎপাদন করে তার উৎপাদন মূল্যের
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।
ব্যক্তিগত পুঁজি অল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে
কেন্দ্রীভূত হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে
পুঁজিপতিদের মধ্যে নিজস্ব প্রতিযোগিতা, অপর
কারণটি হচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে ছোট
ছোট উৎপাদন ব্যবস্থার বিলোপসাদন করে বৃহৎ
শিল্প গঠনের প্রবণতা। এর ফলে এক প্রভূত
ক্ষমতাশালী অল্পসংখ্যক পুঁজিপতির শাসনক্ষমতা
প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ভয়ংকর ক্ষমতা গণতান্ত্রিকভাবে
নির্বাচিত কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রন করতে
পারে না। একথা হয়তো সত্যি যে আইনসভার সদস্য
মনোনীত করে রাজনৈতিক দলগুলি, কিন্তু পুঁজিপতিরা
এই ব্যবস্থায় অর্থ ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা সরবরাহ
করে নির্বাচক এবং আইনসভার মধ্যে একটি দেয়াল
খাড়া করে, ফলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দুর্বলতর
মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে অক্ষম হয়। সর্বোপরি
বর্তমান ব্যবস্থায় ব্যক্তি পুঁজির মালিকরা বেতার,
সংবাদপত্র, শিক্ষা-দীক্ষা সবই প্রত্যক্ষ অথবা
পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রন করে।
সুতরাং একজন নাগরিকের স্বাধীন ও বাস্তব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গটনের অদিকার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত কষ্টকর এবং কখনও কখনও অসাধ্যও বটে।
পুঁজির ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজের
প্রধানত দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। এক উৎপাদনের উপকরণ
– এক্ষেত্রে পুঁজির উপর ব্যক্তিগত ও ইচ্ছামতো
নিয়ন্ত্রন, দুই তথাকথিত স্বাধীন শ্রমচুক্তি। অবশ্য
বিশুদ্ধ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ বলতে কিছু হয়
না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে শ্রমিকরা
অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই করে
তথাকথিত মুক্ত শ্রমশক্তির শর্তগুলির কিছুটা তাদের
স্বপক্ষে আনতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বর্তমান অর্থনীতি বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উৎপাদনের উদ্দেশ্য ব্যবহার নয়, কেবল মুনুফা।
সকল সমর্থ ও ইচ্ছুক ব্যক্তি কাজ পাবেন এমন
ব্যবস্থা নেই, বেকারবাহিনী সব সময়েই মজুত
আছে। শ্রমিক নিরন্তর রোজগার হারানোর ভয়ে
ভীত, যেহেতু বেকার ও স্বল্প আয়ের লোকেদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। তাই ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন মুনাফা অর্জনকারী বাজারের অভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য-বঞ্চিত শ্রমিকের দুর্দশাও অবর্ণনীয়।
ক্রমাগত প্রযুক্তির উন্নতি নতুন কর্মসংস্থানের
বদলে নিরন্তর বেকার সৃষ্টি করে চলেছে।
মুনাফার প্রতি লোভ ও পুঁজিপতিদের বিরামহীন
প্রতিযোগিতার যুগপৎ প্রভাবে পুঁজির ও পুঁজির
বাজারে স্থায়িত্বের সংকট আনে এবং কখনও কখনও
ভয়ংকর মন্দার সৃষ্টি হয়। অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতায়
শ্রমের শুধু অপচয় নয়, ব্যক্তির সমাজ-সচেতনতার
যৌক্তিকতা সমাজের উপর আস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
ব্যক্তির এই প্রতিবন্ধকতাই আমার মতে ধনতন্ত্রের
সবচেয়ে খারাপ দিক। আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাই
এই প্রতিবন্ধকতার শিকার। অত্যধিক প্রতিযোগিতার
বীজ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয় ছাত্রজীবনে অর্জিত
সাফল্য ভবিষ্যতে উজ্জ্বল রোজগার আর্থিক
প্রাপ্তির সোপান।
আমি নিশ্চিত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার
প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই এই মন্দ দিকগুলো দূর করা
যেতে পারে। সেই সঙ্গে এমন একটি শিক্ষা
ব্যবস্থা দরকার যার উদ্দেশ্য হবে একটি সামাজিক
লক্ষ্য স্থির করা, এই অর্থনৈতক ব্যবস্থায় উৎপাদনের
উপকরণের মালিকানায় থাকবে সমাজ এবং উৎপাদনের ফল পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার হবে। একটি পরিকল্পিত অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থা কেবলমাত্র সমাজের প্রয়োজনের জন্য গড়ে ওঠে। একমাত্র এই
ব্যবস্থাতেই সকল সমর্থ ব্যক্তির কর্মসংস্থান এবং
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পুরুষ-স্ত্রী, শিশু নির্বিশেষে গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় সুনিশ্চিত করবে। সহজাত উৎকর্ষতা বা সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তির শিক্ষা তার সামাজিক দায়বোধের চিন্তা ভাবনা জাগাবে। বর্তমানে
যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও সাফল্যের সোপান হিসাবে
শিক্ষাকে তুলে ধরা হয়, উল্লিখিত ব্যবস্থা হবে তার
ঠিক বিপরীত।
তাহলেও মনে রাখা উচিত পরিকল্পিত অর্থনীতি
হলেই সমাজতন্ত্র আসে না। একটি পরিকল্পিত
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যক্তিকে ক্রীতদাসে পরিণত
করতে পারে। সমাজতন্ত্রের সাফল্যের জন্য
প্রয়োজন অত্যন্ত জটিল সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান। অপর্যাপ্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে তা কেমন করে সম্ভব
হবে? কেমন করেই বা আমলাদের সর্বশক্তিমান
হওয়াকে রোখা যাবে? ব্যক্তির অধিকারকে
সুরক্ষিত রেখে, গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ
আমলাতন্ত্রকে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করবে?
সুতরাং এই যুগান্তরকালে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ও
সমস্যা সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণার তাৎপর্য অপরিসীম।
বর্তমানে অবশ্য এই সব স্বাধীন চিন্তা এবং নিরন্তর
আলোচনা যেন এক অপবিত্র কর্ম।
.
[আলবার্ট আইনস্টাইনের এই প্রবন্ধটি ১৯৪৯ সালে
আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার
১ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ওই পত্রিকার
সম্পাদকমন্ডলীর অনুরোধে আইনস্টাইন
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশের জন্য
এই লেখাটি রচনা করেন।
লেখাটি চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা
থেকে প্রকাশিত বই থেকে নেয়া, অনুবাদ
করেছেন শ্যামল কুমার ঘোষ।]