৬২’র শিক্ষা আন্দোলন কি আদৌও শেষ হয়েছে!

প্রকাশিত: ১:০২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪

৬২’র শিক্ষা আন্দোলন কি আদৌও শেষ হয়েছে!

ইয়াতুননেসা রুমা |

শিক্ষা কোন সুযোগ নয়, শিক্ষা প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার। আর এ অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েই গেছে। আজও কিছু মানুষের কাছে উচ্চশিক্ষা যেন দুরাশা। অথচ সেপ্টেম্বর মাস আসলেই মনে পরে যায় শিক্ষা দিবস ও তার ইতিহাসের কথা। ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস।

১৯৬২ সালে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুল সহ অনেকে। তাদের স্মরণে সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের দুই মাস পরেই ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ‘শরীফ কমিশন’ নামে খ্যাত তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত ১১ সদস্যের এ কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবেদন পেশ করে। এ কমিশনে বাকি ১০ জনই কিন্তু ছিলেন শিক্ষাবিদ। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা মূলত শিক্ষাকে সংকোচন করার পক্ষে ছিল।

প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ”সস্তায় শিক্ষা অর্জন করা যায় বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে তা ত্যাগ করতে হবে।” অর্থাৎ সোজা কথায়, “টাকা যার শিক্ষা তার।”
এতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র- ছাত্রীদের বেতন বৃদ্ধি করার প্রস্তাব ছিল।

২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ঐ প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
এতে আইয়ুব সরকারের ধর্মাশ্রয়ী, পুঁজিবাদী, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা সংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল।

শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ৩ বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল।
যা কেবল শিক্ষা নয়, বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানতে যাচ্ছিলো।

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন।

ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে তিনজনের মৃত্যু হয়। ওই দিন সারাদেশে মিছিলে পুলিশ গুলি করে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিকেরও হত্যার খবর পাওয়া যায়।

১৯৬৪ সালে যখন ছাত্র আন্দোলন প্রকট রূপ নেয়, তখন সরকার একটি সমঝোতায় এসে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। সেই সাথে তখনকার মতো আন্দোলনের ছাত্রদের বিজয় হয়। কিন্তু আজও পর্যন্ত ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পায়নি।

শিক্ষা ভবনের কাছে হাই কোর্টের সামনে শিক্ষা অধিকার চত্ত্বরে প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো ফুল দিয়ে শিক্ষা দিবস পালন করার চেষ্টা করে। অথচ যদি এই দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকতো তবে সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা দিবস পালন করতো এবং দিবসটি আরও বেশি তাৎপর্য পেত। সেইসাথে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার শিক্ষা পেত। কারণ শিক্ষা দিবসের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এত এত আন্দোলনের ইতিহাস থাকার পরেও আজও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হয়নি। আজও শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবকেরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় কতটা বিভাজন রয়েছে।

করোনাকালেও বঞ্চিত অসহায় ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের রঙিন পর্দার আড়ালে রেখে সরকার অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে গেছে। গরিব-নিম্নবিত্তদের সন্তানরা যাদের মোবাইল বা ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য নেই, প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট নেই, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় পানিবন্দি হয়ে যেসব শিক্ষার্থীরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছে সেসব শিক্ষার্থীদের সমস্যা দূর না করে এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত না করে অনলাইন শিক্ষা কি বৈষম্যমূলক শিক্ষা নয়?

বৈশ্বিক মহামারী ও দূর্যোগের কালেও সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ নিশ্চিতের জন্য সরকারের কাছ থেকে অন্তত আশা করেছিলাম এইচএসসি ভর্তি ফি এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেতন কমানোর কোন নির্দেশনা আসবে। অথচ সে ব্যাপারেও কোন সরকারি নির্দেশনা দেখিনি।

শিক্ষার বৈষম্য যে কতটা গুরুতর তা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়। সমাজে যেমন তিনটি ভাগ রয়েছে– উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনটি ভাগ হয়ে গেছে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। বিত্তবানদের সন্তানরা পড়ছে ইংরেজিমাধ্যমে, মধ্যবিত্তদের সন্তানরা পড়ছে বাংলা মাধ্যমে আর গরিব ও পশ্চাৎপদ যারা তাদের সন্তানরা পড়ছে মাদ্রাসায়। আমরা ভাবি শিক্ষা সমাজকে বদলে দিবে। আসলে বাস্তবে দেখি তার উল্টো। মানুষের ভিতরে যে শ্রেণীবিভাজন, শিক্ষাব্যবস্থা সেই বিভাজনকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য এটা খুবই করুণ ও মর্মান্তিক।
আবার বড়লোকদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে চমৎকার একটি মিল পাওয়া যায়। আর তা হলো উভয় ধারার শিক্ষার্থীই বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষার ইতিহাস- ঐতিহ্য ও বাংলা সংস্কৃতির জ্ঞান থেকে। অথচ মাতৃভাষাই হলো শিক্ষার সহজ, স্বাভাবিক ও কার্যকর মাধ্যম। অন্য ভাষায় শিক্ষালাভ সবসময়ই কঠিন ও কৃত্রিম হয়। যে শিক্ষা কখনোই ফলপ্রসূ হয় না। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু এখন তা কেবল বাড়ছে। শুধু শহরেইই নয়, গ্রামগুলোতেও এর চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার মান খুবই নিম্ন ও ভয়াবহ হলেও এর পরিমাণও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৭২ এর সংবিধানে রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত ধর্মীয় কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার কথা না। কিন্তু সংবিধান থেকে যেন ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে যাচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ভয়াবহভাবে বেড়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা বাড়ানো ও উন্নয়নের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। সেভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল খোলার জন্য সরকারি বরাদ্দ হচ্ছে না। এর কারণ বিপুল পরিমাণ মোল্লাদের সমর্থন আদায় এবং গরিব শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিরত রাখা।

শিক্ষাকে কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেছে। আর তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অধিকাংশ শিক্ষার্থী চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় পাবলিকে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটছে। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে ধনীদের সন্তানদের কাছে শিক্ষা বেচাকেনা হয়। পাঠদান পদ্ধতি ও পরীক্ষা প্রক্রিয়াও একদম ভিন্ন। যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখ করে রাখা হয়। শিক্ষার সাথে রাজনীতির একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। কোন কিছুই যেখানে রাজনীতির বাইরে নয়, সেখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে থাকছে। এর ফলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি থেকে বিরত থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে কোন দাবী নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম হবেনা। সাধারণ জনগণ ও রাজনীতির মধ্যে তফাৎ সৃষ্টি হবে। সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার বিষয় থাকবে না। তখন জনগণকে শোষণ করা সহজ হয়ে যায়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও শিক্ষা বৈষম্য এখনো শেষ হয়নি। আইয়ুব খানের শিক্ষানীতিই যেন এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের কারণে শ্রেণীবিভাজন আরও গভীর হচ্ছে।

শিক্ষার বৈষম্য দূর করে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হলে, সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা এমন হোক যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় এবং মানুষের অধিকার ও সমতা রক্ষা পায়।
#

ইয়াতুননেসা রুমা
সাবেক সহসভাপতি
কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী