বাষট্টির আন্দোলনের স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: ১২:৩৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

বাষট্টির আন্দোলনের স্মৃতিকথা

হায়দার আকবর খান রনো |

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি ঐতিহাসিক দিবস। আইয়ুবের সামরিক শাসন আমলে প্রথম হরতাল, যেদিন পুলিশের গুলিতে ওয়াজিউল্লাহ ও বাবুল শহীদ হয়েছিলেন। এই দিবসটি শিক্ষা দিবস নামে পরিচিত। কারণ শিক্ষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ে এই হরতালটি আহুত হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা আন্দোলনের আগেই আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল যা একটা পর্যায়ে শিক্ষা আন্দোলনে পরিণত হয়। আমি এখানে সংক্ষেপে তার প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক দিকসমূহ এবং সেই সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন ঘোষণা করেন। সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, যেকোন ধরনের গণসংগঠন নিষিদ্ধ এবং সামরিক আইনে দণ্ডনীয় ছিল। সামরিক আইন ছিল খুবই বর্বর ও মধ্যযুগীয় ধরনের। মৃত্যুদণ্ড, দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড থেকে শুরু করে বেত্রাঘাত পর্যন্ত দণ্ডবিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোনো দেশে বেত্রাঘাত দণ্ড হিসেবে থাকলে তাকে আমরা অসভ্য বলে মনে করবো। যেমন এখন সৌদি আরবে শাস্তি হিসেবে হাত কেটে ফেলার নিয়ম চালু আছে। আজকের যুগে তা একটি অসভ্য দেশ বলে গণ্য হয়।

আইয়ুবের সামরিক শাসন ছিল খুবই প্রতিক্রিয়াশীল এবং কমিউনিস্ট বিরোধী। ক্ষমতায় এসেই আইয়ুব খান বলেছিলেন তার শত্রু ভারত নয়, তার শত্রু হচ্ছে উত্তরে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। পরবর্তীতে অবশ্য চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল এবং ভারতের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধও হয়েছিল। ক্ষমতায় এসেই তিনি কমিউনিস্ট ও ন্যাপ কর্মীদের পাইকারিভাবে গ্রেফতার করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় নির্যাতনে ন্যাপ নেতা ও কমিউনিস্ট হাসান নাসের শহীদ হন। আমাদের দেশেও আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির একটি গোপন পত্রিকা (শিখা) পাওয়ার অভিযোগে কমিউনিস্ট ও ন্যাপ নেতা কাজী বারীকে বেত্রাদণ্ড দেয়া হয় যার ফলে তিনি সারা জীবনের জন্য বধির হয়ে যান। এমনি ছিল আইয়ুবের শাসনকাল। মার্শাল ল’র সঙ্গে সঙ্গেই মওলানা ভাসানী এবং জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের ন্যাপ নেতৃবৃন্দ (যাদের অধিকাংশই ছিলেন কমিউনিস্ট) গ্রেফতার হয়ে যান। অনেকে আত্মগোপনে যান। কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগোপনে থেকেই আইয়ুব সরকার বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই গ্রেফতার হননি। তবে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছিল। জজ কোর্টে তিনি এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু হাইকোর্ট তাকে মুক্তি প্রদান করে। ফলে তিনিও প্রকাশ্যে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কমরেড মণি সিংহ ও কমরেড খোকা রায় গোপনে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়ার সঙ্গে মিলিত হন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এই ব্যাপারে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে (মিছিলের লোকসংখ্যা তিন চারশ’র বেশি হবে না) সামরিক শাসন বিরোধী স্লোগানও দুই একবার উচ্চারিত হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ১৯৬১ সালেই কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন ছাত্র কমলাপুরের একটি গোপন জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম যেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে পরের বছর ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিল থেকে সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম শুরু করতে হবে। এইরকম গোপন আরো কয়েকটি মিটিং হয়েছিল। আমরা ২১ ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এর মধ্যে ঘটে গেলো অন্য একটি ঘটনা।

আইয়ুব খান নিজেই ঘোষণা করেছেন যে তিনি ’৬২র ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান ঘোষণা করবেন এবং সামরিক শাসন উঠে যাবে। আওয়ামী লীগসহ যে বুর্জোয়া নেতারা এতদিন চুপচাপ বসে ছিলেন, ওকালতি-চাকুরি-ব্যবসা ইত্যাদি করছিলেন (এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজেও একটি বীমা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের পদে কাজ করছিলেন), তারা এবার একটু নড়েচড়ে বসতে শুরু করলেন। সেই সময় ’৬২র জানুয়ারি মাসে মুসলিম লীগ নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকজন জাতীয় নেতাদের বৈঠক ও আলাপ আলোচনা হয়। ঠিক হয় সামরিক শাসন উঠে গেলে তারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন। এই খবরটি দ্রুতই আইয়ুব খানের কানে পৌঁছেছিল। ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী ঢাকা থেকে প্লেনযোগে করাচি পৌঁছালেন। তাকে গ্রেফতার করা হল। এই সংবাদ ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে খুবই ক্ষুদ্ধ করে তোলে। এখনই কিছু একটা করা হোক এই ছিল তাদের মনোভাব। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আমরাও সেই সুযোগটি গ্রহণ করলাম। ৩১ জানুয়ারি রাতে মধুর ক্যান্টিনে চারটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ছিলেন মোহম্মদ ফরহাদ, মহিউদ্দীন আহমেদ (ছাত্রনেতা, ন্যাপ নেতা নন), বদরুল হক (পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি) ও আমি। এই চারজনের মধ্যে আমি ছাড়া বাকি তিনজনই এখন প্রয়াত। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। এছাড়াও এনএসএফ ও ছাত্রশক্তির প্রতিনিধিরাও ছিলেন। শেষোক্ত দুটি সংগঠন ছিল সরকারি দলের দালাল সংগঠন। তবু সর্বদলীয় চরিত্র দেবার উদ্দেশ্যেই বোধ হয় মোহাম্মদ ফরহাদ তাদেরকে ডেকেছিলেন। আমরা এবং ছাত্রলীগ প্রস্তাব করলাম সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রধর্মঘট করা হোক। এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি বিরোধিতা করলো। অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক চলল। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ ফরহাদ প্রস্তাব করলেন রাত গভীর হয়েছে, আজকে থাক, আগামীকাল সকালে আবার বসা যাবে। সভা সমাপ্ত হলো। আমি ফরহাদ ভাইয়ের এই আচরণে আশ্চর্য হয়েছিলাম। শেখ মণি তো রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কিন্তু মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের ডেকে আলাদা করে বললেন যে, ‘ওদেরকে একটু ফাঁকি দিলাম। ওরা আজ রাত্রে আরাম করে ঘুমাক। অন্যথায় তারা এখনি গোয়েন্দা বিভাগকে খবর দিত। অবশ্যই কাল ধর্মঘট হবে’। সেই রাত্রে রাত চারটা পর্যন্ত খবরের কাগজের উপর পোস্টার লিখে ধর্মঘটের ঘোষণা জানালাম এবং তা হলে হলে ও ইউনিভার্সিটির গেটে সেঁটে দিয়ে আসলাম। রাত চারটার সময় ফরহাদ ভাই আর আমি ঢাকা হলের একটি রুমে এক বিছানায় ঘণ্টা দুয়েকের জন্য শুতে পেরেছিলাম। সকাল থেকে পিকেটিং শুরু হল। ধর্মঘট সফল হল। আমতলায় শ’ পাঁচেকের মত ছাত্র জমায়েত হয়েছিল। সেখানে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হলো। কোনো মাইক নাই। সভার কোনো সভাপতি নাই। একটা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আমি বক্তব্য রেখেছিলাম। আমিই ছিলাম একমাত্র বক্তা।

ধর্মঘটের সংবাদ কোনো কাগজেই ছাপা হয়নি। তাই ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা (ছাত্রলীগেরও দু-একজন ছিলেন) সংখ্যায় একশ’র বেশি হবে না, তারা মিছিল করে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে খবরের কাগজ পোড়ান। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা আব্দুর রহিম আজাদ এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তার পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের মন্ত্রী মনজুর কাদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বক্তৃতা করতে। প্রথমেই তাকে বক্তৃতা করতে বাধা দিলেন ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা। তার নাম জিয়াউদ্দীন মাহমুদ। তিনি একদিকে মন্ত্রীর কলার চেপে ধরলেন অপরদিকে তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগলেন (প্রশ্নগুলি ছিল এইরকম- দেশে গণতন্ত্র নাই কেন? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন? ইত্যাদি)। পুলিশ কোনমতে মন্ত্রীকে উদ্ধার করে। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছাত্রদের কাছ থেকে মন্ত্রী সাহেব কিছু চড় ও কিল খেয়েছেন। তার গায়েও থুথু ছেটানো হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তার গাড়িটি ছাত্ররা অগ্নিদগ্ধ করে। মন্ত্রীকে পুলিশের গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন আমতলায় জিয়াউদ্দীন মাহমুদ (বর্তমানে প্রয়াত) দারুণ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিবরণ দীর্ঘ করব না। ৫ ও ৬ তারিখে ছাত্ররা মিছিল বের করেছিল। ৫ তারিখে পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছিল। মিছিলটি পুরান ঢাকা দিয়ে প্রদক্ষিণ করার সময় দুই পাশের বাড়ি থেকে হাততালি দিচ্ছিল অসংখ্য মানুষ। মিছিলটি শুরু হয় পাঁচশ’ ছাত্রদের নিয়ে। পরে পথিপার্শ্বের সাধারণ মানুষের যোগদানের কারণে এই সংখ্যাটি ১০ হাজারে পরিণত হয়েছিল।

২৩ মার্চ আইয়ুব খান এককভাবে একটি সংবিধান ঘোষণা করেন। বিস্তারিত বিবরণে যাব না। এক কথায় এই সংবিধানটি ছিল চরমভাবে একনায়কত্বমূলক। যেখানে গণতন্ত্র ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলে কিছু ছিল না। ছাত্ররা এই সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা সংবিধানের কপি ছিঁড়ে ও পুড়িয়ে ঘোষণা করে ‘এই সংবিধান আমরা মানি না’। তখন বলা হত (ইংরেজিতে)Scrapping of the Constitution। ছাত্ররা এরপর তখনকার রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যান। এবং তাদেরকেও চাপ দেন তারাও যেন Scrapping of the Constitution কথাটা উচ্চারণ করেন। ছাত্রদের চাপেই সংবিধান অস্বীকার করে নয় নেতা এক বিবৃতি দেন। দেশ যেন অগ্নিগর্ভ। পরিস্থিতি বুর্জোয়া নেতাদেরকে ভীত করে তুলল। তারা অসহায় বোধ করতে লাগলেন। কারণ Scrapping of the Constitution বলার সঙ্গে সঙ্গে দেশ তো বিপ্লবের দিকে চলে যাবে। তেমন সম্ভাবনা কিন্তু বাস্তবেও ছিল।

ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন শরীফ কমিশন যে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল তা বাতিল করার জন্য তারা দাবি জানান। বিষয়টি আমরাও কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করলাম এবং শুরু হল শরীফ কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন। শরীফ কমিশন শিক্ষা রিপোর্টে (প্রায়ই ভুল করে অনেকে এটাকে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বলে উল্লেখ করেন) শিক্ষা সংকোচন ও শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করার নীতি গৃহীত হয়েছিল। এই শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তা ধাক্কা দিয়েছিল। এমন কোনো স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না যেখানে এই আন্দোলন হয়নি, মিছিল ধর্মঘট সভা হয়নি। সবচেয়ে দুর্গম এলাকাটিও বাদ যায়নি। সত্যিকার অর্থে একেই বলে গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে প্রাধান্যে ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও কাজী জাফর আহমেদ। ফরহাদের বিচক্ষণতা এবং কাজী জাফর আহমেদের বাগ্মিতা ও সাংগঠনিক যোগ্যতা তাদেরকে শুধু ছাত্র ইউনিয়নের নয় সমগ্র ছাত্র সমাজের সর্বময় গ্রহণযোগ্য নেতায় পরিণত করেছিল। পরবর্তীতে মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবং কাজী জাফর আহমেদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

শিক্ষা আন্দোলনের একটা পর্যায়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে হরতাল ডাকা হল ১৭ সেপ্টেম্বর। এর কয়েকদিন আগেই সোহরাওয়ার্দী মুক্তি লাভ করেছেন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি বিমানযোগে ঢাকায় আসলে বিমানবন্দরে তাকে বিশাল সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ উভয়ই সমান তৎপর ছিল। বিমান বন্দরে নেমেই সোহরাওয়ার্দী এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় Scrapping of the Constitutionএর ধারণা বাতিল করে নতুন ধারণা আনলেন। বললেন, যা করতে হবে তা হল Democratization of the Constitution। ইতিপূর্বে নয় নেতার দেয়া বিবৃতিকেও তিনি নাকোচ করে দিলেন। তিনি বললেন ‘এখন আর নয় নেতা নয়, এখন আছে নয় কোটি নেতা’।

১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল, গোলাগুলি, ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ, ওয়াজিউল্লাহ-বাবুলের শাহাদত বরণ, ১৪৪ ধারা জারি ইত্যাদি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরদিন প্রতিবাদে আবার হরতাল ডাকা হবে। এই প্রস্তাব নিয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন নুরুল আমিনের বাসায় অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। অবশ্য সকল জাতীয় নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। মওলানা ভাসানী তখনও কারাগারে। কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড তোয়াহা প্রমুখ তখনও আত্মগোপনে। সোহরাওয়ার্দী কিছুতেই আরেকটি হরতাল করতে, এমনকি একটা প্রতিবাদ সভা করতেও রাজী হলেন না। অন্যান্য জাতীয় নেতারাও কোনো কথা বলছেন না। কেবল মাঝেমধ্যে আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে শেখ মুজিবুর রহমান মুখ খুলছেন। তাতেও সোহরাওয়ার্দীকে তার অবস্থান থেকে নড়ানো গেল না। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, `I am not a politician to be dictated by kids like you’। তিনি আরও বললেন যে পরদিন তিনি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে বন্দি ছাত্রদের মুক্ত করে আনবেন। এটাই হবে আমাদের জিত। ঠিকই সোহরাওয়ার্দী পরদিন গভর্নরের সঙ্গে দেখা করলেন। যে সংবিধানকে ছাত্ররা পুড়িয়ে ফেলেছিল সেটাকে গ্রহণযোগ্য করা হল। সোহরাওয়ার্দীর যুক্তি ছিল নির্বাচনে মেজরিটি পেয়ে একটা একটা করে সংশোধনীর মাধ্যমে একটা নতুন সংবিধান তিনি আমাদের উপহার দেবেন। এইভাবে ’৬২র শিক্ষা আন্দোলনসহ গণআন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। সেদিন যে বিপ্লবী ধারায় সংগ্রামকে পরিচালিত করার সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল, সোহরাওয়ার্দীর মত শ্রেণিসচেতন ও বিচক্ষণ বুর্জোয়া নেতৃত্ব তার রাশ টেনে ধরলেন।

তবে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ আবার জেগে উঠেছিল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত করলেন ৬ দফা। জেগে উঠল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাকে দমন করার জন্য আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করল যেখানে প্রধান আসামি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু আগরতলা মামলা বা কোনো ধরনের নির্যাতন বাঙালি জাতির এই উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। বরং জাতীয়তাবাদের ধ্বনি আরো উচ্চস্বরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী গভর্নর হাউজ ঘেরাও করেন, ৭ ও ৮ তারিখে পরপর হরতাল ডেকে এবং ২৯ ডিসেম্বর হাট হরতাল ডাক দিয়ে আন্দোলনকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে এক নতুন বিপ্লবী অবস্থা তৈরি করলেন। এরপর ছাত্ররা এগিয়ে এলো। তৈরি হল ১১ দফা। ৬ দফার সঙ্গে যুক্ত হল শ্রমিক কৃষকের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও বড় পুঁজি বিরোধী কর্মসূচি। এজেন্ডায় চলে এল স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র। সৃষ্টি হল গণঅভ্যুত্থান। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন গণঅভ্যুত্থান ইতিপূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি (কলকাতার রশীদ আলী দিবস কিছুটা তুলনীয় হতে পারে)। এ ছিল এমনি গণঅভ্যুত্থান যখন শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘেরাও আন্দোলন করছেন। কৃষকরা জেগে উঠেছেন লাল টুপি মাথায় দিয়ে। ভয়-ভীতিহীন মানুষ কারফিউ ভঙ্গ করে অকাতরে জীবন দান করছেন। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৬২র আন্দোলনের পর এক দশকও পূর্ণ হতে পারেনি। তার আগেই বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। ’৬২র আন্দোলন সেই প্রেক্ষাপটই তৈরি করেছিল।
#
লেখক : হায়দার আকবর খান রনো

[মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার প্রবক্তা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক পলিটব্যুরোর সদস্য, বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাম তাত্ত্বিক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত তিনি। ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’, ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’সহ রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ে তাঁর অনেক বই আছে। তাঁর আত্মজীবনী ‘শতাব্দী পেরিয়ে’র জন্য ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক রনো জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালে কলকাতায়।]